গল্প।। সঞ্জু ।। আবেশ কুমার দাস
প্রায় আটটা বেজে গেল ফিরতে আজ। সদরে তালা মেরে কোথাও বেরোচ্ছিলেন পড়শি সন্ধ্যামাসি। মনোময়কে দেখে এগিয়ে এলেন।
এই যে মনোময়, আজ দেরি হল এত?
সচরাচর এত দেরি হয় না মনোময়ের। দুটো স্টেশন পেরোলেই স্কুল। ট্রেন থেকে নেমে মিনিট পাঁচেক হাঁটতে হয়। সাড়ে পাঁচটার মধ্যেই ফিরে আসে অন্যদিন। আজ যেতে হয়েছিল বিপ্লবের বাড়ি। মনোময় বলে, এক কলিগের বাড়ি গেসলাম। তারপর আপনি এখন কোথায় চললেন?
এই যে বাবা ওষুধের দোকানে। ফুরিয়ে গেছে এখুনি হঠাৎ চোখে পড়ল। আর ওষুধ না খেলে তো আজকাল আর…
এই রে। রোগের ফিরিস্তি শুরু হল সন্ধ্যামাসির। বিরক্তিকর। মনোময় লোকটা এমনিতেই একটু অন্তর্মুখী ধরনের। চুপচাপ। দু’ কথায় কাজ মিটে গেলে দু’ কথাই বলে। পাঁচ কথা বলা পছন্দ করে না। অবশ্য সন্ধ্যামাসির প্রথম প্রশ্নটার জবাব এক কথাতেই সারা যেত। দ্বিতীয় বাক্যটা উচ্চারণ করেছিল ভদ্রতায়। কিন্তু জবাবে মাসিকে এখন গৌরচন্দ্রিকা করতে দেখে মনে মনে প্রমাদ গোনে সে। কিছু বলাও যায় না মুখের উপর। বয়স্ক মানুষ। বাধ্য হয়ে তাই প্যান্টের পকেট থেকে চাবির গোছাটা শুধু বের করে মনোময়। ছোট্ট ইঙ্গিত একটা।
কাজ হল ইঙ্গিতটায়।
যাই, দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। তুমিও ফিরলে সারাদিন তেতেপুড়ে। বাড়িতেও নেই কেউ…
বলতে বলতে পেছন ফেরেন মাসি। মনোময়ও নিশ্চিন্ত হয়ে সদরের তালায় চাবি পুরেছে সবে। মনে মনে হাঁফ ছেড়েছে। একবার মাসির পাল্লায় পড়লে সহজে রেহাই পাওয়া ভাগ্যের কথা। পড়শিদের কাছে যার দরুণ হালে মূর্তিমান বিভীষিকার নাম সন্ধ্যামাসি। আচমকা আবার পেছন থেকে আক্রমণ।
ওই দেখেছ, ভুলেই গেসলাম বেমালুম। এই হল বুড়ো বয়েসের রোগ। বলছিলাম না যে ওষুধ না খেলে আর…
মাসি আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। বাধ্য হয়েই মনোময়কেও ফিরতে হয়। আসল কথাটাই যেন বলতে ভুলে গিয়েছিলেন, এখন মনে পড়ল, এমন ভঙ্গিতে সন্ধ্যামাসি বলেন, সঞ্জু বলে চেনাশুনো কেউ আছে নাকি তোমার?
সঞ্জু! মনোময়ের ভুরু কুঁচকোয়। চেনাজানার পরিচিত বৃত্তটার মধ্যে সঞ্জু বলে কাউকে তো কই মনে পড়ে না। মুখে বলে, এই নামে তো কাউকে ঠিক… কিন্তু কেন?
আজ সন্ধেবেলা— ক’টা হবে তখন— ওই ধরো সওয়া সাতটা, কেউ একটা এসেছিল তোমাকে খুঁজতে…
কী বলে গেছে?
কিছু বলে তো গেল না।
সঞ্জু বলে গেছে নাম?
শোনো না পুরোটা। আমি ঘরে বসে টিভি দেখছি তখন। হঠাৎ শুনলাম কে যেন কলিংবেল বাজাচ্ছে তোমার গেটের। প্রথমে তো ভেবেছি তুমিই ফিরলে বুঝি। তারপরই মনে পড়ল তুমি ফিরলে কলিংবেল বাজাবে কেন? বউমা তো বাড়ি নেই। তবে কি অন্য কেউ এল কোনও দরকারে? পায়ে পায়ে উঠে বারান্দায় এসে দেখি কে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে ঠিক তোমার ওখানেই…
তারপর?
হ্যাঁ, তা আমি তো জিজ্ঞেস করেছি কাকে খুঁজছেন। জানতে চাইল মনোময় অধিকারীর বাড়ি কি এটাই। বললাম, হ্যাঁ, কিন্তু ওরা তো বাড়ি নেই কেউ এখন। তখন গেটের দিকে তাকিয়ে বলল, ও, তাই তো। গেটে তালা। আচ্ছা ঠিক আছে। মনোময় ফিরলে ওকে বলবেন তো যে আমি এসেছিলাম। সঞ্জু বললেই চিনবে।
সঞ্জু বললেই চিনবে! মনোময় অল্প ভাবার চেষ্টা করে। সঞ্জু। না, সঞ্জু বলে কাউকে তো কই মনে পড়ছে না। মাসি তখনও বকেই যাচ্ছেন একটানা। মনোময় জিজ্ঞাসা করে, দেখতে কেমন লোকটাকে? চেহারাস্বাস্থ্য?
এই মরেছে। অত তো বাবা খেয়াল করা হল না।
তবু…
আসলে আমি তো ছিলাম বারান্দায়। আর লোকটা ওই তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছ এখন। মানে পোস্টের আলোর উলটোদিকে। মুখ তো দেখতে পাইনি… ফরসা না চাপা, তাও ঠিক…
আর চেহারা, হাইট…
চেহারা চেহারা, মাসিকে বেশ চিন্তিত লাগে, রোগা, নাকি মোটা! মোটাসোটা বোধহয় হবে না। দোহারা গোছের। নাকি সিড়িঙ্গেই ছিল! লম্বায় তো মনে হয় তোমার মতোই অতটা। না না, অতখানি বোধহয় হবে না…
সন্ধ্যামাসিকে আর কথা বাড়ানোর সুযোগ দেয় না মনোময়। বলে ওঠে, ও আচ্ছা আচ্ছা। বুঝেছি। হ্যাঁ, আসার কথা ছিল ওনার। আচ্ছা মাসি, আটটা বেজে গেছে কিন্তু। আপনার দোকান আবার বন্ধ হয়ে যাবে ওদিকে…
হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা। এই যাই। যাক চিনতে পেরেছ। ভাল হল। আমি তাই ভাবছি…
সন্ধ্যামাসির ক্রমঅপস্রিয়মাণ কণ্ঠস্বরটুকু গলির মুখে মিলিয়ে যায়। পাড়াটা বড়রাস্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গলির ভেতর। কানাগলির এক ঘুপচি কোনায় কে বা কারা কোন মান্ধাতার আমলে বসিয়ে রেখে গিয়েছিল একখানা লাইটপোস্ট। আলোর বেশিটাই পড়ে সন্ধ্যামাসির বাড়িসহ পাড়ার বাছা বাছা ক’টা বাড়ির দিকে। আবার গাঙ্গুলিদের বাড়ি, অমলেন্দুদের বাড়ি বা মনোময়ের বাড়ি বরাবরই বঞ্চিত হয়ে এসেছে পোস্টের আলো থেকে। অবশ্য পুরসভার আলোর এমন একচোখোমি নিয়ে কোনওকালেই এ পাড়ায় কারও তেমন মাথাব্যথা দেখা যায়নি। সব বাড়িতেই বারান্দার আলো বা সামনের একফালি বাগানের আলোর মতো একটা না একটা অল্প পাওয়ারের আলো জ্বলেই সারা সন্ধে। এভাবেই যখন চলে যাচ্ছে কেউ আর গরজ করে মিউনিসিপ্যালিটিকে নতুন পোস্ট বসাতে তাগাদা দেয় না। আর ওদেরই বা কী ঠেকা পড়েছে নিজের তাগিদে আর-একখানা পোস্ট এনে বসিয়ে দিয়ে যাওয়ার! একেই পুরসভায় পাড়াটার একটু বদনাম আছে বিরোধী-ঘেঁষা বলে। বনেদি পাড়া হলে যা হয়।
মনোময়ের সদর পেরিয়েও চিলতে গলি আছে একটা। কম পাওয়ারের একটা আলো জ্বলেই প্যাসেজটায় সারা সন্ধ্যা। আজকের ব্যাপার অবশ্য আলাদা ছিল। আরতি ক’দিন ধরে বাড়ি নেই। সাড়ে পাঁচটার মধ্যে ফিরে সন্ধ্যা লাগার আগে আগে আলোটা জ্বেলে দিচ্ছিল এই ক’দিন মনোময়। আজ বিপ্লবের ওখানে গিয়েই দেরি হয়ে গেল। এতক্ষণ অন্ধকারই হয়ে বসেছিল তাই বাড়ির সামনেটা। আগন্তুককে তাই আর দেখতে পাননি সন্ধ্যামাসি। যা বিবরণ দিলেন চেহারার। আহা…
কে যে সঞ্জু কে বুঝবে অমন বর্ণনা থেকে! বোঝেনি মনোময়ও। তবে বুড়িকে তাড়াতে হত। সারাদিনের ধকল। সেই সকালে বেরিয়ে এতক্ষণে ফেরা। এরপর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বকরবকর শুনতে কার প্রাণেই বা আহ্লাদ জাগে!
