novelette

ছোট উপন্যাস।। গোপাল গোঁসাই।। সৌপ্তিক চক্রবর্তী

মাধবীর বয়স চল্লিশ-বিয়াল্লিশ। ভরাট চেহারায় একটা বেশ বাঁধুনি আছে। লালিত্যের সাথে খানিক চটক। গোপাল মনে করে মোহিনী শক্তি আছে ‘মাধবীমামীর’।
সকালে-বিকেলে দুকাপ চা ছাড়া গোপাল এখানে আর কিছু খায় না। মামা-মামী বলেছিল যদিও বার দুয়েক কিন্তু সে রাজি হয়নি। তারা যে তাকে থাকতে দিয়েছে, সাইকেল ধার দিচ্ছে, এই অনেক। 

এরপর 

দুপুরে ‘তারা মা ভাতের হোটেল’। সব্জি-ভাত কিংবা ডিম-ভাত। কচ্চিৎ মুরগি-ভাত। মাছে তার তেমন রুচি নেই। ব্রেকফাস্ট-স্ন্যাক্সের জন্য তার পাশেই ‘বাপি টি স্টল’। ওই লুচি-তরকারি কিংবা বাটার টোস্ট। আর দুকাপ দুধ চা। রাতে ঝিলপাড়ে রঘুনন্দনের দোকানে রুটি-তড়কা কিংবা আলুমটর। 

এই বাড়িতে দুধ বেশি দিয়ে একটু ঘন চা হয়। সিঁড়িতে বসে চা খেয়ে গোপাল উঠে গেল দেড়তলার ছোট চাতালটায়। আবার ডানদিকে ঘুরে সিঁড়ি চলে গেছে ছাদের দরজায়। চাতালে বসে গোপাল ধুপকাঠি রেডি করতে শুরু করল। বড়বাজার থেকে কিলো দরে সাধারণ ধুপকাঠি কিনে আনে আর সাথে সুগন্ধি। 

জেলে থাকতে থাকতেই সে ঠিক করেছিল যে ছাড়া পেয়ে পুরোপুরি নিজের একটা ব্যবসা শুরু করবে। আর কোনো পার্টনারশিপে সে যাবে না। তবে পুঁজি যৎসামান্য। পৈতৃক কিছু তো পায়নি। তোলাবাজি করে সংসার টেনে দিলেও তার বাবার সঞ্চয় ছিল না বলাই ভাল। যেটুকু ছিল তার মায়ের অসুখেই বেরিয়ে গিয়েছিল। টানা বারো দিন নার্সিংহোমে রেখেও সে মাকে বাঁচাতে পারেনি। ভাবলেই তার মনটা কেমন খারাপ হয়ে যায়। 

কিছুদিন বসে থেকে এই আইডিয়াটা মাথায় আসে। ইউটিউবে বেশ কয়েকটা ভিডিও দেখে আর কয়েকটা সাইটে পড়ে একদিন বড়বাজারে গিয়ে হাজির হয়। সেখানেও দিন দুয়েক ঘুরে, ব্যবসায়ীদের জিজ্ঞেস করে, একটু জেনে-বুঝে শুরু করেছে এই ব্যবসা।

দুটো বড় অ্যালুমিনিয়ামের জারে ভরা তরল সুগন্ধি। একটা চন্দনের আর অন্যটা গোলাপের। আপাতত এই দুটো ভ্যারাইটিই রেখেছে। ধুপকাঠির বেশ কয়েকটা বান্ডিল খবরের কাগজের ওপর খাড়া করে দাঁড় করানো। সবগুলোই এক কিলোর। বেশ কয়েকটা শক্ত কাগজের বাক্স থাকে থাকে সাজানো একপাশে। একটা প্যাকেট সিল করার মেশিন। আর কয়েকটা চটের বড় সাইজের ব্যাগ।

