আবার এসো ফিরে

  বরযাত্রী আর বাজনা দেখে তিনি আনমনা হয়ে পড়েছেনমনে ভিড় করে এলো  ভাই, হরিশ্চন্দ্রের কথা। বীরসিংহ গ্রামে এরকমই কোনও এক  বিয়ের অনুষ্ঠনে বাজনা শুনে হরিশচন্দ্র বলেছিল, দাদা, আমার বিয়েতেও কিন্তু  বাজনা করতে হবে  ছেলের বয়স তখন মাত্র আট বছর। কিন্তু হায়! ভাইয়ের বিয়ে করবার শখ আর মিটল কৈ? তায় বিয়ের বাজনা! আট বছর বয়সে সে ইহলোক ছেড়ে চলে গেল। হরচন্দ্রের আগেই সে মারা গেছে। কলকাতার বাসায়। একই ওলাওঠার আক্রমণে।   

  ঈশ্বরচন্দ্রের মনে চিরকালের জন্যে ভাইয়ের কথার আঁচড় পড়ে রয়েছেসে কথা স্মরণ করে  তাঁর  চোখ জলে ভিজে উঠল। কোমল হৃদয় তাঁর খানিকটা কাঁদলেন। মন শান্ত হতে ফের তৈরী করে নিলেন নিজেকে। গোকুলকে ডেকে তুললেন। তার তন্দ্রা এসে গিয়েছিল। চোখ রগড়ে নিয়ে সে উঠে দাঁড়াল। পথ চলা শুরু হল আবার।   

তারপর… 

পায়ে পায়ে পথ কাটা চলছে। গোকুল ঈশ্বরচন্দ্রের পাশে রয়েছে। সে চুপ করে  হাঁটছে। ঈশ্বরচন্দ্রের মনে পুরনো দিনের অনেক কথা ভেসে উঠছিল। ইচ্ছে করছে সেসব কথা শোনাতে।  পথ চলার ক্লান্তি তাতে কিছুটা লাঘব হলেও হতে পারে। তাহলে এখন গোকুলেই কেন না তা শোনান? গল্পও হবে। সঙ্গে পথও চলা হবে। গোকুলের মনটাকে অন্য খাতে বইয়ে দেওয়া যাবে। মুখ ফিরিয়ে তার দিকে তাকালেন। অন্ধকারে মুখ নজরে এল না।  তবে বুঝলেন, ছেলেটার মুখ বেশ শুকিয়ে গেছে।  প্রশ্ন করলেন, খিদে পেয়েছে, গোকুল?  সে মাথা ঝাঁকাল। ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, চল, পথে কোনও আহারের আস্তানা পেলে রাতের খাবারটা খেয়ে নোব।

একটা বসতি অঞ্চল এলো। কিছু বাড়িঘর রয়েছে। মাটির কুঁড়েঘর। তাল পাতার ছাউনি। দালান কোঠাওয়ালা বাড়ি নেই বললেই চলে । গ্রামের পর গ্রাম একই ধরণের বাড়ি চোখে আসছে। রাতের অন্ধাকার গায়ে মেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেগুলো। একটার থেকে অন্যটার দূরত্ব অনেক। বাড়িতে টিম টিম করে  জ্বলা তেলের বাতির আলোর দেখা মিললেও, তা চলার পথের অন্ধকার দূর করতে সাহায্য করছিল না।

আধা ক্রোশ মতো পথ চলে আসার পরে নজরে এল একটা ছোট গুমটিঘর। সেখানেও ঘরের মাথা তালাপাতা দিয়ে ছাওয়া। পথের কান ঘেঁষে ঘরটা দাঁড়িয়ে আছে।  ঘরের ভিতর-বার করে দু চারজন মানুষ বসে রয়েছে।  রেড়ির তেলের কুপি জ্বলছে । একটা বাইরে। একটা গুমটিটার ভিতরে। কাছে পৌঁছতে ঈশ্বরচন্দ্র বুঝলেন, ওটাই খাবারের আস্তানা। সামনের উনুনটা নজরে এসেছিল। নিচু উনুন। মাটির তলায় পাতা। উনুনের তিনটে কানা জমির ওপর গজিয়ে আছে। ধিকি ধিকি আগুন জ্বলছে সেখানে ।  শুকনো ডালাপালার আগুন। উনুনের ওপরে একটা মাটির সরাই। রান্না চলছে। আগুনের আঁচ এতই নরম যে তার আলো সরাইকে ঠেলে ঠিকরে বাইরে আসতে পারছে না।

-খাবার পাওয়া যাবে, কত্তা?

সামনে এগিয়ে গিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র দোকানীকে জিজ্ঞেস করলেন।

-পাওয়া যাবে। কী খাবেন? ভাত পাবেননি। রুটি রইয়েছে? জাঁতায় পেষা জবের আটার রুটি। গরম। সদ্য বানানো হয়েছে।

-তরকারী কী আছে?

-সিদ্ধ ছোলা দিয়ে বানানো কুমড়োর ছক্কা। সঙ্গে মাস কলাইয়ের ডাল।

-মূল্য কত?

-দুজন খাবেন তো?

– হ্যাঁ।

-দুই দুই করে চার পয়সা লাগবে দুজনের। বসুন।

-আমার কাছে কোম্পানির পয়সা রয়েছে। বাঘমুখো। ভাঙানি হবে তো?

