উপন্যাস।। আবার এসো ফিরে।। রামেশ্বর দত্ত

সান্নিধ্যের ভাবনা আসাতে ঈশ্বরচন্দ্রের ভাবনা সুদূর প্রসারিত হয়। তিনি মনে করেন, এই যে তিনি নিজেই বা এখন কটাদিন দীনময়ীকে সঙ্গ দিতে পারছেন? কিন্তু দীনময়ী জানে,  স্বামী একবার গ্রামে আসলে, তাঁকে কাছে পাবেই। এই বয়সে শরীরের টান তো আর থাকে না; যা থাকে তা হচ্ছে দুজনের অন্তরের টান। স্বামী এসে সন্তানদের কাছে টেনে নিচ্ছে, তাদের অভাব অভিযোগ, আহ্লাদ স্বামী মেটাচ্ছে, তাতেই পত্নীমন বর্ষার জলে টইটুম্বুর পুকুরের মতো হয়ে যায়। এছাড়াও রয়েছে, দুজনের একটু কথা, অসময়ের একটু চোখাচোখি, নিভৃতে গা ছোঁয়াছুঁয়ি, রাতটুকু পাশাপাশি থাকা, সামান্য খিটিমিটি, কখনও মতান্তর, তা থেকে মনান্তর, তারপর এক রঙিন রাতে  রাগ অভিমান ভেঙে পরস্পর পরস্পরকে বুঝে নেওয়া, কে দোষী, কে নির্দোষ, তার ফয়সালা ঘটিয়ে স্বামী–স্ত্রীর মাঝে আজীবন ঘটে চলা সোহাগ আদর, এর মূল্যই বা কম কি? এতেই তো দুজনের অন্তর বাঁধা পড়ে থাকে আমৃত্যুঅথচ, মায়ের ক্ষেত্রে, তাঁর কাকে পাবার আছে? নেই নেই, কেউ নেই…

এরপর

পর্ব- ২২ 

  ভেবে ভেবে ঈশ্বরচন্দ্র কুল কিনারা করতে না পেরে মাস কয়ের মধ্যে আবার একদিন গ্রামের দিকে রওয়ানা দিলেন। মনে নানান পরিকল্পনা,- ভাইদের যার যার নিজের বাসা বাড়ি বানিয়ে দিয়ে পৃথান্ন করবেন। তাহলে সংসারের শান্তি বজায় থাকবে। খরচ খরচা তিনি নিজেই করবেন। এখন তো অর্থের টান নেই যদিবা বাইরের বেশ কিছু ধারকর্জ রয়েছে। তা শোধ করে দিতে পারবেন। বই বিক্রিতে অর্থাগম মন্দ হচ্ছে না। নয় নয় করে নিজের লেখা পনেরোখানা বই বাজারে কাটছে।

প্রথম থেকে এক এক করে বইগুলোর নাম মনে করছেন আর পথ ভাঙছেন,-প্রথম বই বাসুদেব-চরিত, সেই কোন বাইশ বছর আগের লেখা। বইটার চাহিদা এখনও কম হয়নি। এছাড়া রয়েছে, বেতালপঞ্চবিংশতি, বাংলার ইতিহাস, জীবনচরিত, বোধোদয়, সংস্কৃত ব্যাকারণের উপক্রমণিকা, তিন ভাগে ঋজুপাঠ, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যবিষয়ক প্রস্তাব, শকুন্তলা, বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা- এতদবিষয়ে দুখানা পুস্তক, কথামালা, চরিতাবলী, মহাভারত (উপক্রমণিকা)…

শেষোক্ত বইটার বিষয়ে তাঁর মনে পড়ছে, এটি তিনি তত্ত্ববোধিনী সভার দ্বারকানাথ ঠাকুরের অনুরোধক্রমে সংস্কৃত ভাষার মূল গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ, যা কিনা ওই পত্রিকায় ক্রমে ক্রমে প্রকাশিত হয়েছিল, রচনা করেন। আর ঠিক সেইকালে দেবেন্দ্রনাথের শেষ সন্তানের জন্ম হয়; পুত্র সন্তান। দেবেন্দ্রনাথ যার নাম রাখলেন রবীন্দ্রনাথ। চোদ্দো সন্তানের শেষ তিনিই।

এবার মনে পড়ছে, এরপরেও তিনি লিখেছেন, সীতার বনবাস, আখ্যানমঞ্জরী, আর সব শেষ তো বেরিয়েছে ভ্রান্তিবিলাস।

ভ্রান্তিবিলাস বইটার কথা কেমন করে মাথায় খেলল, ভাবতেই মনের ভিতরে একটা হাসির ঝলক উঠল। মহাকবি সেক্সপিয়ারের কমেডি অফ এররস পড়ছিলেন। তখনই ভাবনাটা মাথায় আসে। এরপর রোজ পনেরো মিনিট সময় নিয়ে মাত্র পনেরো দিনে বইটার রচনা শেষ করলেন। এমন একটা হাস্যকৌতুক মার্কা বই হাতে পেয়ে পাঠককুল এখন তা গোগ্রাসে গিলছে। অথচ লেখাবার সময় কত চিন্তাই না হচ্ছিল,-বাঙালির রক্ষণশীল সমাজের কাছে বিদেশী নাটকের রূপান্তর সাদরে গৃহীত হবে তো?