ঘরে ঢুকে সামান্য জিরিয়ে নিয়ে হাতমুখ ধুয়ে পাখাটা ফুলস্পিডে ছেড়ে দিয়ে একটু বসেছে মনোময়। ইতিমধ্যে সঞ্জুর কথাটা মাথা থেকে বেমালুম হারিয়ে গিয়েছিল। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবছে আর মিনিট পনেরোর মধ্যে ভাতটা চাপাবে। হঠাৎ বেজে ওঠে মোবাইল ফোনটা।
আরতি।
হ্যালো, কখন ফিরলে?
মিনিট পনেরো হবে। বিপ্লবের বাড়ি যাব বলছিলাম না। তারপর মায়ের শরীর এখন কেমন? ফিরছ কবে?
এখন ভালর দিকেই। দু’-একদিনের মধ্যেই ফিরছি।
আরও ক’টা ছুটকোছাটকা কথাবার্তার পর আরতি হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে, সঞ্জয়বাবু এসেছিলেন নাকি এর মধ্যে? এ মাসেই বক্সখাটটা…
হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে যেতে সোজা উত্তর বেরিয়ে আসে একটা হেঁয়ালির। মনোময় বলে, হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক আছে। আজ সওয়া সাতটা নাগাদ উনি এসেছিলেন। আমি অবশ্য ফিরিনি তখনও। কাল বিকেলে গিয়ে দেখা করে আসব ওনার সঙ্গে একবার।
আরও খানিক এটা-সেটা কথাবার্তার পর ফোনটা কেটে দেয় আরতি। মনোময় এতক্ষণে বুঝতে পারে কে এসেছিল তখন। সন্ধ্যামাসির কথা শুনেই আঁচ করা উচিত ছিল। এখন ভাবতে গিয়ে আসল ব্যাপারটা টের পেয়ে মজা লাগে। আসলে তখন একে তো সারাদিনের ক্লান্তি দেহমনে। তাতে কানের গোড়ায় অমন বকবকানি। ঠিক মতো কাজ করেনি তাই মাথাটা। সামান্য একটু বুদ্ধি খাটালেই কিন্তু ধরা যেত। আসলে মাসির মুখে যেমনটা শুনেছিল অন্ধকারে ঠিক সেভাবেই হাতড়াচ্ছিল মনোময়। খুঁজছিল সঞ্জুকে। তেমন কাউকেই মনে পড়েনি। পড়বেটা কোত্থেকে! স্বভাবতই জানাশুনোর মধ্যে পোশাকি নামগুলোকেই নাড়াচাড়া করছিল মনোময়। কিন্তু সঞ্জু কি আর কারও পোশাকি নাম হয়! ও তো ডাকনাম। সঞ্জয়, সঞ্জীব বা সঞ্জীবন গোছের পোশাকি নামগুলোকে ছোট করে বা ডাকার সুবিধার্থে সঞ্জু বলে চালানো হয়। তখন যদি এভাবে একটু চিন্তা করত আর ভাবার চেষ্টা করত এই সঞ্জয় বা সঞ্জীব গোছের কার কার তার বাড়ি আসার সম্ভাবনা আছে, তক্ষুনি মনে পড়ে যেত সঞ্জয়মিস্ত্রির নামটা।
সঞ্জয় সরকার কাঠের মিস্ত্রি। বাড়ির একতলায় দোকান দিয়েছে হালে। নিজে হাতে আর কাজ করে না আজকাল। লোক দিয়ে করায়। আরতির বেশ কিছুদিনের ইচ্ছে একটা নতুন বক্সখাট করানোর। বাবলি বড় হচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো একা শোবে। আর-একখানা খাট লাগবে তখন। বক্সখাট বানালেই ভাল হয়। তাই সেদিন বাজারে সঞ্জয়মিস্ত্রির সঙ্গে দেখা হতে একদিন তাকে বাড়িতে আসতে বলেছিল মনোময়। মাপজোখ-দরদামের ব্যাপারে কথা বলতে। আজ তাহলে এসেছিল সঞ্জয়মিস্ত্রি। মনোময় ভাত বসাতে উঠল।
আরতির মায়ের শরীরটা হঠাৎই খারাপ হতে আজ দিন চারেক হল বাবলিকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যেতে হয়েছে আরতিকে। এই ক’দিন তাই মনোময়কেই রাতে দুটো ডালভাত ফুটিয়ে নিতে হচ্ছে নিজের মতো। প্রথম দিন ভাত চাপাতে গিয়েই টের পেয়েছিল এসব কাজে একেবারেই আনাড়ি সে। সত্যি বলতে কি অনেক ব্যাপারেই যে খামতি আছে তার, আজকাল বেশ বুঝতে পারে মনোময়। প্রথমত সে মিশুকে নয়। খুব বেশি বন্ধুবান্ধব কোনওকালেই ছিল না তার। স্কুলজীবনে তো ছিল সে বলতে গেলে একেবারেই বুক-ওয়ার্ম ধরনের। তারপর আবার অনেককিছু যেন দেখেও দেখতে পায় না সে। আরতি যতক্ষণ না তাকে সেসব হাতে ধরে দেখিয়ে দিচ্ছে ততক্ষণই যেন ব্যোমভোলা হয়ে থাকে সে। এই যেমন বাবলি যে বড় হচ্ছে, এবার আলাদা আর-একটা খাটের ব্যবস্থা করতে হবে, এই ব্যাপারটাই এতদিন খেয়াল হয়নি তার।
হঠাৎ মনোময়ের একটানা চিন্তায় ছেদ পড়ে। কথাটা হঠাৎই খটকা জাগায় মনে। মেয়েকে ছোটবেলায় আদর করে সে বাবলি নামে ডাকত। সেই থেকেই ওর ডাকনাম হয়ে গিয়েছে বাবলি। তাহলে বলা যেতে পারে ডাকনামটা শুধু পোশাকি নামের সংক্ষিপ্তকরণের জন্য বা সম্বোধনের সুবিধার্থেই ব্যবহৃত হয় না। একটা ঘনিষ্ঠতার আভাসও থাকে এক্ষেত্রে। আর তাছাড়া কারও কোনও বিশেষ ডাকনাম থাকতেই পারে। কিন্তু সবাই তাকে সেই নামে ডাকে না। অথবা সে-ও সকলকে সেই নাম বলে বেড়ায় না। যেমন মনোময়কেই স্কুলজীবনে সুরেশ, তীর্থ বা অজিতরা মন বলে ডাকত। কিন্তু তাই বলে বাবলি নিশ্চয়ই তাকে ওই নামে ডাকবে না কোনওদিনই। কিংবা যদি এমন হয়— ভাবার চেষ্টা করে মনোময়— বাবলির খোঁজে হয়তো সে গেল কোথাও। তাকে তখন সেখানে পেল না। কী বলে আসবে সেখানে? ‘বাবলি এলে বলবেন মন খুঁজতে এসেছিল’ নাকি ‘বাবলি এলে বলবেন ওর বাবা খুঁজতে এসেছিল’! নিশ্চয়ই দ্বিতীয়টাই বলবে। অর্থাৎ যার সঙ্গে যেমন সম্পর্ক তার বাড়ি গিয়ে তেমন নামই বলে লোকে। সম্পর্কের লঘুগুরু ছায়া ফেলে ডাকনাম বা সম্বোধনের উপর।