– হবে। কড়ি নিতে হবে, পণ্ডিতমশাই।

দোকানী বুড়োর নজর ততক্ষণে সাফ হয়ে গিয়ে ঈশ্বরচন্দ্রের মাথার পিছনে শিখাখানা নজরে এসেছিল।  তাতেই আগন্তুককে পণ্ডিত ঠাওর করে  নিয়েছে।

-দাদু, তাই দিন। কাকা ভাইপোয় রুটি তরকারী খেয়ে আবার পথ ধরি।

গোকুল বলল কথাটা।

দোকানের বাইরে মাটির ঘড়ায় জল রাখা ছিল। ঘটি করে তা তুলে হাত মুখ ধুল। ভিতরে ঢুকল। মাটিতে আসন পাতা ছিল। দুজনে সেখানে বসল। দোকানী শাল পাতায় খাবার সাজিয়ে এনে ভূঁয়েতে নামিয়ে রাখল। খাওয়া শুরু হল। শুরুতে ঈশ্বরচন্দ্র আচমন সারলেন। গোকুলের অবশ্য সেসবের বালাই নেই। সে কুলীন বামুন নয়।

খাওয়া চলছে। আস্তানার বাইরে বসে থাকা একজনের প্রশ্ন ধেয়ে এল, পণ্ডিতমশাই কী তীর্থপথে?

মুখে রুটির গ্রাস নিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র উত্তর করলেন, অম্বিকা-কালনা যাব। তা মশায়, আপনার আন্দাজ তো ভারি খাসা! বুঝলেন কেমন করে ?

-অনেকেই তো এই পথ ধরে কালনা কাটোয়া হয়ে নবদ্বীপে চৈতন্যপ্রভুর ধামে যায় কি না? তাই ভাবলাম, বাপ ব্যাটায় সেদিকেই চলেছেন।

ঈশ্বরচন্দ্র একটু হাসলেন। বাপ ব্যাটা? মানুষটার ভ্রান্ত ধারণাকে দূর করবার প্রয়াস নিয়েও চুপ করে  গেলেন। পরে বললেন, তা মশায়, আপনাদের এই পথ তো বেশ পুণ্যের পথ। নিত্যি পুণ্যারথীর দর্শন হয় আপনাদের! তাঁরা সকলেই কি এই আস্তানায় আহার ক্রিয়া সারেন?

পূর্বক্তো বক্তা ঈশ্বরচন্দ্রের তির্যক কথার ধার ধরতে পারল না। সে বলে চলল, পুণ্যারথীর দর্শনে আমাদের পুণ্য অর্জন হয়। নিজেদের তো আর কোনোদিন যাওয়া হয়ে উঠবে না?

-কেন? গেলেই তো হয়।

খাওয়ার মাঝে গল্প জুড়েছেন ঈশ্বরচন্দ্র। আরও দু তিন জনের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। গোকুল তাতে মাঝে মধ্যে যোগ দিচ্ছে। এর মাঝে দোকানী এসে জানান দিয়ে গেল, রুটি শেষ। আর চাইলে, নতুন করে  রুটি করা সম্ভব হবে না।

দোকানীর কথাটা সত্যিই হোক, বা মিথ্যে, ঈশ্বরচন্দ্র বুঝলেন, দু পয়সার ভোজন শেষ। এবার তাদের উঠতেই হয়। মুখের গ্রাস শেষ করলেন। পেট ভরে জল খেলেন। উঠে পড়লেন। তাঁকে দেখে গোকুলকেও উঠতে হল। তা না হলে, গোকুলের ইচ্ছে ছিল, খাসা স্বাদের কুমড়োর ছক্কা দিয়ে আরও কয়েকটা রুটি সাবাড় করে সে  ওঠে।

ঈশ্বরচন্দ্র খাবারের দাম মেটাবার জন্যে ফতুয়ার পকেট থেকে একটা বাঘমুখো সিক্কা বের করে  দোকানীর হাতে দিলেন। দোকানী উল্টে পাল্টে দেখে নিয়ে বাকিটা ফেরত দেবার জন্যে কড়ির গাঁটরি খুলে বসল। কড়ি গুণতে গুণতে প্রশ্ন করল, পণ্ডিতমশায়, আপনাদের শহরে আলু নামের বস্তুটার কি দেখা মেলে?

-আজ্ঞে না কত্তা। আমাদের মতো সধারণের চোখে তা দেখতে পাই না। শুনেছি, ইংরেজ সাহেবদের ঘরে তা কিছু কিছু ঢোকে। সে হচ্ছে বম্বে আলু। আসলে, আলু তো আসে কাঠের জাহাজে চালান হয়ে। মূল্য অনেক বেশি। সাধারণের নাগালের বাইরে…

ঈশ্বরচন্দ্রের কথার মাঝে দোকানী কথা বলল, শুনি ফসলটা নাকি খুব সোয়াদের। তা, আমাদের দেশে ওই ফসল ফলানো যাবে না, পণ্ডিতমশায়?

-যাবে, যাবে। সোয়াদ যখন লোকে পেয়েছে, তার ফলন না করে  কি আর ছাড়বে? ইংরেজরাই তা করাবে, বুঝলেন, কত্তা।…আচ্ছা, এখন বেরতে হয়। ক’ কড়ি ফেরত দিলেন?

