উপন্যাস ।। আবার এসো ফিরে।। রামেশ্বর দত্ত

১৮৫৬ সাল ২৬ শে জুলাই। হিন্দু বিধবাদের ভালে নতুন করে সিঁদুর ওঠার ব্যবস্থা পাকা হল। জয়ল্লোসাসে ফেটে পড়ল হিন্দু সমাজের নারীকুল। আর কুচুটে স্বার্থান্বেষী পুরুষদের বুকে জ্বালা  ধরল। নারীদের বিজয় মিছিল বেরল। উদারমনা আইনের স্বপক্ষে থাকা পুরুষরাও তাতে যোগ দিল। সকলে মিলে ঈশ্বরচন্দ্রের গলায় রজনীগন্ধার মালা পরিয়ে মাথায় করে নিয়ে নাচতে নাচতে চলল কলিকাতার রাজপথ ধরে। এই সেই ছাব্বিশ তারিখ। ২৬ শে সেপ্টম্বর ১৮২০ ঈশ্বরচন্দ্রের জন্ম। আর তার ঠিক দুমাস বাদ রেখে ছত্রিশ বছর পর ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর অমর কীর্তি সাধন করলেন। উঠে পড়ে লাগলেন, বিলকে কাজে পরিণত করে এক বিধবাবিবাহ সম্পন্ন করবেন।

এরপর… 

খোঁজ খোঁজ, বিধবা পাত্রীর খোঁজ শুরু করে দিলেন তিনি।  তিন মাসের মাথায় পাওয়া গেল এক বিধবা মেয়ের মা লক্ষ্মীমণি দেবীকে। মেয়ের বাবা ব্রহ্মানন্দ মুখোপাধ্যায়। তিনি গত হয়েছেন। মেয়ের মা-ই অভিভাবক। মেয়ের নাম কালীমতি। কালীমতির বয়স তখন বারো বছর। নিবাস বর্ধমান জেলা, গ্রাম পটলডাঙা । মাত্র চার বছর বয়সে কালীমতির বিয়ে হয়েছিল নবদ্বীপের হরমোহন ভট্টাচার্যের সঙ্গে। বিয়ের দু বছরের মাথায় স্বামী মারা গেছে, মেয়ের কপালে নাকি এই বৈধব্যযোগ ছিল, তা আর খণ্ডাবে কে? মেয়ের মা কিন্তু তা মনতে রাজী নয়। দশ বছরের মেয়ের বাকি জীবনের বৈধব্যের পরিণতি কী করুণ হবে, তা উপলব্ধি করে মা এসে ধরলেন ঈশ্বরচন্দ্রকে। ঈশ্বরচন্দ্র যেন হাতে মোয়া পেলেন।

শুরু হল পাত্রের খোঁজ। হোক না সে দোজবরে, তবু যেন তার ঘাটে যাবার পথ অনেকদূরের হয়। দশ বছরের বিধবাকে পুনর্বিবাহ দেবার জন্যে ঈশ্বরচন্দ্র এবার পাত্র খুঁজতে বেরলেন। মনে পড়ল এক সদ্বংশীয় ছেলের কথা। নাম,   শ্রীশচন্দ্র ভট্টাচার্য । সংস্কৃত কলেজ থেকে পাশ দেওয়া।  বিদ্যারত্ন উপাধিধারী। ওই কলেজেই কাজ করে।  ঈশ্বরচন্দ্র তাকে চিনতেন। তাছাড়াও শ্রীশচন্দ্র ইতিপূর্বে গভর্নমেন্টের সভায় পেশ করা বিধবাবিবাহের আবেদনে সাক্ষর দিয়েছিল। তার বাবাও বিখ্যাত মানুষ। রামধন তর্কবাগীশ।

একদিন শ্রীশচন্দ্রকে ডেকে পাঠালেন নিজের অফিসে। ঈশ্বরচন্দ্র তখন আবার দক্ষিণবঙ্গের স্পেশাল স্কুল ইন্সপেক্টর হয়ে অতিরিক্ত কাজের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। এমন গণ্যমান্য ব্যক্তি তাকে ডাকছেন। শ্রীশচন্দ্র দেরী করল না। তাড়াতাড়ি অধ্যক্ষের ঘরে গিয়ে অনুমতি নিয়ে ভিতরে ঢুকল। অধ্যক্ষ বসতে বললেন তাকে। একথা, সেকথা চলতে চলতে ঈশ্বরচন্দ্র আসল কথা পাড়লেন। বললেন, শ্রীশ, তোর তো বিয়ের বয়স হল। বাবা কিছু বলছেন না?

আমতা আমতা করতে থাকল শ্রীশ।

-আহা, খুলেই বল না। বিয়ের ইচ্ছে আছে?

  ঈশ্বরচন্দ্র উদগ্রীব হয়ে উত্তরের অপেক্ষায় । শ্রীশ ঘাড় নিচু করে মুখ বুঁজে বসে। অধ্যক্ষের গুরুগম্ভীর চালে বললেন, তুই তো বিধবাবিবাহের পক্ষে আমার সঙ্গে ছিলি। একটি বিধবা বালিকা রয়েছে। মেয়েটিকে আমি দেখেছি। বেশ সুলক্ষণা। সুশ্রীও বটে। তবে পিতৃহীনা। কন্যাটি আমার হাতে রয়েছে, যদি বলিস তো আমি মেয়ের মাকে তোর বাবার কাছে পাঠাই। প্রয়োজনে আমিও সঙ্গে যেতে পারি। কী বল?

-এবিষয়ে আমি আর কী বলব? আপনি গুরুজন ব্যক্তি। ভাল বুঝলে অবশ্যই আমি বিয়ে করতে রাজী আছি। বাবার সঙ্গে আপনি কথা বলতে পারেন।

পাত্রের সম্মতি পেয়ে ঈশ্বরচন্দ্র আর দেরী করলেন না। পরের দিনই কন্যামাতাকে সঙ্গে নিয়ে রামধন তর্কবাগীশ মশায়ের বাড়িতে চলে গেলেন। নামী মানুষ রামধন তর্কবাগীশ। তিনিও ঈশ্বরচন্দ্রের গুণগ্রাহী। ছেলের ইচ্ছে আছে জেনে তিনি এ বিয়েতে এক কথায় রাজী হয়ে গেলেন। ব্যাস। শুরু হয়ে গেল বিয়ের  প্রস্তুতি।

