উপন্যাস।। আবার এসো ফিরে।। রামেশ্বর দত্ত
ঈশ্বরচন্দ্রের অনুরোধে মেম তাঁকে সমস্তটাই ঘুরিয়ে দেখালেন। প্রশস্ত জমির একদিকে বাংলো ধরণের বাসস্থান। বেশ পুরানো, ভগ্নপ্রায় অবস্থা। তবে সেখানে রয়েছে চারটে ঘর, দুটো হল ঘর, দুটো বারান্দা।
তিনি বুঝলেন, এ সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত নয়। বসত বাড়িখানা না হয় পুনর্নির্মাণ করে নিলে হবে। তবে হল ঘর, সামনের এতখানি উন্মুক্ত জায়গা, এগুলোকে দিয়ে নিজের ইচ্ছে মতো অনেক কাজ তিনি করতে পারবেন।
বেশি দেরী না করে, হল ঘরে বালকদের জন্যে ইশকুল তো এখনই বসান যায়।… চারটে ঘরের একটা নিজের থাকবার, একটা বইপত্র রাখা, লেখালিখি করবার, অন্যটায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসালয় বসানো, আর একটায় অভিরামকে কাছে এনে ঠাঁই দেওয়া।
এরপর …
পর্ব- ২৫
দেরী না করে ঈশ্বরচন্দ্র তৎক্ষণাৎ কথা দিয়ে দিলেন মেমকে। এবং বিকেলের মধ্যে টাকা দিয়ে বাড়ি কেনার বায়নামা করে দিলেন। স্থির করলেন, এই খেপে থাকবার কালেই বাড়ি কেনার কাগজপত্র করিয়ে নিয়ে বাকি টাকা মিটিয়ে দেবেন।
বিকেল হতে তাই করলেনও । মাঝে মাত্র দিন কয়েক অভিরামের অতিথি হয়ে রয়ে গেলেন।
(৩১)
বেশ কিছুদিন কর্মাটাঁড়ে কাটিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র কলিকাতাতেই ফিরলেন। তাঁর মন ভরা তৃপ্তি। মনে মনে বলছেন, এবার তাহলে, কলিকাতা বাস কমিয়ে কর্মাটাঁড়ের বাসিন্দা হতে পারবেন। নিজের একটা বাসা হয়ে গেল, আর কী চিন্তা? মন চাইলেই সেখানে চলে যাবেন। আবার কলিকাতায় কাজ পড়লে সেখান থেকে দিন কয়েকের ছুটি নিয়ে এসে কাজ সেরে নেবেন।
দিন মাস কাটছে। বাড়ির চিন্তাই এখন বেশি করে হয়। মেয়েদের বাবা হয়েছেন। দায়িত্ব অনেক। যদিবা নিজের দায়িত্ব সম্বন্ধে তিনি অতি সজাগ; তবু দীনময়ীর কাছ থেকে ঘন ঘন পত্র আসছে, কুমুদিনীর জন্যে ছেলে স্থির করলেন? প্রতি পত্রে সব কথার শেষে ওই একটাই প্রশ্ন। কোনও কোনওবার সংবাদ দিয়ে স্ত্রীকে চিন্তা করতে না করছেন; আবার মাঝে দু একটা চিঠির উত্তর না দিয়ে ফেলেও রাখছেন। কলিকাতায় বসে যা কাজ করবার তা তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন; পাত্রের খোঁজখবর করা, ঘটকের সঙ্গে আলাপ করা, ইত্যাদি।
আসলে, আজকাল নিজের মেয়েদের ছাড়া আর কারোও কথা তাঁর ভাবতে ইচ্ছে করে না। এমনকি দীনময়ীর কথাও না। তা যে দীনময়ীর কোনও কারণে, তা নয়। উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলের প্রতি মায়ের অত্যধিক স্নেহের কারণে।
তাঁর মনে হয় না, ভালোকে ভালো, খারাপকে খারাপ বলবার শক্তি এতই দুর্বল হয়, যা অপত্য স্নেহের কাছে হার মানে। দীনময়ীর সরলতার সুযোগ নিয়ে নারায়ণও গ্রামে বসে যা খুশি, তাই করে যাচ্ছে। কলিকাতা বাস উঠিয়ে এখন বউ নিয়ে সে গ্রামেই থাকছে।
নানান কুকর্মের জন্যে নারায়ণ হয়েছে চোখের বিষ। ঈশ্বরচন্দ্রের মনে হচ্ছে, বড় হয়ে বিয়ে করে ছেলে নালায়েক হয়ে গেছে! গ্রামে গিয়ে বসেছে। কাজ নেই কম্ম নেই। বাবার বিরুদ্ধেই কুচক্র করছে! অন্যদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। বোঝে না গ্রাম্য রাজনীতি? বয়স তো হয়েছে। নিজের বিবেক কাজে লাগিয়ে বিচার করে বুঝতে পারছে না, সেখানে অনেকেই তার বাবার এত সুখ্যাতি সহ্য করতে পারছে না। মানুষের চরিত্রই ঈর্ষাপরায়ণ। সেখানে ঘরের ছেলেই যদি তাদের সাথ দেয়, তো তাদের পোয়া বারো হবেই!