একটা একটা করে ধুপকাঠির বান্ডিল নিয়ে কিছু চন্দনের আর কিছু গোলাপের সুগন্ধিতে চুবিয়ে, একসেস ঝরিয়ে, উল্টো করে, খাড়া দাঁড় করিয়ে রেখে দিতে থাকল দুটো আলাদা আলাদা অ্যালুমিনিয়ামের ট্রেতে। সুগন্ধি নিয়ে আরও রিসার্চ করতে হবে। তারপর নিজেই বানাবে তার সুগন্ধি। 

হয়ে গেলে একবার নিচে নেমে বাথরুম হয়ে এল। তারপর সিঁড়ির ছোট জানলাটা দিয়ে বাইরে মরা আলো দেখতে দেখতে একটা বিড়ি ধরাল। 

বাক্স-প্যাকেট বড়বাজারের এক দোকান থেকেই অর্ডারে কেনে। ডিজাইন-লোগো-ক্যালিগ্রাফি করিয়েছে টবিন রোডের একটা প্রেস থেকে। ক্যালিগ্রাফিটা তারই পছন্দ করা। অনেক ভেবেচিন্তে, পূজা, উপাসনা, আরাধনা, প্রার্থনা ইত্যাদি নাম ঠিক করে ও বাতিল করে অবশেষে তার মায়ের নামে কোম্পানির নাম রেখেছে ‘বন্দনা ফ্র্যাগ্র্যান্স’।

আধঘন্টা পর বান্ডিলগুলো খুলে ধুপকাঠিগুলো খবরের কাগজের ওপর সমান ভাবে ছড়িয়ে দিল। একটা একটা করে বাক্স খুলে তার ভেতর থেকে পাতলা প্যাকেট বার করে প্রতিটায় তিরিশটা করে ধুপকাঠি ভরল। প্যাকেটের ওপর একপিঠে বাংলায় অন্যপিঠে ইংরেজিতে লেখা চন্দন কিংবা Sandal ও গোলাপ কিংবা Rose। তারপর ধুপভরা প্যাকেটগুলো মেশিনে সিল করে ঠিকঠিক বাক্সগুলোতে ভরতে থাকল। 

ওপর থেকে গাঢ় গেরুয়া নিচে নামতে নামতে ক্রমশঃ ফিকে হয়ে হলু্দ। বাক্সের রং। দুদিকেই ওপরে ঠিক মাঝামাঝি ছোট্ট করে লাল-কালো-সাদায় লাইন ড্রইংয়ে আঁকা ধুপদানি, চারটে জ্বলন্ত ধুপ, ও ধোঁয়া। ওটাই গোপালের কোম্পানির লোগো। লোগোটা এঁকেছে প্রেসের ডিজাইনার রাজীব।

লোগোটার ঠিক নিচেই একদিকে হলুদের তিনটে শেডে বাংলায় লেখাঃ 

বন্দনা 

শুদ্ধ ধুপকাঠি

ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় কিছু বাক্সের ওপর লেখা চন্দন আর কিছুর ওপর লেখা গোলাপ।

অন্যদিকে ইংরেজিতে হলুদের তিনটে শেডে লেখাঃ

BANDANA

PURE AGARBATHIES

আর ঠিক একইরকম মাঝামাঝি লেখা Sandal কিংবা Rose।

এর নিচে দুপিঠেই আবার ঠিক মাঝামাঝি একটু বড় করে লোগোটা আঁকা।

বাক্সের একপাশে লোগো ও বারকোডের সাথে বাংলা-ইংরেজি দুভাষাতেই মূল্য, কোম্পানির নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর ইত্যাদির সাথে লেখা আছে প্রোপাইটারঃ গোপাল গোস্বামী।

সবশেষে প্রতিটা বাক্সের দুমুখে সেলোটেপ মেরে দিল। ব্যাস, আজকের মতো তার কাজ শেষ।

ব্যাঙ্কে কিছু টাকা ছিল। সেই দিয়েই তোষক, বালিশ, মশারি, জামাকাপড়, ফ্যান, টুল ও অন্যান্য টুকিটাকি জিনিশ কিনেছে। আর ঢেলেছে এই ব্যবসায়। সিলিং মেশিন, উপকরণ, ট্রে, জার, চটের ব্যাগ, লাইসেন্স, রেজিস্ট্রেশন এইসব। তাতেই অ্যাকাউন্ট ফাঁকা।