ভ্রান্তিবিলাসের পরবর্তী ভাবনা এসেছে, বহুবিবাহ রোধের বিষয়। তার ওপর দুখানা পুস্তক রচনায় হাত দিয়েছেন। আর এর মাঝেই কিনা, বাবার কাশী যাওয়া, মায়ের একলা হয়ে পড়া, এমনকি বসত বাড়িটাও ভস্মীভূত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটল!…

ভাবলেন, যাক, যা হবার, তা হয়েছে। ওই নিয়ে পড়ে থাকলে দিন এগোবে না, তাই মাকে কলিকাতায় নিয়ে এসে থিতু হয়ে বসে বহুবিবাহের বিষয়টা নিয়ে উঠেপড়ে লাগতে হবে।  বহু বিবাহও সুস্থ সমাজকে দূষিত করছে; এ জিনিষ চলতে পারে না।

পাল্কির দুলকি চালে তাঁর সারা শরীর দুলছে, আর তিনি ভাবছেন, সতীদাহ নিবারণ করে রাজা রামমোহন বিধবা নারীকে  দ্বিতীয় জীবনের দ্বারে পৌঁছিয়ে দিয়ে গেছেন। এবার তিনি নিজের সাধ্যে বিধবা বিবাহ প্রচলন করিয়েছেন। যৌবনবতী বিধবা নারীকে জীবনের অভিশাপ থেকে মুক্ত করেছেন, নারী শিক্ষার ধারা বইয়েছেন। তবে তাঁর কাজ এখনও  শেষ হয়নি।  নারীর যৌবনকে নিয়ে ছিনিমিনি; সে বিধবা হোক, বা সধবা, বহুবিবাহের নাগপাশ থেকে তাদেরকে মুক্তি এনে দিতে হবে। তবেই, এ ঘুণধরা সমাজের সংস্কার সাধন হবে।  এজন্যে তাঁকে আবার কলম ধরতে হবে। জানাতে হবে, বহুবিবাহ রহিত উচিত কিনা, তার বিচারের ভার তুলে নিতে হবে। এ জন্যে, যত বই লিখতে হয়, লিখবেন, প্রচার করবেন। এখানেও দেশের সরকার দ্বারা আইন প্রণয়ন করাবেন…। একটার পর একটা পরিকল্পনা।

পথের শেষ থাকলেও ঈশ্বরচন্দ্রের পরিকল্পনার শেষ নেই। ঈশ্বরচন্দ্র এলেন বীরসিংহে। নারায়ণচন্দ্র কলিকাতায় রয়ে গেছে। সেখানে বাড়িতে সে একলা। একটা চাকরি করছে। মাস মাইনে দশ টাকা। তাঁর পক্ষে বাবার মতো মন করলেই যখন তখন গ্রামের বাড়ি চলে আসতে পারে না। নারায়ণচন্দ্র সেদিন কাজে বেরবার উদ্যোগ নিচ্ছে, হঠাৎ সদর দরজার বাইরে থেকে ডাক, ঈশ্বরচন্দ্র মশাই বাড়ি আছেন?

-কে? নারায়ণচন্দ্র বেরিয়ে এল। সামনেই এক ভদ্রলোক। উত্তর করল, আমার নাম মুচিরাম । মুচিরাম বন্দ্যোপাধ্যায়।

-বলুন। বাবা তো বাড়ি নেই।

-অ…। ভদ্রলোককে একটু নিরাশ দেখাল।

-আচ্ছা, ওনাকে কখন পাওয়া যাবে? বিশেষ এক কাজে ওনার কাছেই এসেছি।

-বাবা গ্রামে গেছে। ফিরতে দেরী হবে। আপনি কোথা থেকে আসছেন, জানতে পারি কি?

-আমি আসছি মেদিনীপুরের ক্ষীরপাই থেকে।…কিন্তু আমার যে ওনাকে বিশেষ প্রয়োজন।

-খুব দরকার থাকলে আপনি বীরসিংহ গ্রামে গিয়ে বাবার সঙ্গে দেখা করতে পারেন। এখানে আমি কি আপনাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?

