kobirkotha

কবীরকথা ।। শুভদীপ সাহা (ধারাবাহিক)

শুরুর কথা 

Mr. Keuner –এর কথা আমি প্রথম শুনি সুমনের কাছে। বার্টোল্ট ব্রেখট তখনও আমাকে ততটা পেড়ে ফেলেননি, যতটা পেড়ে ফেলেছিলেন সুমন। সুমনের থেকে সে গল্পের ছোঁয়া পেয়ে সেই কলেজ জীবনের শুরুতেই পড়া শুরু করি এবং মারা পড়ি। আমায় মেরে ফেলেছিলেন ব্রেখট। আমার মতো ছারপোকাকে তিনি পুষ্ট করেছিলেন। করে চলেছেন।
একসময় কলেজ জীবন শেষ হয়, পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা জীবনের ফাঁকে উঁকি দেয় দু’আনা। সেই দু’আনা স্বভাবেই শুধুমাত্র নিজের জন্য লেখার চেষ্টা শুরু করি। প্রতিদিন সকালে উঠে একটা শব্দ, কখনও ভাবনা, কখনও কিছুই না… এই নিয়ে অক্ষর বোনা শুরু হয়। এই কিছুই না-এর জীবনে ভাবনাহীনতা যখন ক্রমাগত ধাক্কা দিতে শুরু করে, তখন পথ দেখান রবীন্দ্রনাথ। ‘যখন মাথায় কিছু আসবে না, অনুবাদ করবে’। সেই প্রথম।
২০১৪ সালে Mr. Keuner বা Mr. K –এর অনুবাদ করার অক্ষম চেষ্টা শুরু করি। বন্ধুবান্ধবরা ভরসা যোগাতে শুরু করে, বেশ হচ্ছে রে ! সেই ভরসার টানেই এগোতে থাকি। অনেকগুলো অনুবাদ করে ফেলি, ছোটো ছোটো গল্প, বেড়ে গল্প। Mr. Keuner – এর বাঙালী নাম যখন ভাবতে বসেছিলাম, তখন প্রথমেই যে নাম মাথায় আসে তা কবীর। এক ধর্মনিরপেক্ষ নাম। কেন ধর্মনিরপেক্ষ বলার প্রয়োজন হ’ল, তা পরের কিছু গল্পে টের পাওয়া যাবে।
আমাদের কবীর কেমন? পাগলা দাশু। কখনও মনে হয় দুরন্ত চালাক, কখনও মনে হয় বড়ই বোকা। কখনও অক্ষম রাগে চুপ করে থাকে, কখনও পিটিয়ে বাপের শ্রাদ্ধ দেখিয়ে দেবে…
আমি এই কবীরের সাথে ঘর করছিলাম ২০১৪ থেকে। কিছুদিন আগে, ‘অদ্বিতীয়া’ ম্যাগাজিনে আমার করা কিছু অনুবাদ (কবিতা) দেখে তৃতীয় পক্ষ যোগাযোগ করেন আরও কিছু অনুবাদ কবিতার জন্য। আমার মন মরে গেছিল তখন। ভালো লাগছিল না আর কবিতার ক্লাস। তাঁরা নাছোড়বান্দা। কিছু লেখা দিন, অনুবাদ লেখা। ‘নাছোড়বান্দা মানুষদের সাথে কী করতে হয় জানিস?’, আমার মনে পড়ে গেল কবীরের কথা। বলিনি। কবীরকে পাড়লাম। কোথায় লুকিয়ে ছিল, খুঁজে বের করতে আরও সপ্তাহ তিনেক। তারপর জুড়ে বেঁধে কিছু লেখা তুলে দিলাম তাঁদের হাতে। পড়ে তাঁরা খুশী, (ঈশ্বরই জানেন কেন !)। জানালেন, প্রতি সপ্তাহে একটা গল্প, ধারাবাহিকভাবে বের করবেন তাঁদের ওয়েবজিন থেকে।

