বই পত্র।। পরা বিশ্বের অপরা কথকতা।। সব্যসাচী মজুমদার
বাংলা কবিতা কেন কেবল,গোটা পৃথিবীর কবিতা আসলে ধারণার জন্ম দেয়।সে কখনও চায় বাস্তবকে চালাতে, কখনও বাস্তব গ্রাস করে নিল তাকে।ধারনাবিশ্ব আর জীব বিশ্বের এই পারষ্পরিক মিথষ্ক্রিয়া শিল্পকে দীর্ঘস্হায়ীত্ব দেয় কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত বলা আমার পক্ষে অসম্ভব হলেও বাংলা কবিতার কিছু কিছু ধারণার অংশ আমার বাস্তবকে নিশ্চিত নিয়ন্ত্রণ করবে একথা শীলা বিশ্বাস রচিত’আজরখ নগর’ পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল।
প্রথমেই তথাকথিত অল্প চেনা শব্দতে মনোনিবেশ করা যাক। আজরখ শব্দের অর্থ খুঁজে পেতে গেলে আপনাকে সাবটেক্সটে নির্ভর করে পৌঁছে যেতে হবে ভারতে অন্যতম জনপ্রিয় বস্ত্র শাড়ির বুনোন পর্বে। গুজরাটের ভূজ থেকে পনের কিলোমিটার দূরে একটা গ্রামে টিকে রয়েছে পৃথিবীর সম্ভবত প্রাচীন শাড়ির এই বিশেষ ছাপ বা ব্লক। মহেঞ্জোদারোর পুরোহিতের বস্ত্র সম্ভবতঃ এই ধরনেরই নিদর্শন।এর অর্থ কারোর মতে নীল,কেউ বা keep it with অর্থেই নির্ভর করে।নামকরণেই কাব্য আমাদের একটা বড়ো কালপর্বের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।যে বুদ্ধি কেন্দ্রিক বিকাশ পর্বে মানুষ কারু ও শিল্পের একটা বিরাট ও দ্রুত বিবর্তন ঘটিয়েছে।
‘আলো’এই শব্দটাকে যদি ভরকেন্দ্র মনে করি তবে তা এ গ্রন্থে পরতে পরতে ছড়িয়েছে একটা সময়ের বিবিধ স্তরে। একজন মানুষ সম্পৃক্ত নিবিষ্টতায় নিজের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছেন তত্ত্বনিরপেক্ষভাবে,”অসময়ের জন্য জমানো দানা মুখে কিলবিল করে মানুষ বেরিয়ে আসছে পিঁপড়ের মতো/মাটির গর্ভ থেকে।একটা সময় আরও একটা সময়ের ভিতরে খাপ খাইয়ে নিতে/ পারলেই আয়ুরেখা বরাবর জন্মান্তরবাদ লিখে দিচ্ছে এলোমেলো আঙুল।”(সুতলি)
একটা নীল রঙের আলো কখনও চাষি কখনও বীজ হয়ে নিজের অবস্থান বদলে বদলে এসে পড়ছে মা-বাবার আজন্মের ওপরে,”ক্ষয়ের চিহ্ন নিয়ে ঋজু দাঁড়িয়ে আছে যে গাছ তাকে আমি বাবা বলে জানি। এও জানি বিগত দশ বছর ধরে বাবার কাছে মা ফিরে ফিরে আসেন। পায়ের নখ কেটে দেন।এই দেখে ছায়াদের কত ফিসফিসানি।” ছায়া একটা স্পষ্ট ব্যাখ্যা পেয়ে গেলেও গ্রন্হের সূত্রপাতেই কিন্তু ধারণা সম্পূর্ণ করলে ভুল হবে কেননা এর পরেই এসে দাঁড়ায়’অসুর-রিয়াল’—“আমি অযাচিত ভ্রুণ,মাংস ও গর্ভ,জন্মপসারিণী।আমি কাটা জিভ,আমিই চিৎকার বিক্ষত পাপড়ির।আমি জবরদস্তি চিতা,না পোড়া নাভি, নদীতে না ভাসানো ভস্ম। আমি সেই বিপরীত বর্ণ যার স্বপ্নহীন বাস্তব ছাড়া কিছু নেই।”লক্ষ্য করুন এই ‘বিপরীত বর্ণের’ প্রতিভাসকে।কী বিপুল আত্মনির্ভরতায় অনায়াসে আলো নীল আলো গিয়ে পড়লো ছায়াশরীরে। মুহুর্তে পরিবর্তন করলো প্রেক্ষিত।স্পষ্ট দুটো সামাজিক অবস্হানে ভাগ হয়ে যায়।চোদ্দ পৃষ্ঠার শেষ আর পনেরোর শুরু আপনাকে আরও উদাহরণ যোগাবে,”সোনাঝুরির উড়ন্ত প্রেমপরাগ পেরিয়ে গ্রামিণরেখা/প্রান্তরের দিকচক্রবালে তাঁতিরা বোনে রোদপোশাক…”এবং”শৈবালে ছেয়ে আছে দেয়াল আমার।যারা উল্টোমুখো হাঁটছিল তারাও পেরিয়ে যাচ্ছে সেতু।”ক্রমান্বয়ে মহেঞ্জোদারো থেকে ‘লাবণ্যময় লণ্ঠন’ আবর্তন করে সঞ্চারিত ‘তাপ ও তাড়সে’।
