উপন্যাস।। আবার এসো ফিরে।। রামেশ্বর দত্ত

ঈশ্বরচন্দ্র ভাবলেন, প্রত্যেকেরই সন্তানরা বড় হয়েছে। তারা তাদের মা, বাবাকে এমন কূটকচালি করতে দেখলে, নিজেরা কী শিখবে? নিজের দুই মেয়ের এখনও বিবাহ দেওয়া বাকিতারা বাড়িতে রয়েছেদীনু, শম্ভু, ঈশান, তাদের ছেলেমেয়েরাও রয়েছেএরপর ভাইবোনদের মাঝেও ওই রোগ এসে উপস্থিত হবে। তখন?…তার থেকে, এটাই উপযুক্ত সময়, ভাই-ভাইয়ের  হাঁড়ি আলাদা করে দেওয়াএর জন্যে দরকার প্রত্যেকের আলাদা বাস। বাসস্থান আলাদা হলে, কাছাকাছি, পাশাপাশি থাকবে। নিজের নিজের সংসার নিজে সামলাবে। তাতে না আসবে কাজের ভাগ বাটোয়ারা, না আর্থিক বিষয়ে মন কষাকষি। নিজেদের মধ্যে সদ্ভাবও থাকবে।  

  তিনি নিজে তো আর বীরসিংহ গ্রামে যাবেন না। ভাইদেরকেই কলিকাতায় ডেকে পাঠালেন। তাঁরা এলেন।  আলাদা বসতবাটির প্রস্তাব রাখলেন তাদের সামনে। এবার যা হয়। প্রশ্ন উঠল, টাকা কোথায় নিজের নিজের বাড়ি বানাবার? –আমি টাকার জোগান দোবো। কাজটা তোরা করবি, ঈশ্বরচন্দ্র বলে উঠলেন।

  দাদার এ কথায় ভিতরে ভিতরে তারা খুশী হলেও বাইরে দেখাল, সংসার আলাদা করতে কতই যেন দুঃখ তাদের। মুখ শুকনো করে রাখল।

এরপর… 

পর্ব- ২৮ 

ঈশ্বরচন্দ্র এখন এসব বিষয় ভালই বোঝেন। আগের দিন হলে, সহোদরদের এ প্রস্তাব দিতেন না; আর বাধ্য হয়ে তা দিলেও ওদের ওই শুকনো মুখ দেখে দুঃখে গলদশ্রুলোচনে নিজের প্রস্তাব নিজেই গলাধঃকরণ করতেন। তবে এখন আর সে অবস্থা নেই। ওরাই নিজেদের নানান স্বার্থপর আচরণে তাঁর মন ভেঙে দিয়েছে। দৃষ্টিপতন ঘটিয়েছে তাঁদের প্রতি।

ঈশ্বরচন্দ্র টাকার জোগান দিলেন। সহদোররা নিজের নিজের বসতবাড়ি বানিয়ে নিল। সবই হল গ্রামে। ঈশ্বরচন্দ্র নিজের জন্যে বাড়ি বানালেন না। আদি বাড়িতেই পরিবারকে রেখে দিলেন।

প্রথম কাজটা এবার পরে ধরলেন। সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারার জন্যে উকিলকে দিয়ে উইল লেখা করাচ্ছেন। উইল লিখছে হাইকোর্টের এক নামজাদা উকিলের মুহুরি। বাড়িতে বসেই কাজটা সারছেন।

নিজের পরিবারের যার যা ভাগ তাকে দিলেন; শুধু বাদ রাখলেন পুত্র নারায়নচন্দ্রের নাম। উইলে তাকে ত্যাজ্যপুত্র হিসবেই লিখতে বললেন।

বিষয়টা জানাজানি হতে দীনময়ীর তরফ থেকে প্রথম চোটপাট দেখানো হল। স্বামীকে বললেন, এভাবে নিজের ছেলেকে আপনার সম্পত্তির  উত্তরাধিকার হওয়া থেকে  বঞ্চিত করে দিতে পারেন না। আইনে কি একথা লেখা আছে?

দীনময়ীর কথায় ঈশ্বরচন্দ্র গুরুত্ব না দিয়ে উত্তর করলেন, যা করছি, ভেবেচিন্তেই করেছি।

দীনময়ী এখন কলিকাতায়।

তিনি উত্তর করলেন, -ছেলের প্রতি এত নির্দয় হলেন কেন? সে এমন কী অপরাধ করেছে, যে তাকে ত্যাজ্যপুত্র হিসেবে সম্পত্তির ভাগ থেকে বাদ দিয়ে উইল করছেন?

