গল্প।। লাশ।। সৌপ্তিক চক্রবর্তী
শহরতলীর স্টেশন। মাটি থেকে একটু উঁচুতে। নিচে দুপাশে কলোনী। রাত তখন সাড়ে এগারোটা কি পৌনে বারোটা। মেঘ ডাকছে। বৃষ্টি এল বলে। বুল্টাই আর ঘোতনা প্লটফর্মের শেষ মাথায় একটা ছোট সিমেন্টের বেঞ্চে বসে বাংলা খাচ্ছিল। খুঁটির টিমটিমে আলোর নিচে। এটা কর্ড লাইন। শেষ ট্রেন চলে গেছে বহুক্ষণ। রাতে কোনো টহল থাকে না। থাকলেও অবশ্য তারা কেউই বুল্টাই-ঘোতনাকে ঘাঁটাতো না। তারা এলাকার কুখ্যাত সমাজবিরোধী বা সুখ্যত সমাজসেবী। দ্বিমত আছে। তবে যেটা নিয়ে এলাকাবাসী কিংবা লোকাল থানার কোনো দ্বিমত নেই তা হল যে এদের মাথার ওপর বিশুদা ওরফে পুরপ্রধান বিশ্বদেব দাশের হাত আছে। বেশি ডিটেইলে না গিয়ে সংক্ষেপে এটুকুই তাদের পরিচয়।
ঘোতনা জড়ানো গলায় বললঃ গুরু, চল না, আজ চম্পার ঘরে যাই।
তলানি মালটা শেষ করে বুল্টাই হেসে বললঃ খুব রস জেগেছে না আজ তোর!
-আরে চল না গুরু, গুরু, প্লিজ। ঘোতনা নাছোড়।
-ঠিক আছে আগে বোতলটা ফিনিশ করি তারপর। আশ্বস্ত করার মত করে বুল্টাই বলল।
-জিও, এই না হলে গুরু! দাঁড়াও একটু মুতে আসি। বলে ঘোতনা উঠে টলতে টলতে প্লাটফর্মের শেষে মুততে গেল।
আজ ওরা সেই রাত সাড়ে আটটা থেকে খাচ্ছে। প্রথমে বিজন বারে দুবোতল বাংলা। তাতেও তেষ্টা না মেটায় ব্ল্যাকে আরও একটা বোতল তুলে সাথে একটা দুলিটারের বিস্লেরি আর সস্তা দুটো চিপ্সের প্যাকেট নিয়ে এখানে এসে বসেছে পৌনে এগারোটা নাগাদ। নেশা হয়েছে প্রবল। চিপ্স শেষ অনেকক্ষণ। বোতলও প্রায় শেষ।
ঘোতনা ছড়িয়ে ছড়িয়ে মুতছে। বুল্টাই সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাইটা পকেটে ভরে আস্তে করে উঠে ওর ঠিক পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। বুল্টাই চেহারায় ঘোতনার প্রায় দেড়া। ততক্ষণে ডান পকেট থেকে রামপুরীটা বার করে নিয়েছে। বাঁহাতে খপ করে ওর মুখটা চেপে ধরে রামপুরীটা খুলে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললঃ তলায় তলায়, সেন্টুর সাথে দল পাকাচ্ছিস, ভাবজিস কিজু জানি না। তারপর মুহুর্তের মধ্যে অভ্যস্ত হাতে ডিপ করে ওর নালি ফাঁক করে দিল। একটু ছটফট করতে করতে স্থির হয়ে গেল ঘোতনার শরীরটা। বুল্টাই ছেড়ে দিতেই লাশটা মুখ থুবড়ে পড়ে গেল সামনের ঝোপটায়। বুল্টাইয়ের রাগ তখনও পড়েনি। সে প্যান্টের চেন খুলে মুততে শুরু করল ঘোতনার লাশের ওপর। আর দু এক পশলা বৃষ্টি নামল তখনই।