একটি নির্দিষ্ট স্পন্দে সময় নিজেকে স্তরে স্তরে বিবর্তিত করতে থাকে। বস্তুত গদ্য নির্ভর লেখাগুলো মুক্ত প্রবাহে ছুঁয়ে যেতে থাকলো প্রতিক্রিয়াশীল সময়কে।দ্রুত ইতিহাস ও তার পূণর্বিন্যাসের সঙ্গে লিপ্ত হতে হতে লেখারা একটি সম্পূর্ণ অবয়ব নির্মাণ করে।’দশাবতার’বললেই যে মহাকায় ছায়াটি হে প্রাজ্ঞ আপনার দৃশ্যে ফুটে ওঠে, মূলতঃ ইতিহাসের প্রেক্ষিতে সেই বিরাট বিবর্তনকে ধরতে চেয়েছেন ও সার্থক হয়েছেন বলেই বিশ্বাস করি,কেবল তাই নয় মেধা সরিয়ে বার বার জায়মান কবিও প্রবেশ করেন সে প্রহেলিকায়।স্হান-কাল-পাত্রের ভারসাম্যে রচিত হয় তৃতীয় বিশ্বের প্রবহমান মনস্তাত্ত্বিক পৃথিবী,”স্নেহদোষ কেটে গেলে নিজের ভেতর/রেখে এসো কিছু শাসনের তরল/গড়িয়ে যাওয়া বরফের বল/ঘুমের খোলস খুঁটে কুসুম চলাচল”(ধ্যান রঙের মুখ)।
তারপর নির্বিচারে পর্দা দুলে ওঠে। বেরিয়ে আসে লোকায়ত চিহ্নগুলো।তারা এক এক করে মিশে যায় বৃহত্তর অনির্নয়ে।যেখানে কিছুই থাকে না। তবুও রয়ে যায় অনেকটা সুর, বিভিন্ন রঙের সুর,”চৌকিদার কালু সিং লামা পাউরুটি আর জুতোর সুকতলায় নেতাজীর চিঠি পাচার করতো।এসব কথা জানে না এই লেপচা ভিক্ষুক।/সে শুধু সারিন্দায় লোকগানের সুর তুলে ভেঙে ফেলে ভাষার প্রাচীর।অস্পষ্ট হয় রাজনৈতিক মানচিত্র অথবা ভিন্নতার/দাবি।”(আমি গিদ্দা পাহাড় বলছি)।
আগেই বলেছি এ গ্রন্থে যে রং পেয়েছে এ পাঠক,তা নীল ।তাই গ্রন্হের শেষ সিরিজ ট্রেকার্স হাটের একটু আগে অধ্যাপক চিন্ময় গুহের কাছে ঋণ স্বীকার করা দশটি টুকর লেখার শেষে কবি লিখছেন,”কথার শরীরে রশি ছেঁড়া রক্তরথ কোন পথে গেঁথে যায় কোন স্রোতে ভেঙে যায় একবুক সাঁতার…”(ঘুমের দরজায় চিঠি)।
এই গ্রন্হের দুটি ভাগকে যদি স্বীকার করে নিই, দেখতে পাবো,প্রথম পর্বের কথক সময়ের আন্তরিক পর্যটনে এসে প্রবেশ করেছেন একটা সময়হীন চিহ্ন পৃথিবীতে।আর দ্বিতীয় পর্বে তিনি ধীরে ধীরে পৌঁছতে চেয়েছেন সেই শীর্ষ বিন্দুতে যেখান থেকে দেখা যায় অবলোকিতেশ্বর।একটা প্রলম্বিত সময়খণ্ডে দাঁড়িয়ে তিনি দেখেন একটা লক্ষ্যাতীত সময়পর্বকে।যে সমকাল ঘটেছে একদা।অথবা ঘটেই চলেছে অবিকল,”নাম জানা-অজানা শৃঙ্গদেরও আমাদের জন্যে অপেক্ষা থাকে।”(চ)
বার্নিক প্রকাশন বইয়ের গঠনে যথেষ্ট আন্তরিক। অর্পণের প্রচ্ছদ যথাযথ।এক অর্থে নির্মাণ যোগ্য সংগত করেছে।এই মেলায় আপনার পাঠসঙ্গী হোক আজরখ নগর। বাংলা কবিতার একটি নতুন অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচয় হবে।
আজরখ নগর: শীলা বিশ্বাস: প্রচ্ছদ-অর্পণ: মূল্য-১৩৫টাকা:বার্ণিক প্রকাশন(৮৩৯১০৫৮৫০১)
লেখক পরিচিতিঃ
সব্যসাচী মজুমদার
রামনগর রোড, বনগাঁ, উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা, পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা। গৃহশিক্ষক।ছোটোবেলা থেকেই লেখালিখি শুরু। বাংলা ভাষার ছাত্র। বাংলা ভাষার বিভিন্ন কাগজে লেখা প্রকাশ।
তিনটি কাব্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে–মেঘ আর ভাতের কবিতা, আজন্ম ধানের গন্ধে, তৃতীয় পৃথিবী। নিয়মিত কবিতা রচনা ও কাব্য গ্রন্থ আলোচনা লেখেন।