ছোট উপন্যাস।। গোপাল গোঁসাই।। সৌপ্তিক চক্রবর্তী
মোড়ের মাথায় পৌঁছে বাপির দোকানে গোপাল চা আর টোস্ট বলল। ভোম্বল স্ট্যান্ডেই ছিল। তাকে দেখেই ‘কি রে পাগলা, কি খবর?’ বলে চেচিয়ে উঠল। গলা শুনেই গোপাল বুঝল অলরেডি ভোম্বল চড়িয়ে আছে। চায়ে নিতে নিতেই ‘ভালই রে’ বলে আলগোছে উত্তর দিল। আর পাত্তা দিল না। ভোম্বলটা খুবই বদ ও ফিচেল। এক্ষুনি বউ-টউ নিয়ে পিনিক দেওয়া শুরু করবে।
রিকশা থেকে নেমে টেরিকাটা চুল নিয়ে ভোম্বল চায়ের দোকানে তার কাছে এসে দাঁত কেলিয়ে দাঁড়াল। ওপর-নিচ মিলিয়ে সব দাঁতেই পানমশলার গাঢ় ছোপ ধরেছে। একটা বিড়ি চাইল। গোপাল বুঝেছে এইবার শুরু করবে খোঁচাখুঁচি করা আর থেকে থেকে পিনিক মারা।
এরপর…
ভোম্বল বিড়িটা ধরাতে ধরাতেই বললঃ বুবাই মালটা কি হারামি জানিস? ওই মথুরগড়ের রবি সাহার মেয়েটাকে ছক করচে। খবর আচে। বিড়ি ধরিয়ে দেশলাইটা জামার পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে গোপালের দিকে তাকিয়ে বললঃ ওদিকে আবার তোর বউটাকে নিয়ে, ভাব, কেমন ঢ্যামনা!
ভোম্বল আগে তাকে ‘তুমি’ করে বলত গোপালের স্পষ্ট মনে আছে। তুই-তোকারিটা ইদানিং শুরু করেছে। সে জেল থেকে ফেরার পর।
গোপাল জানে যে ইনিয়ে-বিনিয়ে ভোম্বল তাকে তার বউ নিয়েই খোঁচাবে। ও কোনো উত্তর দিল না। চা-টোস্ট জলদি শেষ করে, মানে টোস্টের শেষটুকু চিবোতে চিবোতেই ‘একটু তাড়া আছে, ভাই’ বলে হাঁটা দিল। বিরক্ত হয়ে মনে মনে বলে উঠলঃ অসহ্য মাল একটা!
চায়ের দোকান ছেড়ে গোপাল এগোল ঝিলটার দিকে। ঝিলপাড়ের উল্টোদিকে ‘বলদা’ অর্থাৎ বলরামের বাড়ি।
বলরাম, যে সর্বত্র শুধু ‘বল’ বলেই পরিচিত কি তারপর ‘দা’ কিংবা ‘কাকু’, ছিল শেষদিকে গোপালের বাবার ডানহাত। গোপালের বাবা খুন হওয়ার পর কয়েকমাস এলাকাছাড়া ছিল। প্রাণভয়ে। সন্তোষের শাসানিতে। তারপর কাউন্সিলর বিশ্বরূপ পোদ্দারের মধ্যস্থতায় ফিরে মুচলেখা দিয়ে তোলাবাজি ছেড়ে একতলা বাড়ির সামনের ঘরে মুদিখানা খুলেছে।
গোপালের থেকে বছর দশেকের বড়। বাড়ির পেছনের ঘরে ছেলে-বউ নিয়ে থাকে। সকাল-দুপুর-বিকেল নিজেই বসে দোকানে। আর সন্ধে সাতটা নাগাদ ছেড়ে দেয় বউয়ের হাতে। নটায় দোকান বন্ধ করে তার বউ।
আট
বলর বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে গোপাল দেখতে পেল ‘বল-বৌদি’ দোকানে বসে আছে। রোজই থাকে।
