উপন্যাস।। আবার এসো ফিরে।। রামেশ্বর দত্ত
নারায়ণ বাবাকে পত্র দিল। দেখুন, আমার এমন কোনও গুণ নাই যে আপনার মুখোজ্জ্বল করি, তবে আপনার জীবনের মহৎ ব্রত, বিধবাবিবাহ প্রচলন করে , বাল-বিধবার ভীষণ বৈধব্যযন্ত্রণা দূর করা। এ অধম সন্তানের তা অবশ্য সাধ্যায়ত্ত। আমি তাতে পশ্চাদপদ হব না। তাতে আপনাকে কতকটা সন্তুষ্ট করতে পারলেই আমার জীবন ধন্য হবে, আর তাহলে বোধ হয়, আপনার সদভিপ্রায়ের বিপক্ষবাদীরাও সন্দিহান হতে পারবে না।
এরপর…
পর্ব-২৩
পত্র পাঠে উল্লসিত হলেন ঈশ্বরচন্দ্র। এ ভার তিনি মনে অনেকদিনই বহন করে চলেছেন। পরের সন্তানদের ধরে ধরে বিধবা কন্যাদের সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছেন আর নিজের সন্তানের বেলায়…, লোকে কী ভাবত? নারায়ণ অন্য আর যা কিছু হোক, অন্ততঃ এ বিষয়ে তাঁর ভার মুক্ত করল।
তবে আপত্তি উঠেছে বাড়িতে। ভাইদের আপত্তি। অনেকের মন দোলাচলে। শম্ভুচন্দ্র দাদাকে নানান বিষয় অবগত করে বাড়ির আপত্তির কথা জানালেন। সকলের প্রতিনিধি হয়ে তিনিই চিঠি লিখলেন।
চিঠি হাতে পেয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বারবার চিঠিখানা পড়ছেন আর মনটা তাঁর ভারী হয়ে উঠছে। গম্ভীর হয়ে গেলেন। বিনা বাক্য ব্যয়ে দিন কাটাচ্ছেন। মাথায় নানান চিন্তা আসছে। কখনও ভাবছেন, সকলের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে একাজ করলে, দম্পতির ভবিষ্যত কি ভালো হবে? আবার পরক্ষণে মানছেন, বাড়ির মত মানতে গেলে নিজের কর্তব্য , আদর্শের কাছে তিনি হেরে যাচ্ছেন। মন তাতে সায় দিচ্ছে না। এছাড়াও নারায়ণ নিজে থেকে যেখানে সিদ্ধান্ত নিয়েছে , সেখানে এই বিয়ে বন্ধ হলে, নারায়ণের মনে আঘাত আসতে পারে।
মানুষের মনের দোলাচল বোধ হয় ততক্ষণ আসে না, যতক্ষণ না তা মনের সুস্থিত অবস্থাকে সমূলে নাড়া দেয়। আর তখনই কঠিন হয়ে পড়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া। তা সে ঈশ্বরচন্দ্রের মতো শক্ত মনের মানুষের ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য হল। তবে তিনি এক চিন্তার মানুষ। তাই দেরী না করে নারায়ণের বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে ফেললেন। দিনটা ২৭ শে শ্রাবণ। নারায়ন এবং ভবসুন্দরী সহ তাঁর পরিবারকে কলিকাতায় আনিয়ে নিয়েছিলেন। বিয়েও হয়েছে কলিকাতায়। মির্জাপুরে । সুহৃদ কালীচরণ ঘোষের বাড়ি থেকে। বিয়ের অনুষ্ঠান যতদূর সম্ভব কম আড়ম্বরে সেরেছেন। কিছু চেনাজানা গণ্যমান্য ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ করে বিয়ের সাক্ষী করে রেখেছেন।
শেষে শম্ভুচন্দ্রকে তার চিঠির সমুচিত প্রত্যুত্তর লিখলেন ৩১ শে শ্রাবণ,
নারায়ণ যে কাজ করছে, তাতে সে আমার মুখ উজ্জ্বল করছে। সে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এ কাজ করছে। তাতে যদি বাধ সাধি, তাহলে আমি খুবই অন্যায় করব। আর তার বিধবা বিয়ের ফলে, তুমি আত্মীয় পরিজনদের সম্বন্ধে লিখেছ, আমাদের কুটুম্ব মহাশয়রা আহার ব্যবহার পরিত্যাগ করবেন, তায়ে ভয় পেয়ে যদি নারায়ণকে তার অভিপ্রেত কর্ম থেকে বিরত করি, তাহলে আমা অপেক্ষা নরাধম আর কেউ হবে না। আমি দেশাচারের নিতান্ত দাস নই, নিজের বা সমাজের মঙ্গলের জন্যে যা উচিত বা আবশ্যক বোধ করব, লোকের বা কুটুম্বের ভয়ে বা অন্য কোনও কারণে নারায়ণের সঙ্গে আহার বিহার করতে যাদের সাহস ও প্রবৃত্তি না হবে, তারা স্বচ্ছন্দে তা রহিত করবেন। এর জন্যে নারায়ণ কিছুমাত্র দুঃখিত হবে, তা আমার মনে হয় না এবং আমিও তার জন্যে বিরক্ত বা অসন্তুষ্ট হব না। আমার বিবেচনায় সকলেই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র , অন্যের ইচ্ছার অনুবর্তী বা অনুরোধের বশবর্তী হয়ে চলা কারোও উচিত নয়।
লোক মারফৎ চিঠি পাঠিয়ে দিলেন।
মনে কষ্ট হল। দীনময়ীকেও জানাতে পারলেন না কিছু। ভুল করলেন। মনে করেছিলেন, বাড়ির অন্যান্যদের মতো দীনময়ীও বোধ হয়, ছেলের এই বিয়েতে অসন্তুষ্ট হচ্ছে। তবে সেটা ছিল ভুল ধারণা। দীনময়ী সেই যে স্বামীকে বলেছিলেন, তুমি গ্রাম ত্যাগ করলে, আমিও বাবার কাছে চলে যাব, কথাটা নিছক কপট অভিমানের ছিল না। সত্যি সত্যিই তিনি তা করে দেখিয়েছেন। ছিলেন বাপের বাড়িতে। তাঁকে কোনও খবরও দেওয়া হয়নি। পরে যখন তিনি জানলেন, অত্যন্ত কষ্ট পেলেন। তিনি নিরক্ষরা বটে, তবুও কোন মা-ই বা চায়, গর্ভের সন্তানের বিবাহে অনুপস্থিত থাকতে? আগে থেকে জানলে কি তিনি কলিকাতাতেই এসে হাজির হতেন না? অবশ্যই হতেন। মায়ের সঙ্গে সন্তানের নাড়ির যোগ, এ তো স্থল-জল-আকাশ–বাতাস-অন্তরিক্ষের মতোই চিরন্তন সত্য।