স্থির হল বিয়ে হবে কলিকাতায়। বাবু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে। বাড়ি মধ্য কলিকাতার সুকিয়া স্ট্রীটে। সেখানেই লক্ষ্মীমণি দেবী  কালীমতিকে নিয়ে এসে উঠলেন। বর এসে উঠল কাছের রামগোপাল মশায়ের বাড়িতে। বিশাল করে বিবাহ অনুষ্ঠান হচ্ছে। আট’শ জনকে নিমন্ত্রণ পত্র দেওয়া হয়েছে।  অনুরোধ, বিশেষ বিবাহ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বর কনেকে আশীর্বাদ জানিয়ে রাতের খাওয়া সেরে যাবার । নিমন্ত্রিতদের মধ্যে কলিকাতার হেন বিশিষ্ট ব্যক্তি নেই যিনি কিনা আমন্ত্রিত না হয়েছেন।

বিয়ের দিন, ২৩শে অগ্রহায়ণ। রবিবার। কলিকাতায় কাজের ছুটির দিন হলেও সুকিয়া স্ট্রীটের পথ লোকে লোকারণ্য। অতিথি আসার বিরাম নেই। কেউ আসছে পাল্কি চেপে। কেউ ঘোড়া গাড়িতে। কেউ জুড়ি গাড়ি হাঁকিয়ে। পায়ে হেঁটেও কারোও কারোও আগমন ঘটছে। সাজ পোশাকের বাহার দেখবার মতো। পুরুষেরা যেমন তেমন, অবশ্য বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি ছাড়া, যাঁদের সাজের আলাদা বৈচিত্র। গায়ে চোগা চাপকান, মাথায় পাগড়ি, গলায় মোটা সোনার চেন, দশ আঙুলে দশ আংটি। হীরে জহরত বসানো।  তাঁদের সঙ্গের মহিলারা আরও এক কাঠি ওপরে। জড়ি বসানো ঝলমলে শাড়ি। গা ভর্তি গয়না। মাথায় টিকলি।

  এ তো গেল বৈভবশালীদের সাজ। সাধারণ মহিলারাও আজ যে যতটা পেরেছে সেজে এসেছে। এমন বিয়ে আগে কেউ দেখেনি। বিধবা বিয়ে! না জানি, কেমন হবে? তবে মহিলারা অনেকেই কন্যাপক্ষের সমর্থনে। তাঁরা সেই ভাগ্যবতীকে দেখবে যে কিনা নিজে বিধবা হয়ে এক আনকোরা পুরুষকে বিয়ে করতে যাচ্ছে।

এটাই ঈশ্বরচন্দ্র আশা করেছিলেন। ভিড় সামলানো এবং কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে তার জন্যে আগাম সর্তকতা নিয়েছেন তিনি। স্থানীয় থানায় এত্তেলা দিয়ে পুলিশ মোতায়েন করিয়েছেন। বাড়ির কাছাকাছি। বিবাহ আসরের সামনে।

লগ্ন অনুসারে বিয়ে বসবে রাত ৯টা ২২মিঃ এর পর। অতিথি অভ্যাগতরা সমানে আসছেন। বিবাহ আসরে ভিড় বাড়ছে। তাদের আপ্যায়ন করছেন সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপকের দল। ঈশ্বরচন্দ্র তাঁদের এই কাজে যুক্ত করেছেন। তা না হলে, একলা তিনি আর কতদিক সামলাবেন? বিশেষ কোনও অতিথি এলে তিনি ছুটে আসছেন। এই যেমন দেবেন্দ্রনাথের সময় করলেন। ছিলেন বাড়ির ভিতরে। রসুই তলায়।

বাড়ি লাগোয়া  মাঠ ঘিরে রসুই ঘর। ভিতরের উঠোনে লোক খাওয়ানোর জায়গা। প্রশস্ত উঠোন। একসঙ্গে একশ জন মানুষ বসে খেতে পারে। আটশ নিমত্রিতের জন্যে  ন জন বামুন মিলে রান্না করছে। লুচি, শাকভাজা, বেগুনভাজা, আলু পটল কুমড়োর ছক্কা, মাছের মাথা দিয়ে মুগডাল, ঘরে কাটানো দুধের ছানার ডালনা, রুই মাছের কালিয়া, পাঁঠার মাংস, মিষ্টি দই, ঘরে ভিয়েন বসিয়ে বানানো দরবেশ আর লেডিগেনি। সবই হচ্ছে, তাঁর কথা অনুসারে, নিজের আর্থিক অনুকুল্যে। এমন এলাহি ব্যাপার দেখে বিয়ে যে তাঁর নিজের মেয়ের নয়, তা বোঝবার উপায় নেই। বিধবা কালীমতিকে তিনি নিজের মেয়ে করেই নিয়েছেন। তাছাড়াও, বিধবাবিবাহ আইন পাস হওয়ার পর এই প্রথম বিবাহ। অন্তর দিয়ে নিজের সাফল্যের উদযাপন করছেন। সমাজের সামনে এক দৃষ্ঠান্ত রাখাবার প্রয়াস তাঁর।  কদিন ধরেই তার ব্যস্ততার সীমা ছিল না। আর আজ তো তা চূড়ান্ত পর্যায়ে। ছোটাছুটি হাঁকডাক করে চলেছেন সকাল থেকে।  আদেশ উপদেশ দিয়ে কাজ তুলছেন।

বরানুগম হবে। বর বরণের জন্যে নির্দিষ্ট মহিলারা প্রস্তুত। তাদের মধ্যে কালীমতির মা, লক্ষ্মীমণি দেবী অনুপস্থিত। আজ তাঁর সুখের দিন হলেও নিজে বিধবা। মেয়ের বিয়ে দেখতে সামনে আসতে পারছে না। ঈশ্বরচন্দ্র তাঁকে অনেক করে বোঝাবার পরেও  আসেনি। মেয়ের অমঙ্গল হবে। যুগ যুগের কুসংস্কারের কাছে হার মেনেছেন ঈশ্বরচন্দ্র। তাকে বলেছিলেন, আপনার মেয়েও তো বিধবা। কৈ তাকে তো ভাগ্য ছেড়ে গেল না? তাহলে, আপনি কেন মেয়ের অমঙ্গলের চিন্তায় নিজেকে দূরে রাখছেন?

তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, আপনি পণ্ডিতমানুষ। সবই বুঝবেন।

-লক্ষ্মীমণি দেবী। বুঝছি বলেই না, এই কাজ এত এলাহি করে করছি। সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করবার চেষ্টা করছি। এতে আপনাদেরও এগিয়ে আসা দরকার।

-একদিন আপনার এ প্রচেষ্টা সফল হবে। সেদিন আমাদের মতো নিরক্ষর মহিলারাও এগিয়ে আসবে দেখবেন। তবে আজকের মতো আমায় মাফ করে দিন।

ঈশ্বরচন্দ্র থেমে গিয়েছেন। এর পর আর কী বা করবার থাকে? নিরক্ষর, শব্দটা  কথায় প্রয়োগ করে লক্ষ্মীমণি দেবী তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন,  নারীশিক্ষায় তাঁর কাজ এখনও বাকি। তিনি সরে গিয়েছিলেন। ঘটনাটা সকালে ঘটে গেছে। আর এখন সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত গড়াচ্ছে। মহিলা এখনও ঘরের মধ্যে বসে রয়েছে। একলা। বাইরে আসছে না। এক মনে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা জানিয়ে চলেছে, ভালোয় ভালোয় অনুষ্ঠান শেষ হোক। কালীমতি নতুন জীবন পাক।

বাইরে বরানুগমন ঘটছে। ব্যান্ডপার্টির শব্দ। ব্যান্ড বাজাচ্ছে বড়বাজারের নসিম মিয়াঁর দল। সাদা প্যান্টুলুন কুর্তায় মাথায় পাগড়ি দেওয়া একদল মানুষ। হাতে কাঁধে মুখে নানান বাদ্য যন্ত্র। সুর তুলছে তাতে। বরের পাল্কির আগে তাদের অবস্থান। সঙ্গে রয়েছে বরযত্রীর দল। কাচ্ছা বাচ্ছা, বয়স্ক, বুড়ো। ঝকঝকে তকতকে পোশাক। সাদা রঙিন, ঝলমলে। প্যান্টুলুন পরা ছেলে ছোকরাদের অনেকে বাজনার তালে নাচছে। পাশে চলছে বাতি মাথায় কিছু দিন মজুর। রেড়ির তেলের আলোয় রাস্তা আলোয় আলোময়। পথের পাশে মানুষ দল বেঁধে দাঁড়িয়ে। ভিড় জমেছে। হৈ চৈ। বর দেখার জন্যে হামলে পড়ছে লোক। বড় রাস্তা পেরিয়ে পাল্কি সুকিয়া স্ট্রীটের ভিতরে ঢুকবে। কিন্তু এতই ঢল নেমেছে মানুষের পাল্কিওয়ালারা আর এগোতে পারছে না।  হঠাৎ দেখা গেল, কিছু মানুষ পাল্কি আটকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। এ বিয়ে হতে দেবে না। বিধবা বিয়ে মানে না তারা। বরযাত্রী সহ পাল্কি মাঝ রাস্তায় থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। উত্তেজিতদের মধ্যে দুচার জন বিশিষ্ঠ ব্যক্তিত্বর মুখ দেখা যাচ্ছে।

সঙ্গে সঙ্গে অন্যদিক থেকে অন্য দল দাঁড়িয়ে পড়ল। চ্যালেঞ্জ , এ বিয়ে হবেই। কেউ আটকাতে পারবে না।

বচসা লেগে গেল দুই দলে। হাতাহাতি হবার জোগাড় হচ্ছে। ঈশ্বরচন্দ্রের কানে খবর পৌছল। প্রথমে কিছুটা থমকে গেলেন। পরে হনহনিয়ে চললেন। অতিথি অভ্যাগতদের মধ্যেও চাউর হয়ে গেল, বরকে আটকে রেখেছে। রামগোপাল, হরচন্দ্র, শম্ভুনাথের মতো অনেকে ঈশ্বরচন্দ্রের পিছু নিলেন।  ভিড় কেটে পথ করে সকলে সোজা গিয়ে উপস্থিত হলেন বরের পাল্কির সামনে। ভিড় জমছে দেখে পাহারাদার সিপাইরাও  ছুটে এলো। তাদের হাতে লাঠি।

বর ভয় পেয়ে গেছে। পাল্কির ভিতর থেকে হাত বাড়িয়ে একজনকে সামনে ডাকল। দুজন মানুষ ছুটে চলে গেল সেদিকে। ঈশ্বরচন্দ্র গিয়ে দাঁড়ালেন প্রতিবাদীদের মধ্যে। তাদের উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন রাখলেন, বর, বরযাত্রীদের কেন আটকানো হচ্ছে?

-বরযাত্রীদের নিয়ে যান। বরকে আমরা ছাড়ব না। এ বিয়ে হতে দেব না।

বিশিষ্ট ভদ্র গোছের একজন কথা বলছেন। ঈশ্বরচন্দ্র বুঝলেন, ইনিই হচ্ছেন হোতা। তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, কেন? কেন এ বিয়ে হতে দেওয়া হবে না?

-এখানে বিধবা মেয়ের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

-হ্যাঁ। তাতে কী? ছেলে স্বেচ্ছায় এ বিয়েতে মত দিয়েছে। কোনও অপরাধ সে করেনি। অযথা গোলমাল করছেন আপনারা। পথ ছাড়ুন। বিয়ের লগ্ন পেরিয়ে যাচ্ছে।

  অন্যরাও ঈশ্বরচন্দ্রের সুরে সুর মেলালেন। অপর দিক থেকে জবাব এলো, আপনিই তো মশাই এসবের হোতা। বিধবা মেয়েদের ধরে ধরে বিয়ে দিচ্ছেন। অন্যায় করছেন। সমাজ এ বিয়ে মানে না।

-ঠিক বলেছেন। একদিন তা মানত না। কিন্তু আজ দেশে আইন হয়েছে। বিধবা বিবাহ আইন। জানেন নিশ্চয়ই।

-আইন  কী সমাজকে পাল্টাতে পারে?

-অবশ্যই পারে। যা হচ্ছে, তা আইন মেনে হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে আপনার যদি কিছু বলবার থাকে, তাহলে থানা পুলিশ কোর্ট কাছারিতে যান। আমি বুঝে নোবো। এখন বাধা দিলে আমি বাধ্য হব পুলিশ সিপাইকে অনুরোধ করতে , তারা এতে হস্তক্ষেপ করুক।

ঈশ্বরচন্দ্র সামনের সিপাইদলের দিকে তাকালেন।  লাঠি উঁচিয়ে এগিয়ে এল তারা। গোড়া সিপাই। দুজন শুধু দেশি। প্রত্যেকের দশাসই চেহারা। বিরাট মোচ। লালচে রঙের। গায়ে সাদা উর্দি। মাথায় হ্যাট। দেবদূতের আদল হলেও চোখের তারায় যমদূতের আগুন। এতক্ষণ যারা পাল্কি আটকে দাঁড়িয়েছিল, ভয়ে এক পা দু পা করে সব সরে গেল। পুলিশ পাহারায় বরের পাল্কি সহ বরযাত্রীর দল বিবাহ আসরে এসে ঢুকল।

