উপন্যাস।। আবার এসো ফিরে।। রামেশ্বর দত্ত
এভাবেই দীর্ঘ এক বক্তব্য রেখে মহর্ষি ভাষণ শেষ করলেন। তুমুল করতালি ও হর্ষধ্বনির মধ্যে দিয়ে বক্তৃতা শেষ হল।
শেষ ধন্যবাদ জ্ঞাপক বক্তব্য রাখলেন দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন। সকল বক্তা, উপস্থিত মহামান্য ব্যক্তিত্ব ও অন্যান্য শ্রোতৃকুলকে যথপোযুক্ত ধন্যবাদ জ্ঞাপন শেষে তিনি বললেন, কলেজ স্রষ্টা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসগরের ভ্রাতা হতে পেরে আমি ধন্য। শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের অবদানকে একদিন সমগ্র বাঙালি তথা ভারতবাসী স্মরণ করবে। আগামী শতাব্দী ধরে তাঁর জীবন বাঙালির কাছে প্রেরণার উৎস হবে।
এরপর…
পর্ব-৩৮
আমরা সকলেই চাই, তিনি নিজের জীবনচরিত রচনা করে যান। তবে, আমি আমার ভ্রাতাকে যতটুকু চিনি বা জানি, তাতে তিনি নীরব কর্মী হয়েই থাকতে চান। সময় তাঁর কর্মকে বিচার করবে। তবু তাঁকে জীবিত রাখার দায়িত্ব আমাদের। সে কারণে তাঁর হয়ে আমি নিজে কলম ধরব। বিদ্যাসাগর-চরিত রচনা করব। জানি, হয়তো আরও কোনও মহৎ ব্যক্তি যাঁরা তার সংস্পর্শে এসেছেন, বা যাঁরা ভবিষ্যতে তাঁকে জানতে চাইবেন, তাঁরাও বিদ্যাসাগরকে নিয়ে কলম ধরবেন, এ আমার বিশ্বাস…
উপস্থিত জনতা প্রচণ্ড উৎসাহিত হয়ে সজোরে করতালি করতে শুরু করল। সভা শেষ হল। অতিথিরা মঞ্চ ছেড়ে নামলেন। নিচে এসে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ কর প্রশস্ত করে ঈশ্বরচন্দ্রের করে স্থাপন করলেন। হালাকা চালে কিছু কথাবার্তা শুরু করলেন।
ঈশ্বরচন্দ্রকে বললেন, পরকালের কাজও ইহকালেই আপনি সেরে রেখে গেলেন, বিদ্যাসাগর মশাই!
-দেবেন্দ্রবাবু, ইহকাল পরকাল জানি না। তবে দিন যে আমার শেষ হয়ে আসছে, তার বার্তা পাচ্ছি। তাই মনে হয়, এটাই আমার অন্তিম কাজ যা এজীবনে করবার বাকি ছিল। আজ সেটাই শেষ করতে পেরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এখন ওপারের ডাক আসলেও আমি নিশ্চিন্তে যেতে পারব।
প্রজ্বলিত সূর্যের আলোর নিচে যে অন্ধকারের ছায়া ঘনিয়ে আসছে, ঈশ্বরচন্দ্রের কথায় তার প্রকাশ ঘটল। বক্তা এবং শ্রোতা, দুজনকেই কিছুটা বিমর্ষ দেখা গেল।
(৪২)
বীরসিংহে দীনময়ী দেবী এখন খুবই অসুস্থ। খবরটা ঈশ্বরচন্দ্রের কানে এনে তুলল শম্ভুচন্দ্র। গ্রাম থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে তিনি এসেছেন দাদার কাছে। ঈশ্বরচন্দ্র রয়েছেন কর্মাটাঁড়ে। দাদা যে কলিকাতার বাসায় নেই, তা জেনেই শম্ভুচন্দ্র কর্মাটাঁড়ে চলে এসেছেন। এসে দেখছেন, দাদা দিব্যি সাঁওতালদের মাঝে মিশে গেছে। শরীরও অনেকটা সুস্থ। ভালোই দিন কাটাচ্ছেন।
