কথা দাও বন্ধু আমার যাইবা না ছাড়িয়া।। দীপংকর চন্দ
অন্ধকারে নিপতিত শিশিরবিন্দু আলোর স্পর্শে সাধারণত মরে যায়। নিঃশব্দে।
নিশ্চুপ জন্ম, নিঃশব্দ প্রস্থান।
মহাপ্রস্থান।
একটা দীর্ঘশ্বাস নেমে আসে বৃন্দাবন দাসের বুক চিড়ে।
তবু মন্দ কি! উদাস মনে ভাবে সে। কেউ বুঝলো না, কেউ চিনলো না, মনের খবর রাখলো না কেউ, এভাবে যদি একদিন সে পাড়ি জমাতে পারে পরপারে, কতো ভালোই না হয়!
কিন্তু অমন ভাগ্য করে কি পৃথিবীতে এসেছে বৃন্দাবন দাস!
মনে হয় না! পদ্মকচুর সদ্য জন্মানো পাতার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ দীনহীন মানুষটির! এতো বেলা হলো, অথচ কী বিস্ময়করভাবে পদ্মকচুর সবুজ সতেজ পাতায় একটা শিশিরবিন্দু জীবন্ত তখনও!
পদ্মকচুর সবুজাভ আভা আর সূর্যের তির্যক আলো মিলে পান্নার মতো দেখাচ্ছে শিশিরবিন্দুটিকে!
বৃন্দাবন দাসের পরিবার কয়েক পুরুষ আগে জমিদার ছিলো। দাদুর মুখে ছোটবেলায় সে শুনেছে পান্না নাকি সবুজ হয় দেখতে!
বৃন্দাবন দাস নিচু হয়ে বসে। পদ্মকচুর পাতার কাছাকাছি আনে মুখ। ফিসফিস করে জানতে চায় সবুজ শিশিরবিন্দুর কাছে, কী গো সুন্দরী, আছো কেমন? মনের খবরাখবর কী গো তোমার?
শিশিরবিন্দু তার অবিচল নৈঃশব্দ্য অটুট রাখে, বজায় রাখে অভেদ্য গাম্ভীর্য নিরুত্তর প্রহরে।
তাতে বৃন্দাবন দাস কিছু মনে করে না। পৃথিবীর প্রচলিত নিয়মে সে ভালোভাবেই বুঝেছে সব প্রশ্নের উত্তর প্রত্যাশা করতে নেই!
তবে প্রশ্ন করতে কি কোন নিষেধ আছে?
না, নেই তো!
স্বপ্রণোদনায় গান শোনাতেও কোন নিষেধ নেই নিশ্চয়ই!
তাই সে সহাস্যে শিশিরবিন্দুকে বলে, গান শুনবা সুন্দরী? শোনো, বলেই দোতারায় শব্দ তোলে বৃন্দাবন দাস, টুং-টাং শব্দের সাথে যোজন করে গত রাতে সদ্য সাজানো কথামাথা-
“-যতো খুঁজিলাম তোমারে
এতো খোঁজাখুজির পরে
জানি আমি যথাযথ মিলিতো ঈশ্বর
মিলিলো না তবু তোমার মনেরই খবর-”
গান, যেন গান নয়! অভিমানের কথা, প্রাণের ব্যথা বৃন্দাবন দাসের।
“-যেনতেন বাউলা গানে
আঁখিজল অভিমানে
সহিলাম সকল ব্যাথা সকল অনাদর
মিলিলো না তবু তোমার মনেরই খবর-”
গাইতে গাইতে মাঠ পাড়ি দেয় বৃন্দাবন দাস। মাঠ। মাঠের পর ঘাট। ঘাট পেরিয়ে পায়ে চলার পথ। পথ পথ আর পথ! কোথায় যে পথের শেষ, কে জানে!