সদ্য একটা ঘটনায় তিনি নারায়ণের প্রতি আবার বিশেষ ক্ষুব্ধ হলেন। একেই তো তার ওপর মন বিষিয়ে রয়েছে। তারপরেও…
কী প্রয়োজন ছিল নারায়ণের এক অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়ার? মদুসূদন ভট্টাচার্য নামের মানুষটা এমনিতেই সুবিধার নয়। সে যে নিজপত্নী বিন্ধ্যাবাসিনীকে তাঁর প্রাপ্য সম্পত্তির উপস্বত্বভোগে বঞ্চিত করছে, সেটা বুঝতে পারল না? না বুঝেই ভট্টাচার্যের উদ্যোগে মত দিয়ে দিল! অন্যায় করল। অন্যায়কে জীবনে তিনি কোনও দিন প্রশ্রয় দেইনি।
এক্ষেত্রে শাস্ত্র আর আইন অনুসারে বিন্ধ্যবাসিনীই সম্পত্তির যথার্থ উত্তরাধিকারিণী। স্ত্রীর জীবিত অবস্থায় অন্য কেউ মধুসূদনের সম্পত্তিতে অধিকারী হতে পারে না; এমন অবস্থায় অন্যদের সঙ্গে সুরে সুর মিলিয়ে কোন বিবেচনায় তাকে বঞ্চিত করে আর একজনকে অধিকার দেওয়ায় সায় দিল নারায়ণ? আর তা দিচ্ছে কাকে? না, রামকুমার ভট্টাচার্য, মানে মধুসূদন বাবুর ভাইকে?
তিনি জানেন, এসবে নারায়ণের সাকরেদ হয়েছিল যদুনাথ। অন্যায়ভাবে যাকে সম্পত্তির অধিকার দিতে যাচ্ছে, সেই রামকুমার ভট্টাচার্য যে যদুনাথের একান্ত অনুগত, এ কারোও অজানা নয়? অনুগত বলেই কি বেনিয়মে তাকে অধিকার দিতে হবে?…
যদুনাথ এখন বড়মানুষ হয়েছে, গ্রামের মোড়ল, তাই বোধ হয় সে হিতাহিত বোধ হারিয়েছে, ধর্মজ্ঞানশূন্য হয়েছে। অথচ নারায়ণের পিতৃপুরুষ সেখানে এতকাল যা করে এসেছে, তার সবকিছু জলাজ্ঞলি দিল! এতে তো নারায়ণের পিতৃদ্বেষী রূপটাই ধরা পড়ছে তাঁর চোখে। সে যথেচ্ছাচারী, কুপথগামী হয়ে উঠেছে, এ কথা আর একবার সে প্রমাণ করল।…আর তার মাও সেখানে বসে ছেলের কুকীর্তি সব দেখছে! একটুও বাধা দিচ্ছে না? নারায়ণ তো দীনময়ীকেও তাঁর চোখে বিষময় করে তুলেছে,…তাঁর আর নারায়ণের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখবার মতো মন নেই। তাই তো তাকে ত্যাজ্যপুত্র করেছেন…
সন্তান পিতার কাছে হয় পরম সম্পদ। সেই সন্তানকে যখন ত্যাগ করতে হয়, পিতার মন কি ভেঙে খানখান হয়ে যায় না?
