উপন্যাস।। আবার এসো ফিরে।। রামেশ্বর দত্ত
মনোময়বাবু চলে গেল। কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন ঈশ্বরচন্দ্র। পরে খাতা কলম টেনে নিয়ে খসড়া করতে বসলেন। সমস্যা যখন এসেছে, তা মেটানো তাঁরই দায়িত্ব। তবে তার জন্যে চাই পরিকল্পনা। সেই পরিকল্পনারই ছক কষছেন তিনি। ম্যানেজিং কমিটির মিটিং ডাকবেন, সেখানে কাকে চেয়ার দেবেন, কেমন ভাবে নিজের বক্তব্য পেশ করবেন ইত্যাদি। নিখুঁত পরিকল্পনা করে কাজে এগোতে চান।
পর্ব-৩৩
মিটিংয়ের দিন।
কলেজের মিটিংরুমে শিক্ষকরা এসে বসেছে। ম্যানেজিং কমিটির লোকজন সেখানে তখনও আসবার বাকি। প্রশস্ত ঘরে প্রায় গোটা কুড়ি চেয়ার পাতা। ডিম্বাকৃতি একটা বড় টেবিলকে ঘিরে চারপাশ দিয়ে চেয়ারগুলোর অবস্থান। কাঠের টেবিলের একদিক দিয়ে শিক্ষকরা বসেছে। অন্যদিকের চেয়ারগুলো খালি। সেদিকে ম্যনেজিং কমিটির লোকজন এসে বসবে। প্রধান ব্যক্তির চেয়ারটা ডিম্বাকৃতি টেবিলের একদিকের মাথায় রাখা।
ঘরে দুটো জানলা। তাতে পর্দা লাগানো। সাজানো-গোছানো ঘর। এ ঘর সাধারণত ব্যবহার হয় মিটিংয়ের জন্যে; তা সে কমিটির মিটিং হোক বা শিক্ষক-ছাত্রপ্রতিনিধির মাঝে বিশেষ কোনও কিছুর আলোচনার জন্যে ডাকা মিটিং হোক। ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে এমন সামনাসামনি আলোচনার নিয়ম তিনি বলবৎ করেছেন। দুপক্ষের মাঝে কোনও কিছুর সমস্যা দেখা দিলেই, নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে তা যেন মিটিয়ে নেওয়া হয়। এ জন্যে অলিখিত এক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ছাত্র প্রতিনিধিও মনোনীত করে দেওয়া হয়। সাহেবি কলেজের এই প্রথাকে ঈশ্বরচন্দ্র খোলা মনে অধিগ্রহণ করেছেন।
কমিটি সদস্যদের নিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র ঘরে প্রবেশ করতে উপস্থিত শিক্ষকরা উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করল। ঈশ্বরচন্দ্র বাদে চারজন সদস্য এসেছে। তাদের মধ্যে একজন ইংরেজ সদস্যও রয়েছে। মিঃ প্যেডলার। শিক্ষা বিভাগের এক অধিকর্তা। তিনি বাংলা জানেন।
কলেজ কমিটির মোট সদস্য সংখ্যা সাত। বাকিরা কোনও কারণ বশতঃ মিটিংয়ে যোগ দিতে পারেনি। সদস্যরা তাঁদের চেয়ার গ্রহণ করতে শিক্ষকরা বসল। ঈশ্বরচন্দ্রের বসবার কথা মধ্যবর্তী আসন মানে, প্রধানের চেয়ারে। তবে আজ তিনি তা না করে বসলেন শিক্ষকদের উল্টো দিকের এক চেয়ারে। প্রধানের চেয়ারে বসালেন মিঃ প্যেডলারকে। তিনিই আজকের মিটিংয়ের প্রধান হবেন। ব্যবস্থাটা তাঁর। কেন, তা পরে জানা গেল।
মিটিং শুরু হল। মিঃ প্যেডলার শিক্ষকদের অভিবাদন জানিয়ে প্রথম প্রশ্ন রাখলেন, বলুন, কলেজের পড়াশোনা কেমন চলছে?