দীনময়ীও পারলেন না। সংবাদ পেয়ে ছুটে এলেন কলিকাতায়। পশ্চাতে পড়ে রইল রাগ, অভিমান, বাপের বাড়ি। স্বামীর সামনে এসে কেঁদে পড়লেন। বারবার অভিসম্পাত দিতে থাকলেন নিজের ভাগ্যকে। তবুও নারীর সদ্গুণে না পারলেন স্বামীকে দূরে সরিয়ে রাখতে; না, ছেলের সংস্রব ত্যাগ করতে। শুধু পতিদেবতার প্রতি বিশ্বাসে মনে অকিঞ্চিৎকর চিড় ধরে গেল।
ঠাকুরদাস কাশীতে বসে কোনও কিছুরই খবর পাচ্ছেন না। না পেলেন গ্রাম ছেড়ে ঈশ্বরের চিরতরে চলে যাওয়ার খবর; না তাঁর প্রিয় নাতির বিয়ের। ঘটনাগুলো সবই আকস্মিক ঘটে গেছে।
সংসারকে যে উপেক্ষা করে, সংসারও তাকে ঘটনাকালে ভুলে থাকে। এটাই সংসারের নিয়ম। ঠাকুরদাস খবর পেলেন অনেক পরে।
ঘটনা জানলেন। একলা কাশিতে বসে ভাবলেন, সংসারকে তো তিনি পিছনে ছেড়ে রেখে এসেছেন। তবে কেন আর চিন্তা? তবুও মানুষের মন। নিত্যকার ঘটে যাওয়া ঘটনা মনে দাগ না টানলেও দুর্ঘটনা, বা অতি সুখের ঘটনা, মনকে নাড়া দেবেই। ঘরবাড়ি পুড়ে যাবার কথা এর আগে জেনেছেন। তারপরেও ছেলে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল? চিরদিনের জন্যে বীরসিংহ গ্রাম ছেড়ে চলে গেল! জীবৎকালে সে আর সেখানে যাবে না, এ কথাও জানিয়ে দিয়ে গেছে, -ভেবে তিনি উতলা হলেন। বিষয়গুলোর কারণ জানতে চান।
চিঠি এসেছিল শম্ভুচন্দ্রের তরফ থেকে। ঈশ্বরচন্দ্র এতদিন চুপ ছিলেন। এবার তাঁর লেখা চিঠি এলো। বিস্তর চিঠি। জনে জনে লেখা চিঠির প্রতিলিপি সহ।
ঈশ্বরচন্দ্র লিখেছেন, মা, ভাইদের এবং একমাত্র পুত্রবধূকে। প্রত্যেকের চিঠির বয়ান প্রায় একই রকমের। তার প্রতিলিপিগুলি পাঠিয়েছেন বাবকে। শেষে বাবার জন্যে দীর্ঘ চিঠি।
চিঠি হাতে পেয়ে ঠাকুরদাস উৎকণ্ঠার সঙ্গে পড়তে শুরু করলেন । –
পূজ্যপাদ শ্রীমৎ পিতৃদেব শ্রীচরণবিন্দেষু
প্রণতিপূরবকং নিবেদনম-
নানা কারণে আমার মনে সম্পূর্ণ বৈরাগ্য জন্মেছে। আর আমার ক্ষণকালের জন্যেও সাংসারিক কোনও বিষয়ে লিপ্ত থাকতে বা কারোও সঙ্গে কোনও সংস্রব রাখতে ইচ্ছা নেই। বিশেষতঃ ইদানীং আমার মনের এবং শরীরের যেরকম অবস্থা ঘটেছে, তাতে সাংসারিক বিষয়ে সংসৃষ্ট থাকলে বেশিদিন বাঁচব, এরকম বোধ হয় না। এজন্যে স্থির করেছি, যতদূর পারি নিশ্চিন্ত হয়ে জীবনের অবশিষ্ট ভাগ নিভৃতভাবে অতিবাহিত করব। এই সংকল্প করে মা এবং অন্যান্যদের যে পত্র লিখেছি, তার প্রতিলিপি আপনার শ্রীচরণে রাখছি। পড়ে দেখতে পারেন।
ঠাকুরদাসের হাতে চিঠির গোছা। একটা একটা করে চিঠি খুঁজে নিচ্ছেন। মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন।
আপশোষ হচ্ছে। সাজানো সংসারটা কেমন ভেঙে গেল। এর জন্যে কি তিনি দায়ী? আজ তিনি সংসারের মাথায় থাকলে অবশ্যই এ হতে দিতেন না। যেমন করে হোক ঝড় সামলাতেন। ঈশ্বর একলা হয়তো সামাল দিতে পারল না। নেভা প্রদীপের সলতে উস্কে দেবার মতো জ্বালানি এখনও তাঁর মধ্যে বিদ্যমান- ভাবছেন আর চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল ঝরছে। সামনে কেউ নেই, যার কাছে নিজের মনের কথা প্রকাশ করেন। আকুলিবিকুলি করছে ভেতরটা। ঝাপসা দৃষ্টিতে শেষ চিঠিটা হাতে তুলে নিলেন।
দু লাইনের চিঠি। চিঠি সম্বোধিত হয়েছে ভবসুন্দরি নামের একজনকে-
আমি তোমাদের কাছ থেকে এজন্মের মতো বিদয় নিলাম। তোমাদের নিত্য নৈমিত্তিক ব্যয় নির্বাহের জন্য আপাততঃ মাসিক পঞ্চাশ টাকা নির্ধারিত করে দিলাম।
ইতি
শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা
ভবসুন্দরী! নামটা একেবারেই অজানা! ঠাকুরদাস ভাবতে শুরু করলেন। -এ নামের কাউকে তো তিনি চেনেন না! আশ্চর্য হলেন। তবে কী?… ছেলের তো স্বভাব, নানান অভাবী মহিলার পাশে দাঁড়ানো। বিশেষ করে বিধবা, বাল্যবিধবা, এঁদের প্রতি ছেলের দান অকৃতিম। সেরকই কেউ হবে?
চিন্তায় পড়লেন। অবশ্য , তা যদি হয়ও, তবু মাসে মাসে এতগুলো করে টাকা! নাহ…। নির্ঘাত ওই নামের কোনও মেয়েকে নিজের পরিবারের সদস্য করেছে ছেলে। কে হতে পারে? নারায়ণের…? তবে কিনারায়ণের বিয়ে হয়ে গেল? তার অগোচরে? মনটা একদিকে যেমন ভারী হল। তেমনই আনন্দও পেলেন। ঘরে তাহলে নাতবউ এলো?