ঈশ্বরচন্দ্র বুকের ভিতরে কষ্ট অনুভব করতে থাকলেন। স্থির হয়ে বসে রইলেন। দুচোখ বেয়ে জল গড়াতে শুরু করল। উঠে গিয়ে শয্যা নিলেন। চোখ বুঁজলেন। ঘুমের চেষ্টা করতে থাকলেন। কিন্তু ঘুম কৈ?
দুঃখের বোঝ শাকের আঁটি। গোড়া সমেত রাখলে পচে যাবে; গোড়া বাদ দিলে শাকের সোয়াদ কমে যাবে। তাঁর দুঃখ এখন পচা শাক হয়ে পূতিগন্ধ ছড়াচ্ছে।
ভাবতে ভাবতে ইদানীং কূলকিনারা হারিয়ে ফেলছেন ঈশ্বরচন্দ্র। মনে হয়, আর কত? আর কত দুঃখ সহ্য করতে হবে? বেইমানের জগত কি এভাবেই তাকে পিষে মারবে? নিজে সৎ থেকে অন্যকে সৎ পথে চলবার রাস্তা দেখানো; গরীবের দুঃখের ত্রাতা হওয়া; বিধবা নারীর পুনর্বিবাহের ব্যবস্থা করে নারীকে নতুন জীবনের পথে এগিয়ে দেওয়া, এই ছিল তাঁর আদর্শ। তার বিনিময়ে…
ভাবনার খেই হারিয়ে ফেলছেন। অশ্রু বাঁধ মানছে না।
ঘরে লণ্ঠনের ক্ষীণ আলো। হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। পাশে কেউ নেই। অকূল এই শোকসাগরে কে তাঁকে কূল দেখাবে? ভেবে ভেবে স্থির করেই বসলেন, কর্মাটাঁড়-ই হবে তাঁর অন্তিম শান্তির স্থল।
পরে আবার তিনি ভাবনায় ডুব দিলেন। আজকাল ভাবনাই হয়েছে তাঁর কাল। ভিতরে গুমরাচ্ছেন তিনি, কিন্তু কেন এমন হল? দুঃখের বাঁধন তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে পিষে মারছে কেন?
মনে পড়ছে, প্রথমবার কর্মাটাঁড়ের দিকে পা বাড়াবার কিছুদিন আগে তাঁর ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার’, নামের পুস্তকখানা প্রকাশ পেয়েছিল। তাতেই বাবুদের মৌচাকে ঢিল পড়েছিল। হৈ চৈ শুরু হয়েছে বাংলাদেশে। মায় ভারতেরও নটক নড়েছে। কটুকাটব্য উক্তি উড়ে এসেছে এদিক ওদিক থেকে। তিনি সেসবেও বিচলিত হননি। তবে যখন সাহিত্য সম্রাট, বাবু বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের লেখা একটা উপন্যাসের কিছু উক্তি চোখে পড়ল, জল নিয়ে এলো তাঁর চোখে ।
লেখক তাঁর বিষবৃক্ষ উপন্যাসে সূর্যমুখীর জবানীতে লিখেছেন, ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নামে কলিকাতায় কে না কি এক বড় পণ্ডিত আছেন, তিনি আবার একখানি বিধবা বিবাহের বই বাহির করিয়াছেন। যে বিধবার বিবাহের ব্যবস্থা দেয়, সে যদি পণ্ডিত হয়, মূর্খ কে?’ বঙ্গদর্শন পত্রিকায় এমন উক্তি প্রকাশ পেয়েছে। বঙ্কিমবাবুর কটূক্তির এখানেই কিছু সমাপ্তি করেননি।
১২৮০ বঙ্গাব্দের বঙ্গদর্শন পত্রিকার আষাঢ় সংখ্যাটা এনেছিল বন্ধু। সেখানে বহুবিবাহ রহিত, সম্বন্ধীয় বইয়ের সমালোচনা হয়েছে। বইটাকে একেবারে কোণঠাসা করা হয়েছে।