বরবরণের পালা এবার। সালঙ্কারা, সুবেশিনী, সুন্দরী মহিলারা তা সারল। বরকে নিয়ে বসানো হল ফরাস পাতা ঘরে। বাইরে লোকের জমায়েত। তারা প্রতিবাদী নয়। বর কনে দেখবার জন্যে ভিড় করেছে।

যথাসময়ে বিয়ের কাজ শুরু হল। বৃদ্ধ পণ্ডিত বিয়ে দিচ্ছেন। কন্যা সম্প্রদান করছেন ঈশ্বরচন্দ্র নিজে । তাদেরকে ঘিরে প্রায় একশ লোক। বিয়ের কাজে যেন কোনও বাধা বিঘ্ন না আসে।

শাস্ত্রমতে অনুষ্ঠান। দীর্ঘ সময় পার করে  হোম যজ্ঞ করে বিয়ের কাজ শেষ হল। বরযাত্রীদের খাওয়াদাওয়া করিয়ে বিদায় জানানো হল। সঙ্গে অতিথি অভ্যাগতরাও পাত পেড়ে খেলেন। তখন অনেক রাত । এরপর সকলে ফিরে চললেন।  ফিটন, ঘোড়ার গাড়ি, পালকি যে যাতে করে এসেছিল তাতেই ফিরে গেল । বাড়ির লোকজন যখন খাওয়া শেষ করে উঠছে, ভোরের প্রথম কাক, কা…কা শব্দে জানান দিল, নতুন আর একটা দিন শুরু হতে যাচ্ছে। হয়ত বা, নতুন আর এক যুগেরও তা শুরুর দিন।

পরের দিনই ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে খবর এলো, পানীহাটিতে আর একটা বিধবা বিবাহ সম্পন্ন হতে চলেছে। পাত্র কুলীন ঘোষ। মধুসূদন ঘোষের সঙ্গে কলিকাতার বাবু ঈশানচন্দ্রের বারো বছরের বিধবা মেয়ের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। খবরটা শুনে  ঈশ্বরচন্দ্রের মনে আনন্দ ধরে না। ইচ্ছে, তখনই পানীহাটি পৌঁছিয়ে বর-কনেকে আশীর্বাদ করে আসেন। বিয়ের খরচাটাও বরের হাতে তুলে দিয়ে আসেন।

এখন তো ঈশ্বরচন্দ্র ঠিকই করেছেন, যেখানেই বিধবার বিয়ে হবে, সে চেনা, অচেনা, আত্মীয়, অনাত্মীয়, যেই হোক, আগের থেকে খবর পেলে সেখানে গিয়ে মেয়ের বাবাকে বিয়ের খরচ হাতে তুলে দিয়ে আসবেন। কথাটা প্রকাশ করলেন গিরিশচন্দ্রের সামনে।

গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক। ঈশ্বরচন্দ্রের বন্ধুজন। কথা হচ্ছিল, ঈশ্বরচন্দ্রের বাড়িতে বসে। মেছুয়াবাজারের ভাড়া বাড়ি। সেখানেই গিরিশচন্দ্র এসেছেন বন্ধুর সঙ্গে কলেজের বিষয়ে কিছু কথা সারতে।

গিরিশচন্দ্র বললেন,  তুমি কি জানো ঈশ্বর, তোমার কত শত্রু জন্মেছে?

-এ যে হবে, তা জানা কথা, গিরীশ। তার নমুনা তো গতমাসে হাতে নাতে পেয়েছিলাম। তাতেই না আমার বাবা দেশ থেকে শ্রীমন্ত সর্দার নামের এক লেঠেলকে আমার সর্বসময়ের সুরক্ষার জন্যে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কেন, এ বাড়িতে ঢোকার মুখে দেখনি সেই পালোয়ানকে?

হাসতে হাসতে কথাটা বলে গেলেন ঈশ্বরচন্দ্র।

-ও হরি। তাই বলো। লোকটা আমার নাড়ির খবর নিয়ে তবে বাড়িতে ঢুকতে দিল। আমি ভাবলাম, কে না কে? তা ভালো। তবে কী নমুনার কথা বললে, তা শুনি একবার।

বন্ধুর ঘটনাটা শোনার উৎসাহ দেখে ঈশ্বরচন্দ্র বলতে শুরু করলেন, সেদিন কাজ সেরে ফিরছি। তখন আমি রাস্তায়। আর জানোই তো কলেজ শেষে লাইব্রেরীতে অনেক দেরী পর্যন্ত পড়াশোনা করে তবে আমি বাড়ি ফিরি। সন্ধ্যের পর থেকেই গোলদীঘির আশপাশ কেমন নির্জন হয়ে পড়ে? তা সেই পথে দুটি লোক, মনে হল, আমাকে পিছন থেকে অনুসরণ করছে। আমি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে হনহনিয়ে হাঁটতে থাকলাম। তারাও জোরে হাঁটছে। এবার হল কী, একজন হঠাৎ আমার সামনে এসে তার হাতের লাঠি তুলে আমাকে মারবে । আমিও দমবার পাত্র নই। চোখ লাল করে রুখে দাঁড়ালাম । পিছনের লোকটাও আমার কাছে চলে এসেছিল। সে আমাকে আঘাত করতে আসল। কোনও রকমে নিজেকে বাঁচিয়ে দৌড়তে শুরু করলাম । আমি ছাড়িনি। চিৎকার করে লোক জড়ো করলাম। মেছুয়া বাজারের তিন-চার জন লোক ছুটে এল। মাথায় ফেজটুপি। পরণে লুঙ্গি। গায়ে আমারই মতো ফতুয়া পরে রয়েছে। মুসলমান। দিনের বেচাকেনা শেষ করে পয়সাকড়ির হিসেব নিকেশ করছিল লোকগুলো। অন্য দিনও আমি ওদের ওখানে দেখেছি। ওরাও মনে হয় আমাকে চিনতে পেরে কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, বাবু ক্যায়া হুয়া? ব্যাপারটা খুলে বললাম। তা শুনেই তিনজন দৌড়ে গেল ওই লোক দুটোকে ধরতে। ততক্ষণে তারা পগারপার। বাড়ি ফিরে এলাম। এই ঘটনার কথা যখন গ্রামের বাড়িতে লিখে জানালাম, বাবা দুদিন পরেই আমার পাহারাদার করে শ্রীমন্ত সরদারকে হাজির করে দিলেন।

কথা থামল। তিনি দুচোখ বুঁজলেন। কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল। মুখে কোনও কথা নেই। সামনে বসা গিরীশচন্দ্র তাঁকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন করলেন, কী হল, কিছু ভাবছ নাকি?