মুচিরাম বাবু চুপ করে কী  ভাবল। পরে বলল, সমস্যাটা আমার বিবাহ সংক্রান্ত। কিছু যদি মনে না করেন, তাহলে বলি, আমি ক্ষীরপাইয়ের কেচকাপুর ইশকুলে হেড পণ্ডিত। আমার পছন্দে যে পাত্রী রয়েছে, তার নাম মনোমোহিনী। কাশীগঞ্জ নিবাসী শ্রীযুক্ত কাশীনাথ পালধির কন্যা। অল্প বয়সে বিধবা হয়েছে। আমি ওই মেয়েকে বিয়ে করতে চাই। এবিষয়ে আপনার বাবার সহায়তা আমার প্রয়োজন। আপনি কি আমাকে কোনও সাহায্য করতে পারেন? আপনি তো ওনার ছেলে।

নারায়ণ ভাবল, বাবার অবর্তমানে এ বিষয়ে ওনাকে বিশেষ কিছু পরামর্শ দেবার সাহস নিজের নেই। বরং গ্রামেই পাঠিয়ে দেওয়া ভালো। তাও সরাসরি বাবার কাছে নয়। সেজকাকার কাছে পাঠালে কাকা যা ভাল বুঝবে, তাই করবে। বলল, আপনি বরং গ্রামেই যান। সেখানে আমার সেজকাকা, শম্ভুচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করুন। যা ব্যবস্থা উনি করে দেবেন। আমি কি একটা চিঠি লিখে দোবো?

-তাহলে তো ভালই হয়। সেখানেই যাই। আপনার বাবা এবং কাকার সঙ্গে দেখা করি। আশাকরি, ওনারা আমার এই সমস্যা মিটিয়ে দিতে পারবেন, তাই না?

মুচিরাম উৎসাহের সঙ্গে নারায়ণের দিকে তাকিয়ে রইল।

-তা পারবেন। তাছাড়া, আমিও শিগগীর গ্রামে আসছি। আমি আপানকে সাহায্য করব। বলে, মুচিরাম বাবুকে ঘরে বসিয়ে চিঠি লিখে হাতে দিয়ে দিল নারায়ণচন্দ্র। সে বেরবার আগে জল মিষ্টি খাইয়ে বিদায় দিল।

দুদিন পরে মুচিরাম  বীরসিংহে পৌঁছল। চিঠি সমেত শভুচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করল। ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে শম্ভুচন্দ্র মুচিরাম বাবুকে নিয়ে গেলেন বড়দার সামনে।

ঈশ্বরচন্দ্র বসেছিলেন নিজের পাঠাগারে। সামনে কয়েকজন ব্যক্তি। গ্রামের কেষ্টবিষ্টু। তাঁদের নিয়ে বসে কিছু আলোচনা সারছিলেন। শম্ভুচন্দ্র ঘরে ঢুকে দাঁড়ালেন। ঈশ্বরচন্দ্র ভাইকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কিছু বলবি?

-দাদা, ক্ষীরপাই থেকে মুচিরাম বন্দ্যোপাধ্যায় নামের এক ব্যক্তি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

-আমার সঙ্গে! কেন, কী ব্যাপার?

-কিছু বিশেষ কথা রয়েছে ওনার।

ঈশ্বরচন্দ্র সামনের জনদের দিকে তাকালেন। বললেন, আজ তাহলে এখানেই কথা শেষ করো।…দেখি ভিন জায়গা থেকে কে এল…,বলতে বলতে চেয়ার ছেড়ে উঠে বাইরে এসে দাঁড়ালেন।

মুচিরাম সেখানে দাঁড়িয়ে। শম্ভুচন্দ্র দাদার পিছন পিছন এসেছেন। উভয়ের পরিচয় করিয়ে দিলেন। মুচিরাম হাত বাড়িয়ে ঈশ্বরচন্দ্রের পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। সঙ্গে শম্ভুচন্দ্রের প্রণামটাও এখন সারল। উভয়ের থেকেই মুচিরাম বয়সে নবীন।

প্রাথমিক কথায় গৌরচন্দ্রিকা সারা হল। ঈশ্বরচন্দ্র মুচিরামকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। নিজেও উপবেশন করলেন। কথা শুরু করল মুচিরাম, পাত্রী খুবই সুশীলা। অল্প বয়স্থা। তবে বিধবা বলে আপত্তি হচ্ছে।

-আপাত্তিটা কার? ঈশ্বরচন্দ্র প্রশ্ন করলেন, তোমার বাড়ির?

-না। না। আসলে আমি হচ্ছি একজন রমণীর ভিক্ষাপুত্র। ক্ষীরপাইয়ের হালদার গিন্নীর। আপত্তিটা আসছে সেখান থেকে।

ঈশ্বরচন্দ্র ভ্রু কোঁচকালেন। বিরক্তির প্রকাশ। বললেন, তা কেন হবে? এজন্যে তো তোমার বিবাহ বন্ধ হতে পারে না।

-সেকারণেই আপনার কাছে আসা, বিদ্যাসাগর মশাই। বিধবাবিবাহের নিয়ম কী বলে? আপনি তো এ বিষয়ে সুপণ্ডিত। আপনার সহায়তা ব্যতীত আমার বিয়ে আটকে যাবে।

  ঈশ্বরচন্দ্র মুচিরামের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে কিছু ভাবলেন কিছুক্ষণ। পরে উত্তর করলেন, বিয়ের প্রস্তুতি নাও। আমি ওঁদের সঙ্গে কথা বলছি।