সমালোচনায় সাহিত্যসম্রাট লিখছেন, আমরা এ বলছি না, বিদ্যাসাগর মশায় ধর্মশাস্ত্রে স্বয়ং বিশ্বাসহীন বা ভক্তিশূন্য-তিনি ধর্মশাস্ত্রের প্রতি গদগদ চিত্ত হয়ে তার প্রচারে প্রবৃত্ত হয়েছেন। আমরা এও বলছি যে বিদ্যাসাগর মশায়ের ন্যায় উদার চরিত্রে কপটোচারণ কখনই স্পর্শ করতে পারে না- তিনি স্বয়ং ধর্মশাস্ত্রে অবিচলিত ভক্তি বিশিষ্ট সন্দেহ নেই। কেবল আমাদের কপালদোষে বহুবিধবা নিবারণের সদুপায় কি, তৎসম্বন্ধে তিনি কিছুটা ভ্রান্ত। এর অধিক আর কিছু বলবার নেই।
এরপরে মত দিয়েছেন, মুসলমানদের বহুবিবাহ থাকলে শুধু হিন্দুদের বহুবিধবা বন্ধে আইন আনা উচিত না।
এরপরেই তিনি দু;খ ভুলে ক্রোধাগ্নিতে জ্বলে উঠেছেন। মনে মনে উচ্চারণ করেছেন, ঘুমন্ত সাপের ল্যাজে বুঝি পা পড়েছে তাই এত সমালোচনা? বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরই যদি এই অভিমত হয়, তবে সুষ্ঠু সমাজের ধারক বাহক কারা হবেন?
এমনই সময়ে অন্য একদিন আবার এক সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। এসেছিল বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিক, ঘোষ মশাইদের অমৃতবাজার পত্রিকার তরফ থেকে। বঙ্কিমবাবুর বঙ্গদর্শনের সমালোচনাকে সমর্থন দিয়ে তারা লিখেছে, বহুবিধবা দিন দিন বৃদ্ধি হয়ে সমাজকে আরও কলুষিত করলেও তাকে উঠিয়ে দেবার জন্যে আমরা রাজব্যবস্থার প্রার্থী হতাম না। আমাদের বিশ্বাস, ধর্ম বা সামাজিক বিষয়ে রাজা, বিশেষত বিদেশী রাজার হস্তক্ষেপ রাজনীতি বিরুদ্ধ।
ক্রোধ এবং বিষাদ, দুইই তাঁর মনকে তখন বিচলিত করে তুলেছে । ক্রোধের অগ্নি আর বিষাদের অশ্রু, দুইই মানুষের গন্তব্যকে দূরে ঠেলে দেবার পক্ষে যথেষ্ট; যদি কিনা তা উত্তরণমুখী না হয়। ঈশ্বরচন্দ্র তো সেই মানুষ নন। তিনি কঠোর সমালোচনায় ভাঙেন কিন্তু মচকান না। এক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। উঠে পড়ে লেগেছিলেন বহুবিবাহ রদ করাবার জন্যে। আরও আরও লেখার মাধ্যমে তিনি জনমত প্রতিষ্ঠায় আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে শুরু করেছিলেন। সাড়া পেয়েছিলেন, কলম ধরেছেন, বর্ধমানের অধিপতি মহারাজ মহাতাপ চাঁদ বাহাদুর, কৃষ্ণনগর অধিপতি মহারাজ শ্রীশচন্দ্র, নবদ্বীপের অধিপতি, দিনাজপুরের রাজা বাহাদুর, কলিকাতা, হুগলী, মেদিনীপুর, বর্ধমান, নদীয়া, যশোহর বহু বিশিষ্ট গণ্যমান্য ব্যক্তি, ঢাকার জমিদার বাবু রাজমোহন রায়, সকলেই বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে দিয়ে বহু বিবাহের কুফল সম্বন্ধে প্রচার শুরু করেছেন।
