ইরফানের উত্তরসূরী মেলা কঠিন
একেবারে সামনাসামনি একবারই দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। অকুস্থল তাজ বেঙ্গল। পর্দার বাইরে আরও হ্যান্ডসাম। দীর্ঘদেহী, মেরুদন্ড সোজা করে চলা একজন মানুষ। এক বঙ্গতনয়া তাঁর ঘরণী, সে কথা জানা ছিল না সেদিন। সাংবাদিক সম্মেলনে কথাটা উঠেছিল কিনা, তাও আজ আর মনে পড়ে না। তবে, এটা মনে আছে, উপলক্ষ ছিল কলকাতায় ‘দ্য নেমসেক’ ছবির সাংবাদিক সম্মেলন। সেখানে কলকাতা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও আগ্রহ প্রতিভাত ছিল বক্তব্যের অনেকটা অংশ জুড়ে।
মনে পড়ছে, সাংবাদিক সম্মেলন ও জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব মিটতেই নিজেকে মিলিয়ে দিলেন জনারণ্যে (পড়ুন সাংবাদিক মহলে)। তারকাসুলভ নয়, জনসংযোগও নয়, একেবারে সাধারণের মতো করেই মানুষের কাছে পৌঁছানো। মুখে পরিচয়ের হাসি। চোখাচোখি হলে বার্তা বিনিময়। ইরফান খান যে এদেশের যে কোনও অভিনেতার তুলনায় সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী, সেটা সেদিনই বুঝে গিয়েছিলাম। নেমসেক-এর আগে ও পরে, তাঁর পুরো কেরিয়ারগ্রাফ জুড়ে একেবারে নিজের শর্তে চলার মধ্য দিয়ে এ তত্ত্ব বার বার প্রমান করেছেন তিনি। পর্দায় ও পর্দার বাইরে, সর্বত্র। নিজের অসুখের কথা নিজেই জনসমক্ষে আনেন। যতদূর পর্যন্ত শারীরিক অবস্থা পারমিট করে, চেষ্টা করেন মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে। যেন তাঁর শারীরিক কষ্ট, জটিলতা নিয়েও কোনও ভুল বার্তা কোথাও না যায় ! এতটাই দায়িত্বশীল একজন মানুষ, শুধু কাজের ক্ষেত্রেই নয়, তাঁকে ভালবাসেন যে অগণিত মানুষ, তাঁদের প্রতিও।
দেশবিদেশের বহু পরিচালক, সহ অভিনেতা, টেকনিশিয়ান থেকে অগণিত সিনেমাদর্শক ইরফানের গুণগ্রাহী। তাঁর এমন অসময়ে চলে যাওয়া শুধু চরম বেদনাদায়ক নয়, ভারতীয় তথা বিশ্ব সিনেমার পক্ষেও চূড়ান্ত ক্ষতি। কিন্তু না, ইরফানকে নিয়ে ততটা আকুল নয় এখানকার মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়াও! আমাদের আগ্রহ তাৎক্ষণিক ঘটে যাওয়া কিছু—গসিপ বা বিতর্কে ! ইরফান কিন্তু যতদিন বেঁচেছেন নিজেকে নিংড়ে দিয়েছেন। কী ব্যপ্তি, কী গভীরতা, কী অমোঘ ক্ষমতা চরিত্রের অন্দরে যাত্রার! তাঁর একেকটি কাজে সেসব ফুটে উঠেছে বার বার। কিন্তু না, সেসব আমাদের তেমন ভাবায় না আর। মৃত্যুর পর কিছুদিন কিছু ফেসবুক পোস্ট। টিভি ও খবরের কাগজে কিছু কথকতা । তারপরই বিস্মৃতি। তার কারণ কি এই, ইরফানের কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে চলে যাওয়ার মধ্যে কোনও সস্তা মেলোড্রামা নেই ? তাই তাঁর কথা দীর্ঘায়িত হয় না, মেনস্ট্রিম মিডিয়া থেকে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক, কোত্থাও।
ইরফান তাঁর পূর্বসূরীদের উজ্জ্বল উত্তরাধিকারী হয়েই থেমে থাকেননি। নিজেকে পৃথক দৃষ্টান্তে স্থাপন করেছেন। ভারতীয় সিনেমার ইতিহাস লেখকদের এরপর ওঁর উত্তরসূরী খুঁজতে হবে, যা বেশ কঠিন হবে নির্দ্বিধায় বলা যায় এখনই। এতটাই স্বতন্ত্র তিনি। মীরা নায়ারের ‘সালাম বম্বে’ থেকে শেষ ছবি হোমি আদাজানিয়ার ‘আংরেজি মিডিয়াম’, প্রতি ছবিতে বিচিত্রগামী তিনি। যাঁরা জানেন, তাঁরা জানেন। যাঁরা জানেন না ( সেটা কিন্তু দোষের নয়। ওঁর বহু ভালো ছবি সেভাবে এখন আর আলোচিত নয়।), একবার প্লিজ গুগলে ওঁর কাজের খতিয়ানটা দেখুন। জাস্ট হারিয়ে যাবেন। কোনটা ছেড়ে কোনটা নিয়ে ভাববেন, খেই হারিয়ে যাবে। আর এই সমস্ত কাজই, বলিউডের আজকের হঠাৎ করে বহু আলোচিত নেপোটিজম, লবিবাজির মধ্যেই করে গেছেন ইরফান। ওঁর জন্য পথের কোথাও ফুল বিছানো ছিল বলে আমার অন্তত জানা নেই। বড়-ছোট সব ব্যানারে, হাই থেকে লো বাজেট, ইরফান প্রত্যেকবার দেখিয়েছেন তাঁর কামাল করা অভিনয়। মাফ করবেন পাঠক, সব বড় স্টার থেকে বড় অভিনেতা, বহু হাতড়েও ঠিক ইরফানের মাত্রায় ব্যপ্তি খুঁজে পাচ্ছি না এই মুহূর্তে।