মুতে, বাকি বাংলা আর জল দিয়ে রামপুরীটা ধুয়ে নিল। সাথে হাতটাও অবশ্যই। রামপুরীটা ভাঁজ করে পকেটে ঢোকাল। তারপর হিপপকেট থেকে প্লাস্টিকের একটা প্যাকেট বার করে বাংলা আর জলের খালি বোতলদুটো ভরে নিল। একটা সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে ট্যাপ করে টানতে টানতে নিচে নামতে থাকল। ঝিরঝিরে বৃষ্টি তখন। মনে মনে বুল্টাই ভাবল ভালই হয়েছে বৃষ্টিটা এসে, জামাকাপড়ে যদি কোথাও রক্তের ছিটে লেগে থাকে তো ধুয়ে যাবে। নিচে নেমে একটু এগিয়ে টিকিট কাউন্টারের কাছে রাখা মোটরবাইকের পেছনের সিটটা খুলে প্যাকেটটা রাখল। তারপর উঠে স্টার্ট দিল।
এখান থেকে বি.টি. রোড ধরে সোজা যাবে গঙ্গার ঘাটে রতনের আড্ডায়। রতন একটা ছোট বাংলার ঠেক চালায়। বুল্টাইয়ের জিগরি দোস্ত। বউকে বলে এসেছে ইলেকশনের কাজে দু-তিন দিন বারাসতে থাকবে। গ্যাং-এর আর কাউকে অবশ্য কিছুই বলেনি।
ক্রশিং-এর আলোগুলো সব হলুদ হয়ে জ্বলছে নিভছে। কোনো গাড়িই আর নেই প্রায়। বৃষ্টিটা তখন ঝমঝমিয়ে হচ্ছে। প্রবল নেশায় আর চুপচুপে ভিজে বুল্টাই বি.টি. রোড দিয়ে মোটরবাইকটা প্রায় উড়িয়ে নিয়ে চলেছে। এই তো প্রায় হাফ রাস্তা এসেই গেছে। আজ রাতটা রতনের আড্ডায় কাটিয়ে মোটরবাইকটা ওখানে রেখে কাল সকাল সকাল ফেরীতে চলে যাবে বেলুড়। তারপর সেখান থেকে হাওড়া স্টেশন। সেখান থেকে সোজা মুঙ্গের। একবার মুঙ্গেরে গিয়ে পৌছতে পারলে আর চিন্তা নেই। রক্সল বর্ডার পার করে সোহরাব ভাই তাকে ঠিক নেপাল পাঠিয়ে দেবে।
ওদিকে আরও একজন সেই রাতে প্রচুর মদ খেয়ে প্রেমিকার সাথে ব্রেক-আপ করে ফিরছে। সে আর কেউ নয় এলাকার ডাকসাইটে প্রোমোটার সুবীর দত্তের ছোট ছেলে লিটন। হন্ডা সিটিটা বি.টি. রোড দিয়ে একশোর বেশি স্পিডে ছুটছে।
এইবার সামনের ক্রশিং থেকে ডানদিকে টার্ন নিয়ে সোজা গেলে গঙ্গার ঘাট। প্রচন্ড গতিতে টার্ন নিল বুল্টাই আর ওদিকে উনিশ বিশ গতির তারতম্যে সোজা ছুটে এল লিটনের হন্ডা সিটি। বুল্টাই প্রায় উড়ে গিয়ে চিৎ হয়ে পড়ল ফুটপাথের ধারে আর বড় সিমেন্টের চাঁইটায় সজোরে পড়ল মাথাটা। পড়তেই থেঁতলে গেল একদম। হেলমেটটা থাকলে হয়ত বেঁচে যেত। কিন্তু সে ভেবে আর কী হবে! রাস্তায় দলা পাকিয়ে বেশ খানিকটা ছড়িয়ে পড়েছে তার ঘিলু। বুল্টাইয়ের চোখের সামনে মোটরবাইকের চাকা দুটো তখনও ঘুরছে। সে একটা প্রবল চেষ্টা করল উঠে বসার। পারল না। শুধু ডানহাতটা একটু উঠে কাঁপতে কাঁপতে ফের পড়ে গেল রাস্তায়।
লিটন একটা প্রবল ব্রেক কষে হতভম্ব খানিক দাঁড়িয়ে থাকল। এয়ার ব্যাগটা খুলে যাওয়ায় তার চোট লাগেনি তেমন। গাড়িটারই যা ড্যামেজ হওয়ার হয়েছে। তাকিয়ে দেখল বুল্টাইকে পড়ে থাকতে। তারপর সরু চোখে একবার চারিদিক দেখে নিয়ে সোজা গাড়ি ছুটিয়ে দিল।
ঝমঝম বৃষ্টিতে বি.টি. রোডের ওপর বুল্টাইয়ের লাশটা ভিজতে থাকল…