খুশি মনে চলে গেল মুচিরাম। বিয়ের প্রস্তুতি শুরু করল। বিয়ে ক্ষীরপাইয়ে হবে না। হবে বীরসিংহ গ্রামে। ঈশ্বচন্দ্রের উপস্থিতিতে। তিনিই হবেন এই বিয়ের উদ্যোক্তা। সেখানে উপস্থিত থাকবে শম্ভুচন্দ্র, নারায়নচন্দ্র সহ আরও অনেকে।

কলিকাতায় নারয়নচন্দ্রের কাছে খবর চলে গেল। মুচিরামের বিয়ের আগে সেও গ্রামে আসছে, এমন বার্তা এসে পৌছালো শম্ভুচন্দ্রের কাছে। সকলে খুশি। এক বিধবা মেয়ের বিয়ে দিতে পারছে। সমাজের উপকার হচ্ছে। সঙ্গে একটা দিন হৈ চৈ করা যাবে। যোগাযোগ চলতে থাকল বীরসিংহ আর ক্ষীরপাইয়ের মধ্যে। মুচিরাম  আনন্দে উদ্বেল।  চলে এল বীরসিংহ গ্রামে। বিবাহ কাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকবে। কন্যাপক্ষের লোকজনকেও সেখানে আনিয়ে নিল। দুপক্ষের থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত করা হল গ্রামের সনাতন বিশ্বাসের বাড়িতে। ঈশ্বরচন্দ্রের বাড়ির প্রায় নাকের ডগায়। বন্দোবস্তের সৌজন্যে কাকা , ভাইপো । শম্ভুচন্দ্রের সঙ্গে যোগ দিলেন মেজদা, দীনবন্ধু। পাশে রাখলেন নারায়ণকে।

কিন্তু আশা কুহকিনী হল!

ক্ষীরপাইয়ের হালদারদেরা যার পর নাই প্রচেষ্টা স্বত্বেও এ বিয়ে রহিত করতে না পারায় এবার তেড়েফুঁড়ে উঠলেন। সোজা তাঁরা চলে এলেন একেবারে ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে। তাঁর সামনে কেঁদেকেটে পড়লেন। নাকের জল চোখের জল এক করলেন হালদার মশাই। ঈশ্বরচন্দ্রের পায়ে পড়লেন, আপনি এ বিয়ে বন্ধ করুন। কোনও মতেই  মুচিরামের ভিক্ষামা এ বিয়ে মানতে পারবে না। তিনি আমারই স্ত্রী।

-আরে মশাই, স্ত্রীকে বোঝান। এই বিয়েতে একটা মেয়ে উদ্ধার হচ্ছে। হোক না সে বিধবা। সেও তো মেয়ে…, আপনার স্ত্রী নিজে মেয়ের জাত হয়ে আর একটা মেয়ের সুখী জীবনের পথে কেন বাধ সাধছেন?  ঈশ্বরচন্দ্র যুক্তি দিলেন।

-না। না। হতে পারে, আমার স্ত্রী মুচিরামের গর্ভধারিণী নয়। তবু তো তাকে ভিক্ষে করেই পেয়েছে। এর মূল্য কি এই? আপনি তো শুধু বিদ্যার সাগর নন, দয়ারও সাগর। আপনি দয়া করুণ। তা না হলে, স্ত্রী আমার প্রাণ ত্যাগ করবে। এমনটাই বলেছে।

ঈশ্বরচন্দ্র মহা ফাপরে পড়লেন। কোনও কথা দিতে পারছেন না।  দুদিন ধরে তাকে বোঝালেন। কিছুতেই বুঝতে  চাইছে না হালদার মশাই। এদিকে মুচিরামকেও হ্যাঁ, বলে দিয়েছেন। এখন তাঁকে নিষেধ করলে কথার খেলাপ হবে। কুল রাখি, না মান রাখি অবস্থা ঈশ্বরচন্দ্রের।

ঠিক সেইসময় একদিন হালদার নিজের দলবল সহ বীরসিংহের বিশিষ্ট কয়েকজনকে নিয়ে ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে হাজির।  ইতিপূর্বে বিধবা বিবাহে ঈশ্বরচন্দ্রকে নানা বিষয়ে সহায়তা করেছে ওই বিশিষ্ট জনেরা। এখন কী করে যেন হালদার তাঁদের এ বিয়েতে মত না দিতে রাজী করিয়ে ফেলেছে। তারা আসল। মুচিরামের বিয়ের বিরুদ্ধে নানান যুক্তি দেখাল। ঈশ্বরচন্দ্র মানছেন না। তারা যুক্তি দিল, আপনি বিবাহের উদ্যোগ থেকে সরে আসুন। নিরপেক্ষ থাকুন। দেখবেন, এ বিয়ে হবে না।

অগত্যা ঈশ্বরচন্দ্র অঙ্গীকার করলেন, মুচিরাম- মনোমোহিনী বিবাহে কোনও সংস্রব রাখবেন না।  যারা বিবাহ বন্ধের জন্যে এসেছিল, হৃষ্ট চিত্তে ফিরে গেল। ঈশ্বরচন্দ্র সরে দাঁড়ালেন। আর কোনও গা করছেন না বিয়ের ব্যাপারে। সেখানে যাচ্ছেন না। মুচিরামের দলের জানতে বাকি রইল না, ঈশ্বরচন্দ্র বেঁকে বসেছেন। অথচ মুচিরাম এই মেয়েকেই বিয়ে করবে। এতদূর এগিয়ে সেও পিছু হটল না। শম্ভুচন্দ্র, নারায়ণচন্দ্রকে হাত করল । পরামর্শ হল, গোপনে বিয়ে সারা হবে।

