উপন্যাস।। আবার এসো ফিরে।। রামেশ্বর দত্ত

  পড়া থামিয়ে দিলেন। চোখের কোল মুছলেন ঈশ্বরচন্দ্রক্ষণিকের জন্যে দুচোখ মুদলেন। কিছু ভাবনা মনে আসছিল। তবে সেসব সরিয়ে রেখে আবার চিঠি পড়তে শুরু করলেন,

  আমার জীবনের প্রধানতম কর্তব্য প্রতিপালন করতে পারলাম নাআপনি একবার স্বর্গীয় পিতামহের চরণ সেবার জন্যে কাশীধামে গমন করবার উদ্যোগ করছেন, এমন সময় আপনার এক আত্মীয় বললেন, ‘বিদ্যাসাগর, এমন গরমের দিনে কাশী যাবে বড় ভয়ের কথা।’ আপনি অম্লান বদনে উত্তর দিলেন, ‘কর্তব্য করতে যাব, তাতে প্রাণের ভয় করলে চলবে কেন?’  সেই থেকে মহাপুরুষ উচ্চারিত বেদবাক্যগুলি এ অধমের অন্তরে খোদিত হয়ে আছে। আজ আমি নিজ কর্মদোষে সেই কর্তব্য কর্ম থেকে বঞ্চিত হয়ে রয়েছি

এরপর 

পর্ব- ৩৫ 

  আমি এখন আপনার নিকটে যেতে চাই না। যখন আপনি এ অধমের মুখের দিকে তাকাতেও অনিচ্ছুক, তখন আমি কোন সাহসে আপনার নিকটে বা সম্মুখে দাঁড়াতে যাব। আমি অন্তরালে থাকব। চাকরের দরকার হলে চাকর ডেকে  দেব, কোথাও যেতে হলে চাকরের মতো যাব। চাকরের মতো থাকব, ক্রমে অনুগ্রহ হয়, অনুমতি হয়, নিকটে  যাব। নচেৎ সারমেয়র মতো থাকব। আমি যেমনই হই আপনার পুত্র। আমারও অর্ধেক বয়স গত হল। যেমন হোক আপনার একটি নাতি আছে। যদি বেঁচে থাকে তাকে মহাশয়ের পরিচয় দিতে হবে। যদি পুত্রকে পা দিয়ে ঠেলে গেলেন, তবে পৌত্রটি জনসমাজে কি বলে মুখ দেখাবে, তা অপেক্ষা আমার গলায় পা দিয়েছেনই তারও গলায় পা দিয়ে মেরে ফেলু…

চোখের জলে পরের অক্ষর  মুছে যাচ্ছে ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে। চিঠি আর পড়তে পারছেন না। পড়া বন্ধ রাখলেন। মন চাইছিল, এখনই গিয়ে নাতিকে আঁকড়ে ধরেন।

বুঝতে পারছেন, তিনি যা করছেন তার অপব্যাখ্যাই করছে নিজ পুত্র। মিছিমিছি সে ওই শিশুকে বাপ-ছেলের মাঝের বিসংবাদের মধ্যে টেনে আনছে। রোষ তো তাঁর প্যারীর ওপর নয়। প্যারী তাঁর নয়নের মণি। একমাত্র নাতি। রোষ নারায়ণের ওপর। সে দুশ্চরিত্র। নিজ স্ত্রীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। নিজ ভগ্নীদের প্রাপ্য সম্পত্তির অধিকারও সে ছলেবলে কৌশলে হরণ করতে চাইছে। আজকেই যার এ অবস্থা; না জানে, তাঁর অবর্তমানে ওই ছেলে কী না কী অপকর্ম করে সকলকেই, এমনকি যে মা, দীনময়ী আজ তার পশ্চাতে রয়েছে, তাকেও না সবকিছু থেকে বঞ্চিত করে বসে। দূরদৃষ্টি দিয়ে এখনই তিনি   দেখতে পাচ্ছেন, তাঁর অবর্তমানে নারায়ণ কী এবং কতখানি ক্ষতি করবে তাঁর কষ্টার্জিত খ্যাতি ও সম্পত্তির। তা বুঝেই তিনি তাকে ত্যাগ করেছেন।