রোজ সকাল সাতটা নাগাদ তার অয়নমামা দুধ দুইতে এলে গোপালের ঘুম ভাঙে। উঠে চা খেয়ে লালি-দুলিকে খেতে দেয়। তারপর তারপর হাফ ছিলিম খেয়ে কলতলা থেকে বড় বালতিতে দুবার জল ভরে এনে  গোয়ালঘর পরিষ্কার করে।

সাড়ে আটটা নাগাদ অয়ন মিষ্টির দোকানে দুধ দিয়ে ফিরে আসে। নটা-সাড়ে নটার মধ্যেই গোপাল ওয়ালেট, সেলফোন আর দুটো বড় চটের ব্যাগে ধুপকাঠির প্যাকেট ভরে তার মামার সাইকেলে চেপে বেরিয়ে যায়। 

প্রথমে বাপির দোকানে ব্রেকফাস্ট করে। তারপর দোকানে দোকানে ধুপকাঠি ফিরি করে। পাইকারি দরে। প্রায় দেড়-দু কিলোমিটার রেডিয়াসে ছোট-বড় মুদির দোকান, দশকর্মা ভান্ডার, স্টেশনারি দোকান চষে ফেলে সে। কোনোদিন যায় বেলঘরিয়ার দিকে, কোনো দিন টবিন রোড অব্ধি আবার কোনোদিন দক্ষিনেশ্বর। যতীন কলোনীটাই যা মাড়ায় না আর কি। 

কম্পিটিটর তো কম নেই। তবে গোপাল খুবই ভাল সুগন্ধি, ভাল কোয়ালিটির ধুপকাঠি এবং সর্বোপরি একটু কম দামে দেওয়ায় বলতে নেই এই এক মাসেই ব্যবসাটা দিব্যি ধরেছে মনে হচ্ছে। আরও বাড়বে। মানে গোপালের সেরকমই আশা ও উদ্যম। 

কাজ শেষ করে নিচে নেমে উঠোনের তারে মেলা জাঙ্গিয়াটা আর কালো রঙের স্যান্ডো গেঞ্জিটা তুলে নিয়ে গোয়ালঘরে ঢুকে গেল। ওদুটো শুকিয়ে গেছে। 

গোয়ালঘরে গিয়ে লুঙ্গি ছেড়ে জিন্স-টি-শার্ট পরে-চুল আঁচড়ে রেডি হয়ে বেরিয়ে এল গোপাল।

কলতলা থেকে উঠোন পেরিয়ে সদর দরজার দিকে যেতে যেতে দেখল মাধবীমামী সিঁড়ির সামনেটায় উঠোনের দিকে মুখ করে বসে কুটনো কুটছে। বাঁহাত তুলে কপালের ঘাম মুছল। গোপাল লক্ষ্য করেছে মাধবীমামী সবসময় স্লিভলেস ব্লাউজ পরে। 

গোপাল সদর দরজা টপকে গলির রাস্তায় এসে পড়ল। সন্ধে তখন সাতটা হবে। 

 

পাঁচ

অয়নের বাড়ির গলিতে ঢোকার আগে ডানহাতে ঘুরে হাইড্রেন ঘেঁষে শিবমন্দিরটা পড়ে। তার পেছনে যথারীতি রেল জমি। শিবমন্দিরের চাতালটায় বসে অয়ন আর আনন্দ শাস্ত্রী আড্ডা দিচ্ছিল। সন্ধের পুজো সেরে ততক্ষণে পুরুত কেশব ভটচায চলে গেছে। গোপাল তাদের দেখে এগিয়ে মন্দিরের দিকে গেল।

আনন্দ শাস্ত্রীর বয়স পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ। জোতিষী। একটু মডার্ন টাইপ। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। মোড়ের মাথায় সাইনবোর্ডে যে বিজ্ঞাপন আছে তাতে দেখা যায় আনন্দ নিজের চেম্বারে ল্যাপটপ খুলে বসে আছে। মাথার পেছনে কালীঠাকুরের মস্ত একখানা ছবি। অন্যান্য অধিকাংশ জোতিষীর মতোই আনন্দও তারাপীঠসিদ্ধ। বিজ্ঞাপনে সেটা লেখা আছে। আরও অনেক কিছুর পাশাপাশি সে যে রত্নবিশারদ এবং তার যে এমএ ডিগ্রি আছে তাও লেখা আছে বিজ্ঞাপনে। 

