ভ্রমণ।। তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়।।

ক্যালিফোর্নিয়ার পেসিফিক কোস্ট হাইওয়ে ও বিগ সুর ভ্রমণ 

                                                                        -তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়

 

রাস্তা মানুষকে পৌঁছে দেয় এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায়। বলতে গেলে কোথাও যাবার জন্যই মানুষ রাস্তায় বা পথে নামে। কিন্তু পৃথিবীতে এমনও কিছু পথ আছে যা এক অমোঘ আকর্ষণে মানুষকে শুধুই টানে। কোথাও যাওয়ার না থাকলেও শুধু সেই পথ ধরে যাওয়াটাই হয়ে ওঠে এক আনন্দের যাত্রা। তার কারণ হয়তো এক এক জায়গায় এক এক রকম। আমেরিকায় ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যে উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রসারিত পেসিফিক কোস্ট হাইওয়ে (Pacific Coast highway) এরকমই এক রাস্তা। প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল বরাবর  অতি দীর্ঘ এই রাস্তাটির অবস্থান বলেই তার এরকম নামকরণ। এই বিষয়ে বিস্তারিত আসার আগে যেখানে গেছি সেখানকার কথা একটু বলে নিই।

 

আমার আর আমার স্ত্রীর এবারের আমেরিকা যাত্রায় গন্তব্য ছিল ক্যালিফোর্নিয়া। কলকাতা থেকে দুবাই হয়ে সোজা নেমেছিলাম লস এঞ্জেলেসে। এর আগে  আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলে কখনো যাওয়া হয়নি আমার। লস এঞ্জেলেস থেকে কিছুটা দূরে আর্ভাইন শহরে আমার ছেলে আর বৌমা থাকে। ওরা একটি নামকরা ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করে এবং গবেষণা করে। সেই সূত্রেই আমাদের ওখানে যাওয়া এবং থাকা।

 

আর্ভাইন শহরটি অরেঞ্জ কাউন্টির মধ্যে সুন্দর ছিমছাম সাজানো আধুনিক একটি শহর।  এখানকার যে বিশ্ববিদ্যালয়, University of California, Irvine, তা শহরের অন্যতম বড় অহংকার। তবে শুধু সেইটিই  নয়, আর্ভাইনের মুকুটে আরও অনেক অহংকারের পালক আছে।  অন্যদিকে লস এঞ্জেলেস কাউন্টির মধ্যে লস এঞ্জেলেস শহর হলো নিউ ইয়র্কের পরে আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। তার অহংকারের কোনো সীমা  পরিসীমা নেই। তারও আছে বিখ্যাত একাধিক ইউনিভার্সিটি। তাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিনোদনের আশ্চর্য দুনিয়া, সে কথা সারা পৃথিবী জানে। তার আছে হলিউড, বেভারলি হিলস, ডিজনিল্যান্ড, বিখ্যাত সব ফিল্ম স্টুডিও, আরও কত কী। ভৌগোলিক সীমানার দিক থেকে ক্যালিফোর্নিয়া এক বিশাল রাজ্য। তার মধ্যে এই অঞ্চলগুলো দক্ষিণ দিকে বলে এদিকটাকে বলে সাদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া। বলা বাহুল্য, লস এঞ্জেলেসই হলো দক্ষিণের সবচেয়ে বড় এবং বিখ্যাত শহর। উত্তরে যেমন সানফ্রানসিসকো।

 

 

এই দুটি আধুনিক শহরের মধ্যে দূরত্ব প্রায় চারশো মাইল (প্রায় সাড়ে ছশো কিলোমিটার)। একই রাজ্যের উত্তর আর দক্ষিণ দিকের এই দুটি শহরকে জুড়ে রেখেছে একাধিক রাস্তা। তার মধ্যে প্রথমেই যার কথা বললাম, সেই পেসিফিক কোস্ট হাইওয়ে দিয়ে ভ্রমণের আনন্দ একেবারে অন্যরকম। ক্যালিফোর্নিয়ার মধ্যে এই রাস্তার দৈর্ঘ্য ৬৫০ মাইল। কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়া ছাড়িয়েও এই রাস্তা চলে গেছে আরও উত্তরে ওরেগন  য়ে ওয়াশিংটন রাজ্য পর্যন্ত। ফলে এই রাস্তার মোট দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়েছে ১৬৫০ মাইল (প্রায় ২৬৫০ কিলোমিটার)।