এমন সব দুর্ভাবনায় ঈশ্বরচন্দ্র অকূলের কূল পাবার আশায় প্যারীকে তখন তখনই কাছে পেতে চাইলেন। খাট ছেড়ে নিচে নামলেন। ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালেন। চারিদক অন্ধকারে ডুবে রয়েছে। রাস্তায় জ্বলা গ্যাসের বাতির আলো টিমটিম করে স্বল্প আলো ছড়াচ্ছে। তাতে অবশ্য রাতের নিকষ কালো অন্ধকারকে মুছে ফেলতে পারছে না। ওই অবস্থায় হাতে লন্ঠন নিয়ে পায়ে পায়ে পাশের ঘরের দিকে এগোতে থাকলেন। ভবসুন্দরী প্যারীকে নিয়ে সেখানেই নিদ্রা যাচ্ছে।

রাত এখনও অগভীর। ঈশ্বরচন্দ্রের মনে হল, বউমা হয়তো  জেগেও থাকতে পারে। তা যদি থাকে, তবে প্যারীকে তার কাছ থেকে তুলে এনে নিজের কাছে নিয়ে শোবেন। ভিক্ষে চাওয়ার মতোই তিনি প্যারীকে চাইবেন নিজের পুত্রবধূর কাছ থেকে। পৌত্র তাঁর শরীরের রক্ত নিয়ে বড় হোক; তারই মতো প্যারীর হৃদয় কঠোর-কোমলের কোড়কে গড়ে উঠুক, তাই তিনি চান।

ধীর পদক্ষেপে যখন  ঘরের সামনে পৌঁছলেন, দেখলেন সেখানে তখনও নিদ্রার আবেশ আসেনি মা ছেলের। দুজনে শুয়েছে বটে, তবে ঘুমাইনি কেউ-ই। গল্পে মেতে রয়েছে। নিচু স্বরে কথাবার্তা চলছে মা আর ছেলের মাঝে।

ঈশ্বরচন্দ্রের হাতের লণ্ঠনের আলো ঘরে গিয়ে পড়তে ভবসুন্দরীর চমক লাগল। তাড়াতাড়ি সে বিছানার ওপর উঠে বসল। ঘরের দেওয়ালে শ্বশুরের অবয়বের আবছা ছায়া দেখে দ্রুত উঠে খাট থেকে নেমে দরজায় এসে দাঁড়ল। প্রশ্ন করল, অসুস্থ শরীর নিয়ে আপনি উঠে এলেন কেন, বাবা? আমাকে তো ডাকতে পারতেন…

ভবসুন্দরী ধরেই নিয়েছিল শ্বশুরমশায়ের কিছু প্রয়োজন হয়েছে, তাই তিনি নিজে উঠে এসেছেন।

ঈশ্বরচন্দ্র জবাব দিলেন, বউমা, প্যারীকে কি আজকে আমার কাছে শুতে দেবে?

-হ্যাঁ, হ্যাঁ। যাক না।…আপনার যখন ইচ্ছে হয়েছে…

প্যারীর কানে কথাটা গেছে। সে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলতে শুরু করল, মা, আমি ওঘরে শোব না…

-যাও না বাবা। দাদুর ইচ্ছে হয়েছে তোমাকে পাশে নিয়ে শোবে। তুমি তো বড় হয়ে গেছ।

-না, তাহলে তুমিও ওঘরে চলো।

ঈশ্বরচন্দ্র হেসে উঠলেন। ততক্ষণে তিনি ঘরে প্রবেশ করে খাটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনিই ছোট্ট প্যারীর কথার উত্তর দিলেন। বললেন, দাদুভাই, মা তো তোমার মতো ছোট নয়। তুমি ছোট। তুমি এসো আজ আমরা দাদু নাতিতে একসঙ্গে শুয়ে অনেক অনেক গল্প করব। যাবে চলো…