সেক্ষেত্রে সেই সান্ধ্য আগন্তুক সঞ্জুকে নিয়ে আবার ভাবতে হচ্ছে তো এখন। সঞ্জয়মিস্ত্রি লোকটা কিছু না হলেও মনোময়ের থেকে বছর দশেকের বড় বয়সে। তার সঙ্গে অনেক দিনেরই চেনাশুনো মনোময়ের। কিন্তু সেটা নিছকই কেজো সম্পর্ক। তাছাড়া মনোময় লোকটা আবার এমনিতেই একটু মুখচোরা প্রকৃতির। চট করে মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করাটা আসে না তার। তাহলে বয়সের ব্যবধান আর মনোময়ের স্বভাবে মিলে যা দাঁড়াল— তার সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠতা নেই সঞ্জয়মিস্ত্রির, যাতে করে সে সোজাসুজি লোকটাকে সঞ্জু বলে ডেকে উঠতে পারে। এখন এই কথাটা ভাবতে গিয়ে মনেও হল, তাই তো, এমন বয়স্ক একটা লোককে সে সঞ্জু বলে ডাকবে কল্পনা করতেও কেমন হাসি পেয়ে যাচ্ছে। আর তাহলে সঞ্জয়মিস্ত্রিও কি তার বাড়ি এসে বলে যাবে— সঞ্জু বললেই চিনবে!
সঞ্জু। সম্বোধনটার মধ্যেই কেমন এক ঘনিষ্ঠতার আঁচ। মনোময় আশ্চর্য হয়ে ভাবে এতখানি ঘনিষ্ঠতা তার সঙ্গে কার থাকতে পারে! অন্তত সঞ্জয়মিস্ত্রির যে নেই সেটা হলফ করেই বলা যায়। কাজেই সে আজ সন্ধ্যায় আসেনি। তবুও নিশ্চিত হওয়ার জন্য ফোন থেকে খুঁজে খুঁজে সঞ্জয়মিস্ত্রির নাম্বারটা বের করে কল করে। একটা হিন্দি গান খানিকক্ষণ বাজার পর ওপাশ থেকে ভারী গলায় ভেসে আসে, হ্যালো, বলুন…
মনোময় সংক্ষেপে বলে, সেদিন বাজারে আপনাকে যা বললাম মনে আছে তো! বক্সখাটটার কথা। আসছেন কবে?
ভাবতে হবে না। মনে আছে। কাল-পরশুর মধ্যেই যাব। ক’টা কাজে এদিকে একটু আসানসোল যেতে হয়েছিল ক’দিনের জন্য। এইমাত্র ফিরলাম।
ওহো, ঠিক আছে ঠিক আছে। আপনি তাহলে এখন রেস্ট নিন। আমি রাখছি।
ফোনটা কেটে দেয় মনোময়।
তাহলে কী দাঁড়াল ব্যাপারটা! কে এসেছিল সেই ধোঁয়াশাটা থেকেই গেল। সঞ্জু। নামটার মধ্যেই যে ঘনিষ্ঠতার ছোঁয়া— অত হৃদ্যতা কার সঙ্গে থাকতে পারে তার! ভাবার চেষ্টা করে মনোময়। আত্মীয়স্বজনদের কথা মনে করার চেষ্টা করে একে-একে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাদের পোশাকি নামগুলো যথাক্রমে অতীন, রমেন, সমরেশ, প্রবোধ বা জ্যোতিপ্রকাশ ধরনের। সঞ্জুর লেশমাত্রও নেই নামের কোথাও।
প্রসঙ্গত রমেনের কথাটা মনে পড়তে মনটা একটু খারাপ হয়ে যায় এখন মনোময়ের। সম্পর্কে রমেন তার এক মাসতুতো ভাই। এককালে কেমন মালদার অবস্থা ছিল আর আজ পড়তে পড়তে কোথায় এসে ঠেকেছে! মানুষের ভাগ্য মানুষকে যে কোথা থেকে কোথায় টেনে নিয়ে যায় রমেনকে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। আর এখন তো এমন হাল হয়েছে যে নিজের লোক কেউ গেলে কোথায় বসতে দেবে সেই ভেবে সংকোচের সীমা থাকে না। তেমনি আবার আত্মীয়দের ভেতর কারও ছেলেমেয়ের বিয়েশাদিতে নেমন্তন্ন করলেও আর আসে না ইদানীং ওরা। এই তো সেবার অনিমেষদার ছোটমেয়ের বিয়েতেই যায়নি।
মনোময় কেমন আনমনা হয়ে গিয়েছিল রমেনের কথা ভাবতে ভাবতে। এই তো বছর পাঁচ আগেও এ বাড়িতে এসেছে রমেন। এখন আর আসে না।
মাত্র একটা জীবনের মধ্যেই চারপাশের কত অদলবদল হয়ে যায়! কত কী-ই না দেখে যেতে হয়! চল্লিশটা বছর ধরে কম কিছু তো দেখল না মনোময়। কেউ কেউ মাঝের এই সময়টায় সৌভাগ্যের সিঁড়ি বেয়ে তরতরিয়ে কোথা থেকে কোথায় উঠে গেল। আবার রমেনের মতো কেউ বা কোথায় তলিয়ে গেল। খুব বেশি দূর যেতে হবে না। জ্যোতির কথাই ধরা যাক না। খুব সাধারণ অবস্থা থেকে শুরু করা জ্যোতিই আজ আত্মীয়দের মধ্যে আর সকলের ঈর্ষার পাত্র। টালিগঞ্জের মতো জায়গায় ফ্ল্যাট, দুটো গাড়ি বা ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স তো আছেই। বাইরের কেতাতেও অনেক পালিশ পড়েছে জ্যোতির। বউ-মেয়ের বেশভূষার তো কথাই নেই। দুই মেয়ের নামগুলোতে অবধি যেন মাল্টিপ্লেক্স ঘরানার ছোঁয়া। লুসিয়ানা আর ভেরোনিকা।
ভাবতে ভাবতে আচমকা একটা আশ্চর্য ব্যাপার খেয়াল করে মনোময়। সমরেশ, প্রবোধ বা রমেনের মতন যারা জীবনে বিশেষ কিছুই করে উঠতে পারল না তাদের নামগুলোও কেমন যেন ব্যাকডেটেড হয়ে গিয়েছে না! সত্যি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নামের ধরনেরও কত বদল ঘটে যায়! আবার শুধু সমকালই নয়, অর্থনৈতিক অবস্থানও বেশ ফুটে ওঠে নামের মধ্যে। জ্যোতির মেয়েরা জন্মসূত্রে যে ধাঁচের নামের অধিকারিণী হয়েছে একই যুগে জন্মেও তেমন নাম জোটেনি বাবলির কপালে। বাবলির নাম রেখেছিলেন আরতির বাবা। পুরনো আমলের মানুষ। খানিকটা সাবেকি ভাবধারার। শ্রাবণ মাসে নাতনির জন্ম হতে নাম রেখেছিলেন শ্রাবণী। মনোময়ের মনে হল, হয়তো বহুকাল পর কেবল নাম শুনেই একদিন যে কেউ বাবলির সঙ্গে জ্যোতির মেয়েদের বড় হয়ে ওঠার পরিবেশের ফারাকটা বুঝে নেবে। আবার স্রেফ আর্থিক কাঠামোটুকুই তো নয়। মানুষের সামাজিক বা আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের জগৎটাও ফুটে ওঠে নামেই। নামের শেষে স্টাইন থাকলেই ইহুদি বলে চেনা যায়। পার্সিফোন বা প্রমিথিয়ুসের মতো নামগুলোতেই যেন প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার গন্ধ লেগে থাকে। আজকের খ্রিস্টীয় গ্রিসেও কি অ্যাকিলিস বা অ্যান্ড্রোমিডার মতো পেগান নামকরণের ধারাটা বজায় আছে?