-দু গণ্ডা। গুণে নিন।

-আপনি বলছেন, তাতে আর গোণার কী আছে। চলি, বলে, গুমটিঘরের বাইরে বেরিয়ে এলেন ঈশ্বরচন্দ্র। পিছনে গোকুল। তখনও সেখানে আগের লোকগুলোই বসে ছিল। তাদের কাছ থেকেও বিদায় নিলেন । শেষে মজা করলেন, পরেরবার যদি এ পথে নবদ্বীপধাম যাই, তবে আপনাকে অবশ্যই সঙ্গে নিয়ে যাব।

কথাটা তাঁর উদ্দেশ্যে যে কিনা ইতিপূর্বে ঈশ্বরচন্দ্রকে পুণ্যারথীর দর্শনের বিষয়টা জানিয়েছিল।

ভর পেট খাওয়া সেরে গোকুল কিছুটা আলস্যের বশে এসে গিয়েছিল। চুপ করে  পথ চলছিল। ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে। ঈশ্বরচন্দ্র তাকে চাঙ্গা রাখবার জন্যে গল্প জুড়বেন স্থির করে  জিজ্ঞেস করলেন, কী গোকুল, এত চুপ কেন?

গোকুল উত্তর করল, কী কথা বলব, কাকা,…ভাবছি, আপনি যে  এত কষ্ট করতে পারেন, আগে তা আমার জানা ছিল না।

-জীবনে কষ্ট করতে হয়। তবেই না বড় মানুষ হওয়া যায়।

-কাকা, আপনাকে দেখেই সে ধরণা স্পষ্ট হচ্ছে। আপনি কত বড় মাপের মানুষ!

পথ চালার সাথে সাথে ঈশ্বরচন্দ্র কথা চালাতে থাকলেন। বললেন, সে না হয় হল। তবে, আমাদের কলিকাতাবাসের কথা শুনবি?

-কার? আপনার? তা যদি শোনান তো খুবই ভালো হয়। পথ চলাও সহজ হয়ে যাবে। গল্পে গল্পে এগিয়ে যাব। বলুন…

-তবে শোন, আমাদের, মানে, আমার আর তোর দীনুকাকা, শম্ভুকাকা, অন্য আরও কাকা, দাদাদের কলিকাতায় থাকবার কথা শোন। জানিস তো সেসময় আমরা একটা বাড়ির যে অংশে থাকতাম, সেখানে খুব অল্প জায়গা ছিল। তাতে আমরা ন’জন বাস করি। পাকের ঘরের পাশেই খাটা পায়খানা। আহারে বসতাম, কৃমি আমার খাবার থালার কাছে চলে আসত। একঘটি জল নিয়ে বসতাম। জীবটার ওপর জল ঢেলে সেটাকে দূরে ঠেলে পাঠাতাম। তারপর মুখে গ্রাস তুলতাম। এছাড়া তো খাটা পায়খানার দুর্গন্ধের সীমা ছিল না। পাকশালাও এমন এক স্থানে ছিল, যেখানে ভুল করেও কখনও দিনের বেলায় সূর্যের আলো ঢুকত না। দিনের সময়েও প্রদীপ জ্বালিয়ে রান্না সারতে হত। অন্ধকারে আরশোলার বাস, জানিস তো? কখনও তার এক আধটা উড়ে এসে রান্নার মধ্যেও পড়ত…

-এত কষ্ট করে থাকতে?

পথ চলতে চলতে গোকুল হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। তার মনে প্রশ্ন । বিস্ময়ের শেষ নেই।

-হ্যাঁ, গোকুল। আরও শুনবি?

-বলো  কাকা।

গোকুল উৎসাহ পেয়ে গেছে। আবার চলতে শুরু করলো।

  ঈশ্বরচন্দ্র বলে চললেন, একদিনের একটা ঘটনার কথা তোকে বলি। সেদিন একটু অসাবধানতা বশতঃ রান্না করা তরকারির মধ্যে একটা আরশোলা দেখতে পেলাম। তখন যদি সকলের মাঝে ওই কথা প্রকাশ করি, তো কেউই ওই তরকারী মুখে তুলবে না। পুরোটাই নষ্ট হবে। আবার তুলে নিয়ে সামনে ফেলে রাখাও চলবে না। মহা মুশকিল। ভেবেচিন্তা নিরুপায় হয়ে সেই আরশোলা শুদ্ধু তরকারী মুখের মধ্যে চালান করে দিলাম…

-কাকা, ঘেন্না করল না?, এতে তো অসুখও হতে পারত?