মনটাকে মানিয়ে নিলেন। ভবসুন্দরি! বাহ! নামটাও বেশ মনের মতো। না জানি সে মেয়ে কত রূপ গুণের অধিকারী…, ভাবতে ভাবতে এবার নিজের চিঠিখানা আবার পড়তে শুরু করলেন-
সাংসারিক বিষয়ে আমার মতো হতভাগ্য আর দেখতে পাওয়া যায় না। আমার স্ত্রী, আমার সন্তান, আমার ভাই, তারা তো আমার আপনজন। তারাও কেউ আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেনি। সব থেকে খারাপ লাগে, আমার একমাত্র পুত্র সন্তান কিভাবে তার জীবনটা নষ্ট করল! এত চেষ্টা সত্বেও পড়াশোনা করল না। নানা অপকর্মের দিকে মন। বিদ্যেই নেই তো, উপার্জন! সেখানেও মাথা হেঁট হবার জোগাড়। ওকে নিজ পুত্র বলে পরিচয় দিতেও আমার ঘৃণা হয়। তার জন্যে স্ত্রীর সঙ্গেও বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে। এ ছাড়া প্রিয় বন্ধু বিচ্ছেদের কথা আর নাই বা বললাম। মনে হয়, সংসারের বিষয়ে আমার মতো হতভাগ্য আর কেউ নেই। সকলকে সন্তুষ্ট করবার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করেছি; কিন্তু অবশেষে বুঝতে পারলাম, সে বিষয়ে কোনও অংশে কৃতকার্য্য হতে পারিনি। যে সকলকে সন্তুষ্ট করতে চেষ্টা করে সে কাউকেই সন্তুষ্ট করতে পারে না…
চিঠির পাতা থেকে চোখ সরালেন ঠাকুরদাস। মুখ তুললেন। দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে গেছে। স্বগতোক্তি বেরিয়ে এলো, এটাই জগতের নিয়ম ঈশ্বরচন্দ্র, তবে তোমার এই উপলব্ধিটা অনেক দেরীতে হল।
একথা সেকথা ভাবতে ভাবতে চোখ ফিরিয়ে আনলেন চিঠির পাতায়। পড়ছেন,-
…এই প্রাচীন কথা কোনও ক্রমেই অযথা নয়। সংসারী লোকে যে সকল ব্যক্তির কাছে দয়া ও স্নেহের আকাক্ষা করে, তাঁদের একজনেরও অন্তকরণে যে আমার ওপর দয়া ও স্নেহের লেশমাত্র নেই, সে বিষয়ে আমার অণুমাত্র সংশয় নেই। এরূপ অবস্থায় সাংসারিক বিষয়ে লিপ্ত থেকে ক্লেশ ভোগ করা নিরবিচ্ছিন্ন মূর্খতার কর্ম। যে সমস্ত কারণে আমার মনে এই ধরণের সংস্কার জন্মেছে, তার আর উল্লেখ করা অনাবশ্যক।…
পত্র পড়া শেষ করতে পারলেন না। সন্তানের এমন করুণাঘন উক্তি! মন পিছনের দিনগুলোয় ফিরে যাচ্ছে। স্থির থাকতে পারলেন না। ছোট্ট বাসাঘরের ভিতরে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন। পথে নামলেন। হাঁটতে শুরু করলেন। চিঠিখানা হাতে ধরা।
ডাক বেলাবেলি এসেছিল। এতটা সময় ধরে চিঠি পড়েও তা শেষ করতে পারলেন না। পাঠ যত এগিয়েছে, ততই জ্যেষ্ঠ সন্তানের প্রতি মমত্ব বোধে ডুবতে থেকেছেন। করুণার বারি ঝরেছে। পুত্রের প্রতি দুর্বলতার প্রকাশ ঘটতে থেকেছে। অথচ তিনি জানেন, ভেঙে পড়লে চলবে না। সামনের দিনগুলোয় তাঁকে এখানে এভাবে, একলাই থাকতে হবে। পুরনো স্মৃতি কত মনে আনবেন? তা থেকে মুক্ত হতে তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন।
নিভৃতকাশিবাসী মানুষের নিরুদ্দেশের পথ পুণ্যসলিলা গঙ্গার তীর। সেদিকে পা বাড়ালেন। মনের অবস্থায় পরিবর্তন আনতে পথ ভাঙতে শুরু করলেন। মনে করছেন, এই বারাণসী শহর পৃথিবীর এক প্রাচীনতম শহরের অন্যতম স্থান। বিশ্বে কত নগর, কত শহর, সভ্যতা জন্ম নিয়েছে। কালের রথচক্রে তার অনেক ধ্বংসও হয়ে গেছে। কিংবা পুরাতন সেই গৌরব খ্যাতি বিলীন হয়ে গেছে। অথচ সময়কে উপেক্ষা করে আজও গঙ্গার প্রবাহিত ধারার মতোই বহমান বারাণসীর গৌরব।
বাসা থেকে বেরিয়ে অলিগলি ভেঙে চলেছেন দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে। সরু গলির দুধারে পরপর বাড়ি। তার মাঝ বরাবর পায়ে হাঁটা পথ। গাড়ির চলন নেই। অবিরাম মানুষের ঢল চলেছে সেই পথে। কেউ যাচ্ছে ঘাটের দিকে। কেউবা ঘাট ফেরত যাত্রী। তার মধ্যে দুজন বিদেশিও চোখে এল ঠাকুরদাসের।
গলিপথ একসময় এসে মিশল ঘাটের সিঁড়িতে। পুণ্যতোয়া গঙ্গারধারা নজরে ধরা দিল। গঙ্গা এখানে অনেক নীচে বহমান। এবার সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামছেন। স্বল্প বিস্তার সিঁড়ির। সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। গোটা পঁচিশ–ছাব্বিশ সিঁড়ি নামবার পরে সিঁড়ি অনেক প্রশস্ত হয়ে গেল। সেখানেই মানুষের ভিড় সর্বাধিক। পুরুষ-মহিলা-বাচ্চা-কাচ্চা, সাধু সন্ন্যাসী, ব্রাহ্মণ-পুরোহিত, করে লোকে লোকারণ্য; কাশী বিশ্বনাথ দর্শনে পুণ্যলাভ শেষে গঙ্গা দর্শনে চলে এসেছে। অনেকে গঙ্গার বুকে নৌকো বিহার করছে। বেশিরভাগই বিদেশি পর্যটক। এইঘাটেই তিনি প্রথম এসে নেমেছিলেন।