-আমাকে  প্রশ্ন করার আগে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করো দীনময়ী, সে কী করেনি। বলেই  নিজের কথার ফিরিস্তি দিতে থাকলেন। বললেন, যে বীরসিংহে একদিন ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে লোক মাথা নত করত, আজ সেখানে তিনি তো গ্রাম ছাড়া হয়েছেনই, আমাকেও সে গ্রাম ছাড়া করেছে। এ যে আমার কাছে কী কষ্টের, তা কি তুমি বোঝ না?

কথা বলতে গিয়ে ঈশ্বরচন্দ্রের গলা ধরে আসছিল। তিনি সেখান থেকে উঠে যাবার মতো অবস্থায়। দীনময়ীই তাঁকে জোর করে বসালেন।

দুজনের কথা হচ্ছিল ঈশ্বরচন্দ্রের শোবার ঘরে বসে। স্বামীর বাদুরবাগানের  নতুন বাড়িতে উঠেছেন। সঙ্গে দুই মেয়েকেও নিয়ে এসেছেন। এখানে কিছুদিন থাকবেন তার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন। গ্রামে বসে স্বামীর শরীর খারাপের খবর পেয়ে তিনি এসেছেন।

ঈশ্বরচন্দ্র এই সময়েই ইচ্ছে করে উইলটা করাচ্ছেন, যাতে উইলের সবকিছু দীনময়ীর গোচরে থাকে। তাঁর শরীরের কথা বলা বলা তো যায় না। শরীর এখন এতই খারাপ যে যখন তখন যা কিছু হয়ে যেতে পারে। তাও, এই কলিকাতায় এসে থাকলেই এই কান্ড হচ্ছে। তাই তো কর্মাটাঁড় ছেড়ে থাকতে চাইছেন না। সেখানে থাকলে পেটের গোলমাল দূর হয়ে যায়। রাতে ঘুম ভালো হয়। আর এখানে…

  ঈশ্বরচন্দ্র বসলেন। সামলেও নিলেন নিজকে। পরে দীনময়ীকে বোঝাতে সচেষ্ট হলেন, নারায়ণচন্দ্র ভবিষ্যতে কী হবে, তা তিনি দূরদৃষ্টি দিয়ে বুঝতে পারছেন।

-আপনি নিজের ছেলেকে যতটা বিচার করছেন, কৈ বাইরের লোককে সাহায্য করবার সময়ে তা করেন না তো?

দীনময়ী কথাটা অভিযোগ জানাবার মতো করে বললেন। ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, দীনময়ী, আমি যা করছি তা তোমার ভবিষ্যতকে সুরক্ষিত রাখবার জন্যেই। এটা ভেবো, এ কাজ করতে গিয়ে আমিও মনে কম কষ্ট পাচ্ছি না।

-কষ্টই যদি পান, সে কাজ না করলেই কি নয়? আর আমার ভবিষ্যতের কথা বলছেন, আপনিই কি জানেন, আমি, না আপনি, কে আগে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে? আমিও তো আপনার আগে চলে যেতে পারি।

-আমায় এভাবে দুর্বল করে দিও না, দীনময়ী। সত্যিই যদি তোমার কথাই ফলে, তাহলে, আর তোমাকে চোখে আঙুল দিয়ে সেদিন দেখানো সম্ভব হবে না, আমাদের ছেলে কতখানি স্বেচ্ছাচারী , কতখানি অর্থপিপাসু, সম্পত্তিলোভী। ভবিষ্যতে আমার সারা জীবনের কষ্টার্জিত অর্থ, প্রতিষ্ঠান, এসব নিজ অধিকারে নিয়ে, কী ভাবে তা বিনষ্ট করবে, তা এখনই আমি দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি।

-হ্যাঁ, আপনি বড় ভবিষ্যৎ দৃষ্টা হয়ে গেছেন কিনা…

দীনময়ী তাঁর কথা মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে চোখের জল মুছতে শুরু করলেন। তাঁর একটিই মাত্র পুত্র সন্তান, আর তার প্রতি পিতার এমন আচরণ তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। আবার এর প্রতিকারও নিজের হাতে নেই। তাই কান্নাকাটি করে, মনস্তাপ দেখিয়ে যদি স্বামীর মন পরিবর্তন করতে পারেন।