নাক মুখ কুঁচকে গোকুল কথাটা বলল। মুখে একবার ওয়াকও তুলল। ঈশ্বরচন্দ্র তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গটা চাপা দিয়ে দিলেন। শুরু করলেন অন্য কথা। বলছেন, আমরা ওই বাড়ি ছেড়ে এলাম বড়বাজারে। জগত দুর্লভসিংহ নামের এক ব্যাক্তির বাড়িতে। সে ঘরের দুর্দশা যদি বা অতটা নিম্নস্তরের ছিল না, তবু সেটা ছিল নিচের তলার ঘর। ঘরের মেঝে ভীষণ স্যাঁতসেঁতে । সেখানে শুয়ে আমার তো অসুখই হয়ে গেল। সর্বদাই সর্দি কাশি লেগে থাকত। বাবা আমাকে ডাক্তার দেখাল। আমাদের থাকবার জায়গার কথা শুনে ডাক্তারবাবু বাবাকে বেশ বকাঝকা করে  বলল, ছেলেকে কি মেরে ফেলতে চান? বাবা মুখ কাঁচুমাচু করে জানাল, ডাক্তারবাবু, এ ব্যামো কি শুধু ওই ঠাণ্ডা মেঝের কারণে? আমার মনে হয়, এর জন্যে ঈশ্বরের অন্য অভ্যাসও কাজ করছে।

-যেমন?

ডাক্তারবাবু জিজ্ঞেস করল। বাবা উত্তর দিল, ছেলে আমার রাত জেগে জেগে শরীর খারপ করেছে। বাসায় সকলে যখন ঘুমোয়, ছেলে তখন বাইরের ল্যাম্প পোষ্টের তলায় বসে পড়াশোনা করতে থাকে। আমার তো মনে হয়, অত রাত জাগাও ওর শরীরে সহ্য হচ্ছে না।

ডাক্তারবাবু সব শুনেও বাবাকে উপদেশ দিল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওই বাড়ি পরিবর্তন করতে… সত্যি বলতে কী জানিস গোকুল, আমি সেসময় প্রকৃতই অত্যধিক পরিশ্রম করতাম। আমার রক্তভেদও হচ্ছিল। অসুখ থেকে কিছুতেই মুক্তি পাচ্ছিলাম না। বাবা তখন আমাকে বীরসিংহ গ্রামে নিয়ে চলে গেল। আশ্চর্য! সেখানে গিয়ে বিনা ওষুধে সেরে গেলাম!

গল্প করতে করতে অনেকটা পথ পার হয়ে গেছে। রাতও গড়িয়েছিল। চতুর্দিক নিস্তব্ধ। ঘুটঘুটে অন্ধকার। তাঁর মধ্যে দিয়ে সরু পায়ে হাঁটা পথ এগিয়ে চলেছে। মাঝে মাঝেই হুঁকা হুয়া ডাক। তেনারা এক আধজন ঈশ্বরচন্দ্রের চলার পথও কাটছে । সামনে আসার ভাণ করলেও ঈশ্বরচন্দ্রের হাতের লাঠি দেখে লেজ গুঁটিয়ে গ্রামের পথে দৌড় লাগাচ্ছে। আর হয়তো এক ক্রোশ দূরে গুরাপ। এতটা  পথ যে পেরিয়ে এলেন, গোকুল তা বুঝতেই পারেনি। তবে সে শ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। বলল, কাকাবাবু, কোথাও একটু বসে  জিরিয়ে নিলে হয় না?

-চাইলে তা করতে পারিস। চল, বলে, ঈশ্বরচন্দ্র সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। এক গৃহস্থের বাড়ি পড়ল। বাড়ির সামনে রোয়াক। মাটি দিয়ে লেপা। উঁচু জায়গা। সেখানে বসলেন। গোকুল শোবার মতলব করছিল। ঈশ্বরচন্দ্র বুঝলেন, এখন যদি গোকুল ঘুমিয়ে পড়ে তাহলে তাকে জাগাতে বেগ পেতে হবে। পথ চলা মুশকিল হবে। অথচ সকাল হবার আগে অম্বিকা-কালনায় ঢুকতে হবে। বেলা হলে যদি বাচস্পতি মশায় কোথাও বেরিয়ে যান? তাহলে তো তাঁকে নিয়ে আগামীকাল কলিকাতায় ফেরত আসা যাবে না? ভেবেচিন্তে স্থির করলেন, গল্পে গল্পে গোকুলকে জাগিয়ে রাখতে হবে। এবার শুরু করলেন, এক বাৎসল্য রসের কাহিনি। রায়মণি দিদির কথা।

-জানিস তো গোকুল, আমার ছোট বেলায় আমি এক দিদিকে পেয়েছিলাম। একসময় আমাদের বাস ছিল কলিকাতার বড়বাজারের  জগতদুর্লভ সিংহ, যাঁর নাম একটু আগে করলাম, তাঁদের বাড়িতে । যে দিদির কথা বলছি, তাঁর নাম হচ্ছে রায়মণি। রায়মণি দিদি ভগবতচরণ সিংহের ছোট মেয়ে। জগত দুর্লভ সিংহের বোন।  ভগবতচরন ছিলেন বাবার অতি পরিচিত জন। তাঁরই আনুকূল্যে বাবা ওই বাড়ির নিচের তলার ঘরে থাকবার সুযোগ পান। বাবার সঙ্গে আমি। তবে আমরা আসার অল্পদিনের মধ্যে  ভগবতচরণ মশাইয়ের মৃত্যু হয়। ওনার জ্যেষ্ঠ সন্তান, জগতদুর্লভ সিংহ মশায় সংসারের কর্তা হন। তার বয়স তখন পঁচিশ বছর। বাবাকে উনি কাকা-জ্যেঠার মতো শ্রদ্ধাভক্তি করতেন। সেই সূত্রে আমি তাঁকে দাদা এবং রায়মণিকে দিদি সম্বোধন করতাম।