শিক্ষকদের মধ্যে থেকে একজন উত্তর দিল, ছাত্রদের পড়াশোনা ঠিক মতোই চলছে, স্যার।
পরের প্রশ্ন, পড়ানোর মান বজায় রাখতে আপনাদের কিছু অসুবিধা হচ্ছে কি?
শিক্ষকরা চুপ। অনেক পরে একজন শিক্ষক উত্তর করল, স্যার, আমাদের একটা সমস্যা রয়েছে।
-সমস্যা? কী সমস্যা, বলুন।
-স্যার, এটা অবশ্য আমাদের নিজেদের সমস্যা। তবু আপনি যখন জানতে চাইছেন, জানাচ্ছি।… আসলে আমরা যা বেতন পাই, তা দিয়ে আর চলছে না। আমরা চাই, আমাদের মাসিক বেতন বাড়ানো হোক।
মিঃ প্যেডলার ঈশ্বরচন্দ্রের দিকে তাকালেন। এ বিষয়ে তাঁর অভিমত ব্যক্ত করবার অনুরোধ করলেন।
-এটা কি তোদের অভিযোগ?
ঈশ্বরচন্দ্র প্রশ্ন রাখলেন শিক্ষকদের সামনে। শিক্ষককুল চুপ। কথা সরল না কারোও মুখ দিয়ে।
তিনি এবার বলতে শুরু করলেন, আমি জানাতে চাই, কলেজের শিক্ষকদের আমি যখন যোগত্যা অনুসারে বাছাই করেছি, এবং তদবিষয়ে যে বেতন দেবার মনস্থ করে তোদের বহালি হয়েছে, সেখানে আমি কোনও গলদ রাখার সুযোগ দিইনি। অতএব ততে ক্ষোভ থাকবারও কথা নয়। এছাড়াও তোরা জানিস নিশ্চয়ই, এই কলেজ থেকে মাসিক বা বাৎসরিক যা আয় হয়, তার এক কপর্দকও আমি নিজে নিই না। যদিবা, তা নিলেও কারোও কিছু বলবার থাকতে পারে না, কারণ কলেজ আমার একলার প্রচেষ্টা ও আর্থিক সহায়তায় তৈরী হয়েছে। তাই, কারোও মনে যদি ধারণা থেকে থাকে, এই কলেজ আমার কাছে সোনার ডিম পারা হাঁস, তাহলে, আজ থেকেই আমার স্বীকার উক্তিকে মেনে নিয়ে সকলে মন থেকে সে খেদ মুছে ফ্যাল, এটাই আমি আশা করব।
বক্তব্য শেষ করে ঈশ্বরচন্দ্র মিঃ প্যেডলারের দিকে তাকালেন। প্যেডলার সাহেব, ঘাড় নেড়ে তাতে সায় দিলেন। তিনি তো ঈশ্বরচন্দ্রকে আজ থেকে দেখছেন না। গত কয়েক বছর ধরে দুজনের একসঙ্গে ওঠাবসা, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি কল্পে নানান পরিকল্পনা করা, একে অপরকে কাজে সাহায্য করা, এ চলছেই। তাছাড়াও তিনি ভালোমতো জানেন, ঈশ্বরচন্দ্রের অর্থের প্রতি কোনও লিপ্সা নেই। বরং কলেজ পরিচালনা করতে গিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বহু সময় বিনাবাক্য ব্যয়ে নিজের গ্যাঁটের কড়ি খরচা করেন। এমনকি, পরিচালন কমিটির সদস্যদেরকেও তা জানতে দেন না; তাদের কাছে আর্থিক সাহায্য নেওয়া তো দূরাস্ত। এমন লোক মিঃ প্যেডলার তাঁর জীবনে খুব কমই দেখছেন। আর সেই কারণেই নিজে সরকারী কাজের নানান ঝক্কি ঝামেলার মাঝেও ঈশ্বরচন্দ্রের অনুরোধে কলেজ ম্যানেজিং কমিটিতে যোগ দিয়েছেন। ভাতা হিসাবে শুধু মাত্র আসা-যাওয়ার খরচ নেওয়া ছাড়া কানা কড়িও আর্থিক আনুকূল্য তিনি নেন না।
