উপন্যাস।। আবার এসো ফিরে।। রামেশ্বর দত্ত
সেদিন কিছুটা আগেই দুজন আগন্তুক এসেছে ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে। বৈঠকখানায় বসে কথা বলছেন ঈশ্বরচন্দ্র। অনেক সময় ধরে আলোচনা চলছে। দীনময়ী বারবার বৈঠকখানায় চাকরকে পাঠিয়ে জানতে চাইছেন, বাবুর অতিথিরা আছে, না চলে গেছে। চাকর বার দুই এসে দেখে গেল, বাবু কথা বলছে বাইরের লোকেদের সঙ্গে। মাকে গিয়ে সেই খবর দিতে দীনময়ী তাকে বলে দিলেন, ঘরের সামনে বসে থাকতে, লোককে উঠতে দেখলেই যেন এসে খবর দেয় সে। চাকর তাই করল। মানুষ দুজনকে উঠে দাঁড়াতে দেখে সে দৌড়ে ওপরে গিয়ে খবর দিল, মা ঠাকরুন, মনে হচ্ছে মানুষ দুজন এবার চলে যাবে,…
পর্ব-৩৭
দীনময়ী কী একটা কাজ করছিলেন। তা ফেলে রেখেই তাড়াহুড়ো করে বৌঠকখানার সামনে এসে দেখেন, আগন্তুকদের বিদায় জানিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র কাঁধে চাদর তুললেন। মানে, এবার তিনি বৈকালিক ভ্রমণে বেরিয়ে যাবেন । তখনই দীনময়ী ঘরে ঢুকলেন। অসময়ে গিন্নীকে সেখানে দেখে ঈশ্বরচন্দ্র প্রশ্ন করলেন, এখন এখানে! কী ব্যাপার?
দীনময়ী উত্তর দিলেন, আপনি একটু বসুন, কথা আছে।
-কথা পরে বললে হবে না?
-বিনু কালকেই ফিরে যাবে, কথাটা তাই আজকে বলে নিলে ভালো হয়।
-ও, বলে, হাতের চাদরখানা নামিয়ে রেখে ঈশ্বরচন্দ্র চেয়ারে বসে পড়লেন । মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দীনময়ী। বললেন, আপনি নাকি সূর্যকে কলেজ থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন?
কথাটা একরকম ছুড়েই দিলেন দীনময়ী।
সরাসরি এমন কথা শুনে ঈশ্বরচন্দ্র বিব্রত বোধ করলেন। সামান্য সময় চুপ করে থেকে বললেন, বিনু তোমায় শুধু এই কথাটাই বলেছে?
-না। সবই বলেছে। কিন্তু সেসব কথা থাক। আমি যা জানতে চাইছি, তার উত্তর দিন। ছেলেটাকে কেন হেনস্থা করছেন? ভাবছেন না, এরপরে ওর কী অবস্থা হবে? মেয়েটাই বা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
-বিনু যদি সব কথা বলেই থাকে, তবে নিশ্চয়ই তোমার প্রশ্নগুলোর উত্তরও সে দিয়েছে। আমি আবার নতুন করে তা কেন বলি? না বলে থাকলে, ওর কাছ থেকেই জেনে নিও। তবে, একটা কথা জানিয়ে দিচ্ছি তোমাকে, অন্যায়কে আমি কোনোদিন প্রশ্রয় দিইনি, আজকেও দোবো না। সে সূর্যই হোক, আর যেই হোক।
-হ্যাঁ। আপনি তো আপনার জেদ নিয়েই চললেন সারাজীবন। ছেলেকে ত্যাগ করেছেন, জামাইকে ত্যাগ করতে চলেছেন…, আর কী কী করবেন আপনি?
দীনময়ীর গলার স্বর বেশ উঁচুতে। তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। এরপরেও তিনি বলে যেতে থাকলেন, এমন সব ভাবনা ভেবে ভেবেই নিজের শরীরটাও বারোটা বাজালেন। একবার নিজের চেহারার দিকে চেয়ে দেখেছেন? কী ছিলেন, আর কী হয়েছেন আজ?