তিনি চোখ খুললেন। বললেন, কিছু পরিকল্পনা নিচ্ছি, গিরীশ;  তবে ভাবছি, কোনটা আগে, কোনটা পরে করব?

-কী পরিকল্পনা, সেটাই তো জানালে না।

-ভাবছি, বিধবাদের বিয়ের ব্যবস্থা তো হল। কিন্তু এই ছোট ছোট বয়সের মেয়েদের বিয়ে দিয়ে যে সংসার নামে গাড়িটার সঙ্গে জুতে দেওয়া হচ্ছে, এটা কতখানি ঠিক হচ্ছে? তা সে বিধবাই হোক, আর সধবা। এঁদের না দেওয়া হচ্ছে শিক্ষাদীক্ষা। না জানছে এঁরা বাইরের জগতটাকে। চোখ বন্ধ করে কি কলুর বলদের মতো এঁরা শুধু ঘুরেই চলবে সরাটা জীবন?

কথাগুলো কেটে কেটে বললেন । গিরীশ মনোযোগ দিয়ে সব শুনলেন।পরে বললেন, কী করতে চাও এখন?

-স্ত্রীশিক্ষা, স্ত্রীশিক্ষা…,

শব্দটা বার কয়েক উচ্চারণ করলেন তিনি। তারপরেই চট করে উঠে পড়লেন। বললেন, তুমি কি আমার সঙ্গে যাবে?

-কোথায়? প্রশ্ন করলেন গিরীশচন্দ্র।

-বিটন সাহেবের কাছে যাচ্ছি। যাবে?

-বিটন! মানে, জন ইলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বিটন!

গিরীশ্চন্দ্রের চোখ বিস্ফারিত হল। ভাবলেন, ঈশ্বরচন্দ্র এ কী বলছে? বিটন মানে, বেথুন সাহেব তো কবেই গত হয়েছেন! প্রশ্নটা রাখতে ঈশ্বরচন্দ্র রহস্যটা ব্যক্ত করলেন। বললেন, আমি এখন বেথুন সাহেবের সমাধিতে যাব। ফুল চড়াতে।

-হঠাৎ ?

-হঠাৎ নয় গিরীশ। ওনার মতো ইংরেজদের রোজই ফুলমালা পরানো উচিত। বাংলার মেয়েদের জন্যে কী মহৎ কাজ যে উনি করে দিয়ে গেছেন, তার মূল্যায়ন কি আমরা করতে পারছি?

তিনি কথা থামাতে গিরীশ বললেন, সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে প্রায় ছত্রিশ বছর আগের একজনকে ভুলে যাচ্ছ কেন?

-বুঝেছি, তুমি রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুরের কথা বলছ, আমি বুঝতে পারছি। হ্যাঁ, তিনি এ কাজে হাত লাগিয়েছিলেন। চল্লিশজন পরীক্ষা উত্তীর্ণ বালিকাকে পারিতোষিক দিয়েছিলেন। সেইসময় মহিলা শিক্ষাসমিতি নামে এক সমিতিও গড়ে উঠেছিল। তাদের উৎসাহে কলিকাতার বিভিন্ন জায়গায় কিছু বালিকা বিদ্যালয় গড়া হয়েছিল। কিন্তু আখেরে তার কী পরিণতি হয়েছিল, তাও তুমি জানো নিশ্চয়ই। অর্থাভাবে সেসব পাঠ চুকে গিয়েছিল মাত্র চার বছরেই। এরপর এতগুলো বছর কেটে গেছে, কৈ আর তো কেউ সচেষ্ট হয়নি ওই কাজে; যতক্ষণ পর্যন্ত না মিঃ বেথুন এদেশে এসে পা রেখেছেন? মাঝের এই প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ বছরে দেশের বালিকাদের কী হাল হয়েছে! বিশেষ করে সাধারণ, মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েদের। উনি উদ্যোগ না নিলে, আজকেও স্ত্রীশিক্ষা সেই অতল তিমিরেই পড়ে থাকত।

-সত্যিই, ভদ্রলোক দেশের বড়লাটের ব্যবস্থাসচিব হয়েও , বড়লাটের সমান মাইনে পেয়ে কী অমায়িক ছিলেন, তা বলবার কথা নয়।

গিরীশচন্দ্র কথা যোগ করলেন। তিনি থামতে ঈশ্বরচন্দ্র আবার বলা শুরু করলেন, ঊনপঞ্চাশ সালের সেই দিনটা যেদিন প্রথম বালিকা ইশকুল শুরু হল…,

ফের চোখ বুঁজলেন, যেন পুরনো দিনের ছবিটা দেখতে পাচ্ছেন। আনমনা হয়ে পড়লেন। বলতে থাকেলন, ক্লাস ছাত্রীহীন।  মদনমোহন এগিয়ে এল। তার দুই  শিশুকন্যা, ভুবনমালা আর কুন্দমালাকে হাত ধরে এনে দাঁড় করালো বেথুন সাহেবের সামনে। বলল, এই নিন। এদেরকে আপনার হাতে তুলে দিলাম। ইশকুলে ভর্তি করে নিন।

ওহ, বেথুন সাহেবের সে কী আনন্দ! চোখ দিয়ে তাঁর জল ঝরতে শুরু করল। বললেন, বাবু মদনমোহন, আ পনাকে আমি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। আপনার এই সাহসের জন্যে আমি জানি, আপনার সমাজের কাছে অনেক  কথা শুনতে হবে।…তবে জানবেন,  আজ থেকে আপনার দুইটি শিশু কন্যাকে আমি নিজের করে ভাবলাম। এই বলে মদনমোহনের দুই কন্যা, ভুবনমালা আর কুন্দমালাকে কোলে টেনে নিলেন। আর সেই যে টানলেন, জীবনের শেষ পর্যন্ত দুজনকে কাছের করেই রেখেছিলন। সন্তানের মতোই ভালবেসেছেন। দুজনকে কোলেপিঠে করে নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন।…