বিয়ের দিন এলো। ঈশ্বরচন্দ্র নিশ্চিত মনে রয়েছেন। জানেন, বিয়ে হচ্ছে না। তিনি ভিন্ন, এ বিয়ের মত আর কেউ দিতে পারে না।

এ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল। কিন্তু গোল বাঁধল পরেরদিন ভোরে।

অভ্যাস বশে ঈশ্বরচন্দ্র সেদিনও ভোরেই উঠেছেন। ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে নামলেন। হাতমুখ ধুলেন। প্রাতঃকৃত্য সারলেন। উঠে এলেন ওপরে। বারান্দায় চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন। বাড়ির সকলে তখনও ঘুমচ্ছে। হুঁকো ধরালেন।  ভোরের মিষ্টি হাওয়া গায়ে লাগছে। মেজাজে হুঁকো টানছেন।  ধীরে ধীরে পূবের আকাশ লাল হচ্ছে। তাকিয়ে আছেন সেদিকে।

হঠাৎ মাঙ্গলিক শব্দ কানে এলো। সানাই বাজছে না? কিসের সানাই! কার বিয়ে হল? গ্রামে বিয়ে, অথচ তাঁর কাছে খবর নেই!

হুঁকো টানা থেমে গেল। নল নামিয়ে রাখলেন মুখ থেকে। চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। নীচের তলায় নেমে এলেন। ঘরে ঘরে খোঁজ নিতে থাকলেন। বাড়িতে তিনি ছাড়া দ্বিতীয় পুরুষমানুষ আর কেউ নেই! ভাই বউদের প্রশ্ন করলেন, ওরা সব কোথায়? মাথা নিচু করে উত্তর দিল, ওবাড়ির বিয়েতে গেছে।

-বিয়ে! কার বিয়ে?

-মুচিরাম বাবুর। সনাতন বাবুর বাড়িতে কাল রাতে মুচিরাম- মনোমহিনীর বিবাহ হয়েছে।

ঈশ্বরচন্দ্র থমকে গেলেন। চড়াক করে মাথায় রক্ত উঠে গেল। মুখ লাল। বলে উঠলেন, এত বড়  সাহস! আমি নিষেধ করা সত্বেও এই বিয়ে হল! বুঝেছি। এ কাজ শম্ভু, দিনু, নারায়ণের। সঙ্গে ঈশানও হর্তাকর্তা সেজে এ কাজ করেছে…

রাগে গরগর করতে করতে উপরে উঠে এলেন। মনে মনে আওড়াতে থাকলেন, সকলে এক মাথা হয়ে গ্রামের বিশিষ্ট জনদের কাছে আমার নাক কাটল…!

ঈশানকে ডেকে পাঠালেন।  সে আসল। গর্বের সঙ্গে মাথা তুলে দাঁড়াল। যেন এক মহৎ কিছু কাজ করেছে। ঈশ্বরচন্দ্র প্রশ্ন করলেন, এ কাজ তোরা করলি কেন?

সে দাদার সামনে দাঁড়িয়ে দিব্যি চোটপাট যুক্তি দিল, মুচিরামবাবুর বিয়েতে তো তুমিও মত দিয়েছিলে, দাদা।

-দিয়েছিলাম ঠিকই, তবে পরে তো আমি নিরপেক্ষ থাকবার কথা জানিয়েছিলাম, তারপরেও এ বিয়ে হল কেমন করে? বিয়ের অর্থ পেলি কোথা থেকে?

রাগের মাথায় প্রশ্ন করে চললেন । ঈশানও সেসবের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। জবাব দিল, চাঁদা তুলে অর্থ জোগাড় করেছি।

-ভালই করেছিস। গ্রামের লোকের কাছে আমার নাক কেটেছিস…

-এতে তো লজ্জার কিছু নেই? বিধবা বিবাহে এতকাল অর্থ তো তুমিই দিয়ে এসেছ। এবার না হয় গ্রামের লোকেরা তা দিয়েছে।…দাদা, তুমি তো নিরপেক্ষ থাকবে বলেছিলে। নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলে এই অনুষ্ঠান থেকে। তাহলে নিরপেক্ষ থাকলে এখনই বা  এই নিয়ে অত চিন্তা করছ কেন? ধরো না, বিষয়টা তোমার অগোচরে ঘটেছে।

-ঈশান, তুই কি এখনও সেই আগের মতো দুর্মুখ আছিস? এভাবে কি চিরটাকাল থাকবি?