-না দাদু। মা গেলে আমি যাব।

ভবসুন্দরী হাসল। ছেলেকে আর কিছু বলল না। নিজে থেকে তাকে কোলে তুলে নিল। শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে ইশারায় জানাল, প্যারী ওখানে ঘুমিয়ে পড়লে সে ঘরে ফিরে আসবে।

-চলো, চলো, বলে, সকলে মিলে অন্য ঘরের দিকে পা বাড়াল। ঘরে ঢুকে ভবসুন্দরী দেখল, খাটের ওপরে একটা চিঠি খোলা অবস্থায় রাখা। বুঝতে পারল, ও চিঠি কার। কোনও প্রশ্ন না রেখে প্যারীকে খাটে শুইয়ে দিয়ে নিজে সামনের চেয়ারে বসতে গেল। প্যারী কী বুঝল , মায়ের কাপড়ের আঁচল টেনে ধরল। বলল, মা, শোও…

-বাবা, আমি দাদুর সঙ্গে বসে গল্প করি। তুমি ঘুমোও।

-না, তাহলে, আমিও বসে থাকব, বলে, ছেলে বায়না ধরল। শেষমেশ ছেলের পাশে ভবসুন্দরীকেও শুতে হল। ঈশ্বরচন্দ্র চেয়ারে বসলেন। মা ছেলের গা মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে, ঈশ্বরচন্দ্র কথা শুরু করলেন।

-বউমা, চিঠিখানা যে তুমি হাতে করে আনলে, একবার পড়ে দেখছ?

-বাবা, আপনাকে লেখা চিঠি, আমি পড়তে যাব কেন?

-সেটা তো ঠিকই বলেছ। তবে এখন আমি তোমাকে ওই চিঠি পড়ে দেখবার কথা বলছি। তুমি পড়ো।

-না বাবা। আমায় ক্ষমা করবেন। তা হয় না।

-বুঝছি। তুমি অপারগ। অসুবিধাটা কোথায়। ঠিক আছে, আমিই পড়ছি, তুমি শোনো।

ঈশ্বরচন্দ্র চিঠির প্রথম অংশটুকু যা তিনি এতক্ষণ পড়ে এসেছেন, সেটুকু এড়িয়েই তারপর থেকে পড়তে শুরু করলেন। ঘরের লন্ঠনের আলোয় তিনি চিঠি পড়ছেন,

…ধিক জীবন নিয়ে থাকা অপেক্ষা মৃত্যু ভাল, আমি এতদিন মৃত্যুর আশ্রয় নিতাম, তবে মধুরভাষিণী আশা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বাপ-মায়ের নিকট ক্ষমা পাবার আশা কখনই ছাড়া যায় না। একালে তো আমার অদৃষ্টে এই হল, কিন্তু পরকালের পথটা রুদ্ধ করবেন না। যদি আপনার চরণ সেবা করতে না পারলাম, তবে কিসে পরকালে উদ্ধার পাব? আপনি একবার রাগদ্বেষ বর্জিত মনে-আপনার ঋষিতুল্য মাধুর্য ও মনের উচ্চতায় তদ্গচিত্ত হয়ে ভেবে  দেখুন দেখি, আপনার অধম সন্তানকে ভাসিয়ে দিলে মহাত্মার পৃথিবীব্যাপী সুনামে একটু কলঙ্ক স্পর্শ করবে কিনা? যে ব্যক্তি সহিষ্ণুতার আধার, যার দেহ…,