 

এই দীর্ঘ রাস্তাটি দিয়ে মানুষ যে ভ্রমণ করতে এতো ভালোবাসে তার প্রধান কারণ হলো এর সৌন্দর্য। ক্যালিফোর্নিয়ার স্থলভাগের একেবারে পশ্চিমেই রয়েছে প্রশান্ত মহাসাগর। আর তার কূল বরাবর চলে গেছে এই রাস্তা। কোথাও হয়তো তা সমুদ্রের তীর থেকে সামান্য একটু দূরে,  রাস্তা থেকে নেমে কয়েক পা হেঁটে গেলেই সমুদ্রের জল ছোঁয়া যায়। আবার কোথাও রাস্তা থেকে সমুদ্র এতটাই কাছে যে মনে হবে এই বুঝি চলন্ত গাড়ি থেকে হাত বাড়ালেই তীরে ভেঙে যাওয়া ঢেউগুলো থেকে জলের ছিটে এসে লাগবে। রাস্তার বৈচিত্র্যও কিছু কম নয়। তার একপাশে যেমন রয়ে গেছে সমুদ্র, অন্য দিকে কোথাও পাওয়া যাবে রেন ফরেস্ট তো কোথাও মরু অঞ্চল। কোথাও কিছুটা সমতল, কোথাও উঁচুনিচু। কোথাও কোনো গ্রাম আবার কোথাও কোনো মাঝারি শহর। তবে বেশির ভাগ সময়ই একপাশে ঘিরে থাকবে ছোট বড় পাহাড়। এক একটা অংশের এই অপরূপ বৈচিত্র্য আর নয়ন ভোলানো সৌন্দর্য  দেখবার জন্যই দেশ বিদেশ থেকে ছুটে আসে অজস্র মানুষ শুধু রোড ট্রিপ করার জন্য। কোথাও যাওয়াটা সেখানে মুখ্য নয়। এই রাস্তায় ড্রাইভ করে বা গাড়িতে ভ্রমণ করতে তার দুপাশের সৌন্দর্যকে, প্রকৃতির বিচিত্র রূপকে অবাক দৃষ্টিতে দেখার আনন্দই সেখানে প্রধান হয়ে ওঠে। পুরো রাস্তার মধ্যে ক্যালিফোর্নিয়ার মধ্যে যেটুকু অংশ আছে সেইটিই অত্যধিক জনপ্রিয়।

 

ছেলে বৌমার সঙ্গে মাঝে মাঝেই এই রাস্তায় একাধিক শহরে গেছি। বেশির ভাগই সকালে গিয়ে সেই জায়গাগুলো দেখে আবার একই রাস্তায় সন্ধ্যায় ফিরে এসেছি। খাতায় কলমে অরেঞ্জ কাউন্টির মধ্যে ডেনা পয়েন্টে এই রাস্তার দক্ষিণ অংশ শেষ। কিন্তু তার পরেও এই রাস্তা চলে গেছে সেখান থেকে আরও ৬৬ মাইল দক্ষিণে সান ডিয়েগো পর্যন্ত। আর্ভাইন থেকে  ডেনা পয়েন্ট বা সান ডিয়েগো আরও দক্ষিণে। তাই সেই জায়গাগুলোতে যখন গেছি তখন সমুদ্র পড়েছে রাস্তার ডানদিকে। তবে ডেনা পয়েন্ট পর্যন্ত যাওয়ার সময় এই রাস্তা অনেকগুলো ছোট ছোট শহুরে পরিবেশের মধ্যে দিয়ে গেছে। এর মধ্যে অনেকগুলো জনপ্রিয় সমুদ্র সৈকতও আছে। সেই সেই জায়গায় কোথাও রাস্তা থেকেই সি বিচ দেখা যায়। কোথাও কয়েকটি বাড়ি আড়াল করে দিয়েছে সমুদ্রকে। কোথাও আবার বাড়ির ফাঁক দিয়েই সমুদের ঢেউ ভেঙে যাওয়ার দৃশ্য দেখা যায়। সেখানে ছোট ছোট পাহাড়ের গায়ে বাড়ি, রাস্তা আর সমুদ্র যেন হাত ধরাধরি করে সহাবস্থান করছে।

 