খুব নামকরা না হলেও পসার ভালই। সকাল-বিকেল ক্লায়েন্ট মিট করে। সন্ধে থেকে কোনো কাজ করে না। প্রথমে শিবমন্দিরে আড্ডা মারে তারপর রাত বাড়লে নাকি বাড়িতে শক্তির আরাধরানায় বসে। কে জানে!

আগে সাইনবোর্ডে ছবি কিংবা কখনও রাস্তাঘাটে দেখে থাকলেও এ পাড়ায় আসার পর তার অয়নমামার সূত্রেই আলাপ-পরিচয়। গোপাল ডাকে ‘আনন্দদা’ বলে। সে গোপালের ব্যাপারে সবই জানে। সিম্পাথাইজও করে। জ্যোতিষী মানুষ। বলা তো যায়না, হয়ত এক নজরেই বুঝে ফেলেছিল গোপালের কপাল ও নাড়ি-নক্ষত্র!

কিছুদিন আগেই গোপাল হাত দেখিয়েছে আনন্দ শাস্ত্রীকে। যা যাচ্ছে তার বছরগুলো! আগে এসবে তেমন বিশ্বাস ছিল না তার। 

গোপাল দেখেছিল আনন্দদা স্পষ্ট কথার লোক। ক্লায়েন্টের মন জুগিয়ে কিছু বলে না। যেমন তাকে বলেই দিল যে তার গ্রহের দশা কেটে গেছে ঠিকই তবে জীবনে সমৃদ্ধি কোনোদিনই আসবে না। স্বচ্ছলতা থাকবে। বিবাহযোগও নাকি একটাই ছিল এবং তা চলেও গেছে। তবে ব্রহ্মচারী জীবনও তার হবে না। কোনো না কোনো ভাবে সঙ্গিনী হবে তার। একাধিকও হতে পারে। তবে জীবনের ঠিক কোন কোন বয়সে বা সময়ে তারা আসবে, থাকবে বা চলে যাবে তা বলতে গেলে নাকি আরও রিসার্চ করতে হবে এবং তা একটু খরচ সাপেক্ষ। আগামী দশ বছরে কোনো বড় ক্ষতি, জীবনের ঝুঁকি, সংঘাত ইত্যাদি নেই। 

গোপালের জন্য এটুকুই যথেষ্ট ছিল। এমনিতে আনন্দ শাস্ত্রী হাত দেখলে পাঁচশো টাকা ফিজ নেয়। গোপালের থেকে তিনশো নিয়েছিল। দুটো পাথর ধারণ করতে বলেছে। গোপাল পরে নেবে বলেছে। কাছাকাছি একটা সুপার মার্কেট আছে। সেখানে অজন্তা জুয়েলার্সে হপ্তায় দুদিন দুঘন্টা করে বসে আনন্দ শাস্ত্রী। পাথর ও আংটি সেখান থেকেই ব্যবস্থা করে দেবে সে। সব জায়গায় নাকি গ্রহরত্ন খাঁটি হয় না। 

গলির মুখে ডানহাতের প্রথম বাড়িটাই আনন্দ শাস্ত্রীর। তারপরই অয়নদের বাড়ি। আক্ষরিক অর্থেই আনন্দ শাস্ত্রী গোপালদের প্রতিবেশী। গলির দিকে বড় বারান্দা লাগোয়া দুটো ঘরের একটাতে তার চেম্বার অন্যটা ওয়েটিং রুম। দোতলায় বাবা-মা-বউ-ছেলে নিয়ে আনন্দর সংসার। রান্নাবান্না-খাওয়াদাওয়া একতলায়। বাড়ির সদর দরজাটা শিবমন্দিরের দিকে। তার পাশে বাড়ির বাইরে মন্দির লাগোয়া একটা ছোট ঘর। পাকা দেওয়াল। টিনের চাল। পেছনে লাগোয়া বাথরুম। আগে রাতদিনের একজন কাজের লোক ছিল। ওই ঘরে সেই থাকত। কাজ ছেড়ে চলে গেছে বহুদিন। তারপর থেকে ফাঁকাই পড়ে আছে। 