তখন আমি সদ্য বীরসিংহ ছেড়ে এসেছি।  বাবা নানান কাজে সারাদিন বাইরে বাইরে থাকেন। ঘরে আমি একলা। ভীষণ মন খারাপ নিয়ে আমার দিন কাটছে। মা ঠাকুমাকে কাছে পাচ্ছি না। সব সময় কান্না পায় । মায়ের থেকেও ঠাকুমার ওপর আমার টান বেশি ছিল। ঠাকুমার কাছে খাওয়া, শোয়া, নাওয়া, সব চলত আমার। সেসব থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়েছি। এছাড়াও বাদ পড়েছে গ্রামে আমার  দৌড়াত্ম, দুষ্টুমি।  সেসবও হচ্ছে না। কী যে খারাপ লাগত তখন! শুধু মনে হত, সেখান থেকে পালিয়ে গ্রামে ফিরে যাই।

ঠিক সেসময়েই পেয়ে গেলাম গোপালচন্দ্রকে। গোপালচন্দ্র হচ্ছে রায়মণি দিদির ছেলে। আমারই বয়সী সে। কোনও কারণে সিংহ মহাশয়ের মেয়ে ছেলেকে নিয়ে বাবার কাছে এসে থাকত। ছেলের প্রতি মায়ের যেরকম স্নেহ যত্ন থাকা উচিত, তা থেকে বেশিই ছিল রাইমণি দিদির, কিন্তু আমাকেও গোপালচন্দ্রের চেয়ে কিছু কম যত্নআত্তি করত না। নিজের ছেলের থেকে আমায় কিছুমাত্র বিভিন্নতা দেখাত না। দয়াময়ী নারী ছিল ।  সববিষয়ে আমার প্রতি তাঁর নজর ছিল। গোপালচন্দ্রের সঙ্গে আমাকেও নাওয়ানো, খাওয়ানো, শয়ন করানো, গল্প বলা, পড়তে বসানো, সব চলত। কোনও সময়ে তাঁকে অপরজন বলে মনে হত না আমার ।দিনে দিনে আমার মন ভালো হয়ে গেল। আমি ইশকুলে ভর্তি হলাম। তখন অবশ্য আর অতটা খারাপ লাগত না।

   এর মধ্যে একদিন অসুখ হল আমার। ভীষণ রকমের জ্বর, সঙ্গে সর্দি কাশি। আমাদের বসবাসের ঘরটা নিচের তলায় হওয়ার কারণে খুব ঠাণ্ডা ছিল। সামনেই গঙ্গা। তার জন্যেই কি না, ঘরের মেঝের ঠাণ্ডার প্রকোপ এত বেশি ছিল। তা থেকেই আমার অসুখ হয়েছিল। শুধু মাত্র রাইমণি দিদির স্নেহ আর অশেষ যত্নে সেই উৎকট অসুখের নিরাময় হয়েছিল ।

 

কাকার কথা শুনতে শুনতে গোকুলের মনও আদ্র হয়ে উঠেছিল। সে বলল, আপনার ভাগ্য সত্যিই সুপ্রসন্ন ছিল কাকাবাবু । তা না হলে, নিজের বাড়ি ছেড়ে এসে পরের বাড়িতে এমন একজনকে পাওয়া কি হয়?

-জানিস তো গোকুল, স্নেহ, সৌজন্য, অমায়িকতা, সদ্বিবেচনা এসব সদগুণ বিষয়ে রাইমণি দিদির সমকক্ষ স্ত্রীলোক আজ পর্যন্ত আমি দেখিনি। সেই দয়াময়ীর সৌম্যমূর্তি, আমার মনে দেবী মূর্তির মতো ঠাঁই নিয়েছে। আজও তা একই রকম রয়েছে। সেখান থেকেই আমি স্ত্রীজাতিকে সম্মান করতে শিখেছি। এখন লোকে আমাকে স্ত্রীজাতির প্রতি পক্ষপাতী বলে । নিশ্চয়ই আমি তাই। তাতে আমার দ্বিমত নেই। যে ব্যক্তি রাইমণি দিদির মতো মহিলার দয়া, মায়া প্রত্যক্ষ করেছে এবং ওই সদগুণের ফলভোগী হয়েছে , সে যদি স্ত্রীজাতির পক্ষপাতী না হয়, তাহলে তাঁর মতো কৃতঘ্ন, পামর ভূমণ্ডলে নেই।

আবেগের বশে সব কথাই ঈশ্বরচন্দ্র বলে ফেললেন। একটানা কথা বলতে গিয়ে তাঁর গলা শুকিয়ে উঠেছিল। খাবার জল পেলে ভাল হত। অথচ সাথের সঞ্চিত জল সব শেষ। কী করেন? কথাটা গোকুলকে জানালেন। সে চট করে এক গৃহস্থের বাড়িতে গিয়ে হাঁকডাক শুরু করে দিল, কেউ কি জেগে আছেন? আমরা পথিক মানুষ। তৃষ্ণা লেগেছে। একটু খাবার জল পাওয়া যাবে?