ইচ্ছে করেই দেখায় কিনা গোপাল তা জানে না তবে এটা সত্যি যে আজ অব্ধি সে যতবারই ‘বল-বৌদি’কে দেখেছে দোকানে ততবারই দেখেছে তার খাঁজ। শাড়িটা সামান্য একটু সরে থাকে বা হয়ত সরিয়ে রাখে সাথে আঁটো ব্লাউজে গভীর খাঁজ স্পষ্ট দেখা যায়। এটা অবশ্য একটা বিজনেস স্ট্র্যাটিজিও হতে পারে। মানে গোপাল সময় সময় সেরকমও ভেবেছে আর কি। যাক গে।
হাসিমুখে হাত তুলে গোপালের সম্ভাষণে একটা আলগা হাসি ফুটে উঠল তার মুখে। গোপাল বাড়ির ভেতর ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে সোজা ছাদে উঠে গেল।
এই ছাদেই বসে তাদের তিনজনের আড্ডা। গাঁজা-ছিলিম নিয়ে মাদুর পেতে বসা। সাথে জলের দুটো বোতল আর ভবতারিণী মিষ্টান্ন ভান্ডারের গুজিয়া। বলর হাতেই ছিলিম-গাঁজায় হাতেখড়ি গোপালের। আগে অবশ্য শুধু সন্ধেবেলা বলর এখানে এসে খেত। তাও প্রতিদিন নয়। জেলফেরত রোজই আসছে। নিজে হাতেও গোয়ালঘরে দুছিলিম সেজে খাচ্ছে।
আড্ডার আর এক পান্টার হল বৃন্দাবন। স্থানীয় মিউনিসিপ্যালিটির ক্লার্ক। আর বছর তিনেক চাকরি আছে। গোপালের ’বৃন্দাবনকাকা’। বলর ’বৃন্দাবনদা’। বিয়ে-শাদি করেনি। বলর বাড়ির দুটো বাড়ি আগে পৈতৃক বাড়ির তিনতলায় একলাই থাকে। হাঁড়ি আলাদা।
এই ’বৃন্দাবনকাকা’ গোপালের ধুপকাঠি কোম্পানির লাইসেন্স, রেজিস্ট্রেশন ইত্যাদি করতে গোপালকে খুবই সাহায্য করেছে। আড্ডায় গুজিয়াটা নিয়ে আসে বৃন্দাবনই।
তারা প্রত্যকেই অসমবয়সি হলেও সবাই বন্ধুর মতো মেশে। ছোট-বড় বিচার নেই। ঘন্টাদুয়েক বসা হয়। মাঝারি সাইজের ছিলিমে দুবার সাজে বল।
এখানে বলে রাখা দরকার গোপাল তার খোরাকের মালটা বলর থেকেই নেয়। নিজে ঠেকে যায় না কখনও। বল তুলে রাখে ও টাকা দিয়ে নিয়ে নেয়। গোপাল কখনও মাল স্টক করে না। প্রতিরাতেই মাল নেয়। রাতে শুতে যাওয়ার আগে আর পরদিন সকাল-দুপুর তাতে তার হয়ে যায়।
-আয় বোস, আজ নতুন বাঁশিটা উদ্বোধন করব। গোপালকে ছাদের দরজা থেকে দেখতে পেয়েই বলল বল।
বল-বৃন্দাবন ছিলিমকে বলে বাঁশি। গতকাল পুরনোটা ফেটে গেছিল।
ছিলিম সাজানোই ছিল। গোপাল হাসিমুখে মাদুরে বসতে না বসতেই তোলা হল। বৃন্দাবনই তুলল আজ।
-যে বাঁশি শুনে মন ভরে যায় তাকে কি বলে বল তো? গলগল করে ধোঁয়া ছেড়ে ওদের দুজনকেই জিজ্ঞেস করল বৃন্দাবন। একমুখ মিটিমিটি হাসি।
ওরা জানে না। দুজনেই মুখ চাওয়চাওয়ি করে সেটা বলতেই ‘মোহন বাঁশি’ বলে গোপালকে ছিলিমটা পাস করে দিল।
তারপর বললঃ আমাদের এ বাঁশিও মোহন, কি বল?
বল আর গোপাল একটু হেসে উঠল। গোপাল ছিলিমে টান দিতে গেল।
বলর হাসি আর গোপালের টানের মাঝেই বৃন্দাবন বলে উঠলঃ তবে এ বাঁশি শোনার নয়। টানার। টানলেই মন ভরে যায়। তাই না?