অবশ্য, অন্য সদস্যরাও বোধ হয়, তাই করেন,-যা কিনা মিঃ প্যেডলারের অজানা। আসলে এমন একটা মহৎ কাজে যুক্ত থাকাটাই তো অনেক বড় সম্মানের।
শিক্ষকরা ভেবেছিল, ঈশ্বরচন্দ্র বোধ হয়, পূর্বক্তো বক্তব্য রেখেই তাঁর কথা শেষ করলেন। কিন্তু তা নয়। অচিরে তাঁদের সেই ভুল ভাঙল যখন তিনি দ্বিতীয়বার বক্তব্য রাখতে শুরু করলেন। তিনি বলতে থাকলেন, তোদের কথাকেও আমি অযৌক্তিক মনে করছি না । কথায় সত্যতা রয়েছে। দিনে দিনে টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। ফলে বাজারে জিনিষপত্রের দাম বাড়ছে। এটাই অবশ্য কালের নিয়ম। অর্থনীতির প্যাঁচপয়জার। এই বিষয়ে একটা গল্প বলি । শুনবি?
সকলে চুপ। এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। পরে প্রায় সমস্বরে বলল, বলুন। স্যার।
ঈশ্বরচন্দ্র গল্প বলতে শুরু করলেন।-
জানিস নিশ্চয়ই, পিপীলিকাদের মধ্যে রাণী পিপীলিকা কোনও কাজকর্ম করে না। পুরুষ পিপীলিকারা খাবারদাবার খুঁটে এনে রাণী পিপীলিকাকে খাইয়ে পরিয়ে রাখে। এইরকম এক পিপীলিকাদলে একবার একটা ঘটনা ঘটল। ঘটনাটা হচ্ছে, দিনে দিনে পুরুষরা বুঝতে পারছে, অন্ন জোগাড় করা কী দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে। মানুষ আর উচ্ছিষ্ট ফেলছে না, পিপীলিকাদের প্রবেশ বন্ধ করবার জন্যে খাবার সব ঢেকেঢুকে কাঠের আলমারিতে ঢুকিয়ে রাখছে। ফলে নিজেদের খাবারেই টান পড়তে শুরু করল তাদের। এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে সামান্য যা কিছু পেল, তা খেয়ে নিজেদের ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণ করে খালি হাতে রাণীর কাছে পৌঁছতে লাগল। একদিন গেল। রাণীর সেদিন কোনও খাওয়া জুটল না। রাণী কিছু না বললেও, মনে মনে ক্ষুব্ধ হল। তবু মেনে নিল। পরের দিনও তাই হল। তারপরের দিনও তাই। কতদিন আর সে না খেয়েদেয়ে থাকবে? পুরুষদের ডেকে ধমক দিল। নাহ। তাতেও ফল হল না। এবার জল্লাদ-পিপীলিকাকে ডাকিয়ে আনিয়ে কয়েকটা পুরুষ পীপিলিকার ঘাড়, গর্দান থেকে আলাদা করিয়ে দিয়ে ভাবল, ভয়ে পরের দিন পুরুষরা অবশ্যই তার খাবার নিয়ে আসবে। কিন্তু, কোথায় কী? বাজারে খাবারই নেই, তো তা আনবে কোথা থেকে? এখন তো নিজেরাও না খেয়ে শুকিয়ে মরছে। শেষে রাণী দেখল, এভাবে পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে থেকে খাবারের হুকুম চালালে, তাকেও না খেয়েই মরতে হবে। তাই নিজেই একদিন বেরিয়ে পড়ল। মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরল। দেখেশুনে বুঝল, পুরুষরা যা বলছে, তা একশভাগ সত্যি। তাহলে উপায়? উপায় রয়েছে। পুরুষ পিপীলিকা কামড়াতে পারে না। রাণী পারে। রাণী তার মোক্ষম অস্ত্র