বউদির সংবাদটা শম্ভুচন্দ্র বলবেন বলবেন করেও ভাঙতে পারছেন না। তাঁর কাছে বড়দাদা যতখানি প্রিয়, ততখানিই বউদিও। ঘর ছাড়ার আগে তিনি দেখে এসেছেন বউদির অসুখ দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। ডাক্তার বদ্যি করে কিছুতে তা কমছে না। আবার এদিকে এসে তাঁর প্রিয় দাদাকে দেখছেন, জীবনভর কাজ করে গিয়েও বঞ্চনার শিকারে নুব্জ্য হয়ে পড়ার পর নতুন আবাস, জীবনের নতুন আস্বাদ পেয়ে মনের আনন্দে রয়েছেন। সেখানে কেমন করে দাদাকে বীরসিংহে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন? উপরন্তু যে স্থান দাদা জীবনের মতো ত্যাগ করে এসেছেন, শত প্রতিকূলতায়ও যেখনে তিনি যাননি সেখানে কি আর ফিরে যাবেন? তাঁর ধর্মপত্নীর জীবন সংকটে তিনি কি তাঁর প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করবেন? তবে, ভাবলেন, এই নিয়ে দাদাকে একবার বোঝানো যেতেই পারে।
এমনই ভেবে শম্ভুচন্দ্র কথাটা সেদিন বলেই ফেললেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বসেছিলেন তাঁর পড়ার ঘরে। কিছু লিখছিলেন। সাঁওতালদের নিয়ে সারাদিনের নানান কর্মকাণ্ডের পর রাতের দিকে এই সময়টা তিনি হয় বই নিয়ে বসেন, নচেৎ লেখার কাজ থাকলে তা সারেন। আজ লেখার কাজ করছিলেন।
শম্ভুচন্দ্র অভিরামের সঙ্গে কথা বলতে বলতে উঠে এসেছেন। ঈশ্বরচন্দ্রের ঘরে প্রবেশ করলেন। মনোযোগ সহকারে ঈশ্বরচন্দ্র লিখে চলেছেন। পদ শব্দ কানে যেতে কলম থামিয়ে মুখ তুলে তাকালেন। শম্ভুকে দেখে প্রশ্ন করলেন, কিরে, কিছু বলবি?
-আমি এসেছি দুদিন হয়ে গেল। এবার তো আমাকে ফিরতে হয়, দাদা। ওদিকে বউদির শরীরটা মেটেই ভাল যাচ্ছে না…, শম্ভুচন্দ্র উত্তর করলেন।
-কেন ? কি হয়েছে তোর বউদির? আগে তো বলিসনি?
-বলিনি ঠিক। তবে এখন বলছি, একবার বউদির কাছে তোমার যাওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হচ্ছে আমার।
-আমার যাবার! ঈশ্বরচন্দ্র বিস্ময় প্রকাশ করলেন।
-হ্যাঁ দাদা। অনেক ডাক্তার বদ্যি করা হল, বউদি কিছুতেই সুস্থ হচ্ছেন না। কয়েকদিন পর পরই জ্বর আসছে। কেঁপে কেঁপে জ্বর। তার ওপরে মূত্র করতে গেলে অসম্ভব রকমের জ্বালা।
-জ্বর কি রাতের দিকে আসে?
-কখনও রাতে, কখনও বা দিনে। জ্বর আসলে সহজে তা ছাড়ে না। গায়ে হাতে মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা।
ঈশ্বরচন্দ্র চুপ করে রইলেন। ভাবলেন। পরে মুখ খুললেন,-দ্যাখ শম্ভু, আমার মনে হচ্ছে, তোর বউদিকে কলিকাতায় এনে ডাক্তার দেখানো দরকার। সেখানে সব অভিজ্ঞ ডাক্তার রয়েছে। তাদের অনেকের সঙ্গে আমার চেনাজানাও আছে। তাঁরা জ্বরের কারণ নির্ণয় করে সঠিক ওষুধ দিলে সুস্থ হয়ে উঠবে। দীনময়ীকে কলিকাতায় আনবার ব্যবস্থা কর।
-দাদা…, বলে শম্ভুচন্দ্র একটা ডাক দিয়ে থেমে যেতে ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, কী হল রে?