-বয়স হলে সবারই চেহারা খারাপ হয়। আমারও হয়েছে। হাসতে থাকেন ঈশ্বরচন্দ্র।
-আপনি হাসছেন! সত্যিই…
-আচ্ছা। তুমি এখন ভিতরে যাও। আমি দেখছি, কী করতে পারি। আগে তো সে কলেজের চিঠির উত্তর দিক। তারপর না, তোমার কথায় তাকে কলেজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে।…শোনো দীনময়ী, একজন কলেজ অধ্যক্ষকে কলেজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় না। তাঁকে কাজ থেকে নিবৃত করা হয়। কথাগুলোয় একটু মিষ্টতা আনো…
কথা বলতে বলতে ঈশ্বরচন্দ্র চাদরখানা তুলে কাঁধে ফেলে বেরিয়ে গেলেন।
চোখ ভরা কান্না নিয়ে দীনময়ী উপরে উঠে এসে বিনোদিনীকে কোনও আশ্বাস বাক্যই শোনাতে পারলেন না। মা মেয়ে মন খারাপ করে রাতটা কাটাল। পরের দিন বিনোদিনী তার দুই মেয়েকে নিয়ে নিজের বাড়ি ফিরে গেল।
(৪১)
সূর্যকুমার কাজ থেকে অবসৃত হয়েছে। তাঁর পত্রের জবাব কলেজ সম্পাদকমণ্ডলীকে তুষ্ট করতে পারেনি। প্রতিষ্ঠানের কর্তাই যেখানে নিজের জামাতার কাজের জন্যে লজ্জিত এবং নিজে দুঃখ প্রকাশ করছেন, সেখানে অন্যেরা আর কীই বা বলতে পারে । অসততার মসৃণ আঁচড়ও ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে ছুরিকাঘাতের মতো। আসলে যে মানুষ সারা জীবন পরার্থে উৎসর্গ করেও বাংলাদেশে একক রয়ে গেলেন, স্বজাতির দোসর কাউকে পেলেন না, সহযোগীর অভাবে আজীবন একাত্ম নির্বাসনে রইলেন, নিজের মধ্যে যে অকৃত্রিম মনুষত্ব অনুভব করতেন, তা তাঁর চারপাশের জনমণ্ডলীর মাঝে তার আভাস দেখতে পেলেন না, তাঁর কাছে আপন পর, সব সমান।
দীনময়ীও অল্প কিছুদিনের মধ্যে শোক নিয়ে গ্রামে ফিরে গেছেন। ঈশ্বরচন্দ্রের এত বড় বাড়ি যেন এখন প্রেতপুরী। তিনি শুধু অপেক্ষা করছেন, তার কলেজের স্থানান্তকরণের কাজ সম্পন্ন করার জন্যে। কর্মাটাড়ে ফিরে যাবার মন করলেও দুরের পথে এখনই আর যেতে চাইছেন না। সামনেই কাজ রয়েছে। অথচ শরীর যেন আর টানছে না। ধারে কাছে কোথাও গিয়ে নিভৃতে কিছুদিন কাটাবার বাসনায় স্থির করে বসলেন, ফরাসডাঙা জায়গাটাকে।
শহর থেকে দূরে হলেও তত দূরে নয়, যেখান থেকে সহজে এক বেলায় ফিরে আসতে পারবেন না। গঙ্গার ধারের শতাব্দী প্রাচীন ফরাসী কলোনি । সাজানো গোছানো শহর। ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষে ফরাসীদের একমাত্র উপনিবেশ। ফরাসীরা তাদের দেশীয় স্থাপত্যে এখানের ঘর বাড়ি, গির্জা দোকান পাট তৈরী করে নিরিবিলিতে বসবাস করছে। মনোরম পরিবেশ। ধনী ফরাসীদের পাশাপাশি মধ্যবিত্ত, দরিদ্র ভারতবাসী সহাবস্থান করছে। সেখানেই একাকী চললেন। সঙ্গে তাঁর বিশ্বস্ত চাকর। দেখাশোনা, রান্নাবান্না, মায় অসুস্থ হলে সেবা শ্রুশুষার ভারও তার।
সেথায় ট্রেনের যাতায়াত আছে। ট্রেন তো এই লাইনেই প্রথম চালু হয়েছিল। যাচ্ছিল ফরাসডাঙার অনতি দূরের হুগলী পর্যন্ত। এখন না সেই ট্রেনের পথ বাড়তে বাড়তে কাশী-বেনারস, লক্ষৌ, কানপুর পৌঁছিয়ে গেছে। তাতে একবার কানপুর পর্যন্ত পাড়িও জমিয়েছিলেন তিনি। কিছুদিন কাটিয়ে এসেছেন। সেও এই শরীর স্থাস্থ্য উদ্ধারের কারণে।