আর্ভাইন থেকে যখন উত্তর দিকে গেছি, তখন সমুদ্র পড়েছে রাস্তার বাঁদিকে। এখন এই রাস্তা ধরে আরও উত্তর দিকে যাওয়ার কথা বলব।

বেরিয়ে পড়লাম একদিন সকাল সকাল। অবশ্য স্নান সেরে ব্রেকফাস্ট করে পর বেরিয়েছি।  যাব বিগ সুর উপকূলে (Big Sur)। সেখানে দেখার মতো অনেক কিছু আছে, যেমন বিগ সুর ন্যাশনাল পার্ক, নেটিভ আমেরিকানদের হাতের কাজের মিউজিয়াম ইত্যাদি। সেখানকার শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত চর্চা এবং বিনোদনের কেন্দ্রগুলিও অনেককে আকর্ষণ করে। তাছাড়াও আছে রেড উড গাছের ঘন অরণ্য। এসবের কিছু দেখা হবে, কিছু হবেনা, কিন্তু সেসবে আমাদের খুব একটা উৎসাহ নেই। আমরা আজ শুধু সেখানকার বিখ্যাত বিক্সবি ব্রিজ টা  (Bixby bridge or Bixby Creek Bridge) দেখতে আগ্রহী। বিগ সুর উপকূলে অবস্থিত বলে বিগ সুর ব্রিজ বলেও ডাকে অনেকে।

পেসিফিক কোস্ট হাইওয়ে ধরে গাড়িতে আর্ভাইন থেকে সেখানকার দূরত্ব ৩৮৬ মাইলের মতো (প্রায় ৬১৭ কিলোমিটার)। ফলে একদিনে সেখানে গিয়ে দেখে ফিরে আসা যাবেনা। তাই দুদিন সময় নিয়ে বেরলাম। একদিন রাত্রিবাস করতে হবে। ঠিক হয়েছে আমরা মোরো বে তে (Morro Bay) থাকব একটা রাত। সেইমতো হোটেলও বুক করা হয়েছে। আর্ভাইন থেকে মোরো বে’র দূরত্ব প্রায় ২৪১ মাইল।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুটা গিয়েই গাড়ি পৌঁছে যায় হাইরোডে। সে বিশাল চওড়া রাস্তা। অনেকগুলো লেন জুড়ে অজস্র গাড়ির যাওয়া আসা। একসময় হাইরোড শেষ হলে আসে সেই বিখ্যাত রাস্তা, পেসিফিক কোস্ট হাইওয়ে। এই রাস্তা অত চওড়া নয়। অন্য হাইওয়ের মতো অতগুলো লেন নেই। এক এক জায়গায় তো মাত্র দুটি লেন। তা দিয়েই একদিকের গাড়ি যাচ্ছে, অন্যদিক থেকে গাড়ি আসছে। আগেই বলেছি, একাধিক বার যাওয়া করেছি এই রাস্তার কিছুটা অংশে। এক একটা নতুন শহরে গেছি। আজ যাব আরও অনেকটা দূরে। চেনা পথের গণ্ডি ছাড়িয়ে অজানা অচেনা পথে এক অন্য গন্তব্যে। কিন্তু বারবার গেলেও এই পথ যেন পুরনো হয়না। একপাশে আদি অন্তহীন নীল জলরাশি, দূরে রোদ পড়ে চিকচিক করছে, তার এমনই মায়া যে চোখ ফেরাতে দেয়না। অন্যদিকে কোথাও রুক্ষ পাহাড়, গাছপালা কিচ্ছু নেই। আবার কোনো কোনো অংশে মরুভূমিতে বেঁচে থাকার উপযুক্ত ঘাস বা ছোট ছোট কাঁটাঝোপ দেখা যাচ্ছে। কিছুটা দূরে হয়তো আবার কোথাও ঝলমলে সবুজ। প্রকৃতি যেন একঘেয়েমি কাটানোর জন্য সাজিয়ে রেখেছে এক অপরূপ বৈচিত্র্য। চোখ মেলে শুধু দেখতে পারলেই হলো।  রাস্তাও যে সব সময় সোজা তা নয়। হয়তো কিছুটা চলে গেছে একেবারে সোজা, কোনোদিকে এতটুকু না বেঁকে। যেন সমুদ্র বা স্থলভাগ, কোনোদিকেই তার পক্ষপাতিত্ব নেই। আবার কোথাও মাইলের পর মাইল তার বক্রগতিতে চলাচল। স্বাভাবিক ভাবেই ড্রাইভ করতে হয় খুব সন্তর্পণে। সমস্ত নিয়ম মেনে। মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যের জন্য এটি ক্যালিফোর্নিয়ার ঘোষিত প্রথম সিনিক হাইওয়ে।

অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়। তবে আকাশে যে ঝলমলে উজ্জ্বল রোদ,তা নয়। একটু যেন মেঘলা মতো। কিন্তু বৃষ্টি হবে বলে মনে হয় না। সাদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ায় শীতকালেই বৃষ্টি হয়। বছরের অন্য সময় হয়না বললেই চলে। আর শীতকাল শুরু হতে এখনো দেরি আছে। আমরা সেই জুলাই মাস থেকে আছি এখানে। একদিন মাত্র সামান্য একটু বৃষ্টি দেখেছি। শীতকালটাই যেন এখানে বর্ষাকাল। তার এখনো ঢের দেরি।

 

দুপুরে এক জায়গায় লাঞ্চ করে এবং আরও একবার এক জায়গায় থেমে আমরা বিকেলে এসে পৌঁছলাম মোরো বে তে (Morro Bay)। এটি হলো সমুদ্রের উপকূলে একটি শহর। ক্যালিফোর্নিয়ার উত্তর উপকূলবর্তী এলাকায় ঢোকার গেটওয়ে। এটা আসলে মোহনা, যেখানে স্থলভাগের মিষ্টি জল এসে মিশেছে প্রশান্ত মহাসাগরের লবণাক্ত জলে। শহরটা এমন কিছু বড় নয়, কিন্তু শান্ত, সুন্দর একটি বীচ টাউন বলে এর সুখ্যাতি আছে। আবহাওয়াও খুব সুন্দর। তার সঙ্গে অপরূপ প্রকৃতি একে আলাদা সৌন্দর্য দিয়েছে। ইতিহাসের তথ্য অনুযায়ী এখানে প্রথম  ইউরোপিয়ানদের পা পড়েছিল সেই ষোড়শ শতকে। তখন সেখানে শুধুই ছিল আদিবাসীদের বসতি, যাদেরকে নেটিভ আমেরিকান বলা হয়। তারা সেই প্রথম অভিযাত্রী দলের একজনকে মেরেও ফেলেছিল। পরবর্তীকালে এই এলাকা চলে যায় মেক্সিকোর দখলে। তবে মোরো বে শহরটি স্থাপিত হয় আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে, সেই ১৮৭০ সালে।

 

তবে এখানে একটি মুখ্য আকর্ষণের বিষয় আছে। সেইটিই এখানকার ঐতিহাসিক ল্যান্ডমার্ক।  তা হলো মোরো রক (Morro Rock)। সরকারী ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী এই পাথুরে পাহাড়টির সৃষ্টি হয়েছিল দু কোটি তিরিশ লক্ষ বছর আগে আগ্নেয়গিরির লাভা থেকে। এর উচ্চতা ৫৭৬ ফুট। য়ুয়ান রডরিগে ক্যাব্রিলো (Juan Rodriguez Cabrillo) নামে একজন পর্তুগীজ অভিযাত্রী এর নাম দিয়েছিলেন ‘এল মরো’ (El Morro)। সেই ১৫৪২ সালে। সেই থেকেই এরকম নাম হয়ে গেছে পাহাড়টির। স্প্যানিশ ভাষায় ‘Morro’  শব্দের অর্থ মুকুটের মতো দেখতে পাথর। অনেক আগে নাকি এই পাহাড়টি স্থলভাগ থেকে অনেক দূরে ছিল। এখন দেখে আমাদের সেরকম মনে হলোনা। আমরা কাছাকাছি গাড়ি পার্ক করে সহজেই হেঁটে হেঁটে সেখানে পৌঁছতে পারলাম। তার মানে, স্থলভাগ আরও গ্রাস করেছে সমুদ্রকে। বা বলা যায় স্থলভাগ আর পাহাড়টির মধ্যেকার জল সরে গেছে। কাছাকাছি একটি পরিত্যক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে দেখলাম। কয়েক বছর আগেও নাকি সেটি চালু ছিল। এখন বন্ধ।