সত্যি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কত চালু নাম হারিয়ে যায়। দেবেনদের গলির সেই পাঁচকড়ি হাজরা বোধহয় এখনও বেঁচে আছে। একেবারে থুত্থুড়ে বুড়ো। সেই আমলে ছিল তিনকড়ি, পাঁচকড়ি বা সাতকড়ির মতো নামগুলো। অনেকের পরপর ছেলেমেয়ে হয়ে হয়ে মরে যেত বলে শেষে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে কারও ছেলেকে নিয়ে মানুষ করত। তিনটে, পাঁচটা বা সাতটা কড়ি দিয়ে নিয়ে নিত সেই ছেলেকে। আর সেই ছেলের নামেও ধরা থাকত কড়ির হিসেব। সেসব প্রথাও কবে উঠে গিয়েছে। আর আজকাল তো টেস্টটিউব বেবির যুগ। তিনকড়ি বা ন’কড়ির মতো মানুষগুলো মরেহেজে কোথায় চলে গেল। মনোময়ের হঠাৎ মনে হল দেবেনদের গলির সেই পাঁচকড়ি হাজরার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই যেন পৃথিবীর বুক থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
আজকাল কি আর শোনা যায় অনাদি, প্রমথ, বসন্ত বা অবনীর মতো নামগুলো! অথচ একদিন কী জনপ্রিয় ছিল এসব নাম! বসন্ত চৌধুরীর অভিনয় তো ফাটাফাটি লাগত মনোময়ের। আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান। আবার কিছু কিছু নাম দু’-এক বছর বেড়ে চলে হঠাৎ একেবারে হারিয়ে যায়। চব্বিশ থেকে ছাব্বিশের অনেক ছেলের ডাকনাম যেমন জিকো। ওই এজ গ্রুপের বাঙালি ছেলেদের মধ্যেই খালি পাওয়া যাবে নামটা। এইটটি টু-র ওয়ার্ল্ড কাপে জিকোর খেলায় পাগল বাঙালি সেই সময় নিজের ছেলের নাম রাখছিল জিকো। আর সঞ্জু! না, এই নামটা ক্লাসিক। মহাভারতেও ছিল সঞ্জয় নামটা। সেই থেকে আজও দিব্যি চলে আসছে।
সঞ্জুর কথাটা আবার ফিরে আসে মাথায়। কে যে এসে ঘুরে এল! দূর সম্পর্কের কোনও আত্মীয়! হয়তো তার সঙ্গে আজ বহুকাল কোনও যোগাযোগ নেই আর। তাই চট করে মাথায় আসছেও না তার নামটা। বা সে যে আজ এত বছর বাদে তার বাড়ি আসতে পারে সেটাই ভাবতে পারছে না। কিন্তু তেমন হলে কি আর বলে যেত লোকটা— সঞ্জু বললেই চিনবে! কথাটার মধ্যে কেমন একটা নিত্যনৈকট্যের ভাব আছে। যেন প্রায়শই লোকটার সঙ্গে দোকানবাজারে, পথঘাটে, ট্রেনেবাসে বা স্কুল-কলেজে দেখা হয়।
আরে তাই তো। স্কুলের কথা মনে হতেই মনে পড়েছে একটা কথা। জরুরি একটা কথাই তখন জিজ্ঞাসা করা হয়নি সন্ধ্যামাসিকে। অজ্ঞাত আগন্তুকের বয়স আন্দাজ কেমন ছিল জানা দরকার। সঞ্জু নামটার মধ্যে শুধু যে সমবয়স্ক ঘনিষ্ঠতার ছোঁয়াই আছে কে বলল! সঞ্জয়মিস্ত্রিকে সে সঞ্জু বলে কখনওই ডাকবে না তা যেমন ঠিক, আবার কোনও ছাত্রকে ওই নামে ডাকতে তো বাধা নেই। আর এই মুহূর্তে মনেও পড়ছে সঞ্জীব নামে তারই স্কুলের এক ছাত্রের কথা। কিছুদিন আগে বোধহয় সঞ্জীব তার কাছে বাড়ির ঠিকানা চেয়েওছিল একদিন আসবে বলে। আশ্চর্য তো! সেই থেকে এত আকাশপাতাল ভেবে ফেলল। অথচ সঞ্জীবের কথাটাই মাথায় এল না কেন!