ঈশ্বরচন্দ্র কিন্তু আদৌ দুর্বল চিত্তের ব্যক্তি নন। তিনি অবশ্যই নিজের সন্তানের মলিন চরিত্রের আগাম আভাষ পেয়েছেন বলেই নিজের অবর্তমানে বিষয় সম্পত্তিকে সুরক্ষা দেবার জন্যে পুত্রের প্রতি এতখানি বিরুদ্ধাচরণ করলেন। তিনি যা ভেবেছিলেন, উইল করার বিষয়টা সেভাবেই সেরে ফেললেন। এমনকি তাঁর প্রদত্ত মাসিক বৃত্তি থেকেও নারায়ণকে বঞ্চিত করে দিলেন।

  কী কঠিন এ বিচার! কাজীর বিচারে যদিবা পুনর্বিচারের আশা থাকে, এ বিচারে তাও বন্ধ। ভগবানের মতো মানুষ ঈশ্বরচন্দ্রও যে নিজের বিচারে সঠিক ছিলেন, তা, না তিনি, না দীনময়ী চাক্ষুষ করতে পেরেছেন, কালই তার প্রমাণস্বরূপ নারায়ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কৃত  কর্মের সাক্ষী থেকে গেছে।

বাদুরবাগানের বাড়ির নির্মাণ কাজ তখনও চলছে, ঈশ্বরচন্দ্র সেই অবস্থায় বিনোদিনী, মানে তাঁর তৃতীয় কন্যার বিয়ে দিলেন। পাত্র ফরিদপুরনিবাসী সূর্যকুমার অধিকারী, হেয়ার স্কুলের শিক্ষক। ভালো ছেলে। এক তো  কন্যার প্রতি টান, তায় সূর্য এখন নিজে কলিকাতাবাসী। ঈশ্বরচন্দ্র ভীষণ খুশি হলেন, দুজনকে নিজের কাছে চোখের সামনে রাখতে পেরেছেন। সেই আনন্দে জামাইকে স্কুল চাকরি থেকে ইস্তফা করিয়ে নিজের মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশনে নিয়ে এলেন। কলেজ সুপারিন্ডেন্ট পদে বহাল করলেন।

বিগত ক’টা বছর নানান ঝড়ঝাপটা সামলে এখন বাদুরবাগানের নতুন বাড়িতে থিতু হয়ে ঈশ্বরচন্দ্র অনেকটা সুখ পাচ্ছেন। সঙ্গে দীনময়ী, আর অবিবাহিতা ছোট কন্যা, শরৎকুমারী।

বিধবা হওয়া ইস্তক বড় মেয়ে হেমলতা মায়ের কাছেই এসে থাকছে।  হেমলতা তাঁর দুই পুত্র, সুরেশ ও যতিকে নিয়ে বাবার কাছে এসে উঠেছে। এছাড়াও তো রয়েছে বিনোদিনী আর জামাতা, সূর্য। সকলকে নিয়ে সুখে দিন কাটছে ঈশ্বরচন্দ্রের। তবে মাঝে মধ্যেই স্ত্রীর ওপরে বিরক্ত হচ্ছেন, নারায়ণের প্রতি তাঁর দুর্বলতার জন্যে। এই নিয়েই একদিন স্ত্রীর সঙ্গে বচসা শুরু হল। দীনময়ীকে দোষারোপ করে বললেন, তুমি দেখি ছেলের কাছে আমার নাক কাটছ, দীনময়ী।

-হ্যাঁ, আপনার উঁচু কপালের মতো, নাকও তো অনেক উঁচু, তাই তা কাটবার বাসনা হয়েছে আমার। কী যে আজেবাজে কথা বলেন আপনি!

-কেন, লুকিয়ে লুকিয়ে ছেলেকে টাকা দাওনি তুমি?

-ছেলের মাসহারা বন্ধ করে দিলেন তো তার চলবে কোথা থেকে?

-সেটা তাকেই বুঝতে দাও না। আমি যেখানে তার প্রতি কঠোর হচ্ছি, সেখানে তুমিই তো তাকে প্রশ্রয় দিচ্ছ।

-হতেন সন্তানের জননী, দশ মাস, দশ দিন গর্ভে ধরে সন্তানের জন্ম দিতেন, তাহলে বুঝতেন, ছেলের জন্যে মায়ের প্রাণ কেন কাঁদে…

  দীনময়ীর নাক টানার শব্দ পাওয়া গেল। ঈশ্বরচন্দ্রের মনটা সামান্য টললেও নিজের প্রতি অবিচল থেকে অন্য অভিযোগ আনলেন স্ত্রীর প্রতি। বললেন, কাকে জিজ্ঞেস করে হাতের বালাখানা বিক্রি করলে?