একটা সিঁড়ির প্রায় মাঝ পথে একজন সাধু বসে রয়েছে। কৌপিনধারী সাধু। মাথার চুল জট পাকানো। বট গাছের ঝুড়ির মতো তা কাঁধ-বুক ছাড়িয়ে নেমেছে। সঙ্গে জুড়ে নিয়েছে গোঁফ-দাড়ির গুচ্ছ। মুখমণ্ডলসহ সর্বাঙ্গ ভস্মামাখা। গলায় লম্বা রুদ্রাক্ষের মালা নিম্নাঙ্গ পর্যন্ত বিস্তৃত। সাধুকে ঘিরে অনেক মানুষের ভিড়। সাধুবাবা প্রবচন দিচ্ছে। তা দেখে, ঠাকুরদাসও কিছুক্ষণ সেখানে উপবেশন করলেন। সাধুর মুখে ঈশ্বর কথন শুনে চঞ্চল মন কিছুটা শান্ত হল। তারপরে তিনি উঠে পড়লেন।
দশাশ্বমেধ ঘাট পেরিয়ে সাবধানী পদক্ষেপে তিনি গিয়ে উঠলেন অসিঘাটে। এই ঘাট নদীর একেবারে উত্তরাংশে অবস্থিত। এখানে কোনও সিঁড়ির বালাই নেই। গঙ্গা এসে সোজা ঘাটে মিশেছে। ঠাকুরদাস জলে নেমে গঙ্গার স্পর্শ নিলেন। মাথায় গায়ে জলের ছোঁয়া দিলেন। ঘাটে উপবেশন করলেন। পায়ের কাছে বহমান স্রোতস্বিনী গঙ্গা। অপরাহ্ণের রোদ গঙ্গার জলে পড়ে শত বিচ্ছুরণ ঘটাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে রইলেন অনেকটা সময়। মন শান্ত করবার প্রয়াস করছেন বারবার, সর্বত্র, যেখানেই উপবেশন করছেন। ঈশ্বরের পত্রের শেষাংশ পড়বার জন্যে মন টানছে। কিন্তু মনকে কিছুতেই বাগে আনতে পারছেন না। ফেরবার পথে তুলসীদাসের কুঠুরি দর্শন করলেন; যেখানে বসে ভক্তকবি প্রায় দুইশত বছর আগে রামচরিত মানস রচনা করেছিল।
আবার চলতে শুরু করলেন। ঘাট থেকে ঘাট পেরতে থাকলেন। এবার তিনি ফিরছেন উল্টোদিকে। আজ যেন তাঁকে চলায় পেয়েছে। বৃদ্ধ হলেও নবীনের মতো প্রতি ঘাটের সিঁড়ি ভাঙছেন। মনের চঞ্চলতাই তাকে এ শক্তি জোগাচ্ছে।
এলেন প্রয়াগঘাটে। সেখানে কিছুটা সময় কাটালেন। পৌঁছলেন রাজেন্দ্রঘাটে। দাঁড়ালেন মানসিংহের পরিত্যাক্ত প্রাসাদের সামনে। সেখান থেকে ললিতা ঘাটে,-নেপাল রাজের গণেশ কেশব মন্দির দর্শন করলেন। সিন্ধিয়াঘাট,- পুরনো জলমগ্ন মন্দির-আযাবৎকাল জল স্পর্শ করে তাতেই নিমজ্জিত রয়েছে।
শেষ এলেন মণিকর্ণিকায়। শেষ ঘাট। এরপরে গঙ্গা দক্ষিণে বহমান। ঘাটের বিস্তৃত আঙ্গিনা। তবে তার সবটা জুড়ে শ্মশান। সেখানে সার দিয়ে চিতা জ্বলছে। এছাড়াও কত শবদেহ অন্তিম সৎকারের অপেক্ষায় রয়েছে।
জ্বলন্ত চিতার আগুনের দিকে ঠায় তাকিয়ে রইলেন। ধীরে ধীরে মনকে শান্ত করে ফেললেন । ভাবলেন, জীব জীবনের অন্তিম তো এখানেই। একদিন তো এখানে এসেই জীবন থেকে মরণের পথে উত্তরণ ঘটবে। তবে আর এত ভাবনা কিসের? যা হচ্ছে, যা হয়েছে, তাকে হতে দাও, মা ফলেষু কদাচন। সব অবসাদ কেটে গেল। মন ফিরল আলোর দিকে।
হাতের পত্র হাতেই রয়ে গেল। ঘরে ফিরে এলেন। অন্ধকার ঘর। বাতি জ্বালালেন। মোমের বাতি। আলো ছড়িয়ে পড়ল। অসমাপ্ত পত্র পড়তে শুরু করলেন,
…এক্ষণে আপনার শ্রীচরণে আমার বক্তব্য, পিতার কাছে পুত্রের অপরাধ ঘটবার সম্ভাবনা ঘটেছে। সুতরাং আপনার শ্রীচরণে কতবার কতবিষয়ে অপরাধী হয়েছি, তা বলা যায় না। তজ্জন্য কৃতাঞ্জলিপুটে কাতরবচনে শ্রীচরণে প্রার্থনা করছি, কৃপা করে এই অধম সন্তানের সমস্ত অপরাধ মার্জনা করবেন।
কার্যগতিকে ঋণে বিলক্ষণ আবদ্ধ হয়েছি। ঋণ পরিশোধ না হলে, লোকালয় পরিত্যাগ করতে পারছি না। এক্ষণে যাতে সত্বর ঋণমুক্ত হই, সেবিষয়ে যথোচিত যত্ন ও পরিশ্রম করছি। ঋণে নিষ্কৃতি পেলেই কোনও নির্জন স্থানে গিয়ে স্থিতি করব।…আপনার নিত্যনৈমিত্তিক যা প্রেরিত হয়ে থাকে, যতদিন আপনি শরীর ধারণ করবেন, কোনও কারণে তার ব্যতিক্রম ঘটবে না।
ইতি ১৫ শে অগ্রহায়ণ ১২৭৬ সাল।
ভৃত্য ঈশ্বরচন্দ্র শর্মণঃ
পাঠ শেষে পত্র খামে ভরে রাখলেন। মন স্থির হল । বুঝলেন, এটাই ভবিতব্য। ভবিতব্যের উপরে কারোও হাত নেই।
(২৮)
বীরসিংহ গ্রামে ভগবতীদেবীর আর দিন কাটছে না। বড় একলা হয়ে গেছেন। স্বামী কাশীবাসী। জ্যেষ্ঠসন্তান বিমুখ হল। নিজের গ্রাম ঘরদোর ভুলে কলিকাতায় পড়ে রইল। তিনি আর একলা এই পাপড়িবিহীন পদ্মের মতো সংসারটার ডাঁটি ধরে কতদিন বসে থাকবেন? বিলাপ করছেন অথচ শুনছে কে? একদিন ঈশানচন্দ্রকে ডাকলেন। কাছে বসালেন। গায়ে হাত বুলিয়ে বোঝালেন মনের কথা। বললেন, বাবা, একটা পত্র লেখ।
-কার কাছে পত্র লিখবে, মা?
