‘একটু সরে বসুন’ হাসির মোড়কে বাস্তবতার উন্মোচন
‘একটু সরে বসুন’ হাসির মোড়কে বাস্তবতার উন্মোচন
বাসে, ট্রেনে, মেট্রোয় হামেশাই একটা কথা শুনতে পাওয়া যায় ‘একটু সরে বসুন’। আমরা কম বেশি প্রত্যেকেই এই শব্দের সঙ্গে পরিচিত। তবে এরকম বহুবার শুনতে পাওয়া শব্দ যখন হয় বাংলা সিনেমার নাম। কেমন হয়?
বনফুলের ছোট গল্প ‘পাশাপাশি’ অবলম্বন করে কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের সিনেমা ‘একটু সরে বসুন’। মূল গল্পটি যারা পড়েছেন, তারা জানেন গল্পে মজাদার রম্যের আড়ালে বনফুল আপাত শূন্য এক সমাজের কাঠামোকে তুলে ধরেছেন। মূল গল্পের থেকে ‘বীজ’ তুলে এনে কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় সিনেমাটি বানিয়েছেন হরেক রকমের চরিত্রে। যা বলতে গেলে একটু দুঃসাহসীই।
সিনেমা শুরু হয় বেগুনবাগিচা নামে এক গ্রামে, যুবক গ্রুপদ দত্তগুপ্ত ওরফে গুড্ডু (ঋত্বিক চক্রবর্তী), যাকে পদে পদে সকলের খোঁটা শুনতে হয় বেকার হওয়ার জন্য। সবার কথা শুনতে শুনতে একদিন বিরক্ত হয়ে পালিয়ে যায় কলকাতায়। সে ওঠে এক দূর সম্পর্কের দাদা’র বাড়িতে। এরপর নাহয় সিনেমা’তেই দেখা ভালো। এই সিনেমায় আরও আছেন নস্যি নেওয়া এক মহিলা(মানসী সিনহা), ব্যায়ামের শিক্ষক, যিনি যোগব্যায়াম করতে গিয়ে আটকে যান। (লোকনাথ দে), খেঁকুরে যোগেনমাস্টার (খরাজ মুখোপাধ্যায়), গুন্ডা, যার মস্তানি হাস্যরসের উদ্রেগ ঘটায়, আলপিন (পার্থসারথি চক্রবর্তী)।
এই সিনেমায় গুড্ডু, অর্থাৎ গুরুপদ একজন শখের ম্যাজিশিয়ান। যার কাছে জীবন এক ম্যাজিকের (Magic)মতো। হালকা একটা জাদুবাস্তবতার আস্তরণ মোলায়েমভাবে সিনেমা জুড়ে থেকে যায়। সে গাড়ির ধোঁয়া নির্বাপক যন্ত্রে কলা গুঁজে গুন্ডাদের ধরাই হোক, অথবা, টেক-সাধনার আশ্রমে পান্ডু এবং মাদ্রীর সঙ্গমের মন্ত্র চালু হওয়া, তবে যে দৃশ্যগুলি থেকে হাসির উদ্রেগ আরও বেশি হতো, সেগুলি কিছুটা হালকা হয়ে গেছে। তবে সিনেমার ভেতর বেখাপ্পা লাগে না সেসব, কারণ সিনেমাটি সচেতন ভাবে বাস্তবের সঙ্গে সমানভাবে তাল মিলিয়ে একটা অদ্ভুতুড়ে জগৎ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।
এই সিনেমায় মজার ঘটনার পাশাপাশি চরিত্রের দীর্ঘশ্বাসগুলিও ধরে রেখেছে দারুণ ভাবে। আসলে শহর জুড়ে বসবাস করা মানুষেরা যে অন্য মানুষকে ঠকাচ্ছে, সেরকম নয়, আসলে মানুষ নিজেকেই ঠকাচ্ছে এখানে। যেখানে চাকরি নেই, সিট খালি নেই। চারদিকে দুর্নীতি, আত্মপ্রচার সর্বস্ব এক শহর। যে শহরের প্রাণ নেই, কেবল কঙ্কাল আছে। সেখানে গুড্ডু শহুরে আদব কায়দায় নিজেকে গড়েপিটে নিতে চাইলেও, আদতে সে থেকে যায় বেগুনবাহিচার গুড্ডূ হয়েই। ফাঁকিবাজি ধরা পড়ে যাওয়ার পর কতগুলো মানুষকে মান আর হুঁশ ফিরিয়ে দেয় সে।
এই সিনেমা প্রথম ভাগে বেশ সহজ সরল এক নরম উষ্ণতা ধরা পরে। এরপর সিনেমা যত এগোয় চরিত্রের মোড় গাঢ় রঙে ঢেকে যায়। যে রঙগুলি সমাজের প্রতিটা মানুষের আপন। প্রত্যেকের জীবনের সেই গোপন গলিটি যেন শূন্যতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। তবে যখন সব মানুষ এক জায়গায় জড়ো হয়ে শুরু করছেন এক নতুন যাত্রা। সেখানেই সিনেমার প্রাপ্তি।
সিনেমায় ঋত্বিকের অভিনয় চমৎকার ছাপ রেখেছে। পাশাপাশি পাওলি দাম(Paoli dam), পায়েল সরকার, রজতাভ দত্ত(Rajatava Dutta), খরাজ মুখোপাধ্যায় (Kharaj Mukhopadhyay), মানসী সিনহা(Manasi Sinha), পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় (Paran Bandyopadhyay) ঈশা সাহারাও (Isha Saha) দারুণ সঙ্গ দিয়েছেন। সিনেমাটির দ্বিতীয় ভাগ একটু ছোট হতে পারত, কিছু কিছু দৃশ্য অকারণে যেন বড়ো করা হয়েছে। যে ম্যাজিকাল আমেজ ছবিটি শুরু থেকে তৈরি করতে চেয়েছে, সেটার তাল কেটে গিয়েছে মাঝে মাঝে। তবে সুরের মধ্যে একটা তরতাজা ব্যপার আছে। সব মিলিয়ে, বাংলা বাজারে সোশ্যাল কমেডির এই দৈন্যদুর্দশার দিনে নিঃসন্দেহে ‘একটু সরে বসুন’ একটা ঝলমলে সিনেমা।
আর একটু ভেবে দেখবার সুযোগ করে দিয়েছেন ডিরেক্টর কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। সেটি হলো বাস, ট্রেনের সিটে দখলদারি বা নিজের হক বুঝে নেওয়া ছাড়াও ‘একটু সরে বসুন’-এর আরও একটা সুর আছে। সেটি হল, সকলের সঙ্গে থাকা ও অন্যের প্রতি সহমর্মিতা। এই তিলোত্তমার বুকে না হেরে যাওয়া মানুষের সঙ্গে একটুখানি হাঁটার কথাই বলে ‘একটু সরে বসুন’। আপনারাও হেঁটে দেখুন। রম্য সিনেমা ‘একটু সরে বসুন’ দেখে আসুন সিনেমা হল থেকে।