একটু ভাবতেই অবশ্য মনোময় বুঝতে পারে সঞ্জীবের কথাটা এতক্ষণ মাথায় না আসার কারণটা। যা মনে পড়ছে সন্ধ্যামাসি সেই অজ্ঞাত আগন্তুককে একজন লোক বলেছিলেন। একটা ছেলে বলেননি। ওই কথাটাই অবচেতনে রয়ে গিয়েছিল সেই থেকে। তাই এতক্ষণ সঞ্জীবকে আর ধর্তব্যের মধ্যেই আনা হয়নি।
ভাতটা ফুটে এল। ফ্যানটা ঝরাতে বসিয়ে দিয়ে একবার ঘুরে এলে হয় সন্ধ্যামাসির বাড়ি থেকে। জেনে আসতে হবে আগন্তুকের বয়স আন্দাজ কেমন ছিল। ছেলেছোকরা গোছের নাকি বয়স্ক ধরনের। কিন্তু বুড়ি তখন চেহারার যা বর্ণনা দিল তাতে বয়সের কথাটা জিজ্ঞাসা করেও কতটা লাভ হবে সে-ও এক সন্দেহ বটে। তবে বয়সটা তো শুধু চোখে দেখেই ধরা যাবে তা নয়। কণ্ঠস্বরেও বুঝতে পারা যায়। বুড়ি যদি এমনকি অন্ধকারের দরুণ কাউকে নাও দেখতে পেয়ে থাকে, তবু গলার আওয়াজেই আগন্তুকের বয়স আঁচ করে নেওয়ার কথা। অবশ্য আর-একটা কথাও বলেছে বুড়ি। আগন্তুক বলেছিল— সঞ্জু বললেই চিনবে। যদি সঞ্জীবই এসে থাকে তবে সে নিশ্চয়ই মনোময়ের সম্বন্ধে ‘চিনবে’ শব্দটা ব্যবহার করেনি। ‘চিনবেন’ বলেছিল। সে অবশ্য বুড়ির শোনার ভুলও হতে পারে। বয়স তো কম হল না। সত্তর পেরিয়ে গিয়েছে কোনকালে। বুড়ি কি আজকের মানুষ! সেই ছেলেবেলায় মনোময় যখন সাদা জামা নীল হাফপ্যান্ট পরে ইস্কুলে যেত তখন থেকেই বুড়ি এই পাড়ার বাসিন্দা। সেদিক থেকে দেখলে মহিলা এই বয়সেও বেশ ডাঁটো আছেন বলতেই হবে।
ন’টা দশ বাজে। সন্ধ্যামাসির বাড়ি যেতে হলে এখনই যাওয়া ভাল। বয়স্ক মানুষ। এরপর হয়তো শুয়েটুয়ে পড়বেন। হাঁড়িটাকে উলটে ঢাকনার মুখে নোড়ার ঠেকনোয় ভাতের ফ্যানটা ঝরতে বসিয়ে দিয়ে রান্নাঘরের দোর টেনে বেরিয়ে আসে মনোময়।
সদরে এসে একবার দাঁড়ায় মনোময়। সত্যি, তার প্যাসেজের আলোটা নেভানো থাকলে সন্ধ্যামাসির বারান্দা থেকে রাতবিরেতে এখানে দাঁড়িয়ে থাকা আগন্তুকের মুখ দেখা সম্ভব নয়। লাইটপোস্টটা এমনই বেখাপ্পা জায়গায়। এভাবে পোস্টটা বসানোর মানে কী! ভাবার চেষ্টা করে মনোময়। পরক্ষণেই মনে হয় সম্ভবত যে আমলে এই লাইটপোস্ট বসানো হয়েছিল তখন পাড়ার চালচিত্রটা অন্যরকম ছিল। যে ক’টা বাড়ি ছিল তখন পাড়ায়, তাদের সবার যাতে সুবিধে হয় এমন জায়গাতেই বসানো হয়েছিল লাইটপোস্টটাকে। যে জমিগুলো সেকালে ফাঁকা পড়েছিল তাদের কথা আর ভাবা হয়নি বা ভাবা যায়নি। কালেদিনে ফাঁকা প্লটগুলোয় নতুন নতুন বাড়ি উঠেছে। কিন্তু পুরসভার আলোর দাক্ষিণ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে তারা। নতুন পোস্টও আর বসেনি। পুরনোটাও পাড়ার বিবর্তিত ভূগোলের সঙ্গে আর খাপ খায় না।
তাহলে অবশ্য বলতে হয় যে আমলে মনোময়ের বাবা এ পাড়ায় জমি কিনে বাড়ি করেছিলেন, লাইটপোস্টটা তারও আগে বসানো হয়েছিল। তাই কি! নিজের শৈশবের স্মৃতি হাতড়াতে থাকে মনোময়। মনে হচ্ছিল যেন জ্ঞান হয়ে থেকেই পোস্টখানাকে ওখানে ঠিক ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এসেছে সে এতকাল। আজ নতুন করে ওর জরাজীর্ণ শরীরখানার দিকে তাকিয়ে মনে হল শৈশবের অনেক স্মৃতির সঙ্গেই জড়িয়ে আছে পোস্টটার অস্তিত্ব। আজ যেখানে নিবারণ গাঙ্গুলিদের তিনতলা বাড়ি, তার ছেলেবেলায় ওখানে ছিল একখণ্ড ফাঁকা জমি। তখন তার হাফপ্যান্ট পরা বয়স। মনে পড়ে রোজ বিকেলে ধলা, সুরেশ, অজিতরা খেলতে আসত এ পাড়ায়। মনোময় অবশ্য খেলতে-টেলতে বিশেষ বেরোত না দোরগোড়ায় ফাঁকা জমিটা থাকা সত্ত্বেও।
মনে পড়ে অজিতের বলে ধলার সেই সপাট ব্যাট চালানো। সন্ধ্যামাসিদের জানলার আর্চে ছিল লাল-নীল-সবুজ কাচ। ক্যাম্বিসের বলটাকে অত জোরে উড়ে আসতে দেখেই বসে পড়েছিল মনোময়। ক্যাচটা ধরার চেষ্টা না করেই। তারপর তো সন্ধ্যামাসিদের জানলার কাচ-টাচ ভেঙে সে এক বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড। ধলাটার চেহারাও ছিল যেমন হাতির মতো, কবজির জোরও ছিল তেমনই। যাক, তারপর তো মাঠে যে ক’জন উঠতি গাভাসকার বা বেঙ্গসরকার ছিল সব নিমেষে হাওয়া। ধলা আর সুরেশ এসে ঢুকেছিল মনোময়ের বাড়িতেই। সেদিন সন্ধ্যামাসি এক বাজখাঁই মহিলা। সেই আমলেও পোস্টটাকে ওই একভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে বলে মনে পড়ছিল মনোময়ের।
কালে কালে আজকাল দিনকাল কত বদলে গিয়েছে। সেই সন্ধ্যামাসির আজ কী দশা! স্বামী মারা গেলেন তাও বছর পাঁচ তো হবেই। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে আগেই। জামাইদের বাইরে চাকরি। বছরে এক-আধবার মেয়ে-জামাইরা আসে নাতি-নাতনিদের নিয়ে। তা বাদে ওই শূন্যপুরী আগলে একলা একলাই কাটে মাসির। শুধু টিভি দেখে, বই পড়ে আর ফুলের বাগান করে।
হঠাৎ মনোময়ের মনে হল, কে জানে হয়তো ইদানীং বকবকানির ওই রোগটাও মাসিকে ধরেছে ওই নিঃসঙ্গতার কারণেই। নিজের পরিজনেরা দু’দিনের জন্য বেড়াতে আসে তাঁর কাছে। তারপর আবার তো সেই শূন্য দৈনন্দিন। হয়তো তাই এই একাকিত্বের মাঝে যখনই এক-আধজন চেনা লোকের দেখা পান মাসি অমনি দু’ দণ্ড কথা বলতে উশখুশিয়ে ওঠে তাঁর মন। যে মানুষটা দাপটে একদিন তটস্থ করে রাখত সকলকে, আচমকা যদি সে একদিন উপলব্ধি করে যে তার দাপট দেখানোর জায়গাগুলো সব ফাঁকা হয়ে গিয়েছে তবে পরিণতিটুকু কি এমনই হয়! কিন্তু আশ্চর্য, আজকের আগে তো এভাবে চিন্তা করেনি কখনও মনোময়! মাথাতেই আসেনি এসব ভাবনা। সন্ধ্যামাসির সদর খুলে ঢুকতে ঢুকতে মনোময়ের মনে হয়, সেই কবে থেকে মাসি তার প্রতিবেশী। মাত্রই তো ফুটখানেকের ব্যবধানে দুই বাড়ি। অথচ আজ কতকাল পর যে সে এই বাড়ির চৌকাঠ পেরোচ্ছে মনেও পড়ে না। অবশ্য আরতি আসে মাঝেমধ্যেই। আসলে এসব ব্যাপারগুলো মনোময়ের আসে না কোনওকালেই।
সদরের লাগোয়াই বাগান। নাইন ও ক্লকের গাছ। ছেলেবেলায় বল খুঁজতে ধলাদের সঙ্গে এই বাগানে বারকয়েক এসেছিল মনোময়।
মাসি তো মনোময়কে দেখে অবাক। একে তো সে পাড়ায় কারও বাড়ি বিশেষ যায়-টায় না। তাতে এখন রাত প্রায় সওয়া ন’টা।
আরে মনোময় যে, বোসো বাবা বোসো…
না না মাসি, এখন আর বসব না। আসলে একটা কথা জানতে এলাম। তখন আপনাকে বললাম না যে লোকটাকে চিনতে পেরেছি…
কোন লোকটার কথা বলছ?
ওই যে আপনাকে সঞ্জু বলে যে পরিচয় দিয়ে গেছে…
আচ্ছা আচ্ছা। হ্যাঁ হ্যাঁ…
হ্যাঁ, তা আপনাকে বলছিলাম না যে চিনতে পেরেছি লোকটাকে। কিন্তু এখন দেখছি সে লোক নয়। অন্য কেউ এসেছিল। কে যে এল বুঝতে পারছি না কিছুতেই। আচ্ছা, আপনি একটু ভেবে বলতে পারবেন লোকটার বয়েস কেমন হবে আন্দাজ?