-তোর বড়দার কাছে।
-ও বাবা। বড়দার কাছে? আমার পত্র দেখলেই তো, কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলে দেবে। না বাবা, আমি তাঁকে কিছু লিখতে পারব না। …তবে কী বিষয়ে পত্র লিখতে চাইছ?
-মনটা বড্ড উতলা হয়েছে। একবার তোদের বাবাকে গিয়ে দেখে আসতে মন চাইছে। অনেকদিন হয় গৃহ ছেড়েছেন, একবার সেখেনে গিয়ে দিন কতক তাঁর সেবা করে আসি।
-সে তো ভালো কথা। তবে তার জন্যে বড়দাকে কেন লিখছ?
-সে বিনে আমার দুঃখু আর কে বুঝবে? ওকে জানালে, ঈশ্বর অবশ্যই আমাকে সেখেনে রেখে আসবে। দিন কয়ের জন্যে।
ঈশান জানে, মা বিনে বড়দাদা যেমন কোনও কাজ করে না; মাও তেমনি। ছেলেকে না জানিয়ে এক পাও নড়বে না। তাছাড়া, দাদা বিনে তাদের সংগতি কী, খরচ খরচা করবার? মায়ের নাম দিয়ে চিঠি লিখে দিল।
কলিকাতায় বসে ঈশ্বরচন্দ্র চিঠি পেলেন। কতদিন পর মায়ের চিঠি। খুশি হলেন। পড়লেন। মায়ের ইচ্ছের কথা জানলেন। বাবা-মা আবার একত্র হবে। চিরন্তনের বন্ধন। দুজনে দুজনকে ছেড়ে আছেন বটে; তবে মনটা কী তাদের পাখির মতো বারবার উড়ে পরস্পরকে কাছে চায় না?
ঈশ্বরচন্দ্রের মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠল। এ কর্তব্য আশু সমাধা করতে হবে। মন স্থিরও করলেন। তবে একটা মুশকিল হল। হাতে এখন অপর্যাপ্ত কাজ। তা ফেলে রেখে যাওয়া সমীচীন হবে না। ডাকলেন নারায়ণকে।
নারায়ণ এখন কলিকাতায়। বউ নিয়ে রয়েছে। বললেন, নারায়ণ, তোমার ঠাকুমা কাশী যেতে চাইছে। আমি নিয়ে যেতে পারলে ভালো হোত, তবে আমার হাতে অনেক কাজ। তুমি বরং ঠাকুমাকে নিয়ে যাও। কাশীতে দাদুর কাছে রেখে এসো। পরে ফেরবার সময় দেখা যাবে। পারলে আমি তখন যাবো।
-আজ্ঞে বাবা, বলেও মাথা চুলকতে শুরু করল সে।
-তা কবে যাবে জানিও। আমি টাকা পয়সার বন্দোবস্ত করে দোবো। ছেলের ইতঃস্ত ভাবকে উপেক্ষা করেই ঈশ্বরচন্দ্র কথাটা বললেন।
পুরো ব্যাপারটাই নারায়ণচন্দ্রের অমনোমতো । অন্তত এখন। এই অবস্থায়। ঘরে সদ্য বিয়ে করে আনা বউ। তাকে ছেড়ে একলা যেতে মন সরছে না। সে চুপ করে রইল। ঈশ্বরচন্দ্র বুঝলেন, ছেলের কিছু বক্তব্য রয়েছে। প্রশ্ন করলেন, তুমি কি কিছু বলবে?
-না…বলছিলাম কিনা, আমি যাব, আপনার বউমা একেবারে একেলা হয়ে যাবে।
নারায়ণচন্দ্রের ডান হাতের আঙুল তখনও মাথায় অকারণে বিলি কেটে চলেছে। গোপনে হাসলেন ঈশ্বরচন্দ্র। এককালে তো তিনিও নতুন বউয়ের দেখা পাবার জন্যে ছটফট করতেন। সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীকে রেখে পুত্রের যে একলা যেতে মন চাইবে না, তা তাঁর মতো সংসারী মানুষের আগেই বোঝা উচিত ছিল। কথাটা ভাবলেন। বললেন, তাহলে, বউমাকে সঙ্গে করেই না হয় নিয়ে যাও।
একগাল হাসি ফুটে উঠল নারায়নচন্দ্রের মুখে। এরপর আর কি কোনও কথা হয়?