পরদিন সকালে হোটেলেই ব্রেকফাস্ট করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম বিগ সুরের উদ্দেশ্যে। এখান থেকে আমাদের যেতে হবে আরও ১৪৫ মাইল (প্রায় ২৩২ কিলোমিটার)। শহর পেরিয়ে কিছুটা গিয়েই আবার সেই মনোরম রাস্তা। এরপর পুরোটাই পাহাড়ি পথ। আর একপাশে অবশ্যই সমুদ্র।

মাঝখানে একটা রেস্ট এরিয়া দেখে দাঁড়ালাম কিছুক্ষণ। কফি খেয়ে নিলাম সবাই। রোড ট্রিপে কোনো রেস্ট এরিয়ায় বিশ্রামের জন্য দাঁড়ালে মন চায় একটু কফি খেতে। আবার বাকি পথটুকু যাওয়ার জন্য নতুন এনার্জি পাওয়া যায়। এখানেও দেখি অনেক নিচে সমুদ্র। ছোট ছোট ঢেউগুলি এসে ভেঙে পড়ছে পাহাড়ের কোলে। প্রচুর গাছ এদিকটায়। বেশির ভাগই নাম না জানা। তাতে অজস্র পাখিদের যাওয়া আসা, গুঞ্জন। জায়গাটা খুব সুন্দর সাজানো গোছানো। এই একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি আমেরিকায়। যেখানেই গেছি, সেই জায়গাটা যেমনই হোক, ভালো লাগার মতো একটা পরিবেশ ঠিক তৈরি করা আছে। তা কৃত্রিম ভাবে হলেও। এখানে অবশ্য সবই প্রাকৃতিক। প্রকৃতি যেভাবে সাজিয়ে রেখেছে, তার উপর আর হাত চলে না।

 

একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার উঠে বসলাম গাড়িতে।  এই অঞ্চলে রাস্তা আরও বেশি আঁকাবাঁকা। পাহাড় আর সমুদ্রে মাখামাখি। ছেলে গাড়ি চালাচ্ছে। ও খুব ভালো ড্রাইভ করে। অনেক লম্বা জার্নিতেও ক্লান্ত হয়না। এর আগে ও অনেকবার অনেক দীর্ঘ পথ আমাদের নিয়ে গেছে। বৌমাও একটানা অনেক দূর অব্দি ড্রাইভ করে। এই মুহূর্তে গাড়িতে যে গান বেজে চলেছে সেদিকে যেন আর আমার কান নেই। সমস্ত মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে রোম্যান্টিক গিরিপথ। এখানে সমুদ্রের ঢেউয়ের উন্মাদনা তেমন চোখে পড়ছে না। কারণ বোধ হয়, যার জন্য অস্থিরতা, উথাল পাথাল অন্তর, তাকেই যখন কাছে পাওয়া গেছে তখন আর চঞ্চলতা কিসের? পাহাড়কে অনেক অনেক মাইল ধরে একেবারে নিজের করে কাছে পেয়ে মহাসাগর তাই এই অংশে আক্ষরিক অর্থেই প্রশান্ত। আকাশের রঙে তার রঙ। কখনও নীল, কখনও ছাই রঙের। আমরা কাল আর আজ মিলিয়ে তার উপকূল বরাবর এরকম অনেক মাইল পথ অতিক্রম করেছি।  এক এক জায়গায় তার এক একরকম সৌন্দর্য। এই রাস্তায় ড্রাইভ করা একটা অনন্য অভিজ্ঞতা ঠিকই, কিন্তু নিয়ন্ত্রিত গতিতেই তা করা উচিৎ। কেন না রাস্তা খুব চওড়া নয়। তার একদিকে যেমন সুউচ্চ পাহাড়, অন্যদিকে রয়েছে গিরিখাত এবং সমুদ্র।