-বলছিলাম বউদির শরীর কি এতটা ধকল নিতে পারবে? শরীর ভীষণ ভাবে ভেঙে গেছে।
-এতদিন কেন খবরটা দিলি না? তোরাও সব অকম্মের ঢারি হয়েছিস।
কথাটায় ঈশ্বরচন্দ্রের যতটা না উষ্মা প্রকাশ পেল, তার থেকে অনেক বেশি প্রকাশিত হল ভিতরের উদ্বিগ্নতা। জোর দিয়ে বলতে পারছেন না, নিজে বীরসিংহে যাবেন; অথচ চুপও থাকতে পারছেন না। এমত অবস্থায় মানুষ যেমন অপরকে দোষের ভাগী করে নিজের মনকে নিষ্কৃতি দেয়, ঈশ্বরচন্দ্রও তেমনটাই করলেন। শেষে নিজেই তার সমাধান বার করলেন। বললেন, তুই ফিরে যা। একখানা গাড়ি ভাড়া করে তোর বউদিকে কলিকাতায় নিয়ে আয়। আমি সরাসরি কলিকাতায় ফিরছি। যা। কালকেই তুই ফের। আর হ্যাঁ, সঙ্গে তোর ভাইজীদের কাউকে নিয়ে আসিস।দ্যাখ, যদি হেমলতা তার সংসার ছেড়ে আসতে পারে।
ঈশ্বরচন্দ্রের যেমন কথা তেমনই কাজ। ভাইয়ের হাতে টাকা কড়ি দিয়ে দিলেন। শম্ভুচন্দ্র বীরসিংহে ফিরলেন; ঈশ্বরচন্দ্র কলিকাতায়।
ক’দিন পরেই বাদুরবাগানের বাড়ি আবার ভরে উঠল। অসুস্থ দীনময়ী এসেছেন। হেমলতা এসেছে। কলিকাতা থেকে হেমলতা-পুত্র সুরেশ্চন্দ্র এসেছে তাঁর স্ত্রী নলিনীদেবীকে নিয়ে। গ্রাম থেকে হেমলতার অপর পুত্র যতীশ্চন্দ্রও এসেছে। সে অবশ্য অবিবাহিত। এছাড়াও তো রয়েছে শম্ভুচন্দ্র। সকলে মিলে দীনময়ীর চিকিৎসায় উঠেপড়ে লেগে পড়ল।
স্ত্রীর জন্যে ঈশ্বরচন্দ্র হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা শুরু করালেন। ডাক্তার ডাকলেন সুহৃদ মহেন্দ্রলাল সরকারকে। বিখ্যাত চিকিৎসক। এলাপ্যথিক চিকিৎসায় সুনাম কিনেও ঈশ্বরচন্দ্রের পরামর্শে পরে হোমওপ্যাথিক চিকিৎসাশাস্ত্রে যশ করেছেন।
প্রথমাবস্থাতেই ডাক্তার সরকার রোগের নানান উপসর্গ দেখে প্রাথমিক ওষুধ প্রয়োগ করলেন। কিছুদিনের পর সামান্য নিরাময়ের লক্ষণ দেখে ধরে ফেললেন, অসুখটা কিসের। গোপনে ঈশ্বরচন্দ্রকে জানালেন, অসুখটা রক্তাতিসার হলেও এর চরিত্রে বিভিন্নতার যোগ রয়েছে। সেকারণে শরীরে রোগ বেশ গাড়িয়ে বসেছে।
ঈশ্বরচন্দ্র বিমর্ষ হলেন। জানতে চাইলেন, এ কী নীরোগ হবার নয়, মহেন্দ্রবাবু?