অত তো খুঁটিয়ে দেখিনি, অন্ধকারে…
না না। দেখার কথা আমিও বলছি না। গলার আওয়াজ শুনে কেমন মনে হয়েছিল? আমাদের মতো বয়স্ক গোছের, নাকি ছেলেছোকরা ধরনের? কথা তো সে বলেছিল আপনার সঙ্গে। ভয়েস শুনেও তো আন্দাজ করা যায় বয়েসটা…
সন্ধ্যামাসিকে দেখে মনে হয় তিনি ভালই চিন্তায় পড়ে গিয়েছেন। মনস্থির করে কিছুই বলতে পারছেন না। মনোময় বোঝে আসলে লোকটাকে মাসি ভাল করে ঠাহর করার চেষ্টা করেননি। ‘সঞ্জু বললেই চিনবে’ শুনে হয়তো মনে করেছিলেন মনোময়ের কোনও চেনা লোক। হয়তো আসার কথা ছিল তার। হয়তো মনোময়কে বললেই সে চিনে নেবে। কাজেই আর লোকটাকে কোত্থেকে আসছে কী দরকারে আসছে কিছু জানতে চাওয়ার বা তার চেহারা, চালচলন, কণ্ঠস্বর ভাল করে খুঁটিয়ে দেখার দরকার মনে করেননি। ব্যাপারটা যে শেষে এত ঘোরালো হয়ে উঠবে কে জানত!
এই কথাটাই মনে মনে ভাবছিলেন মাসিও। নিদেনপক্ষে লোকটা কোত্থেকে আসছে জেনে রাখাটা তাঁর দরকার ছিল বলেই মনে হচ্ছিল এখন। আমতা-আমতা করে বলেন মাসি, দ্যাখো বাবা, আমি ঠিক মতো খেয়াল করিনি অত। লোকটার কথা শুনে মনে হয়েছিল তোমার খুব চেনা বুঝি। তাই তখন আর অত মাথা ঘামাইনি। টিভিতে আবার তখন ‘পঞ্চশর’ সিরিয়ালটা হচ্ছিল। দেখতে দেখতে উঠে গিয়েছিলাম। মনটা পড়েছিল ওদিকেই। এখন তোমার কথা শুনে তো আরওই তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে সব আমার। ঠিকঠাক কিছুই আর মনে করতে পারছি না। দ্যাখো দেখি, কী ভুল হয়ে গেল। কত লোকে কত মতলবে সুলুকসন্ধান নিয়ে যায়। তখন যদি ভাল করে লোকটাকে…
মনোময়ের বুঝতে বাকি থাকে না যে মাসিকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করেই কোনও লাভ নেই। বলে, আচ্ছা মরুক গে। যেতে দিন। দরকার থাকলে আবার আসবে সে লোক। তখন থেকে খালি ভেবে মরছি। কে না কে এসেছিল তার ঠিক নেই…
মাসি আর কিছুই বললেন না। মনোময়ের মুখের দিকে তাকালেন একঝলক। যেন এক অদ্ভুত শূন্যতামাখা চাহনি সেই দৃষ্টিতে। সেদিকে তাকিয়েই হঠাৎ মনে হল মনোময়ের— মাসি বোধহয় আহত হলেন ওই শেষের কথাটায়। কেমন একটা অবিশ্বাসের সুর লুকিয়ে আছে না কথাটুকুর ভাঁজে! যেন সঞ্জুর আসার খবরটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না সে।
একেই তো পড়শিরা মাসিকে এড়িয়ে চলে আজকাল। ওই বকবকানির জন্যই। আড়ালে আবডালে হাসাহাসিও হয় তাঁকে নিয়ে। মাসিরও একদম অজানা নয় এসব কথা। তাতে আজ এক আগন্তুকের আসার খবর তিনি দিলেন। অথচ আর কিছুই বলতে পারছেন না লোকটার বিষয়ে ঠিকঠাক। মনোময় নিশ্চয় বিরক্ত হচ্ছে এতে— এমনটাই কি ভাবছেন এখন মাসি!
এককালের বাজখাঁই মহিলার চোখের সেই শূন্য চাহনির দিকে তাকিয়ে মনোময়ের এবার মনে হল কেমন অসহায় চাহনিটা। যেন সকলের সমস্ত বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে সংসারে একেবারে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ার যন্ত্রণা মূর্ত হয়ে উঠেছে ওই দৃষ্টিতে। হঠাৎ টের পেল মনোময়— মাত্র একটা সন্ধ্যার মধ্যেই সহসা যেন মানবমনের গূঢ় মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের ক্ষমতাও কীভাবে করায়ত্ত করে ফেলেছে সে নিজের অজান্তেই। আর-একটা ব্যাপারও অনুভব করতে পারে সে। ভাবনাচিন্তা না করে দুম করে এখন কথাটা বলে ফেলা তার উচিত হয়নি। এই এক দোষ বটে তার। বলে না তো কিছুই বলে না, আবার যখন বলে আগুপিছু না ভেবে বলে বসে দুমদাম কথা।
সে যাক, প্রসঙ্গটাকে ধামাচাপা দিতে হবে এখন। ম্যাজিকের মতোই কথা জোগাল মুখে, দেখুন তো দেখি। সেই সন্ধে থেকেই ভাবছি যে কে এল। কিছুতেই বুঝতে পারছি না। কেউ যে এসেছিল সিওর। আপনি বলছেন যখন। আপনার চোখ এড়িয়ে কেউ ঘুরে যাবে সেও কি হতে পারে! আরতি তাই মাঝেমধ্যে বলে বাড়ির পাশে আপনি রয়েছেন এ এক বিরাট ভরসা আমাদের। দু’ দিন যদি বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে হয় তবু খানিকটা নিশ্চিন্ত থাকা যায়। যা দিনকাল পড়েছে আজকাল! আমিও তাই বলি আরতিকে যে কী আর দেখছ আজ সন্ধ্যামাসিকে। সেসব দিন ছিল আমাদের ছোটবেলায়। ক্রিকেট খেলতে খেলতে মাসির বাগানে বল পড়লে ভয়ে আমাদের…
মাসির মুখে হাসি ফুটে ওঠে। খানিক আরও এটা-সেটা কথার পর, সোমাদি-মিঠুদিদের খোঁজখবর নিয়ে বেরিয়ে আসে মনোময়।
একটা ব্যাপার কিন্তু বেশ টের পায় সে। সঞ্জুর বিষয়ে বিভ্রান্তিটা কাটল না ঠিকই এখনও। কিন্তু সেই অদেখা সঞ্জু যেন আজ তার কয়েকটা মুহূর্তের উপস্থিতির মাধ্যমে মনোময়ের নিরুত্তাপ মনোজীবনে বেশ একটা তোলপাড় এনে দিয়েছে। সঞ্জুকে খুঁজে বের করতে গিয়ে মনোময়কে নিজেরই অতীতটার দিকে ফিরে তাকাতে হচ্ছে আবারও। অন্তত একবার করে হলেও গিয়ে দাঁড়াতে হচ্ছে টিকে থাকা বা ফিকে হয়ে আসা সমস্ত সম্পর্কগুলোর কাছেই।
এই ডাকনামের প্রসঙ্গেই মনে হয় আর-একটা কথা। সম্পর্কভেদে একজন মানুষেরই তো এক-এক জায়গায় এক-এক নাম। হয়তো পোশাকি নামে কেউ কান্তিরঞ্জন। বাড়ির লোকে ডাকে কানু বা কানাই বলে। বন্ধুবান্ধবের কাছে সে-ই আবার কানা। বয়ঃকনিষ্ঠের কাছে কানুদা। কিন্তু এর বাইরেও আর-এক জাতের গোপনীয় ডাকনাম থাকে অনেকের। প্রেমিক-প্রেমিকা বা সদ্য বিয়ের পরপর দম্পতিরা একে অপরের এক-একটা বিশেষ গোপনীয় নাম দেয়। নিভৃত আদরের ছোঁয়া থাকে নামগুলোতে।
মনোময়ের কোনওদিনই ছিল না এমন কোনও নাম। প্রেম-ট্রেম করার তো প্রশ্নই ছিল না তার। আর বরাবরই এমন গোমড়ামুখো সে যে বিয়ের পর আরতিও কখনওই পারেনি তাকে এমন কোনও নামে ডাকতে। সন্ধ্যামাসির বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে হঠাৎই মনে হয় আজ মনোময়ের, সদ্য বিয়ের পরপর হয়তো একদিন আরতিরও মনে মনে ইচ্ছে হত তাকে আদর করে এমন কোনও নামে ডাকতে। হয়তো সে ভেবেওছিল তেমন কিছু নাম। কিন্তু মনোময়ের শীতলতা শেষ অবধি তাকে আর সুযোগ দেয়নি সেই নাম উচ্চারণ করতে। আচ্ছা, তার সঙ্গে বিয়ে না হয়ে যদি আরতির বিয়ে হত অন্য কোনও সপ্রতিভ পুরুষের সঙ্গে তবে কি আরতি তার সেই স্বামীকে ডাকত অমন কোনও নামে! তাহলে কি সে খুশি হত! মনোময়কে বিয়ে করে কি তবে সুখী আরতি! কে জানে! বিয়ের আগে আগে কি সে মনোময়ের মতো স্বামীকেই পেতে চেয়েছিল!