সমাজের করুণ চিত্রটা উঠে এসেছিল। খোঁজ পাওয়া যায়, কূপমণ্ডূক বাঙালি সমাজের কুলীন বীরপুঙ্গবদের। সধবা বা বিধবা, কিশোরী বা যুবতী, একাধিক রমণীর পাণিগ্রহণ করে অভাগিনীদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রক হয়ে এই সমাজে বাস করছে তারা । নিজেদের রাখছে সুখের আশ্রয়ে। আর রমণীকুলের অধিকাংশকেই চিরদুঃখের অনলে ফেলে দগ্ধ করছে।
জেলা জেলার হিসেব দিচ্ছেন এক একজন লেখক। হুগলী জেলায় ১৯৭ জন কুলীন বিবাহ করেছেন ১২৮৮ জন রমণীকে। ঢাকা, বরিশাল, ফরিদপুর জেলার ৬৫২ জন পুরুষ বিবাহ করেছেন ৩৫৬৮ রমণীকে। সর্বাধিক ৫০ বছর বয়স্ক এক বীরপুঙ্গব বিবাহ করেছে ৫০ জন রমণীকে। তৎ পরবর্তী বাক্তি ৩৫ বছর বয়সে ৪০ জনের পাণিগ্রহণ করেছে। এমনকি এক ১২ বছরের বালকের পাঁচজন দম্পতি!
ঈশ্বরচন্দ্র আকুল হয়ে উঠেছেন। এ কি! এ তো পুতুল খেলারও অধিক? নারীর দেহ, মন, মান-সম্ভ্রম, লাজ-লজ্জা, বসন-ভূষণ, পানীয়-আহার, এসবের একমেব অধিকর্তা তো একমাত্র ভগবানই হতে পারেন; তদ্ভিন্ন কোনও মনুষ্যজন কেমন করে হয়? এ কুলীন কুলাচার সমাজকে শুধু কলুষিতই করছে না, নারীর মনুষ্যত্বের অধিকারকেও তো খর্ব করছে! তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, হা বিধাতা , তুমি কি কুলীন কন্যাদের কপালে নিরবচ্ছিন্ন ক্লেশ ভিন্ন আর কিছু লিখতে শেখোনি।
ঈশ্বরচন্দ্র ইচ্ছা করেছিলেন, তাঁর আবেদন পত্র নিয়ে ইংল্যান্ডে রাণী ভিক্টোরিয়ার সামনে পেশ করবেন। কারণ ইতিপূর্বে দু দুবার এই দেশের সরকারের সামনে তা পেশ করেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। ইংরেজ সরকার ইতিপূর্বে বিধবাবিবাহ আইন চালু করিয়েই হিন্দু সমাজ সংস্কারের কাজে ক্ষান্ত হয়েছে। তাদের ভয়, পরপর এমন সংস্কার করতে গেলে নিজেদের রাজ্যপাটই না জনরোষে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
তখন ঈশ্বরচন্দ্রের মনে অসম্ভব যন্ত্রণা। আইন আনা সম্ভব হল না। তবে সমাজ-সংস্কার ও সামাজিক বিষয়ক এক প্রতিজ্ঞা পত্রের রচনা করলেন। পুরুষ ধর্ম–সাক্ষী করে দশ দফা অঙ্গীকার পত্র পাঠ করবে।
কী কী অঙ্গিকার? না, -কন্যাকে বিদ্যাশিক্ষা করাব। -একাদশ বছর পূর্ণ না’হলে কন্যার বিয়ে দেব না। -কুলীন, বংশজাত, শ্রোত্রিয় (বেদধ্যায়ী ব্রাহ্মণ) অথবা মৌলিক ইত্যাদি গণনা না করে স্বজাতীয় সৎপাত্রে কন্যা দান করব। – কন্যা বিধবা হলে এবং তার সম্মতি থাকলে আবার তার বিয়ে দেব। – আঠারো বছর পূর্ণ না হলে ছেলের বিয়ে দেব না। – এক স্ত্রী জীবিত থাকতে আর বিয়ে করব না। – যার এক স্ত্রী জীবিত, তাঁকে কন্যাদান করব না। – যেরূপ আচরণ করলে প্রতিজ্ঞাসিদ্ধির ব্যাঘাত ঘটতে পারে, তা করব না। – মাসে মাসে নিজ নিজ মাসিক আয়ের পঞ্চমাশত্তম অংশ নিয়োজিত ধনাধ্যক্ষের কাছে প্রেরণ করব। -এই পরিপ্রেক্ষিতে সই করে কোনও কারণে উপরে নির্দিষ্ট প্রতিজ্ঞা পালনে পরাঙ্মুখ হব না।