প্রয়োগ করতে শুরু করল। দলে দলে রাণী পিপীলিকা মানুষের খাবার রাখবার কাঠের আলমারির গা ভরে চলতে শুরু করল। তাই দেখে মানুষ গেল ঘাবড়িয়ে। মানুষ আলমারির দরজা যেই না খুলতে এলো , অমনি তাদের এইস্যা কামড় দিতে থাকল, যে কামড়ের জ্বালায়, আলমারির দরজা খুলে রেখেই মানুষ দৌড়তে শুরু করল। আর সেই ফাঁকে রাণীরা ঢুকে পড়ল ভিতরে। খাবারের ওপর হামড়ে পড়ল।
ঈশ্বরচন্দ্র গল্প শেষ করলেন। শিক্ষকদের দিকে তাকালেন। কমিটির অন্য সদস্যরা মায় প্যেডলার সাহেবও তখন ঈশ্বরচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। ঈশ্বরচন্দ্রের এমন এক কাহিনী শোনাবার পশ্চাতে কী কারণ, তা যখন সকলে অনুধাবন করতে ব্যস্ত, তখন বক্তাই আবার শিক্ষকদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, সকলে হয়তো ভাবছিস, তোদের বেতন বৃদ্ধির সপক্ষে, না বিপক্ষে এ গল্প? আসলে আমি ভবিষ্যতের গল্প শোনালাম তোদেরকে। দিন আসছে যখন দেশে শুধু গরীবই থাকবে, বড়লোকের সংখ্যা হাতে গুণতে হবে। আবার দেশের অর্থনীতির দিক দিয়ে চিত্রটা হবে একেবারে বিপরীত। তখন ওই মুষ্ঠিমেয় বড়লোকের অর্থ দেশের সংখ্যাগুরু গরীবদের এভাবেই কেড়ে নিতে হবে। আমাদের হয়ত সেদিন দেখতে হবে না, তবে দেশের অদৃষ্ট তাই বলছে। আমি চাই না, আজই তোদেরকে ওই পরিস্থিতিতে নিয়ে আসতে। তোদের সংসারে টান পড়ুক, তাই নিয়ে তোরা দিনরাত ব্যস্ত থাক আর তাতে আমার কলেজের ছাত্রদের পড়াশোনায় টান পড়ুক, তা আমি চাইব না…
কথা অসমাপ্ত রেখেই ঈশ্বরচন্দ্র মিঃ প্যেডলারের দিকে তাকিয়ে বলে দিলেন, আপনিই আজকের মিটিংয়ের প্রধান, আপনার মুখ দিয়ে কথাটা উচ্চারিত হোক, তাই চাই। শিক্ষকদের বেতন কতখানি বৃদ্ধি করবেন, তা আপনিই সূচিত করে দিন।
পরে অন্যান্য সদস্যদের দিকে তাকিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বেতন বৃদ্ধি বিষয়ে তাঁদেরও অনুমতি প্রার্থনা করলেন। এক বাক্যে তাঁরা এতে সায় দিয়ে প্রবক্তার উদ্দেশ্যে বললেন, আপনার বিচক্ষণতার তারিফ করতেই হয় বাবু ঈশ্বরচন্দ্র মহাশয়। আমরাও চাই, এই কলেজ যেন তার সুনাম নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে। ছাত্রদের পঠনপাঠনে কোনও রকম খামতি থাকুক, তা আমরাও চাই না।
প্যেডলার শিক্ষকদের কিছুক্ষণের জন্যে বাইরে যাবার অনুরোধ জানালেন। শিক্ষকরা ঘরের বাইরে চলে গেল। অপেক্ষা করতে থাকল। কমিটি নিজেদের মধ্যে আপোচনায় বসল। অল্প সময়েই বেতন বৃদ্ধির হার স্থির করে ফেলল তাঁরা। পরে শিক্ষকদের আবার ভিতরে ডাকা হল। তাঁরা এসে বসল। মিঃ প্যেডলার ঘোষণা করলেন, কলেজ ম্যানেজিং কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আপানাদের মাসিক বেতন বৃদ্ধি করা হবে। এবং তার পরিমাণ হবে, দশ টাকা থেকে পনেরো টাকার মধ্যে। যাঁদের এখন বেতন আশি টাকা থেকে একশ টাকার মধ্যে, তাদের ক্ষেত্রে বৃদ্ধির পরিমাণ পনেরো টাকা আর তার উপরে অর্থাৎ একশত পঞ্চাশ টাকার মাস মাইনের শিক্ষকদের বেতনে বৃদ্ধি হবে, দশ টাকা।