একদিন তো আমি গেছি মদনমোহনের বাড়ি। গিয়ে দেখি কি, বেথুনসাহেব দু হাঁটু মুড়ে, দুটো হাত মাটিতে রেখে ঘোড়া  সেজেছেন; আর ওই শিশুরা দুজন তাঁর পিঠে চড়ে হ্যাট হ্যাট শব্দ করে, ঘোড়ায় চড়ছে। দেখে আমি কেঁদে ফেলেছি। চোখের জল লুকিয়ে মুখে হাসির রেখা টেনেছিলাম সেদিন। পাছে, বেথুন সাহেবেরও আমাকে দেখে মন খারাপ হয়।…এত বড় মনের মানুষ, ইংরেজ সরকারের উচ্চপদস্থ আধিকারিক, খোদ বড়লাটের সঙ্গে কাজে যুক্ত;  অথচ নিজে বিয়ে থা করেননি। বিদেশে এসে দুই বিদেশীয় ভিন ধর্মের কন্যাকে নিজের মতো করে ভালবেসে, স্নেহ দিয়ে কী যে অসীম কীর্তির নিদর্শন রেখাছিলেন…,

ঈশ্বরচন্দ্রের চোখে জল ঝরতে শুরু করল।  হাতের তেলো দিয়ে চোখ আর গালের জল মুছে ফের বলা শুরু করলেন,  তা সেই মদনমোহনের দেখাদেখি পরে আরও অনেক ছোট বড় করে মেয়েরা এসে ভর্তি হল। এলো কাদম্বিনী, চন্দ্রমুখী, অবলা, সরলা, এরকম অনেক মেয়ে। তাদের বাবা কাকারও এগিয়ে এসেছিল সেদিন। দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় মহাশয় তাঁর বাড়ির নিচের ঘর দিলেন বেথুন সাহবকে।  সেখানে ইশকুল বসল। চলছিলও। দিনে দিনে ছাত্রী সংখ্যা বড়ছিল। জায়গার অভাব হতে লাগল। এবার বেথুন সাহেব নিজের খরচে  হেদুয়ার কাছে জায়গা নিয়ে বাড়ি তৈরী করালেন। ইশকুল চালাবার খরচ দিতে থাকলেন। বাড়ি থেকে মেয়েদের একলা ছাড়ছে না। তাদের আসা যাওয়ার জন্যে গাড়ির ব্যবস্থা করলেন। সব নিজের পয়সায়।… তবে হ্যাঁ, এটা অস্বীকার করলে চলবে না, সে সময় বেথুন সাহেবের পাশে কেউ কেউ এসে দাঁড়িয়েছিলেন। যেমন, ওই দক্ষিণারঞ্জন বাবু, মদনমোহন, শম্ভুনাথ পণ্ডিত, রামগোপাল ঘোষ…

-তুমি ছিলে না ঈশ্বরচন্দ্র?

কথার মাঝে গিরীশচন্দ্র প্রশ্ন করলেন। ঈশ্বরচন্দ্র উত্তর দিলেন, ছিলাম ভাই, তবে তখন নিজের অন্যান্য কাজের চাপে ততখানি সামনে দাঁড়িয়ে কাজ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। পরে অবশ্য আমি পুরোপুরি যুক্ত হই। কিন্তু ততদিনে বেথুন সাহেব ইহলোক ছেড়ে গেছেন। যদিবা ওনার ইচ্ছানুসারে ইশকুল এবং পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত বেথুন কলেজের সম্পাদকের পদ আমি গ্রহণ করেছিলাম।

-সত্যিই বড় অল্প বয়সে চলে গেলেন মানুষটা, তাই না?    গিরীশচন্দ্র বললেন।

-ঠিক। ওনার নিয়তি টেনেছিল সেদিন। না উনি সেদিন অত বৃষ্টির মাথায় নিয়ে পাঁচ ছ ক্রোশ হেঁটে জনাইয়ে স্কুল পরিদর্শনে যেতেন, না মারণ জ্বরে তাঁর প্রাণটা যেত। মাত্র পঞ্চাশ বছরে ইহলোক ছেড়ে চলে যেতে হল তাঁকে।

ঈশ্বরচন্দ্র দুঃখ করতে থাকলেন।

এরপর গল্প করবার মতো মন আর রইল না তাঁর। তিনি উঠে পড়লেন। গায়ের চাদরখানা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়লেন। কিছু আগে তিনি বন্ধুকেও যে তাঁর সঙ্গে যাবার আহ্বান করেছিলেন, তা ভুলে রাস্তা ধরে একলা হনহন করে হাঁটাছেন আর কথা বলছেন নিজের মনে, এদেশে নারীশিক্ষার প্রসার না হলে, মেয়েদের মুক্তি নেই… মুক্তি নেই; বাল্যবিবাহ, সতীদাহ, বহুবিবাহ, এসব এঁদের কপালে লেখাই থাকবে চিরকালের জন্যে। যুগ যুগ ধরে এঁরা পুরুষশাসিত সমাজে কুকুর বেড়ালের থেকেও নীচ ব্যবহার পেয়ে নিজেদের অস্তিত্বই ভুলতে বসেছে…,; শিক্ষা দিয়ে এঁদের মানুষের পর্যায়ে আনতে হবে…

ঈশ্বরচন্দ্রের গন্তব্য তখন কলিকাতার মধ্য ভাগে। মেছুয়া থেকে সোজা চলেছেন পার্ক সার্কাসের ক্রিমোটোরিয়ামে। সেখানেই জন ইলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বিটন চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন।

মাঝে এলো শিয়ালদহ বাজার।  অন্যদিনের মতো আজকেও একগুচ্ছ রজনীগন্ধা ফুল কিনলেন।  হাতে করে নিয়ে চললেন। সমাধিতে পুষ্পদান করে বেথুনকে শ্রদ্ধা জানাবেন।

(১৫)

ছোটলাট হ্যালিডের সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্রের ঘনঘন সাক্ষাৎ ঘটে। নানান কার্যকারণে। সেদিনও আবার তিনি ডেকে পাঠিয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্রকে। তাঁর নিজের দপ্তরে । তবে ঈশ্বরচন্দ্রের মন বলছে, সেদিনের সাক্ষাৎ হবে বিশেষ কারণে।

মনে উৎসাহ নিয়ে পাল্কি চেপে তিনি হ্যালিডে সাহেবের দপ্তরে পৌঁছলেন। বসবার আহ্বান হল। ঈশ্বরচন্দ্র উপবেশন করলেন। প্রথম এদিক সেদিকের কিছু কথা হল দুজনের। তারপরেই হ্যলিডে জানতে চাইলেন,  শুনছি, দেশে নারীশিক্ষা নিয়ে আপনি কাজ করছেন। তা যদি হয় তো খুব ভালো খবর। তাহলে কি আপনি বেথুন সাহেবের অসম্পূর্ণ কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যান?