বল হেসে ‘ঠিক’ এবং গোপাল টানটা দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ‘ঠিককথা’ বলে হেসে উঠল। ওদিকে বৃন্দাবনও কান অব্ধি ছড়িয়ে হাসছে, নিশব্দ।
বল টেনে পাস করে দিল তাকে।
রাত সাড়ে নটা নাগাদ গোপাল বলর বাড়ি থেকে বেরিয়ে উল্টোদিকে রঘুনন্দনের দোকানে ঢুকে পড়ল। সাথে বৃন্দাবন।
রঘুনন্দনের দোকানে বসে তেমন কেউ খায় না। রাতের রুটি-তড়কা কাউন্টার থেকে তুলে নিয়ে চলে যায় আধিকাংশ লোক। গোপাল অবশ্য বসেই খায়।
পেছনে একটাই প্লাস্টিকের টেবিল আর চারটে চেয়ার পাতা আছে। রান্না করে বুড়ো রঘুনন্দন। আর ওর বছর তিরিশের জোয়ান ছেলে পবন হেল্পার ও ওয়েটার। ওরা বিহারি। তবে এখানে তিনপুরুষের বাস। বাংলাই বলে। আইটেম বেশি নয়। তড়কা (প্লেইন/এগ/চিকেন), আলুমটর, চিকেন কষা আর রুটি।
গোপাল টেবিলে বসতে না বসতেই পবন বললঃ আজ চিকেন কষা দিই। কি রোজ রোজ ভেজ মারছ।
‘দে’ বলে গোপাল জাগ থেকে গ্লাসে জল ঢালতে লাগল।
বৃন্দাবন রোজকার মতো রুটি-তড়কা নিয়ে ‘চলি রে, গোপলা, কাল দেখা হবে’ বলে চলে গেল।
চারটে রুটি-চিকেন কষা পেঁয়াজ-লঙ্কা দিয়ে খেয়ে দোকানের বাইরে এসে একটা বিড়ি ধরাল গোপাল। তারপর বাড়ির দিকে হাঁটা লাগাল।
নয়
হাঁটতে হাঁটতে গোপাল ভাবতে থাকল যে সে পুরোপুরি সুবোধ বালক না হলেও কতগুলো গুণ ছিল তার। যেমন কোনোদিন পার্টি-পলিটিক্সের ধার সে মাড়ায়নি। মারামারি-লাফড়াবাজিতে ছিল না কখনও। টিটিটা দারুন খেলত। ফুটবলটাও ভালই খেলত। স্টপার ছিল। স্কুল-টিমের হয়ে নার্সারি লীগ-জোনাল খেলেছে। তবে এইচএসের পর আর খেলেনি। ডানপায়ের পাশাপাশি বাঁপাটাও দিব্যি চলত তার। বিরক্তিতে মনে মনে খিস্তি করে উঠলেও খুব একটা মুখে আনত না। চন্দনা ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে ছক করেনি। বেশ্যাবাড়িও যায়নি কখনও। অন্যের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়ার লোকও সে নয়।
সেই কিনা মিথ্যে চুরির দায়ে জেল খাটল! এরপর হয়ত চন্দনা তার ফেরার খবর পেয়ে ডিভোর্স নোটিশ পাঠাবে। জেলখাটা আসামীর সাথে কি আর ঘর করা যায়!