এত পরিশ্রম এত সাধনার পরেও তিনি সফল হতে না পেরে ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন । তবে তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন।
এমনই সময়ে কুমুদিনীর জন্যে বিয়ের পাত্রের খোঁজ নিয়ে আসল এক ঘটক। পাত্রের নাম অঘোরনাথ। ব্রাহ্মণ। চট্টোপাধ্যায় । চব্বিশ পরগনা জেলার রুদ্রপুর গ্রামে বাস। চাকুরী, সাব- রেজিস্ট্রার। পুরুলিয়া জেলায়।
ঈশ্বরচন্দ্র এই সম্বন্ধে রাজী হলেন। যথা সময়ে কুমুদিনীর বিয়ে দিয়ে দিলেন। হেমলতার মতো ধূমধাম না করে হলেও সামাজিক ভাবে যতখানি যা করবার, কন্যার পিতা হিসেবে তাই করলেন।
সাংসারিক দায়িত্বের দিক থেকে কিছুটা মুক্ত হলেন। তবে শরীর ভাঙছে দিনকে দিন। আহার ও নিদ্রা, দুই এখন সীমিত হয়ে গেছে।
এদিকে মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশনকে কলেজে উন্নীত করবার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। অনুমতি মিলছে না। কিছুটা বিরক্ত হয়েই কর্মাঁটাঁড়ে গিয়ে নিজের মনকে শান্তি দেবার কথা ভাবছেন। আর ঠিক তখনই ফের দুঃবাদ। গোপালচন্দ্র , মানে বড়জামাই গিয়েছিল কাশীতে। সেখানে ওলাওঠায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। ঠাকুরদাস খবর পাঠিয়েছেন।
এই ঘটনার জন্য ঈশ্বরচন্দ্র নিজেকেই দায়ী করলেন মনে মনে, কারণ বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে নিজে ব্যস্ত থাকায় বড় মেয়ে আর জামাইকে পাঠিয়েছিলেন তাঁকে সেবাযত্নের জন্য। আর সেখানেই বড়ো জামাইয়ের এমন করুণ পরিণতি !
এক ঝড় সামলে উঠতে না উঠতে আর এক ঝড় ঈশ্বরচন্দ্রকে মাথা তুলতে দিতে চাইছে না।
আদরের জ্যেষ্ঠ কন্যার মাথার সিঁদুর চিরতরে মুছে গেল। বৈধব্য জীবনের সাথী হল। কোন পিতার পক্ষে এ বিষয় সহজে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়? বিধবা হয়ে হেমলতার কঠোর জীবনের কথা মনে করে ঈশ্বরচন্দ্রেরও আহারে নিদ্রায় কোনও সুখ নেই। রাত্রিতে আহারের সময় মেয়ে উপবাসে থাকছে, এই চিন্তা করে তাঁর ক্ষুধা তৃষ্ণা আপনা আপনি লোপ পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এভাবে চললে যে তাঁর নিজেরও আয়ু শিগগীর নিঃশেষ হয়ে যাবে, তা তিনি ভালোমতো বুঝতে পারলেন।
তাই এবার মানসিক শান্তির থেকে বেশি নিজের বাঁচার তাগিদে প্রকৃতই কর্মাটাঁড়ে গিয়ে উঠলেন।
(৩২)