পড়ার মাঝে ঈশ্বরচন্দ্র হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেলেন। কিন্তু পত্রের লাইনের ওপর থেকে চোখ সরালেন না। নিশ্চুপে কয়েক ছত্র পড়ে গেলেন। পরে পুত্রবধূর দিকে তাকিয়ে বললেন, ছেলে আমার গুণের প্রশংসা করেছে। সেগুলো আর নাই বা শোনালাম তোমাকে। তবে হ্যাঁ, এখান থেকে  শোনো, বলে, ফের পড়তে থাকলেন,

-মহাশয় একাকী বিকৃত হয়ে পড়েছেন। আজ যদি গোপালচন্দ্রও থাকত তা হলেও সকল দিক রক্ষা পেত। … সুতরাং বহু পরিবার পরিবৃত হয়েও আপনি একাকী; ছেলে, জামাই, ভাই একজনও মনের মতো হলে, তার উপর ভার ফেলে পীড়ার সময় দশ দিন নিভৃতভাবে নিশ্চিন্ত হয়ে থাকতে পারতেন। যখন যখন আপনার শীর্ণ দেহ, শুষ্ক মুখ ও ক্ষীণ স্বরে কথা কহা আমার মনে উদয় হয়, তার উপরে সকল ঝঞ্ঝাট পোয়ানো মনে পড়ে, অথবা পীড়িত হয়ে একমাত্র চাকর সহায় নিয়ে কর্মাটাঁড়ে যাওয়া মনে হয়, তখন ভাবি, এখনও কেন বেঁচে আছি। আর নিজ কর্মদোষের জন্যে জিহ্বা টেনে মরতে  ইচ্ছা হয়।

ঈশ্বরচন্দ্র পড়া থামালেন। ভবসুন্দরীর দিকে চোখ তুলে তাকালেন। ঘরে লণ্ঠনের মৃদু আলো।  প্যারী ঘুমিয়ে পড়ায় ভবসুন্দরী বিছানায় উঠে বসেছে। তাঁর চোখে জল লক্ষ্য করলেন । পড়া তিনি সম্পূর্ণ রূপে থামিয়ে দিলেন।

দুজনেই চুপ । কারোও মুখে কথা নেই। শেষে ঈশ্বরচন্দ্রই নীরবতা ভাঙলেন।  বললেন, দেখো বউমা, এ কথা মনে কোর না, তোমায় দুঃখ দেবার জন্যে আমি এ চিঠি পড়ে শোনালাম।…নিজ পুত্র ত্যাজ্য হয়ে সে তার বাবাকে এধরণের পত্র লিখতেই পারে। তাই বলে, তোমাকে তো আমি ওই দলে ফেলিনি। আজ যে নারায়ণের জন্যে তোমারও কত দুঃখ, তা কি আমি বুঝি না? সে ছেলে যদি মানুষের মতো মানুষ হোত, তাহলে কি আজ তোমাকে এসব কথা শুনতে হত?

-বাবা, আপনি ওঁনাকে ক্ষমা করে দিন।

এতক্ষণে এই প্রথম ভবসুন্দরীর মুখে কথা সরল। নচেৎ পুরো পত্রটা যখন শ্বশুর পড়ে গেছে, তার  মন বারবার কিছু  বলবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিল। তবে তা করেনি শুধুমাত্র শ্বশুরের কৃপাদৃষ্টি থেকে যাতে না বিচ্যুত হয়। সে জানে, এখনও শ্বশুরের পাঠানো অর্থেই তার সংসারের ব্যয় বহন হয়। না হলে, তিন সন্তান নিয়ে মাসে স্বামীর দশ টাকা উপার্জনে তার পক্ষে সংসারে টিকে থাকা দায় হত। তাই স্বামীর এই কাকুতিপূর্ণ চিঠি তাকে শ্বশুরের ব্যবহারের প্রতি ঝড়ের মতো বিদ্রোহের পথে এগিয়ে নিয়ে গিয়েও শান্ত সমুদ্রে পরিণত করতে বাধ্য করল। স্বামীর হয়ে ক্ষমা ভিক্ষা করল।

ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, ক্ষমা তো নারায়ণও চেয়েছে, বউমা। তবে সে কি সত্যিই ক্ষমার যোগ্য?