-চেষ্টা করব। তবে এর ওষুধ এখনও সেরকম ভাবে এদেশে আসেনি।
-তাই যদি হয় বলুন, আমি বিদেশ থেকে ওষুধ আনাবার ব্যবস্থা করি।
-সে উপায় যদি থেকে থাকে, তাহলে সেটাই করা ভালো। ঠিক আছে, আমি লিখে দিচ্ছি। আপনি চেষ্টা করুন।
-রোগী সেই সময়টুকু দেবে তো? কারণ বিদেশে যোগাযোগ করে ওষুধ জাহাজে আসতে আসতে একটা দীর্ঘ সময় লাগতে পারে।
-আমি দেশীয় ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছি। আপনিও আনাবার চেষ্টা চালান। তবে জার্মানী থেকে আনাবেন। ওদের ওষুধ সব থেকে কার্যকর।
মহেন্দ্রলাল এবং ঈশ্বরচন্দ্র যে যাঁর মতো করে চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলেন। এদিকে রোগও নিজের মতো বিস্তার হয়ে চলল। দেশীয় ওষুধ রোগে সাময়িক উপশম দিচ্ছে, কিন্তু নিরাময় করতে পারছে না। রোগ নির্মূল করা তো দূরাস্ত।
রোগী এখন দিনে রাতে বেশিরভাগ সময়েই বেহুশের মতো চোখ বুঁজে পড়ে থাকছে। হেমলতা মায়ের সেবার কাজ হাতে তুলে নিয়েছে। মাকে ঘুম থেকে তোলা, গা মাথা ধুইয়ে কাপড় জামা পরিবর্তন করে পরিষ্কার রাখা, ডাক্তারের নির্দেশ মতো পথ্য তৈরী করে খাওয়ানো, ধরে ধরে বাথরুম পায়খানায় নিয়ে যাওয়া , সবটাই একলা সারছে। তাকে সাহায্য করছে পুত্রবধূ নলীনি । হেমলতার দুই পুত্র সুরেশ্চন্দ্র ,যতীশ্চন্দ্র বাইরের কাজ সারছে।
ঈশ্বরচন্দ্র দিনে রাতে যখনই সময় পাচ্ছেন, পত্নীর সামনে এসে বসে থাকছেন। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে কিছুটা আরাম দিচ্ছেন রোগীকে। মাঝেসাঝে টুকিটাকি দুচারটে কথাবার্তা হচ্ছে। দীনময়ী ক্ষীণ স্বরে কথা বলছেন। মাথা ঝুঁকিয়ে বক্তার মুখের কাছে কান রেখে তিনি তা শুনছেন। যথাসাধ্য উত্তর দিয়ে স্ত্রীকে আশ্বস্ত করবার প্রয়াস করছেন। তিনি দিন গুনছেন, কতদিনে জার্মান দেশের জাহাজ কলিকাতায় এসে পৌঁছায়।
বৃটেনে তাঁর এক শুভানুধ্যায়ীর মাধ্যমে ওই ওষুধ জার্মান থেকে কিনিয়ে রওয়ানা করিয়েছেন। জাহাজ ছেড়েছে দিন সাত হল। এখনও দশদিন সময় লাগবে তা কলিকাতার ডকে এসে ভিড়তে। এদিকে দিনকে দিন দীনময়ীর অবস্থা সঙ্গিন হয়ে পড়ছে। এখন মাঝে মাঝেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে । দুঘণ্টা তিন ঘণ্টা ওই অবস্থায় থাকবার পর কিছু সময়ের জন্যে জ্ঞান আসছে। তখন খাওয়ানো নাওয়ানো, বাহ্যি পেচ্ছাব করিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
এরকম সময়ে একদিন ঈশ্বরচন্দ্র স্ত্রীর পাশে বসা। দীনময়ীর সামান্য জ্ঞান ফিরেছে। কষ্ট করে তিনি স্বামীর হাতটা নিজের হাতের মধ্যে টেনে নিলেন।
ইশারায় কিছু কথা বলবার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। দু চোখ তাঁর জলে ভরে উঠেছে । অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে দু কপোল বেয়ে। ঈশ্বরচন্দ্রের ধরা হাতখানা বক্ষের উপর তুলে নিলেন। নিজের হাত করজোড় করলেন। থরথর করে হাত কাঁপছে। চোখ বুঁজলেন। । প্রণামের ভঙ্গিমায় মাথা হেলালেন। অস্ফুট উচ্চারণে বললেন, আমাকে কথা দিন, আপনি নারায়ণকে ক্ষমা করবেন…
ঈশ্বরচন্দ্রর মাথা হেঁট হয়ে এলো।