কথাবার্তা পাকা। মাসে তিন হাজার টাকায় গোপাল ওটা ভাড়া নেবে। এক মাসের ডিপোজিট। এগ্রিমেন্টটা আনন্দ করতে দিয়েছে। এবার থেকে গোপাল আর কোনো মুখের মাথায় রিস্ক নেবে না। ঘরটা চওড়ায় মাত্র সাত-আট ফুট হলেও লম্বায় প্রায় দশ। বাথরুমটা খুব ছোট্ট হলেও গোপালের স্নানের কোনো অসুবিধে হবে না।

গোপাল আনন্দ শাস্ত্রীর ও তার অয়নমামার সাথে একটু গল্পগাছা করে উল্টোমুখে রওনা দিল পাড়ার মোড়ের দিকে। কিছুটা এগিয়ে বিড়ি ধরাল। এখন যাবে বাপির দোকানে। 

ঠিক করেছে ব্যবসাটা জমে গেলে আগের মতো সিগারেটে ফিরে যাবে। গোল্ডফ্লেক মিডিয়াম। ইদানিং বিড়িটা খাচ্ছে কিংবা খাওয়াদাওয়া সস্তায় সারছে কারণ টাকা জমাচ্ছে। ডিপোজিট আর ভাড়া মিলিয়ে কয়েকদিনেই ছহাজার দিতে হবে আনন্দ শাস্ত্রীকে। বলতে নেই জমেই গেছে। এখন শুধু উকিল এগ্রিমেন্টটা পাঠালেই হয়ে যায়। 

হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে ভাবল আঃ! আর মাত্র কয়েকদিন। ব্যাস, তারপরই সে গোয়ালঘর ছেড়ে উঠে যাবে নতুন ভাড়া ঘরে। একটা স্ট্যান্ড ফ্যান কিনবে প্রথমেই। 

 

ছয়

ঝিলপাড়ে পাকা বাজার হওয়ার আগে বড়রাস্তার পাশে যতীন কলোনী ঘেঁষে এলাকার বাজারটা বসত। তখন গোপাল কচি। তখন থেকেই দু-তিনজন শাগরেদ নিয়ে নন্দ বাজারে তোলা তুলত। নিজের ওয়ার্ড-পাশের ওয়ার্ড দুই ওয়ার্ডের কাউন্সিলরেরই স্নেহধন্য ছিল। 

একটা ছোট্ট মফস্বলি বাজারের খুচরো বিক্রেতাদের থেকে তোলা আদায় করে তো কেউ বড়লোক হয় না। আবার যা তুলছে তার সবটাই তো আর একার নয়। নানান হিস্যায় ভাগ-বাটোয়ারা করে হাতে যা আসত তা দিয়ে বউ-ছেলে নিয়ে চলে যেত মোটামুটি।

তার বাবার খুন হওয়া ছাড়াও আর একটা গুরতর ঘটনার কথা গোপালের মনে আছে। সেটা ঘটেছিল পালাবদলের কিছু আগ দিয়ে। বছর বারো-তেরো আগে। তাদের কলোনী থেকে কিছু দূরে আসলামবাজার বলে একটা এলাকা আছে। সেখানে একটা জুটমিল ছিল। বন্ধ হয়ে গেছে বহুকাল। এই বন্ধ হওয়া ঘিরেই সেই ঘটনা। 

জুটমিলে তখন লেবাররা ঘেরাও করেছে। দু-তিন ঘেরাও চলছে। ইউনিয়ন তাদের দাবীতে অনড়। লেবাররা প্রবল প্রত্যয়ে গেট ঘিরে বসে আছে। কারও কারও হাতে লালঝান্ডা। তবে মালিককে আর কোথায় পাবে! ওই ম্যনেজার আর কিছু কর্মচারী ঘেরাও হয়ে আটকে আছে। পুলিশ তেমন সুবিধে করতে পারেনি।