 

ঈশ্বরচন্দ্র হাতে চাঁদ পেলেন। তিনি যা করছিলেন তা সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে। একলা কিভাবে এগোবেন, এই নিয়ে চিন্তা তাঁকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। পথ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। প্রয়োজন অর্থের। মনে যদিবা সাহসের কমতি নেই; কিন্তু অত অর্থ তিনি পাবেন কোথায়? এক তো বেশ কয়েকজন বিধবার বিবাহে খরচ জোগানোর  জন্যে ঋণগ্রস্ত হয়ে রয়েছেন। মাইনে যদিবা পাচ্ছেন পাঁচশ টাকা। তা দিয়ে কলিকাতায় নিজেদের খরচ খরচা, বাড়িতে পাঠানো, সন্তান ও স্ত্রীর জন্যে মাসে মাসে আলাদা করে বেশি টাকা মায়ের হাতে দেওয়া, এসবের পর যা থাকে, তাই দিয়ে বাইরের ধার মেটাচ্ছেন কিছু কিছু করে। এর ওপরে আবার যদি মেয়েদের স্কুল করতে তাঁকে ধার নিতে হয়, তো আখেরে তা শোধ করবেন কবে, কিভাবে? বই লিখে বই বিক্রির টাকা আসছে বলে না চলে যাচ্ছে। এই তো সেদিনই হিসেব কষে দেখছিলেন তার ঋণের পরিমাণ। তা প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সবটাই বিধবাদের বিবাহের জন্যে করা ঋণ। চিন্তা হবারই কথা। তাই উপযুক্ত সময়ে হ্যলিডে সাহেবের প্রস্তাবটা তাঁর কাছে দৈববাণীর মতো মনে হল।  উত্তর করলেন, নিজেই উদ্যোগ নিয়েছিলাম। চিন্তা ছিল। তবে এখন সরকারের সম্যক সাহায্য পেলে এ কাজ আমি অবশ্যই সুসম্পন্ন করতে পারব, মিঃ হ্যালিডে।

-ঠিক আছে। আপনি এগিয়ে চলুন। ইশকুল পরিদর্শকের কাজে আপনাকে বহাল করা হবে। অসুবিধা নেই তো?

-তাহলে তো খুব ভালো হয়। সরকারী তকমা নিয়ে কাজ করা যাবে। না, এতে আমার কোনও অসুবিধে নেই। কলেজের কাজ চালিয়েও আমি এই পদ গ্রহণে রাজী আছি।

-বেশ। সরকারী আদেশনামা বের করার ব্যবস্থা করছি।

পরে অন্যান্য আরও নানান বিষয়ে কথায় আলোচানা শেষের দিকে পোঁছাল। ঈশ্বরচন্দ্র মিঃ হ্যালিডেকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে গেলেন। পরিকল্পনা সাজালেন। কাজটা কী ভাবে করবেন। তাঁর দু একজন শুভ্যানুধ্যায়ীকে পরিকল্পনার কথা জানালেন। তাঁরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। কাজে নেমে পড়লেন।

জেলার সদর থেকে কাজ শুরু করছেন। প্রথম গেলেন বর্ধমান। অন্যান্য জেলা থেকে বর্ধমান বেশি বর্ধিষ্ণু অঞ্চল। চাষ আবাদ অনেক বেশি পরিমাণে হয়। সাধারণ লোকের অবস্থা কিছুটা উন্নত। তাদের ঘরের ছেলেরা চাষ আবাদের সঙ্গে সঙ্গে পড়াশোনাও করে। ইশকুল যায়। শহরে একটা ইংরেজি মাধ্যমের ইশকুলও রয়েছে। ধনী লোকেদের সন্তানরা সেখানে পড়ে। রাজবাড়ির ছেলেরাও পড়ে।

ঈশ্বরচন্দ্র সোজা গিয়ে দেখা করলেন বর্ধমান রাজার সঙ্গে। মহতাব চাঁদ রায়। মহারাজাধিরাজ। ব্রিটিশ গভরমেন্ট জেনারেল লর্ড ইউলিয়াম বেন্টিক দ্বারা উপাধিপ্রাপ্ত। রাজবাড়ির প্রশস্থ বাগিচায় বসে দুজনের আলাপ হল। ঈশ্বরচন্দ্র  প্রস্তাব রাখলেন, আপনার এই নগরে মেয়েদের জন্যে ইশকুল গড়ব। আপনার কী অভিমত?

-উত্তম প্রস্তাব। উত্তর দিলেন চাঁদ রায়। তাতে আমার কী করণীয় আছে, বিদ্যাসাগর মশাই?

-আপনি জায়গা দেবেন। সেখানে ইশকুল গড়া হবে। সরকার থেকেই তা গড়বে।

-আচ্ছা। সরকার বাহাদুরও তাহলে এদিকে নজর দিচ্ছে! এ তো খুব ভালো কথা। তবে…

-কিছু সংশয় করছেন কি আপনি?

-ভাবছি, গৃহস্থ ঘরের মেয়েরা বাইরে এসে পড়াশোনা করবে, অভিভাবক কি তা চাইবেন?

-আপনার সংশয় অমূলক নয়, মাহারাজা। তবে সেখানেই আপনার সাহায্য লাগবে। তাঁরা আপনার প্রজা। আপনি চাইলে, তাঁরা সবকিছুই করতে পারে। স্থানীয়ভাবে আপনি কাজটা করুন। অনেক সাহায্য হবে। হ্যাঁ। একদিনেই কিছু অধিক বালিকা পড়ুয়া আশা করা ঠিক হবে না। তবে নিরন্তর প্রচার চললে, একদিন এর উপকারিতা বালিকাদের অভিভাবকও বুঝবে। জানেন, তো এই করে কলিকাতা শহরে এক ইংরেজ ব্যক্তি, নাম শুনেছেন নিশ্চয়য়ই, বেথুন, পুরো নাম জন ইলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বিটন, মহান শিক্ষাবিদ, প্রথম বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করতে গিয়ে কত সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন। কিন্তু হাল ছাড়েননি। আমি নিজেও অবশ্য সেকাজে যুক্ত ছিলাম। তাই বলছি, আপনাদের মতো সমাজের মহান ব্যক্তিদের প্রত্যক্ষ সহায়তা পেলে বালিকা বিদ্যালয় খুলে বসে থাকতে হবে না।

-অবশ্যই। অবশ্যই। বুঝেছি, নারীশিক্ষা বিনা এ দেশের অগ্রগতি নেই।

-এটাই সার কথা, মহারাজা। আপনি তাহলে, স্থান নির্বাচন করে দিন। ইশকুশ গড়া শুরু হোক।

-স্থান ধরুন নির্বাচন হয়েই গেছে। কোথাও না হলে, আমার এস্টেটে এক বিঘে জায়গা দিয়ে দোবো। কটা ইশকুল গড়বেন?