হঠাৎ যেন বুঝতে পারল মনোময়, বিয়ের পরের সেই প্রথম অনুরাগের বয়সটা কবে অজান্তেই যেন কেটে গিয়েছে তার বা আরতির জীবন থেকে। আর-একটা কথাও মনে হল এখন। মেয়েদের বোধহয় জীবনে অনেককিছুই মানিয়ে নিতে হয়। এই যেমন আরতিকেই হয়তো মানিয়ে নিতে হচ্ছে তার মতো স্বামীকে।
মধ্য জুনের রাত্রির প্যাঁচপ্যাঁচে একটা আর্দ্রতা জগদ্দলের মতো চেপে বসে থাকে পারিপার্শ্বিক আবহে। গলির আনাচেকানাচে আলো-আঁধারির প্রেক্ষাপটে চুঁইয়ে চুঁইয়ে জমা হয়ে চলে আধখানা চাঁদের ফিকে হরিদ্রাভা।
রাতের খাবার খেতে বসেও রেহাই মিলল না সঞ্জু থেকে। এমন হয় এক-এক দিন। অনেক চেষ্টা করেও যা মনে পড়ে না, তাকে ভুলেও থাকা যায় না আবার। আজ মনোময়ের হয়েছে সেই হাল। সন্ধ্যামাসির বাড়ি গিয়ে শুধু এটুকুই বুঝেছে সে যে এই সঞ্জু অন্তত সঞ্জীব নয়। সন্ধ্যামাসি যে সঞ্জুকে বরাবর একটা লোকই বলে গিয়েছেন তা নজর এড়ায়নি মনোময়ের।
চেনাশুনো, আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবের মধ্যে এমন কাউকে তো কই এতক্ষণেও মনে পড়ল না যাকে কস্মিনকালেও সে সঞ্জু বলে চিনত।
বন্ধুবান্ধব। আচ্ছা, এই বন্ধুবান্ধব বলতে ঠিক কাদের বোঝায়! শৈশবে স্কুলের সহপাঠী, যৌবনে কলেজ-ইউনিভার্সিটির ক্লাসমেট বা তারপর অফিসের সহকর্মীমাত্রেই কি বন্ধু! স্কুল-কলেজে ক’টা বছর একসঙ্গে কাটালেই কি বন্ধু হয়ে ওঠা যায় পরস্পরের! ক্লাসমেট তো নেহাত কম পায়নি জীবনে মনোময়। সবাই কি তবে বন্ধু ছিল! আচ্ছা, যদি আজ সন্ধ্যার আগন্তুক তার স্কুল-কলেজের কোনও পুরনো সহপাঠীই হয়ে থাকে— বন্ধুমহলে যার ডাকনাম ছিল সঞ্জু— তাকে আর মনে পড়ছে কই মনোময়ের! অথচ আগন্তুকের কিন্তু বিশ্বাস ছিল যে মনোময় তার নাম শুনলেই চিনতে পারবে। আর সেটাই তো হওয়া উচিত। ভাবতে গিয়ে মনে হল এখন। বন্ধুত্ব ব্যাপারটাই তো এমন হওয়া উচিত যাতে পরিস্থিতির প্রয়োজনে দূরে চলে যেতে হলেও মনের কোনায় তার রেশ রয়ে যাবে বরাবরের মতো।
সঞ্জু নামের কোনও সহপাঠীকে কি কখনও পেয়েছিল জীবনে মনোময়! স্মৃতি অল্প হাতড়াতে গিয়েই টের পায়, স্কুল-কলেজের পুরনো ক্লাসমেটদের অধিকাংশকেই আর মনে নেই আজ। খাওয়া হয়ে গিয়েছিল ইতিমধ্যে। মুখ ধুতে ধুতে একটা কথা মাথায় আসে আচমকা। তীর্থকে একবার ফোন করলে হয় না এখন!
স্কুলজীবনে অল্প যে ক’জনের সঙ্গে মনোময়ের মেলামেশা ছিল মোটামুটি, তীর্থ তাদের অন্যতম। এবং অমরকৃষ্ণ পাঠশালার পুরনো সতীর্থদের মধ্যে এই একটা ছেলের সঙ্গেই যা এখনও মাঝেমধ্যে দেখা হয় রাস্তাঘাটে। সওয়া দশটা তেমন রাত নয় আজকের দিনে। একটা ফোন করাই যায় এখন তীর্থকে। ওর হয়তো মনে থাকতেও পারে সঞ্জু নামে কেউ ছিল নাকি ক্লাসে।
রিং করার সেকেন্ডখানেকের মাথাতেই ওপাশ থেকে একটা ট্রেডমার্ক কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, হ্যালো…
হ্যালো, মনোময় বলছি রে। একটা দরকারে…
প্রথমত নাম্বারটা সেভ আছে। আর এটাও জানি দরকার ছাড়া ফালতু গেঁজাতে ফোন করিস না তুই…
এই হল ভিনটেজ তীর্থ।
যাক, এমন মামুলি কথাবার্তাগুলো খানিক চলার পর আসল কথাটা পাড়ে মনোময়। সবটা মন দিয়ে শুনল তীর্থ। কিছুক্ষণ ভেবে চিন্তিত কণ্ঠে টেনে টেনে বলতে লাগল তারপর, না রে, আমার তো কই ওই নামে কাউকে মনে পড়ছে না। তুই যেমন বললি, যদি তেমনই ধরেওনি ওটা ডাকনামই, তবুও কই অমন ডাকনাম আমাদের কারও ছিল বলে তো…
বলতে বলতেই আচমকা বদলে যায় তীর্থর গলাটা, শালা সঞ্জু! ওই নাম শুনেই বোঝা উচিত ছিল তোর যে আমাদের কেউ নয়। কী বিষ ক্লাস ছিল আমাদের ভুলে গেছিস তুই! সেখানে অত ভদ্রসভ্য ডাকনামে কেউ থাকতে পারে! আমাদের স্টাইলই ছিল পুরো আলাদা। ধলা, বাতাসা, মশারি, মাসি। সেখানে ওই ম্যাদামারা সঞ্জু! ইমপসিবল। হ্যাঁ, তাও বুঝতাম সঞ্জুর পর আরও দু’-চারটে অক্ষর আছে। তাহলেও আমাদের কেউ নাকি ভাবা যেত…
তীর্থ হাসতে থাকে।
সঞ্জুর পর দু’-চারটে অক্ষর! মনোময় বোঝে না কথাটা, মানে?