ফের দীনময়ীর ঠোঁট নড়ে উঠল, আপনার কথা না শুনে আমি নিশ্চিন্তে মরতে পারব না।
কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল দীনময়ীর বোঁজা চোখের কোল বেয়ে। ঈশ্বরচন্দ্র হু হু করে কেঁদে ফেললেন। মাথা দুলিয়ে সায় দিলেন স্ত্রীর কথায়।
সেদিনই বেলার দিকে শ্বাস উঠতে শুরু করল দীনময়ীর। ভীষণ কষ্ট পাচ্ছেন। মৃত্যু যন্ত্রণা আর চোখ চেয়ে দেখা যাচ্ছে না। ঈশ্বরচন্দ্র স্ত্রীর মাথার কাছ থেকে উঠে ঘরের বাইরে গেলেন। বুঝতে পারছেন, শেষ সময় এগিয়ে আসছে। তবু মনকে মানাতে পারছেন না। অদ্ভুত একটা কষ্ট অনুভব করছেন বুকের মধ্যে। কাউকে প্রকাশ করতে পারছেন না। বারান্দায় পায়চারী করছেন। মাঝে মাঝে ঘরে ফিরে আসছেন। দীনময়ীর পাশে উপবেশন করছেন। মৃত্যুপথযাত্রী স্ত্রীর মাথায় হাতের স্পর্শ রাখছেন । সময় এগিয়ে চলেছে।
সারাটা বেলা একই ভাবে কাটল। তারপর এলো গোধূলি বেলা। অস্তমিত সূর্য ম্লান আলো ছড়িয়ে দিল চরাচরে ।…
ঘড়িতে টিক, টিক, টিক; সময় এগিয়ে চলেছে। প্রকৃতির আলোও একসময় নিভে গেল। ঘর এখন অন্ধকার। কে যেন একটা লণ্ঠন জ্বালিয়ে এনে দোরগোড়ায় রাখল। ঈশ্বরচন্দ্র দৃষ্টি রাখলেন দীনময়ীর শরীরে। বুক তখনও ওঠানামা করছে। অত্যন্ত ক্ষীণ হয়ে।
একসময় এভাবেই জীবনের অন্তিম শ্বাস এসে নাড়া দিয়ে গেল দীনময়ীর সর্ব শরীরকে। আহ…, একটা শুধু অস্ফুষ্ট শব্দ । তারপরেই মাথা ঢলে পড়ল । বোঁজা চোখ আর খুলল না।
ঘরের মধ্যে কান্নার রোল উঠল। মেয়ে, জামাতা, নাতি নাতনী, উপস্থিত অন্যান্যরা সকলে যখন হাপুস নয়নে কেঁদে চলেছে, ঈশ্বরচন্দ্র তখন কাঁদছেন মনে মনে। মাঝে মাঝেই কেঁপে উঠছেন । ভিতরটা গুমরে গুমরে উঠছে। জীবনভর ভালো মন্দ সুখ দুঃখ কতই না ঘটনার সাক্ষী থেকে সাথ দিয়েছে দীনময়ী; আর আজ তিনি একা। বড় একা হয়ে গেলেন। বাজীগর যেন তার যাদু দণ্ড খুইয়ে শক্তিহীন হয়ে পড়ল।
পত্নীবিহীন ঈশ্বরচন্দ্র দিনে দিনে ক্ষীণশক্তির মানুষে পরিণত হলেন। সব আশা, সব উদ্যমের জলাঞ্জলি ঘটল। শারীরিক দিক দিয়ে তিনিও ভেঙে পড়ার মুখে। রোগ তাঁর দেহেও স্থায়ী বাসা বেঁধেছে। তাঁকে ক্ষীণজীবী করে তুলতে থাকল।
জীবন থেকে পালাবার উপায় কারই বা থাকে? মানুষ তো চায় শেষ বিন্দু পর্যন্ত জীবনের পাঠ নিতে। জীবনকে বহমান করে রাখতে। কর্মযোগী মানুষের তখনও মনে হয়, কত কাজ বাকি রয়ে গেল। অসম্পূর্ণ কাজ কি সে শেষ করে যেতে পারবে? অথচ কাজের অন্ত থাকে না। ব্রহ্মযোগে মানুষ যদি সহস্রাধিক বছরের আয়ুযুক্তও হত, ঈশ্বর যোগে যদি সবল এবং কর্মঠ থাকত তখনও সে কাজের অশেষ রূপই দেখত। কাজের ধর্মই তাই। মানুষ চায় আরও কিছু কাজ করে যেতে। কী যে তার শেষ কাজ, তা কেউ জানে না। তবে সময়ই একদিন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, শেষ; এবার ক্ষান্ত দে ।
আফিং সেবনে ঈশ্বরচন্দ্রের মনে এমনই ঘোর এসে উপস্থিত হচ্ছে আজকাল। কাজ তার আফিং সেবনের মাত্রা বেড়ে গেছে। ভাবেন, কত কাজই তো করলেন। তবু যেন আরও কিছু বাকি। শরীর যদি সহায় হয়, তবে আরও কিছু করে যেতে চান।