দীনময়ী ধরা পড়ে গেছেন। আরও অবদমিত হবার হাত থেকে বাঁচতে বলে উঠলেন, বেশ করেছি। আমার গয়না, আমি বেচেছি। সেই টাকা ছেলেকে দিয়েছি,…আর আপনি যে দুহাতে একে ওকে টাকা বিলোন?

কথাটা ঈশ্বরচন্দ্রের গায়ে লাগল। তিনি বলে উঠলেন, আমার উপার্জন থেকে আমি তা দিই, অন্যের দান নেওয়া বস্তু আমি দিই না।

-এতবড় অপবাদ আপনি আমাকে দিতে পারলেন? আমি না আপনার বিবাহিতা স্ত্রী?

-স্ত্রী বলেই বলার অধিকার আমার রয়েছে। অন্যায়কে আমি প্রশ্রয় দিই না। ছেলে অন্যায় করেছে, তাকে ক্ষমা দেখাবর মতো মন আমার নেই।

দীনময়ী ঢাল করলেন নারায়ণের স্ত্রীকে। বললেন, আজ ছেলের নামও আপনি মুখে নিতে চাইছেন না। তবে, সেই মেয়েটা কি দোষ করল, যাকে একদিন পুত্রবধূ করে ঘরে নিয়ে এসেছিলেন? ছেলেমেয়ে নিয়ে কি সে এবার অত্মহত্যা করবে? আপনি তো বিধবাদের জন্যে অনেক করেন। দেশজোড়া নাম আপনার, আর নিজের ঘরেই প্রদীপের নিচে অন্ধকার?

এতক্ষণে ঈশ্বরচন্দ্র রুখে দাঁড়াবার জায়গা পেলেন। কঠিন ছিলেন, আরও কঠিন হলেন। স্থান ত্যাগ করে তৎক্ষণাৎ বিনোদিনীকে দিয়ে সূর্যকুমারকে ডাকা করালেন। বিনোদিনীকেও ফিরে আসতে বললেন। দুজনে সামনে এলে, তাদেরকে একরকম আদেশই করলেন, যত শীগিগীর সম্ভব বীরসিংহ গ্রামে যাও, সেখান থেকে তোমার বউদি আর  ভাইপো ভাইজীদের দিন কয়েকের জন্যে এখানে নিয়ে এসো। বলবে, আমি তাদের আসবার কথা বলেছি।…এই নাও, আমি তোমাদের যাওয়া আসার জন্যে টাকা দিলাম।

ঘরের তাকে রাখা একগোছা টাকা সূর্যকুমারের হাতে দিয়ে দিলেন।

কাজটা বেশ রাগত হয়েই করলেন। দীনময়ী কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। হাত তুলে তাঁকে বিরত করলেন। তারপর ঘর ছাড়লেন। তার পায়ে পায়ে বিনোদিনী আর সূর্য, দুজনে এগিয়ে গিয়ে বলল, যে আজ্ঞে, বাবা। আমরা দুজনে কালকেই বীরসিংহে যাচ্ছি। আপনি স্থির হয়ে বসুন গিয়ে।

এতক্ষণ তাঁরাও বাবা-মায়ের কথোপকথন শুনছিল। তাই বিশেষ কিছু আর তাদের জানবার প্রয়োজন হল না।

চার দিনের মাথায় বিনোদিনী তাঁর বউদি আর ভাইপো, ভাইজীকে নিয়ে ফিরল।  শ্বশুরমশায়ের ডাক পেয়ে ভবসুন্দরী এসেছ। জানে না, কিসের জন্যে এই ডাক?

ভবসুন্দরীর দুটো দিন কাটল শাশুড়ি, ননদের সঙ্গে গল্পে গল্পে। খাওয়া, শোওয়া আর গল্প। সারাদিনের এই কাজ। কেউই কিছু বলে না। এমনকি শ্বশুরমশাইও নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে থাকেন। দেখা হলে কদিচ কখনও একটা দুটো কথা হয়। তবে কাজের কথা কিছুই নয়। এইসময়ে একদিন দুপুরবেলা ঈশ্বরচন্দ্র দীনময়ীকে নিজের ঘরে ডেকে এনে বসালেন। একটু পরে সেখানে ভবসুন্দরীর প্রবেশ ঘটল। আগে তাকেও ঘরে আসবার কথা বলে এসেছিলেন তিনি।  কথা শুরু হল। প্রথম কথা ঈশ্বরচন্দ্র বললেন। প্রশ্ন করলেন পুত্রবধূকে, তোমরা সকলে কেমন আছো?