আমি জানি, এতে দু’পক্ষেরই ক্ষতি। ওনাদেরও এবং আপনাদেরও, অর্থাৎ যাঁরা পড়ছেন এবং যাঁরা পড়াচ্ছেন। এই অনুবাদ কখনই গতানুগতিকভাবে যায়নি। ২০০৯-এ প্রথম এই লেখা পড়া, তারপর প্রায় পাঁচ বছর মাথার ভিতরে থাকা, অবচেতনেই, তারপরে, ২০১৪ তে লেখা শুরু। এতে কখনও আমার ভাবনা যোগ হয়েছে, পরিবেশ পালটে নিয়েছি আমি, বাঙালীয়ানা বজায় রাখার চেষ্টা করেছি। কোনার’কে কোণে পাঠিয়ে দিয়েছি। যা ইচ্ছে তাই করেছি। বেশ করেছি। ব্রেখটও আমাদের ভাবনা নিয়ে খেলে গেছেন।

এই লেখার কিছু অংশও যদি আপনাদের ভালো লাগে, তার প্রাথমিক কৃতিত্ব আপনাদের, কারণ আপনারা পড়ছেন। কৃতিত্ব, সুমনের, কবীর সুমনের, যিনি না বললে, আমি হয়তো কোনোদিন এই চরিত্রের সাথে মিলিয়ে নিতে পারতাম না। কৃতিত্ব তৃতীয় পক্ষের।

সবাই আমার ভালোবাসা নেবেন।

ক’বার তুমি অন্ধ সেজে থাকার অনুরাগে..
(
The helpless boy )

আড্ডার মাঝে গল্পোচ্ছলেই কথাটা উঠেছিল সেদিন। কবীর বলছিল, আমাদের আশেপাশে কত অন্যায় নিরন্তর ঘটে চ’লে; আমরা সব জেনে এবং বুঝেও চুপ করে থাকি। চুপ তো থাকিই আর…
-আর? আমি ব’লে উঠলাম।
– একটা গল্প বলি শোন,
ব’লেই কবীর বলা শুরু করল।

এই কিছুদিন আগেই, সন্ধে নেমেছে শহরে ; রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে একটা ছেলে কাঁদছে ; রাস্তারই ছেলে। পাশ দিয়ে অনেকেই হেঁটে  চ’লে যাচ্ছে – কেউ তাক ক’রে উদাসীন, কেউ আবার তাকাচ্ছেই না… এরই মাঝে একটা লোক বেমক্কা কৌতূহলেই ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেল ; জিজ্ঞাসা করল,
– কী হয়েছে? কাঁদছ কেন?
সিকনি মাখা গালে, একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একঝাঁক ছেলের দলকে দেখিয়ে ছেলেটা বললো,
– আমার কাছে দুটো দশ টাকার কয়েন ছিল। ওরা এসে জোর করে আমার থেকে একটা কয়েন নিয়ে নিয়েছে।
– যাহ ! তুমি কিছু বললে না? বাধা দাওনি?
– আমি চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু ওরা এতজন !
বলেই ভ্যাঁ করে কেঁদে দিল ছেলেটা।

– আচ্ছা, বুঝলাম। তুমি তো চেঁচাতে পারতে !
লোকটা খুব সহানুভূতি নিয়েই জিজ্ঞেস করল।

– চেঁচিয়েওছিলাম তো , কিন্তু কোনো লাভ হয়নি, কেউ আসেনি।
অসহায় মুখে তাকিয়ে ছেলেটা বলে উঠল।

– সত্যি বলছ? চেঁচিয়েছিলে, কেউ আসেনি? কেউ না?  সত্যি বলছ?
লোকটার কথায় যেন আশা ছিল। সেই আশার আলো ছেলেটার মুখেও ছড়িয়ে পড়ল। কান্না থামিয়ে সে বলল,
– হ্যাঁ, সত্যি বলছি। বিশ্বাস করুন।

– তাহলে তো এই কয়েনটাও আমার নিয়ে নেওয়া উচিত।
ব’লেই, নির্লিপ্তমুখে লোকটা ছেলেটার হাতে পড়ে থাকা কয়েনটা নিয়ে হনহন করে হাঁটা দিল।

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page