“-দোতারার সরল তারে
বাঁধিলাম জীবনটারে
খালি পায়ে দিলাম পাড়ি অচিন তেপান্তর
মিলিলো না তবু তোমার মনেরই খবর-”
দীর্ঘশ্বাসের মিছিল বুকে। এতো দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকা দায় ধুলোধূসর সময়ে! তবু বাঁচে মানুষ! তবু বাঁচতে হয়! হায় জীবন! জীবন আর মৃত্যু হাত ধরাধরি করে এগিয়ে যায় মায়ামাখা দিকরেখায়!
“-পায়ে পায়ে জড়ায় ধুলা
কাটায় দিলাম প্রহরগুলা
মেঘে মেঘে হইলো বেলা, রাত্রি অতঃপর
মিলিলো না তবু তোমার মনেরই খবর-”
মাঠের ওপার থেকে বৃন্দাবন দাসের গান ভেসে আসে মাতবর বাড়ির উঠানের পশ্চিমকোণে রান্নাঘরে। মাতবরের বড় মেয়ে রাহিমার মন চঞ্চল হয়। কেঁপে ওঠে চোখের পাতা। সজাগ হয় নিমেশে তার শ্রবণেন্দ্রিয়-
নতুন গান!! নতুন গান বান্ধছে বৃন্দাবন দা!
রাহিমার মা সুফিয়া খাতুন ডালে পাঁচফোরণ দিতে দিতে আড়চোখে লক্ষ্য করেন মেয়ের মুখের বদলে যাওয়া রঙ, চাপা চাঞ্চল্য। এই মেয়েটাকে নিয়ে বড়ো চিন্তা হয় তার। জ্যেষ্ঠ সন্তানের প্রতি আলাদা মমতা তো থাকেই প্রতিটি বাবা মায়ের, কিন্তু তার চেয়েও কিছুটা বেশি মায়া এই মেয়ের প্রতি সুফিয়া খাতুনের।
আম্মা। বৃন্দাবন দা নতুন গান বান্ধছে মনে হয়?
হইবো হয়তো! ডালের ঘুটনি খুঁজতে পাশ ফেরেন সুফিয়া খাতুন।
বৃন্দাবন দা গান কিন্তু ভালো বান্ধে!
বান্ধলে বান্ধে! হেইডা দিয়া আমাগো কী?
নাহ! আমাগো আবার কী! ভালো গান ভালো লাগনের কথা কইলাম। মাথা নিচু করে মায়ের প্রশ্নের উত্তর দেয় রাহিমা।
তয়, বৃন্দাবন পোলাডা সাদাসিধা! গেরামের কোন আপেলাপে নাই! আজইর্যা ক্যাচালে প্যাঁচালে নাই।
বৃন্দাবন দা আমাগো বাড়িত আসে না আম্মা?
আসে না মেলাদিন!
শেষ কবে আইছিলো?
বৃন্দাবনরে নিয়া গপসপ করনের সময় আমার নাই, সুফিয়া খাতুন বিরক্ত হন মেয়ের ওপর।
একটু মনে করো না আম্মা! সুফিয়া খাতুনের গলা জড়িয়ে ধরে আবদারের সুরে আবার জানতে চায় রাহিমা।
ছাড় ছাড় গলা ছাড়। আমার দম বন্ধ হইয়া আসতেছে।
ছাড়ুম, আগে কও তুমি!
অতো কি আর খিয়াল রাখছি আমি। মনে লয়, তুই শহরে যাওনের পর আর আসে নাই আমাগো বাড়িত।
মায়ের গলা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় রাহিমা। কোন এক অচেনা আলোয় যেন ঝলমলে তার মুখ।
কি রে উঠলি ক্যান? সুফিয়া খাতুনের জিজ্ঞাসা।
ঘরে চিড়ার মোয়া আছে না আম্মা?
আছে তো!
মুড়ি?
আছে
বড়ো ঐ কাসার বাটিখান দ্যাও তো!
ক্যান? কি করবি? বাটি এগিয়ে দিতে দিতে জানতে চান সুফিয়া খাতুন।
বৃন্দাবন দা’রে দু’গা মোয়া মুড়ি দেই!
বৃন্দাবন! হেরে তুই কই পাইলি?