এখন আর অতদূর যাবার মতো তাঁর শরীরের অবস্থা নয়। তাই এখানে এসেই ঠাঁই গাড়লেন। বাড়ি ভাড়ায় নিলেন। একেবারে গঙ্গার কিনারে। ভাড়া বাড়ির সুরক্ষা- পাঁচিলের গা গঙ্গার জল ধৌত করে যাচ্ছে অবিরত।
বাড়ির পশ্চিমের দালানে বসে তিনি সকাল বিকেল গঙ্গা দর্শন করেন। জলে ভেসে চলে ছোট থেকে বড় পোত। বেশির ভাগই বাণিজ্য তরী। কিছুবা, যাত্রীবাহী। দূর দূরান্তের যাত্রী নিয়ে বাষ্পীয় পোত ভেসে চলে গঙ্গায়। দূর দেশের জন্যে স্বল্প খরচের যান। নারী পুরুষ, কচিকাঁচা, গরীব, মধ্যবিত্তরা যায়।
ধনী ব্যক্তি বা বিদেশী ফরাসীদের জন্যে যে পোত চলে, তার গঠন, সাজসজ্জা, চাকচিক্যই আলাদা। তিনি দেখেন আর ভাবেন, কবে এ দেশের আম জনতা এমন তরীতে তরাতে পারবে? বা আদৌ তা পারবে কিনা? দেশ তো পরাধীন। দেশের ধনদৌলত সব ইংরেজ প্রভুদের হস্তগত। তায় এ দেশের আম জনতা অশিক্ষিত। অল্প কিছু সংখ্যক যা শিক্ষিতরা রয়েছে, তারা আর দেশের জন্যে ভাবে ক’জন? এমন সব চিন্তা ভাবনা নিয়ে আর সম্পূর্ণ কাজ বিহীন অবস্থায় যখন দিন কাটছে, তাঁর খোঁজ করে কলিকাতা থেকে দুই সাহেব এসে হাজির। তাঁরা ট্রেনে বা জলপথে নৌকোয় আসেনি। এসেছে শকটে। চার ঘোড়ায় টানা গাড়িতে।
ঈশ্বরচন্দ্রের বাড়ি খুঁজে গাড়ি দুয়ারে এসে দাঁড়াল। হ্যাট কোট পরিহিত দুই সাহেব ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। শকটের দরজা খুলেছে যানের দুপাশের পাদানিতে দাঁড়িয়ে থাকা দুই বেয়ারা। রীতিমতো উর্দি , টুপি পরিহিত ষণ্ডাগণ্ডা পালোয়ানী চেহারা তাদের। ঈশ্বরচন্দ্র বাড়ির বারন্দা থেকে সাহেবদের দেখলেন; তবে সঠিক অনুধাবন করতে পারলেন না, এঁরা কারা? চাকরকে ডেকে খোঁজ নিতে পাঠালেন, ওনারা কে, কার কাছে এসেছে, তা জানবার জন্যে।
চাকর সাহেবদের বাংলায় প্রশ্ন করল, তোমরা কে? কাকে চাইছ?
বাংলা ভাষা বুঝবে কেমন করে সাহেব?তবু আন্দাজে যা বুঝল, তাতে তারা ঈশ্বরচন্দ্রের নাম বলল। তা শুনে চাকর সটান উপরে এসে ঈশ্বরচন্দ্রকে জানান দিল। তিনি তাড়াতাড়ি গায়ে চাদরটা জড়িয়ে নিয়ে চটি পরে নিচে নেমে এসে সাহেবদের অভ্যর্থনা জানালেন। বললেন, আমিই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। উত্তর অবশ্য তাঁর ইংরেজিতে ছিল। হাত বাড়িয়ে সাহেবরা করমর্দনে আহ্বান জানাল তাঁকে। তিনিও হাত বাড়ালেন। করমর্দন সারলেন। দুজনকে আহ্বান করে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গিয়ে বসালেন।
ছোট ঘর। ঘরের এপাশ ওপাশ করে জানলা। আলো বাতাসের অভাব হচ্ছিল না। খোলা জানলায় চোখ রাখলে গঙ্গা দর্শনও হয়। একটা খাট, তিন চারটে চেয়ার, একটা ছোট মতো লেখার টেবিল, তাতে ঈশ্বরচন্দ্রের নিত্য সঙ্গী দোয়াত কলম আর কাগজের বান্ডিল রাখা। এই ঘরে বসে তিনি লেখালেখির কাজ সারেন। তবে এখন খুব একটা বেশি সময় তাতে দেন না। বেশিরভাগ সময়ই তিনি বিশ্রামে থাকছেন।