সঙ্গে এও কথাও যোগ করলেন, কলেজের উন্নতির অর্থ সকলের উন্নতি। হ্যাঁ, আর একটা বিষয়েও কমিটি অনুমোদন দিয়েছে,-এখন থেকে কোনও শিক্ষক দীর্ঘ অসুস্থতার কারণে ছুটি নিলে, দুমাস পর্যন্ত সবেতন ছুটি পাবে।
শিক্ষকদের মুখ হাসিখুশিতে ভরে উঠল। তাই দেখে ঈশ্বরচন্দ্রের মনে অঢেল আনন্দ। শিক্ষকদের তিনি নিজ সন্তানের মতোই ভালবাসেন,- এ কথা সুবিদিত। তাঁর কাছে ছাত্ররা যতখানিই প্রিয়, ততটাই শিক্ষকরাও। বাইরে তিনি কঠোর; ভিতরে ফুলের থেকেও কোমল।
শিক্ষকদের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান যে শিক্ষাদান, সে কথা আর একবার স্মরণ করিয়ে দিয়ে মিটিংয়ে সমাপ্তি টানলেন মিঃ প্যেডলার। হৃষ্ট চিত্তে ঈশ্বরচন্দ্রের গুণগান করতে করতে সকলে প্রস্থান করল।
(৩৭)
বলে কয়েও ঈশ্বরচন্দ্রকে ঘরে বসিয়ে রাখা যাচ্ছে না। শরীর ভাঙছে। অথচ তিনি ছুটে বেড়াচ্ছেন। কাজ পাগল মানুষ। একটা কাজ উৎরচ্ছে, তো অন্য একটা নিয়ে পড়ছেন। এবার পড়েছেন মহিলাদের উচ্চশিক্ষা নিয়ে।
এলো। ১৮৭৭ সাল।
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ মেয়েদের এম এ পরীক্ষা দেবার প্রথম তালিকা অনুমোদন করল। পুরুষ সমাজের চোখ তাইতে কপালে উঠেছে। চারিদিকে সোরগোল উঠল, -সমাজের হলটা কী? মেয়েরাই কি এবার পুরুষদের ঘাড়ে উঠবে? সংসার করা, সন্তান উপহার দেওয়া, সব মাথায় উঠল আর কি!
নানান উপহাস, টীকাটিপ্পনী হাওয়ায় ভাসতে শুরু করল। ঈশ্বরচন্দ্রের কানে তা আসছে। ভীষণ মর্মাহত হচ্ছেন তিনি। একদিকে তাঁর যেমন আনন্দের সীমা থাকছে না কারণ, আজ থেকে পনেরো বছর আগে প্রথম নারীশিক্ষা প্রবর্তন করে তিনি যে বীজ বপন করেছিলেন, তার শেষ ফল এবার তিনি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করবেন; অপরদিকে মেয়েদের সমাপ্তি শিক্ষা নিয়ে এই বিড়ম্বনা! তিনি আর চুপ থাকতে পারলেন না। কলম তাঁর নিশপিশ করছিল। জোরদার একটা লেখা লিখে তা পত্রিকায় প্রকাশ করে দিতে চাইলেন। তবে, তাঁকে আর সেই বেগ নিতে হল না।