সে যাইহোক, নন্দর মতো লোকেরা এইসব ঘেরাও-বিক্ষোভ সমাবেশে যেত টেত। পার্টির লেবার ইউনিয়নের হয়ে ভীড়-হল্লা বাড়াতে। মানে যেতে হত আর কি। সেবারেও ব্যাতিক্রম হয়নি। আশেপাশের তৎকালীন আরও নানান সব হুব্বা যেমন বাজারের মুরগি-শ্যাম, রূপালী সিনেমা হলের টিকিট ব্ল্যাকার নারায়ণ ওরফে নাড়ু, সাট্টা-কানাই, ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের স্টার্টার গোবিন্দ নস্কর প্রমুখদের জুটিয়ে রোজই সেখানে নন্দ হাজিরা দিচ্ছিল। আন্দোলন জোরদার করার উদ্দেশ্যে। স্থানীয় নেতাদের নির্দেশে। 

এরপরই ঘটে সেই ন্যাক্কারজনক ঘটনা কিংবা অপরাধ। কে বা কারা ছিল তার নেপথ্যে তা গোপাল জানে না। এমনকি নন্দও ঠিক জানত না। সবসময় তো ভীড়ের ওপর, সে যতই সংগঠিত হোক, পার্টির কন্ট্রোল থাকে না। আর কন্ট্রোল হারিয়েই ঘটে যায় এইসব অঘটন।

তিনদিনের দিন দুপুরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় জুটমিলে। অন্যান্য কর্মচারীরা প্রাণ বাঁচিয়ে পাঁচিল টপকে কোনোভাবে পালালেও বেচারা বুড়ো ম্যানেজারটা আগুনে পুড়ে মারা যায়।

এই ঘটনার পর বছর দুয়েক নন্দ ফেরার ছিল। গোপালের মনে আছে তখন তার অয়নমামা তাদের বাড়িতে এসে মাঝে মাঝে কিছু টাকা তার মায়ের হাতে দিয়ে যেত। মা নিতে না চাইলে বলত ‘আরে রাখ তো, নন্দদা ফিরলে তখন শোধ দিয়ে দিস, না হয়। এখন সংসার চালাবি কি করে? 

যাইহোক, পালাবদলের পরপরই তার বাবা নন্দ ফিরে এল এলাকায়। এলাকার বাইরে থেকেই সবকিছু ফিক্স করে এসেছে সে। পুরনো অভিযোগও পাতলা হয়ে গেছে। দেখা গেল নন্দ লাল ছেড়ে ভোল বদলে সবুজে গেছে। তারপর আবার যে কে সেই। বাজার, লুঙ্গি-শার্টে নন্দ, শাগরেদবৃন্দ ও তোলাবাজি। দিব্যি সংসার চলতে থাকল।

গোপাল আর তার মাকে নন্দ বলেছিল যে যখন আগুন লাগানো হয় তখন সে সেখানে ছিল না। একটু দূরে একটা হোটেলে গোবিন্দকে নিয়ে দুপুরের খাওয়া সারছিল। জুটমিলে ফিরে দেখে এই কান্ড! সবাই হুড়োহুড়ি করে পালাচ্ছে। তাই নন্দ-গোবিন্দও সেখান থেকে চম্পট দেয়। 

খুন হওয়ার দিন সাতেক আগে নন্দ তার দুই শাগরেদ মুরগি-শ্যাম আর বলরামকে নিয়ে মোটরসাইকেলে চেপে গিয়েছিল শ্রীপল্লী। দুটো পেটো ফেলেছিল আর কয়েক রাউন্ড ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করে এসেছিল। 