পৌঁছলাম বিগ সুর এ, যার কিছুটা পরিচয় আগে দিয়েছি। এখানেই অবস্থিত সেই বিখ্যাত সেতু যার নামও আগে বলেছি, বিক্সবি ব্রিজ। গিয়ে দেখি সেখানে আরও অজস্র পর্যটক  উপস্থিত। ব্রিজ পেরিয়েই আমরা ডানদিকে ঘুরে লাল রঙের কাঁচা রাস্তার উপর দাঁড়ালাম।  কিন্তু কাছাকাছি গাড়ি পার্ক করার জায়গা পাওয়া গেলনা। আমরা নেমে গেলাম। ছেলে একটু দূরে গিয়ে গাড়িটা পার্ক করে এলো। এই অঞ্চলে যে পর্বতমালার অবস্থান তার নাম সান্টা লুসিয়া পর্বতমালা। তা যেন অকস্মাৎ প্রশান্ত মহাসাগর থেকে উঠে এসেছে এখানে। সমুদ্র যেখানে শেষ, পাথর আর অজস্র গাছ বুকে নিয়ে পাহাড় সেখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। সমুদ্রের জল অনেকটা শ্যাওলা রঙের। ঢেউগুলো এসে পাথরের গায়ে ধাক্কা খেয়ে অনবরত ভেঙে যাচ্ছে। অসাধারণ এই জায়গাটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। অনেকে বলে জায়গাটি ভূভাগ ও সমুদ্রের এক আশ্চর্য মিলনস্থল। অনেকের মতে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর উপকূল রেখাগুলোর মধ্যে অন্যতম। সেদিক থেকে বিশ্বের পর্যটন মানচিত্রে প্রথম ৩৫ টি গন্তব্যের মধ্যে বিগ সুর জায়গা করে নিয়েছে। প্রকৃতি যেন সমস্ত বিস্ময় আর সৌন্দর্য  উজাড় করে এখানে তুলে ধরেছে মানুষের চোখের সামনে। একটির উপরে আর একটি সাজিয়ে রেখেছে পরতে পরতে। মানুষ যেন দেখে অবাক হওয়ারও সময় পায়না।

 

তার একটা বড় কারণ অবশ্যই বিক্সবি ব্রিজ। এটির কাজ শেষ হয়েছিল ১৯৩২ সালে। ব্রিজটি ৭১৪ ফুট লম্বা, ২৪ ফুট চওড়া আর নিচে মাটি থেকে এর উচ্চতা ২৬০ ফুট। এই পুরো হাইওয়েতে এত বড় নির্মাণ আর নেই। কিন্তু এই পরিসংখ্যানগুলো আদৌ কোনো বিষয় নয়। মূল বিষয় হলো অপূর্ব ডিজাইন আর স্থাপত্যশৈলী। এখানকার অপার্থিব সৌন্দর্য আর চোখ জুড়নো প্রকৃতি। যেন কংক্রিটের এই সেতুটি মানুষের তৈরি হলেও বিসদৃশ কিছু নয়। যেন এটি প্রকৃতিরই অঙ্গ। ঐখানে ঐ সেতুটি না থাকলেই যেন কোথাও ছন্দ কেটে যেত। অসম্পূর্ণ মনে হতো। ফলত সেই জায়গার সার্বিক রূপটি মানুষের অকৃত্রিম ভালোলাগা আদায় করে নেয়। শুধু চোখে দেখেই মন ভরেনা। বলা বাহুল্য, ছবি তোলার হিড়িক পড়ে যায়। ক্যালিফোর্নিয়াতে যে ব্রিজগুলোর সবচেয়ে বেশি ছবি তোলা হয় তার মধ্যে এই ব্রিজটি অন্যতম।

 

এ মুগ্ধতা শেষ হওয়ার নয়। অসীম নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মাঝে দাঁড়িয়ে সেই কথাই বারবার মনে হচ্ছিল। তবু একসময় ফিরে আসতে হয়। আমরাও চোখ ভরে দেখে, মন ভরে আনন্দ নিয়ে ফেরার পথে পা বাড়ালাম। এখান থেকে উত্তরে আরও ১২৫ মাইলের মতো গেলেই পৌঁছে যাওয়া যায় আর এক বিখ্যাত শহর সানফ্রানসিসকোতে। কিন্তু  আমাদের  এবারের সফরসূচীতে সানফ্রানসিসকো নেই। আমরা  ফিরে যাব সোজা আর্ভাইন, এখান থেকে যার দূরত্ব  ৬০০ কিলোমিটারেরও বেশি। অবশ্য মাঝে থামব, লাঞ্চ করব, আবারও থামব। তবে যে পথে এসেছি সে পথে ফিরবনা। আর একটা অন্য পথে ফিরব। আমাদের কাছে সে পথটাও নতুন। গ্রেট সেন্ট্রাল ভ্যালির মধ্য দিয়ে গেছে সে পথ। তাতে দূরত্ব কিছু কম পড়বে না বেশি পড়বে জানা নেই।  সে পথের কথা অন্য সময়।

——-

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page