ভবসুন্দরীর উত্তর, ভালই আছি বাবা।

-খেতেদেতে পাচ্ছ তো?

-কোথায়, এখানে?

-না,না। এখানে তো পাবেই। আমার এখানে খাওয়া দাওয়ার অভাব হয় না। আমি জিজ্ঞেস করছি, গ্রামের বাড়িতে যখন থাকো।

-কেন, আপনি তো মাসে মাসে টাকা পাঠান। তা দিয়ে ঠিকই চলে যাচ্ছে।

 ঈশ্বরচন্দ্র একবার তির্যক দৃষ্টি দিলেন স্ত্রীর দিকে। দীনময়ী মুখ ঘুরিয়ে বসে রয়েছেন। পুত্রবধূকে পরের প্রশ্ন, ছেলেমেয়ের লেখাপড়ায় যা খরচ হচ্ছে, তা আমার পাঠানো টাকা দিয়ে চলে যাচ্ছে তো?

-সে আর কতটুকু খরচা। সব চলে যাচ্ছে। আপনি এসব নিয়ে চিন্তা করছেন নাকি, বাবা?

সরল মনে ভবসুন্দরীর কথা। ঈশ্বরচন্দ্র দীনময়ীর দিকে হাত তুলে দেখিয়ে বললেন, না, না। আমি করছি না। করছেন উনি। তোমার শ্বশ্রূমাতা । তোমাদের নাকি দিন চলছে না, তাইতে ওনার দিনরাতের ঘুম উড়ে গেছে…

-কী যা তা বলে যাচ্ছেন ছোট ওই মেয়েটার সামনে?  দীনময়ী খনখন করে উঠলেন।

ঈশ্বরচন্দ্র নির্লিপ্ত। তিনি বলতে থাকলেন, ভবসুন্দরী আর ছোট নেই, ও এখন দুটো সন্তানের মা; সংসার চালাচ্ছে।

স্বামীর কথার উদ্দেশ্য তিনিই , দীনময়ী তা ভালোরকম বুঝছেন। এও বুঝছেন, আজ বউমাকে দিয়ে প্রমাণ করালেন যে তিনি ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করলেও, তার পরিবারকে উপবাসে রাখেননি। নিয়মিত অর্থের যোগান দিয়ে যাচ্ছেন। ঈশ্বরচন্দ্রের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে উঠলেন, যা বলবার,স্পষ্ট করে বলুন। অত ভণিতার কথা আমার শুনতে ভালো লাগছে না।

-বউমা, করে, ডাক দিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র ভবসুন্দরীকে বললেন, টাকা তুমি কি ভাবে পাচ্ছ, তা ওনাকে জানিয়ে নিশ্চিন্ত করো।

-কেন? আপনি তো পত্র মারফৎ টাকা পাঠান।

-পত্র কার নামে যায়?

-আমার নামে।

এবার ঈশ্বরচন্দ্র দীনময়ীকে সরাসরি আক্রমণ করে বসলেন। বললেন, এরপরেও নারায়ণ তোমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যাচ্ছে। তুমি তাকে টাকা যোগাচ্ছ নিজের গায়ের অলঙ্কার বিক্রি করে! আশ্চর্য হচ্ছি আমি। ছেলে তো উচ্ছন্নে গেছেই, এবার তাকে নরকের পথ তুমিই দেখাচ্ছ, দীনময়ী। এর ফল তোমাকেই ভুগতে হবে। আমি কিন্তু ড্যাং ড্যাং করে চলে যাব। ছেলে তোমাকে ভাত কাপড় না দিলে, তখন আমার কথাগুলো মনে কোর…

-ওগো, আমার কেন মরণ হয় না…, বলে, দীনময়ী হাতের শাঁখা, নোয়া কপালে ঠুকে কাঁদতে শুরু করলেন। ভবসুন্দরী প্রথমটা ঘাবড়ে গেলেও, পরক্ষণে উঠে গিয়ে দীনময়ীর কাছে পৌঁছল। তাঁকে জড়িয়ে ধরল। বলতে থাকল, মা, এরকম করবেন না, মা…

-ওরে, আমি কী ছেলে পেটে ধরেছিলাম?…, আমার যে মরলে তবে শান্তি হবে…

চলবে… 

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page