-আমার বিষয়ে তুমি যা মনে করো, তাতে আমার কিছু বলবার নেই। তবে, আমার মনে হয়েছে, এ কাজ তোমার দেখানো পথ ধরেই আমরা সুসম্পন্ন করেছি। বিধবা-বিবাহ প্রচলনের জন্যে দেশের মানুষ তোমাকে প্রধান উদ্যোক্তা বলে মানে। তোমায় জিজ্ঞেসও করেছিলাম, এই বিবাহ ন্যায্য কিনা। স্বীকার করেছিলে, এ শাস্ত্রসম্মত। ন্যায্য; কিন্তু হালদারবাবুদের মনে দুঃখ হবে।… , আমার কথা হচ্ছে, লোকের খাতিরে এসব বিষয়ে ক্ষান্ত হওয়া তোমার মতো মানুষের পক্ষে দোষের কথা।

ঈশ্বরচন্দ্র একেবারে চুপ করে গেলেন। ঈশানের কথা তাঁর মাথায় বজ্রাঘাত করল। ভাবছেন আর মনে মনে আওড়াচ্ছেন, এ ছেলেকে যতই কিনা দুর্মুখ বলে গাল পাড়ি, ওর যুক্তিতে ধার আছে। কিন্তু তবু কী, গ্রামের সেই বিশিষ্টজন বা হালদারবাবুদের কাছে আমার মাথা হেঁট হল না? তাঁরা কী ভাববেন, আমি চোরকে বলি চুরি করতে আর গৃহস্থকে উপদেশ দিই ঘুমিয়ে থাকতে?- এ তো দ্বিচারিতা করা, এ আমার স্বভাব বিরুদ্ধ। আমি এ কাজকে ঘৃণা করি।

নিজের ওপরেই নিজের রাগ হতে থাকে তাঁর। স্ববিচারে তিনি হেরে যাচ্ছেন। তাঁর জ্ঞান, প্রজ্ঞা, অধ্যাবসায়, সহমর্মিতা, সহবেদনা, দানধ্যান, সবই কি তাহলে বৃথা! মাথায় রক্ত চড়ে যাচ্ছে। চোখমুখ লাল হয়ে উঠছে, কানের লতি গরম হয়ে উঠেছে, নাসিকারন্ধ্র উষ্ম শ্বাস-প্রশ্বাস বহন করছে, চোখের দৃষ্টি কুয়াশার মতো আস্তরণে ঢেকে যাচ্ছে ধীরে ধীরে…

মানুষ যখন নিজ বিচারে নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করেও মনের রাগ-দ্বেষ-অভিমান অবসানে পথের কূলকিনারা করতে পারে না, তখনই সে কিছু এমন ঘটনা ঘটিয়ে বসে, যা  আদৌ স্বাভাবিকের মতো হয় না। ঈশ্বরচন্দ্রের ক্ষেত্রেও তাই ঘটল। মুহূর্তে ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা করে বসলেন, তিনি নিজেই এ গ্রাম পরিত্যাগ করবেন। বীরসিংহ গ্রামে আর ফিরে আসবেন না কোনওদিন। সকলকেই তা জানিয়ে দিলেন।

চণ্ডাল রাগ। অলুক্ষণে কথা! অর্বাচীনের সিদ্ধান্ত! কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র তো তা নন? দোষ না হয় করেছে নিজের ভাইয়েরা। তাই বলে পরিবার,  ছেলেমেয়ে, বীরসিংহ গ্রাম, সকলে কী দোষ করল? এমন এক সুপণ্ডিত, জ্ঞানী, পরোপকারী, দয়াময় ব্যক্তিকে গ্রাম হারাবে?…তাই কি হয়?

ঘর বার থেকে অনুরোধ উপরোধ আসতে শুরু করল, যা হবার হয়ে গেছে, আপনি চিরতরে গ্রাম ছেড়ে যাবেন না। দীনময়ীদেবী কান্নাকাটি শুরু করলেন। ভগবতীদেবীও কেঁদে ভাসাচ্ছেন। সকলকে তিনি সান্ত্বনা দিলেন, যখন ইচ্ছে করবে কলিকাতায় আমার কাছে চলে আসবে । সেখানে সুখে থাকবে।

প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে দীনময়ীদেবী যুক্তি দেখালেন, এভাবে আপনি সরে দাঁড়ালে, আপনার বাকি দায়িত্ব কেমন করে সারবেন? আমার কথা না হয় বাদই দিলাম; কিন্তু ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। তাদের বিয়ে-থা দিতে হবে। সেসব কেমন করে হবে?