-আপনি মহৎ ব্যক্তি। চাইলে আপনি তা করতেই পারেন।

-আজ আমি তাকে ক্ষমা করে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করব, আমার কি ওর চরিত্র জানবার, চেনবার বাকি রয়েছে?

-বাবা, চরিত্রগুণে তিনি আপনার নজরে অধম হলেও, তিনি আমার স্বামী। একজন নারীর কাছে তাঁর স্বামী কতখানি নির্ভরতার স্থান হয়, তা আপনি জানেন।

-এ তো সংসারের সত্য। তবে সেটা তোমার আর নারায়ণের ব্যাপার। আমি তার যে রূপ চিনেছি, তাতে আমি তোমার ভরসার স্থলকে খুব দৃঢ় বলে মনে করিনি; আজকেও তা করছি না।

-আপনি এতখানি নিষ্ঠুর হবেন না, বাবা।  আমি আবার অনুরোধ করছি, আপনার পুত্রকে আপনি ক্ষমা করে সম্পত্তিতে উপযুক্ত প্রাপ্য তাঁকে দিন।

-বউমা, এতদিন তো আমি দিয়েই এলাম। প্রতিদানে তো আমি কারোও কাছ থেকে কিছু চাইনি। আমি চেয়েছিলাম, তাঁরা সকলে আমায় বুঝুক। কিন্তু কেউ তা বুঝল না। আমি ঠকেই গেলাম এতটা কাল। তাই আমি ঘরপোড়া গরু। আমি চাইব না, আমার লিখিত সম্পত্তির উইল পরিবর্তন করে সেখানে নারায়ণকে উত্তরাধিকার দিয়ে বাকিদের পথে বসাতে।

-তাঁর স্ত্রী হয়ে আপনার এ যুক্তি আমি মানতে পারছি না, বাবা।

ভবসুন্দরী এবার প্রকৃতই বিপরীত মতো কথা বলে বসল। স্বল্প শিক্ষিতা মহিলা সে। পারবে কেন বিচক্ষণ ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে যুক্তির জাল বুনে তাঁকে কাবু করতে। সে তো প্রথমেই ক্ষমার পথ ধরেছিল। তাতে কাজ হল কৈ? তবে কেন না এবার অধিকারের জোর ফলানো?

ঈশ্বরচন্দ্র স্থির হয়ে গেলেন। এই অবস্থায় অতিরিক্ত বাক্য ব্যয় না করে তিনি শুধু বললেন, বউমা, রাত হয়েছে। শুতে যাও।

ঈশ্বরচন্দ্র কি এক সামান্য শিক্ষিতা অথচ পতি পরায়ণা নারীর কাছে হার মানলেন?

ভবসুন্দরী সামান্য উষ্মা দেখিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেল। যাবার আগে ঘুমন্ত ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে ফিরে গেল।

ঈশ্বরচন্দ্রের মুখটা শুকনো হয়ে উঠল। একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। মুখে কিছু বলতে পারলেন না । বুকে যেন  শেলের আঘাত পড়ল।

ভবসুন্দরী ঘরের চৌকাঠ পেরতেই তিনি হাউ হাউ শব্দে কেঁদে উঠলেন। এ কান্নার কারণ রাগ নয়; অভিমান নয়; নয় জীবনযুদ্ধে হেরে যাবার। কান্না তাঁর হৃদয়ের বাৎসল্য প্রেমের উৎসস্থল থেকে নিষ্ক্রান্ত অগ্নুৎপাতের কারণে।  লাভা ছড়িয়ে পড়ার মতো তা তাঁর মন প্রাণকে ভেঙে খানখান করে দিতে থাকল। যে বাৎসল্যপ্রেম তাঁর ‘প্রভাবতী সম্ভাষণ’ লেখার রসদ দিয়েছে, তাই কি তবে প্যারীমোহনের জন্যেও সঞ্চিত হল তাঁর অন্তরে?