-আপাতত পাঁচটা। পরিকল্পনা থাকবে আগামী বছরে তা বাড়িয়ে কুড়িটা করবার। অন্যান্য জেলাতে, যেমন হুগলী, মেদিনীপুর, নদীয়া, সর্বত্র মিলিয়ে পঞ্চাশটা ইশকুল গড়া হবে।

-সবটাই কি আপনার দায়িত্বে?

-তা একরকম বলতেই পারেন। এজন্যে সরকার বাহাদুরের ছোটলাটের বিশেষ উৎসাহ রয়েছে। তিনিই আমায় এ দায়িত্ব ন্যস্ত করেছেন।

-বাঃ। ভারী সুখবর দিলেন। উঠেছেন কোথায়?

-পথের ধারের এক সরাইখানায় আপাতত ঠাঁই গেড়েছি। পরে দেখি…

-আপনার আপত্তি না থাকলে, আমার অতিথিশালায় এসে থাকতে পারেন। যতদিন খুশি। মানে আপনার কাজ যতদিন না সম্পন্ন হচ্ছে।

-কোনই আপত্তি নেই। তবে এখন হুগলী হয়ে নদীয়ায় যাব। শেষে যাব মেদিনীপুর। পরিকল্পনা অনুযায়ী এখানে ফিরে আসতে সময় লাগবে। ততদিনে কাজটা না হয় লোক মারফৎ আপনাকেই এগিয়ে রাখবার অনুরোধ করছি।

-ঠিক আছে। আমি দেখছি। তবে এর পর বর্ধমানে এলে সোজা এখানে এসে উঠবেন। চিন্তা করবেন না, ইশকুল গড়া হবে।  এবার আপনার সঙ্গে আমিও কাজে নেবে পড়ব।

হাত মেলালেন দুজনে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদায় নিলেন। বর্ধমান থেকে যাচ্ছেন হুগলী জেলায়। এসব সবই সরকারী কাজে তিনি ঘোরাফেরা করছেন। হাতে সময় কম। তাই ঘোড়ার গাড়ি নিয়েই হুগলী জেলায় ঢুকলেন। এলেন শের শাহের তৈরি বিখ্যাত গ্র্যান্ড ট্র্যাঙ্ক রোড ধরে। অর্ধেক দিনের মধ্যে পৌঁছিয়ে গেলেন হুগলীর ফরাসডাঙ্গায়।

জেলার বর্ধিষ্ণু স্থান ফরাসডাঙ্গা। বৃটিশ ভারতের রাজধানী কলিকাতার প্রায় দোরগোড়ায় ফরাসীদের একমাত্র উপনিবেশ। কলিকাতা থেকে  হাঁটা পথে দূরত্ব মাইল একুশ ।  শহর হুগলী নদীর পশ্চিম পাড়ে।

সেখানে দেখা করলেন, ফরাসী অধিকর্তা, ফ্রাংক জোসেফের সঙ্গে। গভর্নর। সদরের হর্তাকর্তা। ফ্রান্সের রাজার অধীনে সরাসরি শাসন কাজ চালান। ধন দৌলত, শিল্পে উন্নত স্থান ফরাসডাঙ্গা। বস্ত্র, রেশম, ঝিনুক শিল্প। সেখানে ফরাসি শিক্ষার চল। ছেলেরা পড়াশোনা করে; কিন্তু মেয়েরা অন্ধকার যুগে পড়ে রয়েছে। ঈশ্বরচন্দ্র তা নিয়ে গভর্নরের সঙ্গে কথাবার্তা চালালেন। দুদিন ধরে। খুব একটা সুরাহা হল না। বর্ধমান মহারাজার মতো ফরাসী এই উচ্চ পদাধিকারী উৎসাহ দেখালেন না। অল্প কথায় আলাপ শেষ করলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বেরিয়ে এলেন সেখান থেকে।  তিনি বুঝেছেন, কারণটা আর কিছুই নয়। অধিকর্তা বিদেশ থেকে এখানে চাকরি করতে এসেছেন, বোঝেন নিজের দেশোয়ালিদের ভালোমন্দ। ওনাদের জাতের মহিলারা তো আর অশিক্ষিত নয়? তাই দেশীয় মহিলাদের জন্যে তাঁর অত গরজ নেই। ঈশ্বরচন্দ্র তাতে দমলেন না। ঘুরে ঘুরে শহরের কিছু বিদগ্ধ ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করলেন। বাঙালি। তাঁরা ঈশ্বরচন্দ্রকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। কাজ হাসিল হল। এক লপ্তে তিনটে জায়গা পেয়ে গেলেন ইশকুল বসাবার জন্যে। তৈরী বাড়ি। দুজন ব্যক্তি তাঁদের বসত বাড়ির নীচের অংশ ছেড়ে দিলেন। আর একজন নিজের বাগানবাড়িতে চালাঘর করে ইশকুল বানিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিলেন। তাতেই ঈশ্বরচন্দ্র খুশি। কাজ এগোচ্ছে। ঠিক রাস্তা ধরে।

এ জেলার বাকি জায়গা ব্রিটিশরাজের অধীন। উত্তরপাড়া, কোন্ননগর , শ্রীরামপুর, শেওড়াফুলি, চুঁচুড়া । সেখানে বর্ণ হিন্দুদের বাস। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাম তাঁদের অজানা নয়। তবু সেখানে মেয়েদের ইশকুলের কথায় বিশেষ সাড়া পাচ্ছেন না।  অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিও মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন। মেয়েদের পড়াবার কথায় বেঁকে বসছেন। ঈশ্বরচন্দ্রের তখন মনে পড়ল বেথুন সাহেবের কথা। মেয়েদের ইশকুল চালু করবার জন্যে প্রথমাবস্থায় তিনি কী করেছিলেন। মদনমোহনের দুই মেয়ে ভুবনমালা আর কুন্দমালাকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। নিজের করে। একই পথ ধরে তিনিও এগোলেন।

ঘটনার সূত্রপাত শ্রীরামপুর থেকে। শ্রীরামপুর মিশনারিদের জায়গা। সাধারণ গৃহস্থদের মাঝে তাদের অবস্থান।  গৃহস্থ বাড়িতে যাতায়াত অবাধ না হলেও লোক ইংরেজ পাদ্রীদের কথা শোনে। এক পাদ্রীর সঙ্গে ভাব জমালেন। তাঁকে নিয়ে একদিন এক গৃহস্থ বাড়িতে গেলেন।

চলবে…

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page