-দীনময়ী, আমি কি এতই অবিচক; নাকি দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষ? তোমার এ চিন্তা আমারও রয়েছে। তবে চিন্তার কিছু নেই, গ্রামে না এসেও সঠিক সময়ে সঠিক ভাবে আমি ওদের বিয়ে-থা দোবো। আর যদি মনে করো, আর্থিক দিকের কথা, সেবিষয়েও আমি সব বন্দোবস্ত করেই যাব। তাতে বাড়ির খরচ খরচা, গ্রামের স্কুল , ছাত্রাবাস, দাতব্য চিকিৎসালয়, রাখালস্কুল, বালিকাবিদ্যালয়, সবকিছুর জন্যে  মাসিক খরচের বরাদ্দ করেই তবে যাব।

সব দুঃখকে হজম করেও দীনময়ীদেবীকে মেনে নিতে হল স্বামীর কথা। তবু নারীর মন। রাতের শয্যায় দিনের পর দিন কান্নাকাটি, অভিমান, অভিযোগ চলতেই থাকল। ঈশ্বরচন্দ্রও অভীষ্ট পূরণের জন্যে তাঁর কথিত কর্মাবলী সুচারু ভাবে সম্পন্ন করবার কাজে লেগে গেলেন।

দীনময়ী সে রাতে প্রকাশ করে বসলেন তাঁর ঠাকুরপোদের নানান দোষের কথা। স্বামীকে আগ বাড়িয়ে বলেও ফেললেন, এ সংসার আপনি পৃথাগন্ন করে দিন। তাতেই শান্তি হবে আপনার। এখন তো সবাই যা হোক করে উপার্জন করছে, তাতে না হয়, তাঁদের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করে নিতে পারবে। এবার নিজের দিকে মন দিন। আপনি আমাদের ছেড়ে যাবেন না।

-তোমাদের ছেড়ে যাচ্ছি কই? আমি বলছি, আমি নিজে আর বীরসিংহে আসব না। চাইলে তোমরাও আমার কাছে গিয়ে থাকবে। সকলকে নিয়ে থাকবে। আর ভাইদের পৃথাগন্ন করবার কথা বলছ, সেটা আমি আগেই ভেবে রেখেছি। তবে এক-দু বছর আমাকে সময় দাও। বাজারের কিছু দেনা রয়েছে, সেসব মিটিয়েই আমি এখানে ভাইদের জন্যে আলাদা আলাদা বসত বড়ি বানিয়ে দোবো। পারলে নারায়ণের জন্যেও একটা বাড়ি বানিয়ে দোবো। ক’দিন পরেই তো ওরও বিয়ে-থা হবে। আলাদা থাকবে। তবু তোমার চোখের সামনে থাকবে।

-আপনি এই গ্রামে আর না আসলে, আমিও বাবার কাছে গিয়ে থাকব। হ্যাঁ, এটা বলে দিলাম।

দীনময়ীদেবী হাত বাড়িয়ে শায়িত ঈশ্বরচন্দ্রকে কাছে টেনে কপট রাগ দেখিয়ে কথাটা বললেন। ঈশ্বরচন্দ্রের মন ভিজে উঠল। স্ত্রীকে আদর করলেন। ওষ্ঠের স্পর্শ দিলেন দীনময়ীর আবেশভরা বন্ধ চোখের পাতায়।

পুরুষের আবেগ সহজে প্রকাশ হয়ে পড়ে। তায় যদি নারীর অচঞ্চল স্থিরতা সেই আবেগের সহায়ক হয়। তাকে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। তবে আবেগ তার চূড়ান্ত রূপ পায়, যদি কিনা বয়স, শরীর, সামাজিকভাবে দৃষ্টিকটু না হয়। ঈশ্বরচন্দ্র আর দীনময়ীদেবীর এক্ষেত্রে সবকটা প্রতিবন্ধকতাই বিদ্যমান। তাই অচিরে তাঁদের আবেগ স্থিমিত হতে বাধ্য হল।  ভিজে ওঠা মনটা ঈশ্বরচন্দ্রকে ভাবনায় ফেলল, বীরসিংহকে বিদায় জানানোর সিদ্ধান্ত বিষয়ে। কে জানত, হয়তো মনের তিনি পরিবর্তন সাধন করতেন; কিন্তু তায় বাধ সাধল একটা কথা। কথাটা আবার কে বলল? না, তাঁরই অন্নে প্রতিপালিত এক অতি অন্তরঙ্গ আত্মীয়। মুচিরামের বিবাহ বিষয়ে ঈশ্বরচন্দ্রের আপত্তির কারণে লোকটি এধার ওধার বলে বেরিয়েছে, জানেন, এখনই ওঁর ধোপা নাপিত বন্ধ করে দিতে পারি; আমাকে এখানে না চেনে কে?

কী ভীষণ অবমাননাকর উক্তি! যার নুন খাওয়া, তারই বে-গুণ গাওয়া!

কথাটা আবার ঈশ্বরচন্দ্রের কানে পৌঁছিয়ে দেবার লোকের অভাব হল না।

এই তো হচ্ছে দিনের হাওয়া। এখন পঞ্চাশের প্রৌঢ় ঈশ্বরচন্দ্রের থেকে বয়সে নবীন, তাজা রক্তের যুবকদের জোর বেশি। তাদের মান অপমান জ্ঞান কি আর সেই বিশ ত্রিশ বছর আগের মানুষগুলোর মতো রয়েছে? সব যুগেই যা হয়েছে,-প্রবীণদের সরিয়ে নবীনরা সমাজে আধিপত্ত খুঁজে নিতে ব্যস্ত হয়, তা এযুগেও ঘটল। নিজের মান থাকতে থাকতে এখন  বীরসিংহ থেকে বিদায় নেওয়াই শ্রেয়।