ভোর হয়ে আসছিল। আলো ফুটেছে। লোক চেনা যাচ্ছিল। জায়গাটাও গ্রাম গঞ্জের বাইরে। নগরের ঘরবাড়ি সেখানে। বাড়ির বাইরে হাঁকডাক শুনে এক গৃহস্থ খিড়কি দিয়ে উঁকি মেরে দেখল, দুজন ব্যক্তি দাঁড়িয়ে। পানীয় জলের প্রত্যাশায় হাঁকডাক করছে। একজন আবার ব্রাহ্মণ।

লোকটি নিজে জাতে শূদ্র। দাস পদবী। পেশায় কুম্ভকার। ইতস্তত করছিল। শূদ্রের হাতের জল কি ব্রাহ্মণ পান করবে? বাইরে বেরিয়ে মানুষটা তার মনের কথা ব্যক্ত করল । ঈশ্বরচন্দ্র অভয় দিয়ে বললেন, আমি চালকলার ব্রাহ্মণ নয়, মশায় । পড়াশোনা করা ব্যক্তি। আপনি নির্দ্বিধায় আমায় জল দিতে পারেন।

অবাক হলেও আর দেরী না করে  বাসার ভিতরে গিয়ে সে ভরা কুঁজো জল এনে হাজির করল।  নিজের হাতে কুঁজোখানা নিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। তা উপুড় করে মুখের মধ্যে অনেকটা জল চালান করে দিলেন। তৃষ্ণার তৃপ্তি। ঢেঁকুর তুললেন। বাকি জলটুকু গোকুল পান করল । পরে আর এক কুঁজো জল আনিয়ে নিজেদের সঙ্গে থাকা ছোট ভিস্তাটায় ভরে গৃহকর্তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবার রওয়ানা হলেন। বাকি পথ নির্বিঘ্নে পার করলেন।

দিনের প্রথম প্রহরে ঈশ্বরচন্দ্র অম্বিকা-কালনায় পৌঁছলেন। তারানাথ তখন স্নান পুজো সেরে বাইরে বেরবার উদ্যোগ নিচ্ছেন। তিনি টোল-পণ্ডিত হলেও ব্যবসায়ীও বটে।  তাও যে সে ব্যবসায়ী নন তারানাথ । একাধিক ব্যবসার মালিক। তার মধ্যে রয়েছে, বস্ত্র বানানো।  বিলেত থেকে সুতো কিনে আনিয়ে গ্রামের তন্তুবায়দের দিয়ে নানান ধরণের বস্ত্র তৈরী করানো। দেশে কাপড় বোনার মতো সুতো পাওয়া যায় না। বিদেশি সূতোই তাই ব্যবহার করতে হয়। সেই বস্ত্র বিক্রয়ের জন্যে বিভিন্ন জায়গায় পাঠান। দেশের উত্তরপশ্চিমে বেশি তা প্রেরণ করেন। রেল চলাচলের সূচনা হয়নি। আবার গো যানের জন্যেও সেপথ সুগম নয়। তাই মুটের মাথায় মালপত্র পাঠান। এছাড়াও তারানাথ মশায়ের রয়েছে কাঠের ব্যবসা। নেপাল থেকে শালকাঠ কিনে আনিয়ে তা বিক্রি করেন। কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে নিজের বসানো অসংখ্য ঢেঁকিতে তা ছাঁটাই করে চাল প্রস্তুত করেন। সেই চাল বাজারে  বিক্রি করেন। এত ধরণের ব্যবসা করে তারানাথ বেশ টাকা কামাচ্ছেন । অম্বিকা কালনায় দেখবার মতো বিশাল বাড়িও তৈরী করেছেন।

এর সবটুকুই ঈশ্বরচন্দ্রের সম্যক গোচরে না থাকলেও, কিছুটা দেখা ছিল। তবু তিনি নিজের বিচারে স্থির ছিলেন, এত ধনী এক ব্যক্তিও তাঁর কথা উপেক্ষা করবে না। কারণ সৎ সুশিক্ষিত, সুপণ্ডিত একজন মানুষের কাছে অর্থই সব নয়। তাঁর নিজের মতোই জ্ঞানদানে উৎসাহী মানুষই হবেন তারানাথ। তারানাথকে তো কলেজ জীবনে দেখেছেন তিনি। হ্যাঁ, বণিক ইংরেজদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশীয় মানুষও যে বাণিজ্যে লক্ষ্মীর বসত গড়তে পারে, তার উদাহরণ, আগের কালের রামমোহন রায় থেকে এখনকার দ্বারকানাথ ঠাকুর, মতিলাল শীল, রামদুলাল দে, গোপালচাঁদ মিত্র, তারনাথ চক্রবর্তী’র মতো তারানাথ বাচস্পতিও স্থাপন করতে পারেন, এটাই তিনি প্রমাণ করেছেন। বাংলার সমাজ জীবনে রেনেসাঁ যুগের স্রষ্টা।

এত সকালে বন্ধুর আগমন! তারনাথ মশাই অবাক হলেন। বসো , বসো করে, দুজনকে বসালেন। জল পান করালেন। ঈশ্বরচন্দ্র ধীরেসুস্থে সুসংবাদটা  দিলেন। তারানাথ কিঞ্চিতমাত্র দ্বিধাগ্রস্ত হলেন না। প্রকৃত জ্ঞান সাধকের মতোই সাগ্রহে শিক্ষকতা করবার অনুগ্রহ গ্রহণ করলেন। তাঁর চিন্তাই সঠিক ছিল তা প্রমাণিত হল ।স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন ঈশ্বরচন্দ্র। হাড়ভাঙা পরিশ্রম সার্থক হতে সানন্দে কোলাকুলি করে দুজনের মাঝে পুরনো বন্ধুত্বের রেশ আর একবার নবীকরণ করে ফেললেন। বাকি কথপোকথন তাড়াতাড়ি শেষ করে নিলেন দুজনে।