শ্রীপল্লী সন্তোষের এলাকা। সন্তোষ তার বিরোধীগোষ্ঠীর। তাই তাকে খানিক চমকে দেওয়াই ছিল উদ্দেশ্য। যাইহোক, সেই সময় সন্তোষ বা তার দলবল এলাকায় ছিল না। থাকলে কি হত বলা যায় না। হয়ত আরও বড় কিচাইন হয়ে যেত। যাইহোক, নিরাপদে কাজ সেরে ফিরে এসেছিল নন্দ। 

খুনের দিন বাজারের সামনেটায় নন্দ দাঁড়িয়ে ছিল। সকাল সাড়ে দশটা-এগারোটা হবে। সাথে ঠিক কে কে ছিল সেটা গোপাল জানে না। মোটরসাইকেলে করে দুজন এসেছিল। পেছনের জন পরপর দুটো গুলি ছুঁড়েছিল। একটা লেগেছিল নন্দর গলায় আর একটা বুকে। স্পটডেড। 

কিছুদিন পর পাপ্পু, যে গুলি ছুঁড়েছিল আর রাকেশ, যে মোটরসাইকেল চালাচ্ছিল ধরা পড়ে ছিল। তারা এখন জেলও খাটছে। তবে তারা ছিল ভাড়াটে। জেরায় জানিয়েছিল কে কোথাকার এক বাব্বান নাকি তাদের নন্দর সুপারি দিয়েছিল। স্কেচও নাকি করানো হয়েছিল তার। তবুও সেই বাব্বান এখনও অধরা। তাই সরাসরি সন্তোষের দিকে আঙুল তোলা যায় না।

নন্দ খুন হওয়ার পর থেকে গোপাল লক্ষ্য করেছিল যে তার আশেপাশের লোকজনের ব্যবহারের পার্থক্য। যারা আগে যথেষ্ট সমীহ করে চলত তারাই কেমন কাঁধে হাত রাখতে শুরু করল। সেটাই  হয়ত স্বভাবিক ছিল। সে মেনেও নিয়েছিল তা।

বিয়ের পরপর প্রোমোটিং শুরু করবে ভেবে বাড়িওয়ালা ‘তড়িৎজেঠু’র সাথে কথা বলেছিল কিন্তু সে রাজি হয়নি। আসলে ওখানে একটা গল্প ছিল। ‘তড়িৎজেঠু’ অর্থাৎ তড়িৎ হালদারের দুই বোন ছিল। আর তারা বাড়ির ক্লেইম ছাড়েনি এবং তারা দুজনেই ফ্ল্যাট চায়। তো জি প্লাস থ্রি কনস্ট্রাকশন হলে একতলায় সামনের দিকে দুটো গ্যারাজ-দোকান ছেড়ে পেছনদিকে একটা ফ্ল্যাট হয় এবং সেটা গোপালদের দিতে হয় কারণ তারা প্রায় সাতাশ বছর ভাড়া আছে। আর তিনটে তলায় ছটা ফ্ল্যাটের তিনটে তারা তিন ভাই-বোনে নেবে। বোনেদের না দিলে তো প্রোমোটিং করতেই দেবে না তারা। তা হলে বিল্ডারের হাতে রইল মাত্র তিনটে ফ্ল্যাট। তাতে কোনো বিল্ডার রাজি হবে না। গোপালকে অবশ্য তড়িৎ এটা খুলে বলেনি। ইচ্ছে করেই। 

ওদিকে বুবাই-পিকলুর সাথে আলাদা করে কথায় তড়িৎ সেই সমস্যার কথা জানিয়েছিল। আসলে তড়িৎ ছিল মহা ধুরন্ধর। সে মনে মনে ফ্ল্যাট চেয়েছিল কিন্তু দেখেছিল যে বিল্ডার, দুই বোন ও ভাড়াটে সবাইকেই খুশি করা অসম্ভব। একজন কে না একজনকে বাদ দিতেই হবে। 

ইনিয়ে বিনিয়ে বুবাই-পিকলুকে সে বুঝিয়েছিল যে আসলে গোপালই হল এই প্রোমোটিংটার কাঁটা। তাকে সরাতে পারলেই আর কোনো সমস্যা থাকবে  না। তারা তিন ভাই-বোন খুশি খুশি তিনটে ফ্ল্যাট নিয়ে নেবে। আর বুবাই-পিকলুর শেয়ারে থাকবে চারটে ফ্ল্যাট। যাকে বলে এক কথায় আইডিয়াল ডিল। 