কর্মাটাঁড়ে পৌছিয়ে বিলিতি মেমকে বাকি টাকাটা দিয়ে পুরো বাড়ির দখল নিলেন। মেম এ দেশ ছেড়ে চলে গেল। ঈশ্বরচন্দ্র বাড়ি মেরামতিতে লাগলেন। অভিরাম মণ্ডল এসে যোগ দিল ঈশ্বরচন্দ্রের কাজে। বরাবরের জন্যে সে এসে উঠল নতুন বাড়িতে। মাস খানেক একটানা কাজ করিয়ে পুরনো বাড়ি সংস্কার করে স্থায়ী বাসের উপযুক্ত করে নতুন বাড়ি বানিয়ে নিলেন। গেটের মাথার উপরে চুন সুরকী দিয়ে বড় বড় অক্ষরে নাম বাড়ির নাম লেখালেন, নন্দনকানন।
নন্দনকাননই বটে। বিশাল তিন একরের ওপর জায়গা নিয়ে বাড়ির চৌহদ্দি। বসতবাড়িটা জমির একধারে। সামনে পাশে করে অফুরন্ত খালি জায়গা। জমির একধারে একটা ফলনযুক্ত আম গাছ। পুরো জমিকে কাজে লাগাবার জন্যে সাফসাফাইয়ের কাজে হাত দিলেন।
অদূরেই সাঁওতালদের গ্রাম। অভিরামকে বললেন, কিছু কুলি কামিন যোগার করে আনতে।
অভিরাম সেরকম কিছু মেয়েকে ধরে নিয়ে এলো। মেয়েরাই কামিনের কাজ করে। সাঁওতাল পুরুষরা কুলির কাজের থেকে বেশি পছন্দ করে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে পাখী, বন্য খরগোশ, সাপ শিকার করতে। দিন শেষে তা ঘরে এনে পুড়িয়ে পরিবার শুদ্ধু সকলে মিলে হাঁড়িয়া সহযোগে খায়।
অভিরাম তাদের ঈশ্বরচন্দ্রের সামনে এনে দাঁড় করালো। তিনি প্রশ্ন করলেন, দিন মজুরী কত পাস?
উত্তর এলো, এক আনা। ওদের মধ্যে একজন মেয়েই ছিল যে কিনা বাংলা কথা বুঝতে পারে। কিছুটা বলতেও পারে। সে-ই উত্তর দিয়েছে। ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, মাত্র এক আনা? সারাদিন কাজ করে এক আনা পাস? আমি তোদের দু আনা করে রোজ দোবো। কাজ কর।
সকলে হেসে উঠল। তারা জানে এই বাবু মিথ্যে বলছে। বলল, বাবু, তুই ঝুটো বইলিছিস কেনে?
-আমি ঝুটো বলি না।
ঈশ্বরচন্দ্র জোর দিয়ে কথাটা বললেন। তাতেও তাদের বিশ্বাস হল না। শেষে মেয়েটিকে কাছে ডেকে বোঝালেন, দ্যাখ, এখানে আমি শহর থেকে এসেছি। তোদের সঙ্গে থাকব। শহরে এত কম পয়সায় কেউ সারাদিন কাজ করে না। তোদেরকে ঠকিয়ে কাজ করাতে চাই না। তুই বরং সকলকে বুঝিয়ে বল, বাবু দু আনাই দেবে।
মেয়েটি নিজেদের ভাষায় সকলকে বুঝিয়ে দিতে তারা হৈ হৈ করে কাজে নেমে পড়ল।
জঙ্গল সাফ করা চলছে। অর্ধেক দিনের কাজের পরেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। বৃষ্টির মধ্যে তারা কাজ চালিয়ে যেতে থাকল। না হলে জানে, পুরো দিনমজুরী পাবে না। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কাজ। গা মাথা ভিজছে। ঈশ্বরচন্দ্রের মনে দয়া হল। ভাবলেন এভাবে বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বরজারিতে পড়ে যেতে পারে।
কাজ ছেড়ে তিনি তাদের বাড়ির ভিতরে এসে আশ্রয় নেবার কথা বললেন। অথচ কেউ আসে না।
তিনি তাদেরকে আবার অনুরোধ করলেন। একজন বলে উঠল, পুরা কাজ না করলে, পুরা রোজ দিবি কি তুই? রোজ না প্যেলে আমরা আজ খাব কী?
চলবে…