আইজ বৃন্দাবন দা মাতবর বাড়িত আসবেন।
কেমনে জানস তুই? তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়ের মুখের দিকে তাকান সুফিয়া বেগম। কেমন একটা সন্দেহের কুয়াশা জন্ম নিচ্ছে যেন তার মনে!
এমনে এমনেই জানি।
কার কাছে আসবো বৃন্দাবন?
মাতবর সাবের কাছে!
তর আব্বার লগে কী কাম অর?
কাম কী, হেইডা জানিনা, তয় আব্বার খোঁজে যে আসবে হেইডা জানি। বলতে বলতে মোয়া মুড়ি আনতে ঘরে যায় রাহিমা। মেয়ের গমন পথের দিকে চিন্তিত চোখে তাকিয়ে থাকেন সুফিয়া খাতুন।
“-যতো খুঁজিলাম তোমারে
এতো খোঁজাখুঁজির পরে
জানি আমি যথাযথ মিলিতো ঈশ্বর
মিলিলো না তবু তোমার মনেরই খবর-”
গান গাইতে গাইতে মাতবর বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ে বৃন্দাবন।
মাতবর সাব! ও মাতবর সাব। বাড়িত আছেন নি? মাতবর সাব-
বৃন্দাবন দাসকে হকচকিয়ে দিয়ে ডাকের অসমাপন্তে হুট করে খুলে যায় মাতবর বাড়ির দরজা!
না, নাই। মাতবর সাব বাড়িত নাই। মাতবর সাবের মাইয়া আছেন বাড়িত। তারে দিয়া চলবো আফনের কাম? হাসিমুখে জানতে চায় রাহিমা!
আরে রাহিমা যে! কাইল রাইতে শুনলাম বাড়িত আসছো-
হ, কাইল রাইতে আসছি। আর আফনে আইলেন আইজ বেলা দুই প্রহর পার কইরা। অবশ্য আমার খবর নিতে তো আসেন নাই, আসছেন মাতবর সাবের খোঁজে। বলেন, কী নালিশ! আব্বায় গঞ্জে গেছে। গঞ্জ থিকা ফিরলে আমি আপনের হইয়া সমস্ত কথা সবিনয়ে জানায় দিবানে- রাহিমার একটানা কথায় খেই হারায় বৃন্দাবন, কি থেকে কি বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। আমতা আমতা করে বলে, না- না, আসলে কোন নালিশ না- এই পথ দিয়া যাইতেছিলাম- ভাবলাম মাতবর সাবের একডা খবর নিয়া যাই-
অ- তাই কন! কিন্তু আব্বায় যে বাড়িত নাই! খবর আফনেরে দিবো কেডা?
ঠিক আছে! তোমার আব্বার খবর পরে নিবানে! তোমার খবর কও- কত কেলাস পাশ দিলা জানি?
আস্তে ধীরে বলি! একটু বসেন দাওয়ায়। নাকি তাড়া আছে?
কি যে কও!! আমার আবার তাড়া!
ক্যান? হুনলাম নয়া নয়া গান বান্ধতাছেন। টাউনের বড়ো বড়ো মানুষজনে নাকি গেরামে আসতেছে আপনের খবর নিতে!
ঐ আর কি!! কাইজ কাম না থাকলে মাইনষ্যের যা হয়! হুদাই লোকগুলান এতো কষ্ট কইরা সময় নষ্ট করে! লজ্জায় মাথা নিচু করে বৃন্দাবন। বলে, আমি গান বান্ধি মনের খিয়ালে- আউলা গান সব- মাথা নাই মু-ু নাই-
একটু আগে শুনলাম একখান নয়া গান গাইতেছেন-
হ, নয়া বান্ধিছি কাইল রাইতে- মিলিলো না তবু তোমার মনেরই খবর- তোমার বেরেন তো জব্বর গো কইন্যা!
তা সত্য। তয় কার মনের খবর খোঁজেন আফনে, কন দেহি?
হতভম্ভ বৃন্দাবনের হঠাৎ কাশি শুরু হয় প্রবল বেগে!