আর দেরী করার নেই।  সেদিনই ফিরতি পথে সকলে রওয়ানা দেবেন । ঈশ্বরচন্দ্র এবং গোকুলকে নিজ বাসায় স্নান, খাওয়া করিয়ে নিলেন তারানাথ । ব্যবসাপাতির ভার বাবা এবং ভাইদের হাতে ন্যস্ত করে যাত্রা শুরু করলেন। আসবার পথটা অবশ্য পুরোটা হেঁটে আসতে হল না। তারানাথের অনুরোধ ও আনুকূল্যে ঘোড়ায় টানা বগি গাড়িতে করে  সকলে কলিকাতায় ফিরলেন । হাতে সময়ও ছিল অল্প। সোমবারে নতুন কাজে যোগ দিতে হবে তারানাথকে।

সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণের ১ম শ্রেণিতে মাসিক চল্লিশ টাকার মাইনেতে  নতুন কাজে যোগ দিলেন বৈয়াকরণ তারানাথ বাচস্পতি।  মার্শাল সাহেব খুশি হলেন। ঈশ্বরচন্দ্রের এমন  বন্ধুপ্রীতির কথা শুনে তাঁর অকুণ্ঠ প্রশংসা না করে থাকতে পারলেন না তিনি ।

তবে এতেও ঈশ্বরচন্দ্রের কাজের শেষ হল না। খালি পদের জন্যে একজনকে ঠিক করে  দিয়ে ভাবলেন, তাঁর কাজ শেষ হল। কিন্তু কোথায় কী? এবার খোদ ময়েট সাহেবের ডাক পড়ল । তাঁর কথা, ১ম শ্রেণীর অধ্যাপক তো ঠিক করে দিলেন; ২য় শ্রেণীর জন্যে পদ কি খালি রাখবেন, ভিদ্যাসাগর মহাশয়? আমি অনুরোধ করছি, আপনি ওই পদ গ্রহণ করুন।

স্ববিরোধীতাকে ঈশ্বরচন্দ্র হীন চোখে দেখেন। একবার যেখানে তিনি না করেছেন, সেখানে পুনঃ অনুরোধে মত পরিবর্তন করা তাঁর স্বভাবে নেই। হৃষ্টচিত্তে ময়েটকে উত্তর করলেন,  না, মহাশয়, আমি তো একবার জানিয়ে দিয়াছি, আমি ওই কাজ নেওয়ায় উৎসাহী নয়। তাছাড়াও আমি ফোরট ইউলিয়াম কলেজে মিঃ মার্শালের সঙ্গে কাজে অত্যন্ত সুখে আছি। এখন আমার চাকরী বদলের কোনও ইচ্ছা, বা পরিকল্পনা, কিছুই নেই।

-আ প নি, মানুষটি সত্যিই ভিন্ন প্রকৃতির। বেশি মাইনের পদেও আপনি আসতে ইচ্ছুক নয়!

এহেন ব্যক্তির সামনে এ ব্যতীত অন্য আর কিই বা উক্তি হতে পারে? ময়েট কথাটা মনে মনে ভাবলেন।   ঈশ্বরচন্দ্র একটু হাসলেন। ইতিপূর্বে এই বিষয়ে মিঃ মার্শালকে তিনি যা বলেছিলেন, তার দ্বিরুক্তি করলেন। তবুও ময়েট  ছাড়বার পাত্র নন। তাঁর ওপরে দায়িত্ব দিলেন, দ্বিতীয় অধ্যাপক ঠিক করে  দেবার জন্যে।

ঈশ্বরচন্দ্রের মনে ওই পদের জন্যেও ব্যাক্তি স্থির করাই রয়েছে। বললেন, এই প্রার্থীকে উপযুক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে  নির্বাচন করতে চাই, মিঃ ময়েট।

-কেন, পদের জন্যে কি আপনার মনোনীত অন্য কোনও ব্যাক্তি নেই ?

-তা নয়। তবে কী জানেন, বারবার নিজের প্রার্থীকে স্থান দিলে, ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু হয়ে দাঁড়াবে। পরীক্ষার মাধ্যমেই করা ভালো। অনুমতি দিলে পরীক্ষা গ্রহণের আগে কিছুটা সময় চাই।

-সে আপনি নিন। তবে কত দিনে তা করতে পারবেন?