সিনেমা ছেড়ে একটু টেলিভিশনে চোখ রাখা যাক। দূরদর্শনে ‘লাল ঘাস পর নীলে ঘোড়ে’-তে লেনিন চরিত্রে, ‘ডর’-এ সাইকো কিলার, উর্দু কবি ও মার্ক্সবাদী এক্টিভিস্ট মখদুম মহিউদ্দিনের চরিত্রে ‘কাহকাশান’ সিরিজে অভিনয়, চাণক্য, চন্দ্রকান্তা, দ্য গ্রেট মারাঠা থেকে শ্যাম বেনেগলের ‘ভারত এক খোঁজ’ ! ব্যপ্তি ও বিস্তারটা অবিস্মরণীয়। আদতে সামান্যই উল্লেখ করলাম। স্বল্প পরিসরে ওঁর কাজের পরিধি বোঝানো অসম্ভব এক কাজ।
শাহরুখ খান ইরফানের সঙ্গে ‘বিল্লু’ ছবিতে অভিনয় করাকালীন বলেছিলেন, ইরফানের সঙ্গে এক ফ্রেমে থাকলে অভিনয়টা অনেক বেশি মন দিয়ে করতে হয়। আর ‘স্লামডগ মিলিওনেয়ার’-এ ইরফানের অভিনয় দেখার পর স্বয়ং ড্যানি বয়েল বলেছিলেন, “he has an instinctive way of finding the ‘Moral Centre’ of any character, so that in Slumdog, we believe the policeman might actually conclude that Jamal is innocent.” বয়েল ইরফানকে একজন অ্যাথলিটের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, যে প্রত্যেকবার একই মাত্রায় ‘মুভ’ করতে পারেন, এতটাই নিখুঁত ধারাবাহিকতা।
সত্যিই তো ! মকবুল, হাসিল, তলওয়ার, লাঞ্চবক্স, দ্য লাইফ ইন আ মেট্রো, লাইফ অফ পাই, পিকু, পান সিং তোমর, দ্য নেমসেক—কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলবো ? স্মরণ করবো অপেক্ষাকৃত বিস্মৃত বাসু চ্যাটার্জি পরিচালিত ‘কমলা কি মউৎ’ বা তপন সিংহের ‘এক ডক্টর কি মউৎ’ ! আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রশংসিত শর্টফিল্ম ‘রোড টু লাদাখ’ ! পৃথক পটভূমি, পৃথক চরিত্র, নিখুঁত ধারাবাহিকতা। ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা-র এই প্রাক্তনী বার বার নিজেকে ভেঙেছেন আর নতুন অভিজ্ঞতা উপহার দিয়েছেন দর্শকদের।
সব থেকে আক্ষেপ হয় এটা ভাবলে, আর ক’বছর পর হলিউডেও নিজের অপরিহার্যতা প্রমাণ করে ফেলতেন তিনি নিশ্চিতভাবে । কাজ করছিলেন ব্রিটিশ ও আমেরিকান ছবি ও সিরিজে (টেলিভিশন ও ওয়েব )। ‘জুরাসিক ওয়ার্ল্ড’ থেকে ‘দ্য এমেজিং স্পাইডার ম্যান’, ‘লাইফ অফ পাই’ বা ‘ইনফার্নো’ এবং এইচবিও-তে প্রদর্শিত সিরিজ ‘ইন ট্রিটমেন্ট’, ইরফান বার বার গর্বিত করেছেন ভারতবাসীকে। ইরফানকে নিয়ে কিছু লেখা মানে নিজে সমৃদ্ধ হওয়া। উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হওয়া। আজ তিনি বহুদূরে। কত সে আলোকবর্ষ কে জানে ? কিন্তু প্রকৃত সিনেমাপ্রেমীর হৃদয়ে থাকবেন তিনি। তার জন্য তাঁর রেখে যাওয়া কাজগুলোই যথেষ্ট।
সব মৃত্যুই বিচ্ছেদবেদনা বয়ে আনে। সে মৃত্যু অকালে হলে তো আরও বেশি। কিন্তু শুধু তাঁর চলে যাওয়া নিয়ে দু’একদিন আক্ষেপ করেই দায় সেরে ফেলবো ? জীবিতকালে কি অবদান তিনি রেখে গেলেন, তা নিয়ে একটা ধারাবাহিক আলোচনা করবো না ? আমরা যারা নিজেদের সিনেমা অন্ত প্রাণ মনে করি, তারাও এই মানুষটিকে সামনে রেখে আরও একটু সমৃদ্ধ হবো না ? শিক্ষা, বোধ বা জ্ঞানলাভ নয়, আমাদের আগ্রহ যদি নিছক হালকা ভাবাবেগেই হয়, তাহলে আগামী প্রজন্ম কি শিখবে? তারা কি করে ভালো সিনেমা, উন্নত কাজ, উত্তম গুণের উপভোক্তা হবে ? দয়া করে ভেবে দেখবেন সবাই।
অজন্তা সিনহা
প্রায় দু’দশক সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন সংবাদ প্রতিদিন-এ। অবসর নেওয়ার পর নিয়মিত লিখছেন উত্তরবঙ্গ সংবাদ-এ। লেখার বিষয় বিনোদন, পর্যটন ও সামাজিক সামস্যাদি। এছাড়াও কলকাতা দূরদর্শন ও তারা টিভির স্ক্রিনিং কমিটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।