বুবাই-পিকলু পড়াশুনা একটু কম করলেও যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছিল। তারা সারার্থ বুঝে যায় অতি সহজেই। প্রথম কনস্ট্রাকশন তোলার সুবর্ন সুযোগ তাদের দুর্নিবার আকর্ষন করে। তারা বড়ই উদ্বেল ও প্রবল উৎসাহী হয়ে ওঠে।

সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে এরপরই গোপাল-উৎখাত ষড়যন্ত্রের অবতারণা। হ্যাঁ, আর একটা কথাও এখানে বলে রাখতে হবে তা হল চন্দনার ওপর প্রথম থেকেই বুবাইয়ের নজর ছিল। গোপাল নন্দর ছেলে বলেই পাঙ্গা নেয়নি আগে।

 

সাত

-পুন্নিমা রাতে মোচ্ছব হবে। অমাবস্যাতে হবে তান্ডব। হবেই। কেউ আটকাতে পারবে না। হাহাহাহা…

‘এই সেরেছে, ননী পাগলা’ গোপাল মনে মনে বলে উঠে হনহন করে হাঁটা দিল। 

ননী পাগলাও ছাড়বার পাত্র নয়। রাস্তাটা যেখানে ঝিলপাড়ের দিকে ঘুরেছে সেখানেই একটা রকে বসে ছিল। গোপালকে দেখেই সুর করে চিৎকার ছুঁড়েছে। এবার উঠে গোপালের পিছু নিল। লাফাতে লাফাতে ওকে ধরেও ফেলল। গোপালের প্রায় ঘাড়ের কাছে গিয়ে হিসহিস করে বললঃ অ্যাই বাঁড়া, দশটা টাকা দে। দে, বলছি। 

গোপাল অগত্যা পিছু ছাড়াবার জন্য দশটা টাকা তাকে দিল।

দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল। মাথার মাঝখানে টাক পড়েছে। দুপাশে কাঁধ অব্ধি লম্বা চুল। সবই কাঁচাপাকা মেশানো। রুক্ষ ও অবিন্যস্ত। নোংরা একটা ফুলহাতা শার্ট। এই গরমেও গলা ও হাতার বোতাম আটকানো। পরনে অতি নোংরা পায়জামা। ডান হাঁটুর কাছে খানিকটা ছেঁড়া।

মালটা প্রায়দিনই এই সময় এখানটায় বসে থাকে। আর গোপালের থেকে দশ টাকা চায়। দিতেও হয়। নইলে পিছুপিছু খিস্তি খিস্তি করতে করতে চলে। হয়ত অন্যদেরও পিছু করে টাকা তোলে। কে জানে! 

মোড়ের মাথায় পৌঁছে বাপির দোকানে গোপাল চা আর টোস্ট বলল। ভোম্বল স্ট্যান্ডেই ছিল। তাকে দেখেই ‘কি রে পাগলা, কি খবর?’ বলে চেচিয়ে উঠল। গলা শুনেই গোপাল বুঝল অলরেডি ভোম্বল চড়িয়ে আছে। চায়ে নিতে নিতেই ‘ভালই রে’ বলে আলগোছে উত্তর দিল। আর পাত্তা দিল না। ভোম্বলটা খুবই বদ ও ফিচেল। এক্ষুনি বউ-টউ নিয়ে পিনিক দেওয়া শুরু করবে। 

রিকশা থেকে নেমে টেরিকাটা চুল নিয়ে ভোম্বল চায়ের দোকানে তার কাছে এসে দাঁত কেলিয়ে দাঁড়াল। ওপর-নিচ মিলিয়ে সব দাঁতেই পানমশলার গাঢ় ছোপ ধরেছে। একটা বিড়ি চাইল। গোপাল বুঝেছে এইবার শুরু করবে খোঁচাখুঁচি করা আর থেকে থেকে পিনিক মারা। 

চলবে…

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page