এতকাল আফিং সেবন তাঁকে কাজে উদ্যোগী হবার প্রেরণা দিত। শরীরে শক্তি জোগাত। তবে এখন আর তা হচ্ছে না। আফিং নিলেই তিনি নিঝুম হয়ে পড়ছেন । লেখা-পড়া, কলেজ পরিদর্শন, কিছুই আর সেরকম ভাবে করতে পারছেন না। মন ভেঙে যাচ্ছে। শরীর তো ভাঙছেই, সঙ্গে মনও আর সাথ দিচ্ছে না। বুঝতে পারছেন, এতে দ্রুত তাঁর আয়ুর ক্ষয় হচ্ছে। তিনি বুঝছেন, তবু তা থেকে বিরত হতে পারছেন কৈ? লাইব্রেরীতে গিয়ে বসছেন, এ বই সে বই খুলছেন। অথচ বইয়ের অক্ষরে মন বসাতে পারছেন না। ঘুরে ফিরে আসছে, জীবনভর তিনি কী করলেন, আর কী তার প্রতিদান পেলেন। দেনা পাওনার হিসেব তিনি করতে চান না। না, জীবনে তিনি যা করেছেন তার মূল্যায়ন করবার তাঁর অভিপ্রায় রয়েছে; কিন্তু এত উদারতা, এত সদয়তা, বন্ধু-পরিবার-পরিজনের জন্যে নিঃস্বার্থ কর্ম, অন্তিমে কি শুধুই বঞ্চনার প্রাপ্তি ঘটালো? এই চিন্তা তাঁকে স্থির থাকতে দিচ্ছে না।
দীনময়ীর মৃত্যুর পরে বাদুরবাগানের ফাঁকা বাড়ি এখন যেন তাঁকে গ্রাস করতে আসে সব সময়। স্ত্রীর পারলৌলিক কাজ সারা হয়েছে বীরসিংহের বাড়িতে। নারায়নচন্দ্রই তা করেছে। সঙ্গে এবং পাশে ছিল পরিবারের অন্যান্যরা। কিন্তু সেখানেও তিনি অনুপস্থিত থেকেছেন। গ্রামে পা না রাখার জন্যে তিনি নিজেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কেমন করে যাবেন?
স্ত্রীর অন্তিম কাজে উপস্থিত না থেকে মনে কষ্ট পাচ্ছিলেন। আবার চলে গেলেন ফরাসডাঙ্গায়। সেখানের নিভৃতাবাসে বসে অবিরত উন্মুক্ত হাওয়া সেবন এবং গঙ্গা দর্শন, সঙ্গে চাকরের তত্ত্বাবধানে কিছুদিন কাটিয়ে অসুস্থ শরীরের কিছুটা উন্নতি করে ফেরবার বাসনা ছিল। কিন্তু তাও হল না। আসলে এখন তাঁর দরকার নিয়মিত ডাক্তারের তত্তব্বধানে থাকার। তা এই দূরের আবাসে থেকে হচ্ছে কৈ? ফলে আরও অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাড়াতাড়ি কলিকাতায় ফিরে এলেন। সেই একলা বাসের বাদুরবাগানের বাড়িতে এসে উঠলেন।
সেদিন লাইব্রেরী ঘরে এসে বসেছেন। প্রথম তো কিছু লেখার চেষ্টা করলেন। কলম সরল না। বই খুলে বসলেন। মন চঞ্চল। উঠে ঘরে গেলেন। নেশার বস্তু খেয়ে যদি কিছুটা শান্ত করা যায় নিজেকে। কিন্তু ঘরের টেবিল আলমারি আতিপাতি করে খুঁজেও আফিঙয়ের কৌটো উদ্ধার করতে পারলেন না। পরাবেন কী করে? ডাক্তারবাবু যে সে কৌটো হাতে করে নিয়ে চলে গেছেন, সেটাই মনে করতে পারছিলেন না। তা যখন পারলেন, হতাশ হলেন।
চিকিৎসা চলছে হাকিমের দ্বারা। তিনিই ওই বস্তুটি নিতে বারণ করেছিলেন। প্রথমে মুখে তা বলেছিলেন। তাতে বিশেষ কাজ না হওয়ায়, শেষমেশ কৌটোটাই তুলে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। সেটা করেছিলেন অবশ্য রোগীর অজ্ঞাতে; চাকরকে জানিয়ে। এরপর তো ঈশ্বরচন্দ্র ফরাসডাঙ্গায় চলে গেছেন। সেখানে আফিং সেবনের কথা মনে আসেনি। তবে আজ যেন সত্যিই তিনি আর স্থির থাকতে পারছিলেন না। তাই কৌটো খুঁজতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। তা না পেয়ে চাকরকে ডাকলেন। চাকর ঘরে আসতে বললেন, আমার কৌটাটা কোনচুলোয় ঢুকিয়ে রাখলি রে হারামজাদা?