হ্যাঁ, দোষের মধ্যে হল নেশা। ইলেভেন থেকে নিয়মিত সিগারেট। বেশি নয় সারাদিনে ওই বড়জোর এক প্যাকেট। ডিপ্লোমাতে ঢুকে গাঁজা। তাও আগে নিয়মিত খেত না। হপ্তায় বারকয়েক যেত ‘বলদা’র বাড়ি। মদে কোনোকালেই তেমন রুচি ছিল না। ওই পুজো, দোল, ইত্যাদিতে বন্ধু-বান্ধবের সাথে বসলে একটা প্রিমিয়াম বিয়ার, ব্যাস। তবে তার সব থেকে বড় দোষ বোধহয় লোককে অতিরিক্ত বিশ্বাস করা। যার মাশুল সে আজ হাড়ে হাড়ে গুনছে।
কোনোদিন ফেল-টেল না করলেও পড়াশুনায় তার বিশেষ আগ্রহ ছিল না। তবে মাথা ভাল ছিল। সায়েন্স নিয়ে এইচএসে ফার্স্ট ডিভিশনেই উতরে ছিল। চাকরি যে করবে না সেটা ভেবেই রেখেছিল। ছোট থেকেই তার স্বধীনভাবে বিজনেস করার ইচ্ছে। ক্লাশ টুয়েল্ভে পড়তে পড়তেই বাবার যোগাযোগ ও পরিচিতি দেখে বুঝেছিল কনস্ট্রাকশন লাইনটাই হবে রাইট চয়েস।
টেকনিক্যাল নলেজ অবশ্যই একটা প্লাস পয়েন্ট। বিজনেসে গ্রিপ থাকবে। রান করাতে সুবিধা হবে। এসব ভেবেই সিভিলে ডিপ্লোমাটা করা। ডিপ্লোমা করে ক্লাসমেটদের বেশির ভাগই এদিক সেদিক নানান প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ঢুকলেও। সে ঢোকেনি। একে অনেক খরচার ব্যাপার। তও আবার তার কোনো দরকারই নেই ডিগ্রির। তার যা প্ল্যান তার জন্য ডিপ্লোমাই যথেষ্ট। আলাদা কোনো পুঁজি তো ছিল না তাই সাপ্লায়ার্সের বিজনেস দিয়ে হাত পাকানো শুরু। ভেবেছিল একদিন বড় বিল্ডার হবে সে। কিন্তু কপাল!
বিয়েটা একটু তাড়াতাড়ি করেছিল সে। তার কারণও ছিল সঙ্গত। যখন চন্দনাকে সেবার দোলের দিন সে প্রপোজ করে তখন গোপাল ক্লাশ ইলেভেনে পড়ে আর চন্দনা এইটে।
তখন সন্ধে। মুখের হাফ ওঠা রং নিয়ে পাড়ার রকে গোপাল ও তার তিন বন্ধু মিলে গুলতানি করছিল। আর তেল-সাবানে রং খানিক উঠে, যেন মেঘ সরে আবার জ্যোৎস্না ফুটেছে, এমন মুখে চন্দনা চপ কিনতে বেরিয়েছিল। গোপাল সেদিন সেই তিন ক্যালানে বন্ধু সাক্ষী রেখে, মুঠোয় লাল আবির নিয়ে, স্যাট করে খোলা রামপুরী ছুরির মতো উঠে, চন্দনার গাল রাঙিয়ে করেছিল প্রপোজ।
গোপালের ‘আই লাভ ইউ’ এর কোনো উত্তর না দিয়ে রাস্তা থেকে চন্দনা খিলখিলিয়ে দৌড়ে সোজা বাড়িতে। তার গাল থেকে তখন গুঁড়ো গুঁড়ো ঝরে পড়ছিল গোপালের সহসা সোহাগ! চপ কেনা আর হয়নি সেদিন।
ওদিকে প্রত্যয়ী গোপাল চওড়া হাসি নিয়ে বন্ধুদের বিস্মিত চাহনি ও চন্দনার সলজ্জ প্রস্থানের মাঝে। টানটান ঋজু কঞ্চির মতো।
আট বছরের প্রেম। ওফঃ এখনও বেশ মনে আছে লেকের ধারে টিউশন কেটে খাওয়া প্রথম চুমুটা। নিজে কলেজ কেটে ও চন্দনাকে স্কুল কাটিয়ে কুটীঘাট থেকে বেলুড়ের সেই নৌকা পারাপার। কচুরি-আলুর দম আর থেকে থেকেই হাতে-কাঁধে-কোমরে আলতো করে ছুঁয়ে যাওয়ার আকুতি ও অনুভূতি। তারপর, সেই মোনালিসা ক্যাফের দুপুর-কেবিনগুলো। আঙুলের ডগায় ফিশ ফ্রাই-স্যালাডের সাথে চন্দনার গন্ধ মিশে থাকত।
বুবাই-পিকলুর সাথে মিলে বিজনেসটাও ধরে গিয়েছিল মোটামুটি। দুপয়সা আসছিল হাতে। তাই আর দেরি করতে চায়নি। ঠিক করেছিল এইবার চন্দনাকে সিঁদুর দিয়ে ঘরে তুলবে। চন্দনাও রাজি ছিল।
বিয়েটা আরও এক বছর আগেই হয়ত সে করত কিন্তু ওই যে তার বাবা খুন হয়ে গেল। এরপর আবার আর এক গাওনা শুরু করল তার শ্বশুর। শ্বশুরের একটা রোল সেন্টার আছে যতীন কলোনীর মোড়ে। যশোদা রোল সেন্টার। গোপালের শ্বাশুড়ির নামে নাম।
সে যাক গে, গাওনাটা আর কিছুই নয়, ক্রিমিনালের ঘরে মেয়ের বিয়ে দেবে! অথচ এমন নয় যে তার শ্বশুর জানত না তাদের প্রেমের কথা। আবার এটাও জানত যে গোপাল এসব ধান্দায় নেই। সে সৎ ভাবে খেটে খাচ্ছে। কিন্তু ওই যে তার বাবা সদ্য সদ্য খুন হয়েছে সেটাই তখন বড় হয়ে উঠল!