সিদ্ধান্ত পাকা করে নিজের জন্মস্থান, বাল্য কৈশোরের বৃন্দাবন, ভক্তির কাশী—মথুরা, ধর্মের মক্কা–মদিনা সম বীরসিংহ গ্রামকে চিরতরে বিদায় জানিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র চললেন। প্রতিজ্ঞা, যতদিন বাঁচবেন, গ্রামমুখো হবেন না।

 

(২৭)

ঈশ্বরচন্দ্র নিজ গ্রাম তো ছাড়লেন। কিন্তু সাংসারিক দায়িত্ব কি তাঁর পিছু ছাড়ল? না। ঘরে বাইরে সমান দায়িত্ব বহন করবার মানুষ তিনি।

হেমলতার বিবাহ দিয়েছেন। এবার নজর দিতে হচ্ছে নারায়ণের ওপর। কলিকাতার ইশকুল থেকে পালিয়ে গ্রামে ফিরে গেলেও বয়স তো তার বসে নেই। বিয়ের উপযুক্ত বয়স হয়েছে। মাসে দশ টাকা রোজগারের একটা চাকরি করছে। তাই ছেলের বিয়ের চিন্তা। সঙ্গে দ্বিতীয় কন্যা কুমুদিনীর জন্যে ভাবনা। সেও বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠেছে। ঈশ্বরচন্দ্র হিসেব কষে দেখলেন, যদি এই বছর নারায়ণের বিয়ে দেন, তবে পরের দুবছরের মাথায় কুমুদিনীকেও তিনি পাত্রস্থ করবেন।

 

এমনই সময়ে বীরসিংহ গ্রামে এসে উঠলেন এক মহিলা। সঙ্গে তেরো বর্ষীয়া এক কন্যা। মেয়ের নাম ভবসুন্দরী। ওই বয়সেই ভবসুন্দরীকে বৈধব্য বরণ করতে হয়েছে।

মেয়ের বাবার নাম ঁশম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। হুগলীর খানাকুলের কৃষ্ণনগর গ্রামের অধিবাসী তারা। মেয়ের মা, মেয়েকে নিয়ে বীরসিংহ গ্রামে এসেছেন ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে। বিধবা মেয়ের বিয়ের বন্দোবস্ত করতে। কিন্তু তিনি জানেন না যে ঈশ্বরচন্দ্র বরাবরের জন্যে গ্রাম ছেড়ে কলিকাতায় চলে গেছেন।

ঈশ্বরচন্দ্রকে না পেয়ে শম্ভুচন্দ্রকে অনুরোধ করলেন, কন্যা আমার এই বয়সেই বিধবা হয়েছে। শুনি,  ঈশ্বরচন্দ্র মশাই বিধবা কন্যাদের বিবাহের ব্যবস্থা করে দেন।  কথাটা তাঁকে জানালে ভাল হয়। আমার বিশ্বাস, তিনিই আমার ভবসুন্দরীর জন্যে একটা পাত্র ঠিক করে বিবাহ দেবার ব্যবস্থা করে দেবেন।

এ বিষয়ে শম্ভুচন্দ্রের বিশেষ কিছুই করবার ছিল না। তিনি বরং  মা,  মেয়েকে বাসায় রেখে কলিকাতায় দাদাকে সংবাদ দেবার উদ্যোগ নিলেন।

পত্র পাওয়া মাত্র ঈশ্বরচন্দ্র অল্পদিনেই এক পাত্র ঠিক করে ফেললেন। পাত্র কলিকাতার। শম্ভুর কাছে দাদার পত্র এলো , পাত্র ঠিক হয়ে গেছে, তুই ওই রমণী সহ কন্যাকে নিয়ে আয়। এখানেই ওর বিবাহ দোবো।

ঈশ্বরচন্দ্র বিধবা ভবসুন্দরীর বিবাহ সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে রয়েছেন। অথচ এদিকে নারায়ণের ওই কন্যাকে দেখে ভালো লেগে গেছে। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, ভবসুন্দরীকে বিয়ে করবে।

নারায়ণ বাবকে পত্র দিল।  দেখুন, আমার এমন কোনও গুণ নাই যে আপনার মুখোজ্জ্বল করি, তবে আপনার জীবনের মহৎ ব্রত, বিধবাবিবাহ প্রচলন করে , বাল-বিধবার ভীষণ বৈধব্যযন্ত্রণা দূর করা। এ অধম সন্তানের তা অবশ্য সাধ্যায়ত্ত। আমি তাতে পশ্চাদপদ হব না। তাতে আপনাকে কতকটা সন্তুষ্ট করতে পারলেই আমার জীবন ধন্য হবে, আর তাহলে বোধ হয়, আপনার সদভিপ্রায়ের বিপক্ষবাদীরাও সন্দিহান হতে পারবে না।

 

চলবে…

 

Ilustration- Gaganendranath-Tagore, Abanindranath Tagore, Rabindranath Tagore, google

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page