-কোন কৌটোর কথা বলছেন!
চাকর যেন কিছুই জানে না। এমনভাবে কথাটা বলল। তিনি খিঁচিয়ে উঠলেন, কৌটো আবার কটা? জানিস তো, একটাই কৌটো আমি ব্যবহার করি। ওটায় আমার বিশেষ কিছু খাবার জিনিষ থাকে।
-তা আমি কী করে জানব, বাবু? আপনিই কোথায় রেখেছেন মনে করে দেখুন।
-মনে করে দেখুন…, মুখ বিকৃতি করে বলে কথা যোগ করলেন ঈশ্বরচন্দ্র। বললেন, আমার মনে থাকলে কি তোকে জিজ্ঞেস করতাম?
-সে তো ঠিকই বাবু। তবে দেখুন তা হয়তো কেউ হাতে করে নিয়ে গেছেন।
-বলিস কিরে! ও জিনিষ অন্যে নিয়ে কী করবে?
-বাবু, ডাক্তারবাবু কি ওটাই আপনাকে না খেতে বলছিলেন?
-ও, সবই জানিস দেখি। তবু না জানার ভাণ করছিস তুই। ছোঁড়া, যা ভাগ এখান থেকে।
চাকর মুখ লুকিয়ে হাসতে হাসতে সেখান থেকে চলে গেল। ঈশ্বরচন্দ্র পড়লেন মহা ফাঁপরে। একদিকে ডাক্তারের নিষেধ আফিং না খাবার; আবার এখন মনের এই অবস্থায়, তা না সেবন করলেই নয়। নিজেকে যে আর কোনও কাজেই লাগাতে পারছেন না। বিরক্তি ধরছে।
উঠে পড়লেন। গায়ে চাদর জড়িয়ে নীচে নামলেন। চটি গলালেন পায়ে। বেরিয়ে পড়লেন। চাকরকেও কিছু জানালেন না। পথে নেমে মেট্রোপলিটনের দিকে হাঁটা লাগালেন। কলেজ অন্ত প্রাণ তিনি। কতদিন পর আবার ওদিকে যাচ্ছেন।
চলায় সেই আগের গতি নেই। পা ফেলেছেন ধীরে ধীরে। কখনও বা শরীরটা টলছে; কখনও হাত নড়ে মাথার ওপর ধরা ছাতাটা দুলছে। ভাবছেন, এভাবে কি এতটা পথ যেতে পারবেন? কিন্তু মনে জোর রেখে শরীর হাত পা বশে এনে এগিয়ে চলেছেন। পথে চেনাশোনা মানুষের সঙ্গে দেখা হলে, তাঁরা ঈশ্বরচন্দ্রকে কুশল জিজ্ঞাসা করছে । দু এক কথায় তাঁদের কথার জবাব দিয়ে আবার এগিয়ে চলেছেন।
এই করতে করতে কলেজে এসে পৌঁছলেন। তাঁর আগমনে কলেজ অধ্যক্ষ নিজে ছুটে এসে তাঁকে সমাদরে ভিতরে নিয়ে গেল। ঈশ্বরচন্দ্র আজ আর নিজের জন্যে কলেজে নির্দিষ্ট কক্ষে গিয়ে বসলেন না। অধ্যক্ষকে বললেন, চল, আজ তোর ঘরে গিয়ে বসব।
আসুন, আসুন স্যার, করে সেখানেই নিয়ে গেল অধ্যক্ষ। জামাতা সূর্যকুমারকে কলেজ অধ্যক্ষের পদ থেকে অপসারিত করবার পর নতুন অধ্যক্ষ বহাল হয়েছে। ঈশ্বরচন্দ্রের পছন্দের ব্যক্তি এই নতুন অধ্যক্ষ। পূর্ব পরিচিতও বটে। তাই তাঁকে ‘তুই’ ‘তোকারি’ করে সম্বোধন করেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বসলেন। জল পানের ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। অধ্যক্ষ নিজে হাতে ঘরে রাখা কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে গ্লাস ভরতি করে এনে তাঁর হাতে দিল। এক নিঃশ্বাসে সবটুকু জল পান করে তিনি কথা শুরু করলেন। অধ্যক্ষই প্রথম কথা বলল, এবার অনেকদিন পর এলেন মাস্টারমশাই । শরীর ভালো আছে তো?