কর্মাটাঁড়ে চলে যাওয়াই মনস্থ করে বসলেন। সত্ত্বর ভবসুন্দরী আর প্যারীর গ্রামে ফেরার বন্দোবস্ত করে দিলেন। তারপরেই চললেন কর্মাটাঁড়ে। যাবার আগে তার করে দিলেন সেখানে। অভিরাম জানল, বাবু আবার আসছে। উল্লসিত হল সে।

(৩৯)

ট্রেন কর্মাটাঁড় ষ্টেশনে এসে ঢুকল। স্টেশন চত্বর লোকে লোকারণ্য। সাঁওতাল অদিবাসীরা অভিরাম মণ্ডল মারফৎ পূর্বেই সংবাদ পেয়ে গেছে, তাদের ঘরের মানুষ, বিদ্যেসাগর ফিরে আসছে। তারা এসে ভিড় জমিয়েছে স্টেশনে। ধামসা বাজিয়ে বিদ্যেসাগরকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছিয়ে দিয়ে আসবে।

গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ঈশ্বরচন্দ্র লোকের মেলা দেখলেন। পূর্বাপর সবকিছু ভুলে প্রাণ তাঁর নেচে উঠল। মনজুড়ে ঠিক যেন মন্দিরের পুণ্যদ্বারে পা রাখার আনন্দ। হাত নেড়ে ইশারায় জনতা জনার্দনকে অভিবাদন জানালেন। তারপর ধীরে ধীরে কামরার গেটের কাছে এসে দাঁড়ালেন। অভিরাম আগেই লাফ দিয়ে গাড়িতে উঠে পড়েছিল। সঙ্গে দুজন সাঁওতালও উঠেছিল; গাড়ি থেকে ঈশ্বরচন্দ্রের মাল খালাস করবার জন্যে।

ঈশ্বরচন্দ্র এবার ট্রেন থেকে নামছেন।কামরার গায়ে সাঁটানো কাঠের সিঁড়িতে পা রাখলেন। হাত দিয়ে কামড়ার হাতল ধরে রয়েছেন। একটা ধাপ নেমেছেন । দ্বিতীয় ধাপে পা রাখতে যাবেন, হঠাৎ পা ফসকে সটান নিচে পড়ে গেলেন। সোজা ভূঁয়ের ওপর।  ঘেসো জমিতে।  তাই দেখে উপস্থিত সকলে হৈ হৈ করে উঠল, পর‍্যে গেছে, পর‍্যে গেছে রে আমাদের বিদ্যেসাগর…। ছুটে এলো। ঈশ্বরচন্দ্রকে কোনোক্রমে তুলে দাঁড় করালো।  শরীরে আর সেই আগের মতো জোর নেই। তবু অন্যের সাহায্যে কোনও মতে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।

ওদের কাছের মানুষ, বিদ্যেসাগর। তাঁর এই অবস্থা দেখে মানুষগুলো ক্ষেপে উঠল। স্টেশনময় ছোটোছুটি  করে  হাঁকডাক শুরু করল, এ স্টেশনবাবু, আয় দেখ্যে যা, আমাদের বিদ্যেসাগরের কী অবস্থা করেছিস।…কেউ বা চিৎকার করছে, এই…এই দৌড়ে যা। টেরেন রুখ্যে দে…