সাহেবদের চেয়ার দেখিয়ে বসবার আহ্বান জানাতে তাঁরা উপবেশন করল। নিজের পরিচয় দিল দুজনে। একজন হচ্ছে, বীটন সাহেবের ভাইপো; অপরজনের পরিচিতি সেরকম কিছু নয়। তবে হ্যালিডে সাহেব তাকে ওই ভাইপো সাহেবের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে পাঠিয়েছেন। নাম তার জিমি জ্যাকব। হ্যলিডে সাহেবের অধীনে কাজ করেছে। যদিবা মিঃ হ্যলিডে এখন চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। আর বীটন সাহেবের ভাইপোর নাম, উইলিয়াম বীটন। সে বিদ্যাসাগরের কাছে এসেছে এক বিশেষ কাজে। বয়সে নবীন। পুরোপুরি বিলিতি সাহেব।
উইলিয়ামের আসবার উদেশ্যটা ব্যক্ত করতে গিয়ে সে জানাল, মিঃ বীটন তাঁর জীবিতকালে বেথুন ইশকুল ও কলেজের জন্যে যে জমি কিনে প্রতিষ্ঠানকে দান করে গিয়েছেন, সেই নথির খোঁজ করছে সে।
ঈশ্বরচন্দ্র একটু অবাক হলেন। এত বছর পর! ওই দানপত্র সম্বলিত নথির খোঁজ করতে উজান বেয়ে ইংরেজ যুবক নিজের দেশ থেকে ভারতবর্ষে এসেছে; শুধু তাই নয়, কলিকাতা থেকে আবার এই ফরাসডাঙ্গায় একেবারে তাঁর কাছে এসে উপস্থিত হয়েছে, তাতেই তিনি আশ্চর্য হচ্ছেন। প্রশ্ন রাখলেন, নথি খোঁজার প্রয়োজনটা তাঁর জানাতে কি কোনও আপত্তি রয়েছে?
-ওহ…, নট। অ্যাবসলিউটলি নো অবজেকশন , স্যার।
-তবে?
-আমি আমার জ্যাঠার জীবন নিয়ে কিছু কাজ করছি। আমার রিসার্চ পেপার। তাই ওই নথির দরকার হয়ে পড়েছে, স্যার।
কথপোকথন ইংরেজিতেই চলছে। ঈশ্বরচন্দ্র জানতে চাইলেন, তাঁরা কি কফি পান পছন্দ করবেন?
কফিরই চলন এখন। ঈশ্বরচন্দ্রের অবশ্য বস্তুটায় কোনও আগ্রহ নেই। কারণ তিনি একমাত্র তামাকু সেবন ছাড়া অন্য কিছুতে আসক্ত নন। তবু কফির একটা কৌটো তাঁর ভাঁড়ারে স্থান করে নিয়েছে যেহেতু মাঝে মাঝেই ইংরেজদের তার গৃহে আনাগোনা রয়েছে। তাঁদের আপ্যায়নের জন্যে কফি বস্তুটা অতি উত্তম।
উইলিয়াম উত্তর করল, তাহলে তো খুবই ভালো হয়। কারণ দিন কয়েক হয় শীতটা জাঁকিয়ে পড়েছে।
-তোমাদের ইংল্যান্ড থেকেও কি বেশি শীত এদেশে? ঈশ্বরচন্দ্র হাসতে হাসতে প্রশ্ন করলেন।
-না, তা নয়। তবে, আপনার এই ফরাসডাঙা জায়গাটায় এসে খুব ঠাণ্ডা লাগছে।
-ফরাসীদের জায়গায় ইংরেজ এসেছে কিনা। হা, হা, হা।
সাহেবও হেসে প্রত্যুত্তর দিল। ঈশ্বরচন্দ্র এক্সিউজ মী ফর ফিউ মিনিটস, বলে, অনুমতি নিয়ে নিজে গিয়ে ঢুকলেন রান্নাঘরে। কফির মতো পানীয়টা বানানো যে তাঁর চাকরের পক্ষে খুব সহজ হবে না, তা জেনেই তিনি নিজে তা বানাতে শুরু করলেন। কফি বানালেন এবং এনে দুজনের হাতে কফি ভর্তি কাপপ্লেট তুলে দিলেন।
নিজে বসলেন গড়গড়া নিয়ে। কথাবার্তা চলতে থাকল। বললেন, দেখুন, আমি যতদিন ওই কলেজ পরিচালন মণ্ডলীর একজন ছিলাম, আমি জানতাম সে নথি কলেজেরই মহাফেজখানায় রাখা রয়েছে। তবে এখন তো বহুদিন হয় আমি আর সেখানে যুক্ত নই, তাই সঠিক বলতে পারলাম না। কিন্তু আমার নাম তোমার কাছে কে নিয়েছে, উইলিয়াম?