গোপাল জানত যে তার বাবা বেঁচে থাকলে এসব ভাবার সাহসও পেত না শ্বশুর। চুপচাপ সম্প্রদান করে দিত। তাই আর সাতপাঁচ না ভেবে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করে নিল গোপাল-চন্দনা। বলা তো যায় না হয়ত মেয়ের মাথা খেয়ে কেঁচিয়েই দেবে সম্পর্কটা।
তার মায়ের ইচ্ছেতেই সাজানো হয়েছিল ফুলশয্যার খাট। আর আগে করে থাকলেও সেরাতে পাগলামি করেছিল স্রেফ। দুজনেই। পরে ভেবে হেসেছেও দুজনে কতবার এই নিয়ে। পাশের ঘর থেকে মা কিছু টের পেয়েছিল কিনা কে জানে!
তার বাবার দিকে ছিল এক পিসি তবে তাদের সাথে সে কোনো যোগাযোগ রাখত না। আর মায়ের দিকে ছিল দুই মাসি। সেক্ষেত্রেও যোগাযোগ তথৈবচ। নিজের কোনো মামা ছিল না। তো তার অয়নমামা ও তার পরিবার, পাড়া-প্রতিবেশী-বন্ধু আর শ্বশুর বাড়ির জনা পনেরো লোক মিলিয়ে তিরিশ-পয়ঁতিরিশ অতিথি ডেকে ছাদে প্যান্ডেল করে একটা ছোট খানাপিনার আয়োজনও করেছিল। রেজিস্ট্রির পর। পাড়ার রমেন ঠাকুরকে দিয়ে কেটারিং করিয়েছিল।
আপ্যায়নে পেপসি-মিরিন্ডার সাথে ছিল পনীর পকোরা আর ফিশ ফিঙ্গার।
রাতের মেনুতে ছিলঃ
লেবু-লঙ্কা
বাসমতী চালের ভাত
কড়াইশুটি দিয়ে মুগ ডাল
বেগুনি
ধোকার ডালনা
ছানার কালিয়া
দই কাতলা
কচি পাঁঠার ঝোল
খেজুর-আমসত্বের চাটনি
মশলা পাপড়
পান্তুয়া (ভবতারিণী মিষ্টান্ন ভান্ডার, এই মিষ্টান্ন বানানোয় তাদের আঞ্চলিক প্রসিদ্ধি আছে)
বাটার স্কচ আইস্ক্রিম
আঁচানোর পর হাতে হাতে যুবরাজের দোকানের মিষ্টি পান। সুপার মার্কেটের এই দোকানেই এলকার সেরা পানটা পাওয়া যায়।
ধুর, সব কিছু বেকার গেল!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিভে যাওয়া বিড়িটা ছুঁড়ে ফেলে দিল গোপাল। বাড়ি প্রায় এসেই গেছে।
গোপাল আর কয়েক পা হেঁটে বাঁহাতে ঘুরে তাদের বাড়ির গলিটায় ঢুকতে যাবে, ঠিক তখনই ভোম্বল গলির ভেতর থেকে রিক্সা নিয়ে বেরিয়ে এল। তাদেরই গলিতে একটা ভাড়া নামিয়ে ফিরছে।
গোপাল মনে মনে বলে উঠলঃ ওফঃ বাঞ্চোতটাকে যতবার অ্যাভয়েড করতে চাই ততবারই মুখোমুখি হই।
ওদিকে তাকে দেখে ভোম্বল রিক্সা থামিয়ে দিয়েছে।
রিক্সার ওপর থেকে পান মশলা চিবোতে চিবোতে ছদ্ম গাম্ভীর্যে চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলঃ দক্ষিণেশ্বরে কোন ফ্যালাটে চন্দনা আচে, খোঁজ নেব একবার?