যথা দিনে ভগবতীদেবী আর ভবসুন্দরীকে নিয়ে নারায়ণচন্দ্র বেনারসের পথে রওয়ানা দিল । জলপথে গমন। চারদিনের যাত্রা।
দিনের কালে নৌকো চলছে। রাতে কোনও ঘাটে ভিড়ছে বিশ্রামের জন্যে। চারজন মাঝি মল্লার মিলে নৌকো বাইছে। তাতে আগেই পৌঁছানো যেত হয়তো, যদি কিনা দিনে রাতে করে নৌকো বওয়া হত। তবে যেখানে তিনজন যাত্রীর দুজনই মহিলা, সেখানে রাতে নৌকো বওয়া সমুচিত নয় জেনে এই ব্যবস্থা।
দিনে যখন নৌকো চলে মা আর বউকে ছইয়ের ভিতরে বসিয়ে রেখে নারায়ণ বাইরে এসে বসে। নদীর দুধারের দৃশ্য দেখতে থাকে।
সে দেখে, দুই পাড়ে কত গ্রাম, বাগান, খেত। বাড়িঘরও নজরে পড়ে। তবে সবই কাঁচা বাড়ি। বাড়ি ঘরের মাথা ছাপিয়ে তাল নারকেল, আম গাছ। গ্রাম পেরলে পড়ে খেত। খেত কোথাও সবুজ ফসলে ভরা। নৌকো নানান রাজ্য পেরচ্ছে। সেখানের জল হাওয়া অনুযায়ী ফল ফসলে মাঠ ভরেছে। আবার কোথাও বাঁজা জমি গভীর ঝোপঝাড় হয়ে পড়ে রয়েছে।
নদীতে জোয়ার আসলে নৌকো মোচার খোলার মতো দুলতে থাকে। নদীর বুকে জল থই থই করে। তখন পাল তুলে দেয়। নৌকো আপন বেগে চলতে থাকে। সেসময় শুধু হাল ধরে থাকা কাজ মাঝির। ভাঁটার সময় নৌকো বাইতে থাকে। দুজন মাঝি তখন পালা করে বসে দাঁড় টানে ।
এছাড়াও এক এক স্থানে গঙ্গা এতটাই চওড়া যে ওপারের কিছুই চোখে পড়ে না নারায়ণের। তখন মনে হয়, কূল কিনারা হীন পথে কোথায় ভেসে চলেছে। ভিতর থেকে ভগবতীদেবী আর ভবসুন্দরীকে বাইরে ডেকে আনে। দেখায়। ভবসুন্দরী প্রশ্ন করে, ঠিক নিশানায় যাচ্ছে তো, গো? নারায়ণ আশ্বাস দেয়, মাঝির দিক-নিশানা কি আমাদের মতো? এটাই ওদের পেশা, নিত্যকার কাজ। ভয়ের নেই কিছু, ভবসুন্দরী।
মাঝে মধ্যে জলে-আকাশে গাং শালিকের দেখা মেলে। আকাশে গোল হয়ে চিল ওড়ে। বিকেল পড়লে নদীর জল ঝিকমিক করে। তারপর আসে সন্ধ্যে, রাত। দিনমানে সময় যেমন তেমন কাটে; কিন্তু সূর্যি ডুবল কী ছইয়ের ভিতরে কুপি লণ্ঠন জ্বলে উঠল। বাস, তারপর থেকেই বুক কাঁপতে থাকে সকলের। নৌকো ঘাটে থাকে বটে। তবে সে তো গ্রাম গঞ্জের ঘাট। অরক্ষিত। যদি কোনও বিপদ আসে? তা অবশ্য হয়নি। মাঝিদের কাছে ছড়রা বন্দুক রয়েছে। খুব প্রয়োজনে তা ব্যবহার করা হয়।
নৌকোর ভিতরেই রান্নাবান্না, খাওয়া দাওয়া; মায় কল বাথরুম করা। মহিলাদের জন্যে কিছুটা ঘেরা জায়গা রয়েছে। পুরুষদের জন্যে সেসবের বালাই নেই। খোলা মেলা। তবে আড়াল করে বসা হয়।
এভাবেই তিনরাত, চারদিন নোকৌ চলার পর যাত্রার সমাপ্তি ঘটল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন ভগবতীদেবী। ভবসুন্দরীরও ধরে প্রাণ এল। এই প্রথম কিনা? বেনারসের সেই দশাশ্বমেধ ঘাট। যেখানে নৌকো ভিড়ল।
একে একে নৌকো ছেড়ে নেমে আসল তিনজন। ঠাকুরদাস এসেছেন নিয়ে যেতে। ঘাটেই একপ্রস্থ নমস্কারের পালা সারা হল। ঠাকুরদাস মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। নাতবৌয়ের মাথায় একহাত ঘোমটা। তা সরিয়ে থুতনি ধরে আদর জানালেন। প্রথম নাতবউয়ের মুখ দেখছেন । কচি মুখ। কপালে মস্ত বড় গোল টিপ। সিঁথিতে টকটকে লাল সিঁদুর। গায়ে গলায় গয়না। হাতে চুড়ির গোছা। বালা। নাকে নোলক। ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে। নারায়ণের তারিফ করলেন। নিজে সঙ্গে একজোড়া মাকড়ি দুল নিয়ে এসছেন। প্রথম মুখ দেখা বলে কথা। শুধু হাতে কি তা হয়? দুল জোড়া ভবসুন্দরীর হাতে দিলেন। ঠাকুরদাস তখনও জানেন না, ভবসুন্দরীর এটা দ্বিতীয় বিয়ে।
হাতে কাঁধে লটবহর নিয়ে ঘাটের সিঁড়ি ভাঙছে সকলে। সিঁড়ির ধাপে ধাপে ভিক্ষুকের দল। থালা গামলা বাটি পেতে বসে রয়েছে। পুণ্যারথীরা গঙ্গা স্নান সেরে ওপরে ওঠবার সময় ভিক্ষা দিচ্ছে। চাল ডাল পয়সা। কেউ বা সঙ্গে আনা কাপড়চোপড়। নতুন , পুরনো। সেসব দেখতে দেখতে ঠাকুরদাস সকলকে নিয়ে পথে এসে উঠলেন।
পথ কিছু রাজপথ নয়। সরু গলি। গলির দুধার দিয়ে ঘরবাড়ি। চালা, মাটির ঘর। হাঁটতে হাঁটতে সেরকমই একটা ঘরের সামনে এসে ঠাকুরদাস থামলেন। পিছনে বাকি তিনজন। ঘরের দরজা আবছানো। ঠেলতেই তা খুলে গেল। চোর ছ্যাঁচড়ের বালাই নেই। ঘরে তাই তালাচাবিও পড়ে না। সব ঘরেরই এক অবস্থা।
একটাই ঘর। সঙ্গে লাগোয়া রান্নার জায়গা। সামনে কিছুটা করে ফাঁকা স্থান। লোকজন আসে বসে। নিজেদের মাঝে কথাবার্তা হয়। সকালে- বিকেলে। সন্ধ্যের পর যে যার ঘরে। অন্য সময়ে অনেকেই সময় কাটায় কাশী বিশ্বনাথের মন্দিরে বসে। কেউ বা, গঙ্গার ঘাটে। সেখানে রাত কাটিয়ে দেয়। কোনও কোনও দিন। ঘরে মন না টিকলে রয়েছে, পুণ্যসলিলা গঙ্গার ঘাট। নচেৎ বিশ্বনাথের মন্দির চাতাল। তাতে কিছু মাধুকরীও জুটে যায়। ধনবান পুণ্যারথীর কাছ থেকে।
সেদিন ঠাকুরদাস আর ভগবতীদেবী বসে রয়েছেন গঙ্গার ঘাটে। পাশাপাশি। ঘাটে মানুষের আনাগোনা দেখছেন। নিচু স্বরে কথা হচ্ছে। টুকিটাকি। নারায়ণচন্দ্র বউ নিয়ে বেনারস শহর ঘুরতে গেছে। ঠাকুরদাস স্ত্রীকে প্রশ্ন করলেন, হ্যাঁ গা, নারয়ণের মেয়ে কে পছন্দ করল?