উফ! রিয়েলি, তুই না সেই একইরকম রয়ে গেলি। একটুও চেঞ্জ হল না। বুদ্ধিসুদ্ধি হল না আর। চার অক্ষর বুঝিস না! মাস্টারি করিস কেমন করে? তোর ক্লাসের ছেলেগুলোও চার অক্ষর কাকে বলে জানে।
মনোময় এবার বোঝে তীর্থর কথাটা। হেসে বলে, ওহো এই কেস। এবার বুঝেছি। তা তোর পাপী মন যে সবখানেই ওই এক জিনিসেরই গন্ধে গন্ধে ঘোরে তা আর আমি কী করে বুঝব বল! তোরও তো দেখছি কোনও চেঞ্জ হয়নি অ্যাদ্দিনেও। বয়েস তো হল। ব্যাটনটা ছেলের হাতে তুলে দিয়ে এবারে নয় একটু ধর্মেকর্মে মন দে। আমি সাদা মনে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে গেলাম…
আরিব্বাস! বেশ কথা ফুটেছে তো! এত সাদা মন নিয়ে আজকাল আর চলা যায় না, বুঝলি। তাতে আবার তোর যাদের নিয়ে কারবার। দেখগে যা তোর সুকুমারমতি ছাত্রেরা অলরেডি তোরও একখানা জবরদস্ত ডাকনাম দিয়ে দিয়েছে। আমরা পার্থস্যার, নন্দস্যারদের যেমন দিতাম আর কি…
তা তোরা অমন বিষাক্ত জিনিস হওয়া সত্ত্বেও আমার কিন্তু একটা তেমন জাঁদরেল নাম মাথা খাটিয়ে বের করতে পারিসনি। আমার ভালনামটাকেই শর্ট করে নিয়ে চালাতিস।
হ্যাঁ, এটা অবশ্য তুই ঠিকই বলেছিস। তবে কি জানিস, তুই তো বিশেষ কারও সঙ্গে মিশতিস না। নিজের মতোই থাকতিস নিজের মনে। দেখে মনে হত যেন সব সময় ভাবের জগতেই বিরাজ করছে তোর মন। তাই তোর ওই নামটা তোর সঙ্গে ম্যাচিংই হয়েছিল। একটা বাজখাঁই নাম দিলেই তো হল না। যাকে দেওয়া হচ্ছে তার সঙ্গে লাগসই হতে হবে তো। অবশ্য এখন মনে হচ্ছে মনের পর ছোট্ট করে দুটো অক্ষর বসিয়ে দিলেও নেহাত খারাপ হত না।
মনোময় আর তীর্থ দু’জনই হেসে ওঠে অতঃপর ফোনের দু’ প্রান্তে। আরও টুকিটাকি দু’-একটা কথার পর শুভরাত্রি জানিয়ে ফোনটা কেটে দেয় মনোময়।
অনেকদিন পর আজ কথা হল তীর্থর সঙ্গে। বেশ লাগল। কথা হতে হতেই মনে পড়ে যাচ্ছিল অনেক মজার স্মৃতি। বিশেষ করে সেই ডাকনামগুলোর উদ্ভবের নেপথ্যে থেকে যাওয়া সেই সব মজাদার ইতিহাস। যার কিছু আজ মনে পড়ে। কিছু পড়ে না। কিন্তু ভাবতে গেলেই হাসি খেলে যায় ঠোঁটের কোণে।
মোটাসোটা তিমির কুশারীকে তার পদবির সঙ্গে মিলিয়ে খচানো হত মশারি বলে। নামটা শুনলেই কী রাগাই না রেগে যেত তিমির! ভাবলে আজও হাসি পেয়ে যায়।
অজিতের ডাকনাম ছিল নাপিত। তারও এক গল্প ছিল। ক্লাসে অজিত চিরকালই ছিল থার্ড নয়তো ফোর্থ বেঞ্চির খদ্দের। আর ক্লাসে বসে বসে সারাদিন একটাই কাজ ছিল ওর। ঠিক সামনের বেঞ্চে যে বসত তার মাথার পেছনের চুলগুলোকে আঙুল দিয়ে উলটেপালটে সরিয়ে নাড়িয়ে নানারকম ডিজাইন করে যাওয়া।
অঙ্কনের বাড়ির ডাকনাম ছিল কাশী। ব্যাকরণের ক্লাসে অপিনিহিতি-অভিশ্রুতি শেখার পর কে যেন কাশীটাকে বদলে মাসি করে দিয়েছিল। অঙ্কনও এই নিয়ে প্রথমে খুব রাগারাগি এমনকি রোগাপটকা প্রতিপক্ষ পেলে মারামারিও করত। পরে হাল ছেড়ে দিয়েছিল।
সুজয় পাঁচটা কথা বললে তার মধ্যে সাড়ে চারটেই থাকত একেবারে নির্ভেজাল ঢপ। আর সেই ঢপগুলোও ছিল এমনই যে ঢোল ফাটতে সময় লাগত না বেশি। সেই থেকে ওরও নাম হয়ে গিয়েছিল ফাটা।
জয়ন্তর ডাকনামটা তো বক্স অফিসে এতটাই হিট হয়েছিল যে ওর ভালনাম আর কেউ বলতই না। ধলা বলেই ডাকত। ধলা নামটা কীভাবে বা ক্লাসে প্রথম কার মাথায় এসেছিল তা অবশ্য মনে পড়ে না আজ আর।
একইভাবে সুরেশের নাম বাতাসা হয়েছিল কেন মনে নেই আর।
তীর্থর কথাতেই মনে পড়ল এতকিছু। কিন্তু আশ্চর্য, যে কারণে তীর্থকে ফোন করা তার কোনও মীমাংসা হল না এবারেও। তীর্থ মনে করতে পারল না সঞ্জু নামে কেউ ছিল নাকি ক্লাসে।
সঞ্জুর খোঁজ না পাওয়া গেলেও অনেককিছুকে আজ খুঁজে পেয়েছে মনোময়।
একটাই আপশোশ রয়ে যায় তার মনে।
এই সঞ্জু যদি আরও অনেক বছর আগে কোনও এক সন্ধ্যায় এসে তার খোঁজ করে যেত।
[প্রকাশিত: সমাকল্য, জানুয়ারি ২০০৭]
লেখক পরিচিতঃ আবেশ কুমার দাস
জন্ম মার্চ ৩০, ১৯৮৩। উত্তর ২৪ পরগনার নৈহাটিতে। বৈদ্যুতিন প্রযুক্তিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর। কর্মসূত্রে অধ্যাপনা বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। শৈশব থেকেই সাহিত্যে অনুরাগ। ছোটগল্পের মাধ্যমে সাহিত্যচর্চার সূত্রপাত। পরবর্তীকালে রচনা করেছেন বেশ কিছু প্রবন্ধ। সাহিত্য, সিনেমা ও ক্রিকেটকে উপজীব্য করে। ২০০৭—২০১১ সময়পর্বে সম্পাদনা করেছেন নৈহাটি থেকে প্রকাশিত ‘সমাকল্য’ নামক সাময়িক পত্রিকা। বর্তমানে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে প্রকাশিত ব্লগজিন ‘বাক্’-এর গল্পবিভাগের সম্পাদক। ইতিমধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা পাঁচ। তিনটি ছোটগল্প সংকলন— বনলতার বিজন (২০০৯), পুরনো দিনের ছবি (২০১২) ও মর্ফিয়ুস (২০১৫)। গবেষণামূলক প্রবন্ধের বই দু’টি— তপন সিংহ: সার্বিক চলচ্চিত্র বীক্ষা (২০১৬) ও বাইশ গজের কিস্সা (২০১৯)।
Picture curtasy- African Art