-ওই কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ। পরে আমি বর্তমান পরিচালক মণ্ডলীর কাছেও জিজ্ঞেস করেছিলাম। তাঁরাই তোমার নাম নিয়েছে।
-তাহলে তো বিষয়টা আমাকে চিন্তা করে দেখতে হয়।
ঈশ্বরচন্দ্র খানিকটা চিন্তিত হলেন। তাঁর চিন্তা আরও বেশি, যেহেতু বিষয়টা খোদ বীটন সাহেবকে নিয়ে। দেশের নারী শিক্ষায় তাঁর অবদান তো ভোলবার নয়? এ ইতিহাস ততদিন জীবিত থাকবে, যতদিন ভারতবর্ষ তথা বাঙলায় নারীজাতি মাথা উঁচু করে চলবে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁকে স্মরণে রাখা কর্তব্য। নারীজাতির উত্থানেই দেশের উন্নতি…
ভাবতে ভাবতে সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুমি যদি মিঃ বীটনের জীবনের ওপর কাজের জন্যে সুদূর ইংল্যান্ড থেকে চার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে এ দেশে আসতে পার, তাহলে, আমার জন্যে দশটা দিন বরাদ্দ করো, আমি তোমাকে সাহায্য করে যথাযথ বস্তু হাতে তুলে দেব।…শিগগীর আমাকে কলিকাতায় ফিরতে হবে।
ঈশ্বরচন্দ্রের আশ্বাসে উইলিয়াম সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে গেল। ঈশ্বরচন্দ্রও কলিকাতায় ফিরলেন চারদিনের মাথায়। নিরিবিলিতে বসে বিশ্রাম নেওয়া তাঁর মাথায় উঠল।
কলিকাতায় পা রাখার ছ দিনের মাথায় তিনি কাজ সমাধা করে নিজে গিয়ে উইলিয়াম বীটনের হাতে সেই নথি তুলে দিলেন।
একবার যখন কলিকাতায় এসে পড়লেন, আর এদিক ওদিক নড়লেন না। সোজা কলেজের নতুন বাড়ির কাজ নিয়ে পড়লেন। যত শিগগীর সম্ভব তা শেষ করে নতুন ভবনে কলেজ চালু করে দিতে হবে। কারণ, তিনি নিজেও জানেন না, অসুস্থতায় তাঁর শরীরের গতিক কোন দিকে যাবে; কতদিন তাঁর পরমায়ু রয়েছে।
মাস খানেক সময় লাগল। নতুন ভবন শেষ হল। এবার কলেজের স্থান পরিবর্তের কাজ।
কলেজের নতুন বাড়ির উদ্বোধন সমারোহ চলছে। বহু গণ্যমান্য অতিথি আমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন। ঈশ্বরচন্দ্র তাঁদেরকে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবার জন্যে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
অতিথি আসনে বসা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রমাপ্রসাদ রায় (রাজা রামমোহন রায়ের পুত্র), ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার, বাবু শ্রীযুক্ত রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীযুক্ত ব্রজনাথ মুখোপাধ্যায়, সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিম চন্দ্র চট্যোপাধ্যায়, অক্ষয়কুমার দত্ত (অতীতে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক। বিশেষ আমন্ত্রণে অতীব ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়েও এসেছেন), হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনবন্ধু বিদ্যারত্ন, শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, স্যার জেমস কলভিন (অবসর প্রাপ্ত সুপ্রিম কোর্ট বিচারপতি), এফ যে হেলিডে (প্রাক্তন লেফট্যেন্যান্ট গভর্নর), ডব্লিউ গরডন ইয়ং (প্রাক্তন ডাইরেক্টর অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন) প্রভৃতি বর্ষীয়ান ব্যক্তিরা।