৩রা জুনের সাধারণী পত্রিকায় কেউ এ বিষয়ে লিখেছেন। তাঁর নজরে পড়ল। লেখাটা পড়লেন। রচনাকার লিখেছেন, সদ্য কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কত্তৃপক্ষেরা বালিকাগণকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় উপস্থিত হবার অধিকারিণী বলে স্থির করায়, বঙ্গসমাজের কোনও কোনও স্থলে মহা হুলুস্থুল পড়ে গেছে। এটাই অর্ধশিক্ষিত বাঙ্গালীর লক্ষণ। তাঁদের সব বিষয়েই উপহাস করা। আজকের কালে তুমি যদি সব বিষয়ে, সমান উপহাস করে, মিটিমিটি হাসতে পার তবেই তুমি একজন চতুর ও রসিক পুরুষ। বাংলার সর্বত্রই অর্ধশিক্ষিত লোকের প্রকৃতি ও বৃত্তি এরকমই; বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণে তাঁরা এবার তাঁদের প্রবৃত্তি চরিতার্থ করবার বিশেষ সুযোগ পেয়েছেন।
কেউই আপন আপন ভগিনীর দুরাবস্থার কথা স্মরণ করেন না; তবে চারুমুখী বি এল দিয়ে শামলা মাথায় কেমন বক্তৃতা করবে, জজসাহেব তাতে কী মনে করবেন-এই সকল অনাবশ্যক বিষয়ের সমাধানের জন্যে সকলেই ব্যস্ত; কেবল ব্যস্ত নয়, অনেকে উন্মত্ত; কেননা যখন তাঁরা নারীজাতি বিষয়ে সরস আন্দোলন করতে থাকেন, তখন তাঁদের চৌদ্দপুরুষের মধ্যে কেহ কখনও যে রমণী জঠরে বাস করেছেন, তা বোঝা যায় না।
লেখককে ঈশ্বরচন্দ্র চেনেন না। তবে মন ভরে বাহবা জানালেন তাঁকে।
ঘটনা একেবারে বাস্তবে পরিণত হল। সেই বছরেই। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি এ আর্টস পরীক্ষা হল। স্নাতক হয়ে বেরল দুজন মহিলা। দুজনই বাঙালি। চন্দ্রমুখী বসু আর কাদম্বিনী গাঙ্গুলি। বাঙালি হলেও দুজনেরই বাস বাংলার বাইরে। চন্দ্রমুখী বসু থাকে ইউনাইটেড প্রভিন্স অফ আগ্রা এবং ওয়ুধের অধীন দেরাদুন শহরে। কাদম্বিনী গাঙ্গুলির আদিনিবাস ভাগলপুরে। উচ্চ পড়াশোনার জন্যে তাঁদের কলিকাতায় এসে থাকা। বেথুন কলেজের ছাত্রী।
গেজেটে পরীক্ষার ফল দেখেই ঈশ্বরচন্দ্র হৈ হৈ করে উঠলেন। এতদিনের স্বপ্ন সফল। আনন্দে কেঁদে ফেলেছেন। বন্ধুদের ডেকে ডেকে সুখবরটা দিতে থাকলেন। বললেন, দেখো, নারীশিক্ষার গতিতে পালের হাওয়া লাগল। এবার তা নিজ গতিতে চলবে। পুরুষের কোনও উপহাস, কটুবাক্য নারীকে পড়াশোনা করা থেকে নিরুৎসাহ করতে পারবে না।
চিঠি লিখতে বসলেন। প্রথম চিঠি, চন্দ্রমুখী বসুকে। লিখলেন, বৎসে, সেদিন তোমায় দেখে এবং তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথপোকথন চালিয়ে, আমি যার-পর-নাই আহ্লাদিত হয়েছি। তুমি সুস্থ শরীরে দীর্ঘজীবিনী হয়ে সুখে কালহরণ কর, এবং স্বজনবর্গের আনন্দদায়িনী ও সজ্জনসমাজে প্রতিষ্ঠাভাজন হও, এই আমার আন্তরিক অভিলাষ ও ঐকান্তিক প্রার্থনা।
এই সঙ্গে যতকিঞ্চিৎ উপহার (সেক্সপিয়ার ওয়ার্কস) প্রেরিত হচ্ছে, গৃহীত হলে নিরতিশয় পরিতোষ হবে।…
সঙ্গে বইয়ের ভিতরের কভারে নিজে হাতে লিখলেন, শ্রীমতী কুমারী চন্দ্রমুখী বসু, দ্য ফার্স্ট বেঙ্গলী লেডি, হু হ্যাজ অবটেন্ড দ্যা ডিগ্রী অফ মাস্টার্স অফ আর্টস, অফ দ্যা ক্যালকাটা ইউনিভারসিটি,