-নিজের পছন্দে বিয়ে করেছে সে। ভগবতীদেবী উত্তর দিলেন। তাঁর কথার মাঝে সামান্য ঝাঁঝ । ঠাকুরদাস বলে উঠলেন, এ বিয়েতে তোমরা সবাই খুশি হয়েছ তো?
-বিধবা মেয়ে বিয়ে করেছে নারায়ণ।
ঠাকুরদাস প্রথমটায় থমকে গেলেন। পরে জানতে চাইলেন, সেটা কেমন করে ঘটল।
-মেয়ের মা মেয়েকে নিয়ে এসেছিল আমাদের বাড়িতে। ঈশ্বরের সঙ্গে দেখা করতে…, এই বলে ভগবতীদেবী পূর্ব বৃত্তান্ত পুরোটা শোনালেন।
ঠাকুরদাস সবটা শুনলেন; কিন্তু চুপ করে রইলেন। মুখে কিছু বললেন না। ভাবলেন, এইটা একটা সুকর্ম করেছে। ছেলে হয়ে নারায়ন নিজের বাবার কর্মপথের সহায়ক হয়েছে। এটারও প্রয়োজন ছিল। না হলে, ঈশ্বরের কাজ দেখে সমাজ ভাবত, নিজের ছেলেকে বাবা বাছা, করে ঘরে আগল টেনে রেখে অন্যের বাছাদের ধরে ধরে মাথায় কাঁঠাল ভাঙছে; বিধবাবিবাহ করাচ্ছে।
প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে ফেললেন ঠাকুরদাস। জানতে চাইলেন, নতুন বসতবাড়ি তৈরীর ব্যবস্থা হল কিছু? ঈশ্বর কি বলছে?
-বলেছে, তা করতে দু তিন বছর সময় লাগবে। ও এখন ধারকর্জের মধ্যে রয়েছে। সেসব মিটিয়ে তবে বাড়িঘর তৈরীতে হাত দেবে। আমায় জানিয়ে গেছে, এবার ভাইদের সে পৃথাগন্ন করবে। আলাদা আলাদা বসত বাড়ি বানিয়ে দেবে।
-সেটাই বরং ঠিক বুদ্ধি, বুঝলে গিন্নী? এ কাজটা অনেক আগেই ওর করা দরকার ছিল। না করে বোধ হয় ভুল করেছে।
-কেন, এই নিয়ে ছেলে কি তোমাকে কিছু জানিয়েছিল?
প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়ে ঠাকুরদাস চট করে উঠে দাঁড়ালেন। -কোথায় চললে? ভগবতীদেবী জিজ্ঞেস করলেন।
ঠাকুরদাস বললেন, চলো ফিরি। একটা জিনিষ দেখাতে চাই তোমাকে।
বাসায় ফিরে ভপগবতীদেবীকে বাইরের ফাঁকা জায়গাটায় বসতে বলে নিজে ঘরের ভিতর ঢুকে গেলেন। খুপরি ঘরের চলনসই আলোয় ছেলের চিঠিখানা খুঁজে বের করে আনলেন । ভগবতীদেবীর পাশে উপবেশন করলেন। চিঠি খুলে পড়তে শুরু করলেন। এ সেই চিঠি যা পেয়ে তিনি উদ্ভ্রান্তের মতো বেনারসের গঙ্গার ঘাটে ঘাটে ঘুরেছিলেন। শেষে মণিকর্ণিকায় এসে শান্ত হয়েছিলেন।
ঠাকুরদাস পড়ছেন, ভগবতীদেবী শুনছেন। পড়া যত এগোচ্ছে, তিনিও ঠাকুরদাসের মতোই ভেঙে পড়ছেন। চিঠির শেষ অংশে এসে যেই জানলেন, ছেলেও কোনও নির্জন স্থানে চলে যাবার বাসনা রাখছে, হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। চিৎকার করে উঠলেন, এ কী সব্বোনাশ হল গো আমাদের? অমন সোনার সংসারটায় এ কোন শনির দশা লাগল?
তাঁর চিৎকার আর কান্না শুনে আশপাশের লোক তাকিয়ে দেখছিল। ঠাকুরদাস কান্না থেকে নিরস্ত করলেন ভগবতীদেবীকে। বললেন, -এ তো আমিই চাক্ষুষ করেছিলাম গিন্নী। তবে এতদিন কথাটা ভাঙিনি। এখন তো দেখছি আমার দেখা স্বপ্ন অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাচ্ছে।
-তুমি স্বপ্নে দেখেছিলে!
আঁতকে উঠলেন ভগবতীদেবী। – স্বপ্নে কি এইসব দেখেছিলে?
-স্বপ্ন তো আর কথা বলে না, স্বপ্ন বোবা হয়। তবে তার যা বলবার, তা অন্যভাবে বলে দেয়।
– কী দেখেছিলে?
-আমি দেখেছিলাম…, বলে, ঠাকুরদাস তাঁর দেখা স্বপ্নের আদ্যপান্ত, মায় নারায়ণ ভট্টাচার্যকে দিয়ে নিজের কোষ্ঠী বিচারের কথা, তাঁর দেওয়া ভবিষ্যদ্বাণী সবটুকুই বিবৃত করলেন । এই প্রথম এসব কথা তাঁর মুখ দিয়ে বের হল। না হলে এতদিন তা মনের ভিতর পুষে রেখেছিলেন।
-এত কথা কৈ আমাকেও তো আগে জানাওনি
-জানাইনি তা ঠিক। তবে জানালেও কী করতে? আমার মতো কি সংসার ছেড়ে চলে আসতে?
-তা হয়তো পারতাম না। তবু…,
অর্ধসমাপ্ত কথায় ঠাকুরদাস খেই ধরে বলে উঠলেন, আমাকে আটকে রাখতে?