নব্যদের মধ্যে কবি রবীন্দ্রনাথ, ডাঃ নীলরতন সরকার, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, চন্ডীচরণ এবং কয়েকজন ইংরেজ যুবক যাঁরা বিভন্ন সরকারী পদে অধিষ্ঠিত।
চাঁদের হাট বসিয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্র। তিনি তাঁর এই অবিস্মরণীয় কীর্তির সাক্ষী রাখবার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন সমাজের তাবড় গণ্যমান্য ব্যক্তিত্বদের জড়ো করে।
অনুষ্ঠানে ছোটলাটেরও আসবার আমন্ত্রণ ছিল। তিনি সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন। তবে কোনও এক বিশেষ কাজে আটকে পড়ায় তিনি সশরীরে উপস্থিত থাকতে না পারলেও, তাঁর লিখিত ভাষণ পাঠিয়ে দিয়েছেন। সভার শুরুতে সেই ভাষণ পড়ে শোনানো হয়েছে।
এখন সভার অন্যান্য অনুষ্ঠান চলছে। কলেজের অগুনতি ছাত্রের দল এসে ভিড় করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সঙ্গে শিক্ষককুল দামাল ছাত্রের দলকে সামলাচ্ছে আর অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় ব্যস্ত রেখেছে নিজেদের। সকলের মনেই আনন্দ। কলেজ নতুন বাড়িতে স্থানান্তরিত হবে। শ্রেণী কক্ষে যে জায়গার সমস্যা নিয়ে এতদিন তাদের শিক্ষা নিতে হত, তার অবসান ঘটতে চলেছে।
মঞ্চে ছোটলাটের জন্যে বরাদ্দ প্রধান অতিথির চেয়ারটা খালি রেখে অন্যান্য চেয়ারে বিশেষ অতিথিদের ডেকে নেওয়া হয়েছে। সভাপতিত্ব করছেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিশেষ বক্তা হিসেবে হ্যালিডে সাহেব, বঙ্কিম চন্দ্র চ্যাটুজ্যে। সকলের মাঝে ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর বিশেষ আসন অলঙ্কৃত করে বসে রয়েছেন। সভার পরিচালন ভার তুলে দেওয়া হয়েছে দীনবন্ধু ন্যায়রত্নের হাতে। সুস্থভাবেই তিনি সভার পরিচালনা করে চলেছেন।
বক্তারা সকলে একে একে তাঁদের বক্তব্য রাখছেন। বক্তাদের যেমন আভিজাত্য; তেমনই জ্ঞানের পরিধি। বক্তৃতা অতি মূল্যবান তথ্যে সমৃদ্ধ। দিকপাল ব্যক্তিত্বদের বক্তৃতা মনোযোগের সঙ্গে অনুধাবন করছে আম শ্রোতৃবৃন্দ। মা’য় স্বল্প বয়সী ছাত্রকুলও।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ যে বক্তব্য রাখলেন, তা সকলের মন কাড়ল। শিক্ষার প্রসার, নারীশিক্ষা ও তার উদ্যোগকর্তা ঈশ্বরচন্দ্রকে তিনি ব্যক্ত করলেন একটি সংস্কৃত শ্লোকের মাধ্যমে-,
‘তরবোহপি হি জীবন্তি জীবন্তি মৃগপক্ষিণঃ।
স জিবতি মনো যস্য মননেন হি জীবতি।।
‘তরুলতাও জীবন ধারণ করে, পশুপক্ষীও জীবন ধারণ করে; কিন্তু সেই জীবিত, যে মননের দ্বারা জীবিত থাকে। মনের জীবন মননক্রিয়া এবং সেই জীবনেই মনুষ্যত্ব।…’
এভাবেই দীর্ঘ এক বক্তব্য রেখে মহর্ষি ভাষণ শেষ করলেন। তুমুল করতালি ও হর্ষধ্বনির মধ্যে দিয়ে বক্তৃতা শেষ হল।
শেষ ধন্যবাদ জ্ঞাপক বক্তব্য রাখলেন দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন। সকল বক্তা, উপস্থিত মহামান্য ব্যক্তিত্ব ও অন্যান্য শ্রোতৃকুলকে যথপোযুক্ত ধন্যবাদ জ্ঞাপন শেষে তিনি বললেন, কলেজ স্রষ্টা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসগরের ভ্রাতা হতে পেরে আমি ধন্য। শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের অবদানকে একদিন সমগ্র বাঙালি তথা ভারতবাসী স্মরণ করবে। আগামী শতাব্দী ধরে তাঁর জীবন বাঙালির কাছে প্রেরণার উৎস হবে।
চলবে…