সত্যি সত্যিই কয়েকজন মিলে গিয়ে চালকের কামরায় উঠে পড়ল। ইঞ্জিনের দড়ি ধরে টান মেরে কু কু  শব্দ তুলল। চালককে গাড়ি ছাড়তে দেবে না। ট্রেন আটকে দিল। স্টেশন মাষ্টার ততক্ষণে ছুটে এসেছে কামরার সামনে। ঈশ্বরচন্দ্রকে  চেনে। ভালোমতো পরিচয় রয়েছে তাঁর সঙ্গে। স্টেশন ধারের রেল কোয়ার্টারে তাঁর বাস। সেখান থেকে প্রায়ই ঈশ্বরচন্দ্রের বাড়ি বেড়াতে যায়। বসে গল্পগুজবও করে বহু সময় ধরে। সেই লোক ঈশ্বরচন্দ্রের এমন অবস্থা দেখে বেশ ঘাবড়ে গেল। কাছে গিয়ে তাঁর পরিচর্যা শুরু করে দিল।

এদিকে ট্রেন আর ছাড়ছে না। লাইন্সম্যান সবুজ পতাকা দুলিয়ে চলেছে; কিন্তু গাড়ি ছাড়তে দিচ্ছে না প্রতিবাদী সাঁওতালেরা। তাদের দাবী, বিদ্যেসাগরের যদি বেশি চোট লেগে থাকে, তবে তাঁকে এই টেরেনেই মধুপুরে নিয়ে যাবে। সেখানের হাসপাতালে ভর্তি করবে। এছাড়াও কেউ কেউ স্টেশন মাষ্টারকে ঘিরে ধরে দাবী জানাচ্ছে, প্ল্যাটফরম উঁচু করার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে তাদের।

গাড়ির দেরী হচ্ছে। সেও সমান বিপদের। ইংরেজ স্টেশন মাষ্টারের কপালের ঘাম ঝরতে শুরু করল। বিপদ বুঝে ঈশ্বরচন্দ্রের কুশল জানতে চাইল। জিজ্ঞেস করল, চোট কি খুব বেশি? তা যদি হয়, তবে এখুনিই তাঁকে মধুপুরে নিয়ে যাওয়া হবে।

ঈশ্বরচন্দ্র জানালেন, চোট তিনি পেয়েছেন বটে, তবে তার জন্যে মধুপুরে যেতে হবে না। এখানেই তা সামলে নিতে পারবেন।

স্টেশনমাষ্টার অনুরোধ জানালেন, কথাটা ট্রেন অবরোধকারী জনতাকে যেন  জানিয়ে দেয়।  তাঁর অনুরোধ রেখে ঈশ্বরচন্দ্র হাত তুলে সকলকে কাছে আসবার আহ্বান জানাতে, তারা এসে তাঁকে ঘিরে দাঁড়াল। তিনি বললেন, এই তোরা ট্রেন ছেড়ে দে। আমার বেশি চোট লাগেনি।

-এই বিদ্যেসাগর, তুই ঠিক বলছিস? নাকি ওই সাহেবের কথা শুনে আমাদেরকে মিছে কথা বলছিস?

ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন চীৎকার করে কথাটা বলে উঠল। ঈশ্বরচন্দ্র আবার জানালেন, তাঁর বেশি চোট লাগেনি। লোকগুলো তাই সত্যি মেনে ইঞ্জিনে চড়ে বসা লোকদের ডেকে নামিয়ে নিল।  হুইসেল দিয়ে ট্রেন প্ল্যাটফরম ছাড়ল। গাড়ি চলে যেতে সবাই মিলে তাদের বিদ্যেসাগরকে কাঁধে চাপিয়ে হৈ হৈ করে নিয়ে চলল তাঁর আবাসে। তিনি যাচ্ছেন আর ভাবছেন, কী বিপদটাই না বাধিয়ে ছিলেন তাঁর এই অশক্ত শরীরে।

বাসস্থানে এসে দিন কয়েক অভিরামের যত্নে শরীরে বল ফিরে পেলেন। নিজের নৈমিত্তিক কাজে লেগে পড়লেন।

চলবে… 

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page