-সময় লাগবে।

-অনেকদিন বাড়ি যাইনি। মনটা উতলা হয়ে আছে।

-আচ্ছা, আচ্ছা। আগে ঘুরে আসুন। তারপর…,

ময়েট রাজী হয়ে গেলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বাড়ি যাবার প্রস্তুতি নিতে থাকলেন।

(৮)

বীরসিংহ গ্রামে এসেছেন ঈশ্বরচন্দ্র । নামেই তাঁর বাড়ি আসা। অথচ একটা দিন ঘরে বসে কাটতে না কাটতেই বেরিয়ে পড়েছেন  কাজে। গ্রামে তাঁর নানান কাজ। সবটাই সেবামূলক। সকাল থেকে দুপুর বাইরে কাটে। দুপুরে আসেন খাওয়া দাওয়া করেন। সামান্য বিশ্রাম নিয়ে আবার বেরিয়ে যান। ফিরতে ফিরতে সেই সন্ধে। তারপর কিছু সময় দেন বাড়ির লোকের জন্যে। তবু তারই মাঝে পড়া লেখা চলতে থাকে। ব্যস্ত মানুষ তিনি। আজকের দিনটাতেও তার রুটিনের ব্যতিক্রম হয়নি।

সকাল গড়িয়ে দুপুর এলো। ভগবতীদেবী আর দীনময়ীর দুপুরের খাওয়া হয়নি। তাঁদের খাওয়া  ঈশ্বরচন্দ্রের আহারের পর। বাড়ির এই রীতি। ঈশ্বরচন্দ্র যখন গ্রামে আসেন, বাড়িতে এই রুটিন চলে। বছরের বেশির ভাগ সময় তিনি থাকেন কলিকাতার মেসে । তখন অবশ্য এর প্রয়োজন পড়ে না। ছোট বড় করে বাড়ির সকলের খাওয়ার পাট চুকলে শাশুড়ি বউয়ে এক সঙ্গে বসে খায়। যৌথ পরিবারের নিয়মরীতি। এ ব্যতীতও দীনময়ীর অভ্যাস হয়ে গেছে ভগবতীদেবীর আঁচল ধরে থাকার। ছোট মেয়ের মতো।   একেই তো শরীরের ফুল ফুটতে না ফুটতে তিনি নিজের শৈশব-কৈশরের চেনা পরিচিত গণ্ডী ছেড়ে নতুন জায়গায় এসে পড়েছেন। তায় পাশে স্বামীর অনুপস্থিতি। তাই শাশুড়িকেই মায়ের স্থান দিয়ে সব সময় তাঁর সঙ্গে লেপটে থাকতে ভালোবাসেন। ভগবতীদেবীও তাঁর প্রথম পুত্রবধূকে বুকে রাখেন। দীনময়ীর এই একলা থাকার দিনগুলোতে দুপুরটা হয় বিশ্রামের সময়। তখন তিনি শাশুড়ির সঙ্গে বসে কথাবার্তায় মেতে থাকেন ।

গ্রামঘরে অবশ্য দুপুরে মেয়েদের সময় কাটানোর একটা নিজস্ব পদ্ধতি থাকে। বীরসিংহে ঠাকুরদাসের বাড়ির ছবিটা তা থেকে কিছুটা ভিন্ন।  সেসময় পাড়ার মেয়ে, গিন্নী, বউরা  ঠাকুরদাসের বাড়ির উপরের দালানে একত্র হয় । মেলামেশা , হাসি হুল্লোড়ের মধ্যে দিয়ে নির্জন দুপুরটা কাটাতে সকলে আসে । বাইরের মেয়ে বউরা তখন বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে ঢোকে। ঠাকুরদাসের বাড়িতে সদর দরজা দিয়ে মেয়েদের আসবার চল নেই ।

আজও অন্যান্য বাড়ির মেয়েলোকেরা হাতের কাজ, খাওয়া দাওয়া সেরে এসে জড়ো হতে শুরু করল। তারা এসেছে ভগবতীদেবীর কাছে।   নিত্যাকার মতো আসরের মধ্যমণি হয়ে রয়েছেন ভগবতীদেবী। কেউ তাঁকে সম্বোধন করছে পিসি, কেউ মাসী, কেউবা শুধু মা ঠাকরুন। তিনি সকলের প্রিয়জন । নিজ গুণে তিনি সকলের প্রিয় হয়েছেন। হৃদয় তাঁর অত্যন্ত দয়ার।

পাড়া প্রতিবেশীর যে কোনোও প্রয়োজনে তিনি রয়েছেন। গ্রামের গরীব দুঃখীর বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নেন, কারোও খ্যাদাভাবে দিন কাটছে কিনা। সাহ্য্য করেন। সাহায্য প্রার্থীর ঘরে চাল বাড়ন্ত, মাসীমা, দু কুনকে চাল ধার দেবেন, বলে, গ্রহীতা এসে দাঁড়াল। ভগবতীদেবী ভাঁড়ার থেকে চাল বের করে  এনে দিলেন । কাউকে গাছের কলাটা মুলোটা; আবার সেরকম হলে, নিজের সংসারের কষ্ট মেনে নিয়েও দুচার পয়সা সাহায্য করেন অতি দরিদ্রদের।

এ ছাড়াও তিনি হচ্ছেন রত্নগর্ভা মহিলা। ঈশ্বর, দীনু, শম্ভুর মতো কৃতি সন্তানদের জননী তিনি। তাঁর প্রায় সব ছেলেরাই কলিকাতা শহরে থেকে পড়াশোনা করে   বিদ্যাসাগর, ন্যায়রত্ন, কেউবা তর্কালঙ্কার উপাধি লাভ করেছে। বীরসিংহ গ্রামে আর কোনও মায়ের এতগুলো কৃতি সন্তান নেই।

চলবে… 

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page