-সেটাই বরং করতাম। তবে এখন আবার অনুরোধ করছি, বাড়ি ফিরে চলো।
-তা আর হয় না, গিন্নী। বরং, তোমাকে বলি, তুমি এখানে চলে এসো। শেষ দিনগুলো বুড়োবুড়ি আবার একসঙ্গে থাকব।
– তোমার যাওয়ার এখনও অনেক দেরী আছে। তবে জেনে রাখো, আমি যেখানেই থাকি, এই কাশীতে এসে তোমার আগে মরব, আমার পর তুমি যাবে ।তাই বলছি, এখন বাড়ি ফিরে চলো।
এত বলে কোয়েও ঠাকুরদাসকে মানাতে পারলেন না ভগবতীদেবী। অবশেষে একদিন স্বামীর কাছ থেকে বিদায় নিলেন। নারায়ণ আর ভবসুন্দরীকে সঙ্গে নিয়ে অন্যান্য তীর্থস্থান দর্শনে বেরিয়ে পড়লেন। এলাহাবাদ, মথুরা, বৃন্দাবন ঘুরে আবার বীরসিংহে ফিরে এলেন।
কিন্তু দৈবের কী খেল! এ যেন কথা মুখ থেকে খসানো নয়; দৈবকে চাক্ষুষ করেই কথা তৈরী করা। ঠাকুরদাস কলিকাতা আর বীরসিংহ, দু জায়গাতেই চিঠি লিখে জানালেন, তিনি ভীষণ রকম অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বোধ হয়, তাঁর যাবার কাল আসন্ন।
ঈশ্বরচন্দ্র, দীনবন্ধু এবং শম্ভুচন্দ্র তিনজন কাশী ছুটলেন। ভগবতীদেবীও পিছু ধরলেন। স্বামী অসুস্থ। কেমন করে তিনি এখানে বসে থাকেন? কাশী পৌঁছলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরদাসের সেবা শুশ্রূষা শুরু করে দিলেন। ভাগ্যক্রমে দিন পনেরোর মধ্যে তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন। ঈশ্বরচন্দ্রের আর সেখানে বসে থাকার যো নেই। কলিকাতায় অনেক কাজ পড়ে রয়েছে। মা এবং দুভাইকে রেখে নিজে ফিরে এলেন। আসবার সময় মাকে বলে এলেন, তুই বুঝি এখানেই বাসা গাড় এবার।
ব্যাস, এও সেই মুখের কথা! যা কিনা নড়নচড়ন হবার নয়। ভগবতীদেবীর খুব ইচ্ছে, মাস দুই ঠাকুরদাসের কাছে থাকেন। তারপর আবার গ্রামে ফিরবেন। তবে, সে ইচ্ছে ইচ্ছেই রয়ে গেল। আগেরবার এসে স্বামীকে বলে গিয়েছিলেন না, এই কাশীতে এসেই তোমার আগে মরব…
ঘটনা তাই হল। সুস্থ শরীর। কোথাও কিছু নেই। হঠাৎ ওলাওঠা রোগ এসে চেপে ধরল শরীরটাকে। এ অসুখের নেই কোনও ওষুধ; নেই উপযুক্ত ডাক্তার। রোগীকে নুন চিনির জল খাইয়ে রাখার আদেশ হল। ঘন ঘন বাহ্যি বমি হচ্ছে। ঠাকুরদাস হাঁকুপাঁকু করছেন। ঘণ্টায় ঘণ্টায় রোগী নেতিয়ে পড়ছে। দুদিনের মাথায় জ্ঞান হারালানে ভগবতীদেবী। একদিন পরে বছরের শেষ দিন । ভগবতীদেবীর সেদিন শেষ নিঃশ্বাস পড়ল। স্বামীর কোলে মাথা রেখে।
কান্নায় ভেঙে পড়লেন ঠাকুরদাস। বলতে থাকলেন, হায়, কী করতে আসলে, কী হয়ে গেল তোমার!
টরে টক্কায় সংবাদ গেল ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে। কাঁদতে কাঁদতে তিনি আবার কাশী ছুটলেন।
(২৯)
কলিকাতায় ঈশ্বরচন্দ্র মায়ের পারলৌকিক ক্রিয়া করছেন। বীরসিংহ থেকে অন্যান্য ভাইরা এসেছে। গুরুদশা সকলের। কাজে আসতে পারল না বাড়ির মহিলারা। তাঁরা সেখানে নিয়ম মানছে।
শহরের বিশিষ্ট জনেরা মায়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে অনেকেই আগে এসে দেখা করে গেছেন ঈশ্বরচন্দ্রের সঙ্গে। সান্ত্বনা জানিয়ে গেছেন। ঈশ্বরচন্দ্র তাঁদের ধরে ধরে বলে দিয়েছিলেন, শ্রাদ্ধে উপস্থিত থাকতে। তাঁরা এসেছেন।
শ্রাদ্ধাদির কাজ করছেন পণ্ডিত মদনমোহন শাস্ত্রী। কাজ হচ্ছে সুকিয়া স্ট্রীটের বাড়িতে। বাড়িময় মেরাপ বাঁধা হয়েছে। সকাল থেকে কাজের তোড়জোড়। অনুষ্ঠান শুরু হল ন’টায়।
ঈশ্বরচন্দ্র কাজে বসলেন। সামনে মায়ের ছবি। আঁকানো পট। কম বয়সের ছবি। পা মুড়ে হাত জড়ো করে বসা। পরনে পট্টবস্ত্র। মাথায় কাপড়। মুখখানা গোলাকার। চেহারায় উজ্জ্বলতা। পটের সামনে থরে থরে সাজানো ফলমূলাদি, ফুলের সাজি, চাল ডাল তেল নুন আনাজ সহ সিধা। ঘরের চারদিকে চারটে প্রদীপ জ্বালানো হয়েছে। ধূনোর ধোঁয়ায় ঘর ভরা। সুগন্ধি ধূপের বাস ছড়িয়ে পড়েছে চারিদকে।
মায়ের ছবির মুখোমুখি বসা ঈশ্বরচন্দ্র। হাত জোড় । চোখ বন্ধ। পাশে বসা দীনবন্ধু। অন্য ভাইরা অন্যান্য কাজে ব্যস্ত। শাস্ত্রী মশাই মন্ত্র পড়ে চলেছেন। মনে মনে তা উচ্চারণ করছেন ঈশ্বরচন্দ্র। এ মন্ত্র তাঁর জানা।
দীর্ঘ সময় ধরে মন্ত্র উচ্চারণের মধ্যে দিয়ে শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠান চলেছে। ঈশ্বরচন্দ্র এক মনে ভক্তিভরে মন্ত্র পড়ে যাচ্ছেন। ঘরে অনেকেই উপবিষ্ট হয়ে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান দেখছে। সেখানে ভাইরা যেমন রয়েছে, রয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্রের বন্ধুস্থানীয় ব্যক্তি ও তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা।
একসময় তাঁর কাজ সুসম্পন্ন হল। আসন ছেড়ে উঠে গেলেন তিনি। ভাইদের ডাক পড়ল। পুরোহিতের নির্দেশে তাঁরা একে একে কাজ সারছে। সেও অনেক লম্বা সময় ধরে চলেছে।
চলবে…