তারপরই বললঃ আমার চেনা আচে ওদিকে, কিন্তু।
‘বোকচোদটা, দেখছি, কেচ্ছাটা এবার ফুল পাব্লিক না করে ছাড়বে না!’ মনে মনে বলল গোপাল।
তারপর বললঃ না, কোনো দরকার নেই। দরকার হলে বলব।
-না, মানে, তোর বউটাকে কিভাবে রেখেচে, কী করচে, সেটা তো জানতে হবে, না?
গোপাল আবার মনে মনেঃ উফঃ, আমার বউয়ের জন্য হারামীটার চিন্তাটা দেখ একবার!
নিজেকে বেশি সেয়ানা ভাবছে। ওর পিনিকটা কি আর গোপাল বুঝছে না!
-এখন দরকার নেই। রাত হল। পরে কথা হবে। বলে গোপাল হনহন করে গলির ভেতর ঢুকে গেল।
‘শুয়োরের বাচ্চা, ঝাঁট জ্বালিয়ে দিল পুরো। ধুনকিটাই চটকে দিল, বাঁড়া।’ এই কথাটাও মনে মনেই বলল গোপাল।
বলতে বলতেই সদর দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়ল।
দশ
বাড়ি ঢুকে উঠোনে এসে গোপাল দেখল মাধবীমামী হেঁশেল থেকে রাতের খাবার নিয়ে ঘরের দিকে যাচ্ছে। রাত সাড়ে দশটার মধ্যে খেয়ে বাড়ির সবাই এগারোটার মধ্যে শুয়ে পড়ে। গোপাল একটু দেরি করে শোয়।
কলতলায় গিয়ে ভাল করে মুখ হাত ধুয়ে বাথরুম হয়ে ঢুকে গেল গোয়ালঘরে। ঝোলানো সুইচটা টিপে আলো জ্বালল। লালি-দুলি দুজনেই পা মুড়ে বসে আছে। ঘুমিয়ে পড়বে কিছুক্ষণেই।
জিন্স-টি-শার্ট ছেড়ে গাঢ় সবুজ লুঙ্গি আর কমলা রঙের স্যান্ডো গেঞ্জিটা পরে খালি বোতলটা নিয়ে বেরিয়ে এল। হেঁশেল থেকে রাতের জলটা ভরে নিল। তারপর আবার ঢুকে গেল গোয়ালঘরে। এইবার এক ছিলিম সাজবে, খাবে ও হ্যাল খাবে ঘন্টাখানেক। তারপর ঘুম।
মশারির একটা দড়ি বেশ লম্বা। সামনের দেওয়ালে গাঁথা পেরেকে অব্ধি। গোপাল আগে মশারিটা টাঙিয়ে তার ভেতর ঢুকে ভাল করে মশারিরটা তোষকের নিচে গুঁজে দিল। তারপর একটুখানি ফাঁক করে বেরিয়ে এল।
খাটিয়ায় হ্যালান দিয়ে মেঝেতে বসল। প্লাস্টিকের টুলটার কাছ ঘেঁষে। ফ্যানটা চালিয়ে দিল। ঠিক মুখের হাইটে। মাধবী প্রতিদিন চার্জ দিয়ে রাখে।
মশার ধুপটা আর সাথে তার নিজের বানানো একটা ধুপ জ্বালাল। মশার ধুপের গন্ধটা তার একেবারে সহ্য হয় না। আর সন্ধে নামার সাথে সাথেই গোয়ালঘরে যা মশার উপদ্রব। তখন হয় মশারির ভেতর থাক না হয় মশার ধুপ জ্বেলে বসে থাক।
চলবে…