ফ্রম হার সিন্সিয়ার ওয়েল উইশার,
ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা।
প্রাপকের কাছে তা ডাকে পাঠিয়ে দিলেন তাঁর দেরাদুন বাড়ির ঠিকানায়।
এবার বেরলেন কাদম্বিনীর সঙ্গে দেখা করে তাঁকে আশীর্বাদ জানাবার জন্যে। কাদম্বিনী গাঙ্গুলি ভাগলপুরের বাসিন্দা হলেও ঈশ্বরচন্দ্র জানতেন, সে এখনও হস্টেলেই রয়েছে। কারণ কলিকাতা মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়বার প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন।
ঘোড়ার গাড়ি ডেকে চড়ে বসলেন ঈশ্বরচন্দ্র। অকুস্থল বিডন স্ট্রীট। সেখানেই কলেজ মহিলাদের হোস্টেল। সঙ্গে নিলেন একই উপহার, মানে সেক্সপিয়ার ওয়ার্কস। তাঁর অতি পছন্দের উপহার। নিজে তিনি বইয়ের ভক্ত। সকলকে তাতেই উৎসাহিত করেন। বই উপহার দিয়ে। তাও ওই সেক্সপিয়ার রচনাবলী।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অর্থাৎ বেথুন কলেজের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য নিজে এসেছে ছাত্রীর সঙ্গে দেখা করতে! সাজসাজ রব পরে গেল সারা হোস্টেলে।
তিনি গাড়ি থেকে নামলেন। মেয়েরা দুড়দাড় করে নেমে এসেছে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে। যে যা পোষাকে ছিল, তাইতেই এসেছে ।
ঈশ্বরচন্দ্র তাকিয়ে দেখলেন। কিঞ্চিৎ অস্বস্তি বোধ করছিলেন। তবে, সকলেই তো তাঁর সন্তানের মতো। অচিরে নিজের অস্বস্তি দূর করে ফেললেন। মেয়েদের আহ্বানে হোস্টেলের ভিতরে ঢুকলেন। কমন রুমে গিয়ে বসলেন। সবার মাঝ থেকে কাদম্বিনীকে কাছে ডাকলেন। আনত শিরে এসে কাদম্বিনী তাঁর পা স্পর্শ করে প্রণাম করল। মাথায় দুহাত রাখলেন। প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন কাদম্বিনীকে। উচ্ছ্বাস দেখিয়ে বললেন, ভেবেছিলাম নিজেই আমায় দেখা দিতে আসবি। তা পাহাড় যখন এলো না, মহম্মদ নিজেই পাহাড়ের কাছে চলে এল। হা হা…
-স্যার, আমি ভীষণ লজ্জিত…, মুখ নিচে করেই দাঁড়িয়ে রইল কাদম্বিনী। অন্য মেয়েরা তাকে ঘিরে দাঁড়ানো।
-ঠিক আছে, ঠিক আছে। এতে লজ্জার কিছু নেই রে। আমি তো সব জায়গাতেই আগে দৌড়ে যাই। এখানেও তাই এলাম। ও এমনই বললাম তোকে। এই নেয়ে…, হাতে ধরা সেক্সপিয়ার রচনাবলী পুস্তকখানা কাদম্বিনীর হাতে তুলে দিলেন। হাত বাড়িয়ে তা নিয়ে আর এক প্রস্থ প্রণাম সারল কাদম্বিনী। তার দেখাদেখি অন্যান্য মেয়েরাও ঈশ্বরচন্দ্রকে প্রণাম করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তিনিও সকলের প্রণাম নিলেন এবং জনে জনে একান্ত শুভকামনা জানিয়ে আশীর্বাদ করলেন। মেয়েরা আপ্লুত।
চলবে…