নিজের দেহের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, দেখে কী মনে হচ্ছে?
-দেখে খারাপ লাগছে, আগের থেকে এখন আপনার শরীর অনেক ভেঙে গেছে। এই অবস্থায় এলেন কেন? যদি কিছুর প্রয়োজন ছিল, আমাকে ডেকে পাঠাতে পারতেন। আমিই চলে আসতাম আপনার বাড়ি।
-সে তো ঠিক বলেছিস। তবে কী জানিস, নিজের বানানো এই মন্দিরটায় পা রেখে যে আনন্দ হয়, চর্ম চক্ষুতে দেখে যে শান্তি পাওয়া যায়, তা কি আর বাড়ি বসে পাওয়া যায়?… তা যাক, ছাত্ররা সব কলেজে আসছে তো?
-তা আসছে। রোলকল অনুযায়ী রোজই কলেজে সাতশ’র মতো ছাত্র আসছে।
-কোনও ছাত্র একাধিক দিন অনুপস্থিত থাকলে তার বাড়িতে লোক পাঠিয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে তো? এটা কিন্তু একেবারে আবশ্যিক। এই বয়সের ছেলেদের বাইরে আড্ডা মেরে সময় কাটানোর একটা প্রচেষ্টা থাকেই। পরে বাড়ির লোক তা জানতে পারলে কলেজের দুর্নাম দেয়। তা যেন না হয়, খেয়াল রাখবি। কলেজ অধ্যক্ষ হিসেবে এটা তোরই দেখার কথা।… হ্যাঁরে, আইন ক্লাস ঠিক মত হচ্ছে? নতুন কোনও শিক্ষককে নিয়োগপত্র দিয়েছিস, নাকি একলা ওই মধুসূদনবাবুকে দিয়েই কাজ সারছিস?
-মাস্টারমশাই, আপনার অনুমতি ব্যতিরেকে নতুন শিক্ষক নেওয়া হয়নি।
-এ কেমন কথা? আজ আমি আছি। কাল তো নাও থাকতে পারি। তাই বলে নিজে কোনও সিদ্ধান্ত নিবি না? না, না। এটা ঠিক করিসনি। এই আজ আমি বলে গেলাম। সাত দিনের মধ্যে নতুন একজন শিক্ষককে বহাল কর। এমনিতে আইনের শিক্ষক না পেলে সুপ্রিমকোর্টের বার লাইব্রেরিতে চলে যাবি। সেখানে গিয়ে কোনও অভিজ্ঞ এ্যডভোকেটের সঙ্গে কথা বলবি…,
কথার মাঝ পথে থেমে গেলেন ঈশ্বরচন্দ্র। চুপ করে রইলেন। কপালে ভাঁজ দেখা গেল। কিছু ভাবলেন মনে হয়। চোখ বন্ধ করে দু তিনবার মাথা ঝাঁকুনি দিলেন। পরে বললেন, হাইকোর্টের নামী উকিল দ্বারকানাথ মিত্র মশাইয়ের কাছে গিয়ে আমার নাম নিয়ে বলবি, আমি বলেছি, এক বা দু তিনজন অভিজ্ঞ উকিল যাঁরা এজলাসে নিয়মিত সওয়াল জবাব করে, তাঁদেরকে জোগাড় করে দিতে । পূর্ণ সময়ের জন্যে না হলেও, তাঁরাও যদি মাঝেমধ্যে এসে ক্লাস নেয়, তাতে বরং বেশি উপকার হবে। পারিশ্রমিক যে যেমন চাইবে দিয়ে দিবি। আমার অনুমতি রইল। বুঝলি?
অধ্যক্ষ ঘাড় নেড়ে ঈশ্বরচন্দ্রের কথায় সায় দিল। বলল, কালকেই আমি যাচ্ছি । আর এ হলে, আপনাকে আমি নিজে গিয়ে জানিয়ে আসব।
ঈশ্বরচন্দ্র এবার কলেজের আয় ব্যয়ের বিষয়ে জানতে চাইলেন। বললেন, এ বছরের হিসেব সমাপ্ত করেছিস?
-করেছি, মাস্টারমশাই।
-হিসাব পরীক্ষকে দিয়ে তা যাচাই করে চ্যাটারড এ্যকাউন্টেকে সইসাবুদ করিয়ে নিবি। কৈ, নিয়ে আয় তো দেখি।
চলবে…
ছবি- পিন্টারেস্ট, গুগল