বালাই ষাট! বালাই ষাট! কিডা জানি আফনের স্মরণ নিতেছে। এই নেন পানি খান! ধরেন গিলাস-
হাত বাড়িয়ে দ্রুত গ্লাসটা নেয় বৃন্দাবন। একদমে পুরো পানিটুকু ঢেলে দেয় গলায়। তারপর কিছুটা অবাক দৃষ্টিতে গ্লাসটা নামিয়ে রাখতে রাখতে বলে, পানি কি হাতের নাগালেই আছিলো?
হ, আমি তো গণা জানি। জানতাম আফনের কাশি উঠবে, হেই কারণে আগেই পানির বন্দোবস্ত। চিড়ার মোয়া আর মুড়িও রাখছি লগে। এই লন। কাসার বাটি এগিয়ে দেয় রাহিমা।
এইসব আবার ক্যান গো কইন্যা!
সকালে নাস্তা করছেন?
মানে, ইয়ে-
ইয়ে মানে কিয়ে? আফনের প্যাঁচাইনা বাংলা বুঝিনা আমি। সিধা বাংলায় কন, করলে হ, নাইলে না!!
তোমার কি মনে হয়?
আমার মনে হয়, না, মানে নাস্তা করেন নাই!
যদি কই, তোমার মনে হওয়া বেঠিক!
আমার মাথা ছুঁইয়া কন- দ্রুত মাথা এগিয়ে দেয় রাহিমা বৃন্দাবনের দিকে।
বৃন্দাবন আঁতকে উঠে সরে বসে দূরে, আরে! আরে! করো কি!
না, আফনে আমার মাথা ছুঁইয়া বলেন!
কিন্তু আমি যে তোমার মাথা ছুঁইতে পারুম না কইন্যা!
ক্যান? ক্যান পারবেন না? ডর লাগে ছুঁইতে?
আমি ছুঁইলেই হারায় যায় মানুষ। ছোড থাকতে বাবারে ছুঁইছি, মায়েরে ছুঁইছি- ছুঁইতে না ছুঁইতেই হারায় গেছে তাঁরা- আরো যাগো ছুঁইছি, হারাইছে বেবাকতে-
আমারে ছোঁন, আমিও হারাইতে চাই!!
নাহ! তোমারে নিয়া তো ভারি মুশকিল! দেখি, দেখি তো তোমার বাটিখান। সকাল থিকা কিছুই খাই নাই আসলে! বৃন্দাবন বাটি তুলে নেয় হাতে। খেতে থাকে মাথা নিচু করে। এতো নিচু, যার চেয়ে নিচু হওয়া যায় না আর!
রাহিমার চোখ পানিতে ভরে আসে। পানি লুকাতে চট করে ভেতর বাড়িতে ঢুকে পড়ে সে। ওড়না দিয়ে চাপা দেয় চোখ।
সুফিয়া খাতুনের নজর এড়ায় না বিষয়টি। চুলায় রান্না ফেলে তিনি এগিয়ে আসেন মেয়ের কাছে। মেয়ের মাথায় হাত রাখেন বিশুদ্ধ মমতায়! হৃদয়ের গহীনে জন্ম নেয়া নিরুপায় শত শত শব্দের মৃত্যুদৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন তিনি শব্দের জন্মলগ্নেই!
বৃন্দাবন দাস বড়ো ছটফট করে সারারাত। বন্ধ হয় না তার চোখের পাতা। শব্দের পর শব্দ জোড়া দেয় সে। দোতারায় ঝড় তোলে। তুমুল ঝড়। ভোর তখন।
আশ্চর্য এক ভোরে নির্ঘুম চোখ নিয়ে বারান্দায় বসে থাকা রাহিমা নির্জনতায় কান পেতে শুনতে পায় বৃন্দাবন দাসের নতুন গান, আশার গান, ভালোবাসার গান-
“-কাশফুলের মালা পরামু তোমার গ’লে
সাজামু তোমায় আমি সাদা পরীর রঙে
কথা দাও বন্ধু আমার যাইবা না ছাড়িয়া-”
*“কাশফুলের মালা পরামু তোমার গ’লে”-গীতিকবিতার এই লাইন তিনটি সংগৃহীত।