উপন্যাস।। আবার এসো ফিরে।। রামেশ্বর দত্ত

 নাতি বীরসিংহে এলেই ঈশ্বরচন্দ্রের মন বাড়ির দিকে টানতে থাকে। কখন সেখানে যাবেন, কতক্ষণে নাতিকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করবেন।  আসলের চেয়ে সুদ বেশি মিষ্টি- চিরন্তন বিষয়। যতই কিনা তিনি বইলেখা, ইশকুল বানানো,  ইনিস্টিটিউট গড়ুন, তাঁর অন্তর যে স্নেহছায়াময়, মমতার অতলে ডুবে থাকে, তা তিনি এখন নাতির সান্নিদ্ধে আসলে ভালই বুঝতে পারেন।

এরপর…

পর্ব-২১ 

 

সদা নির্মল আকাশ। কোথাও কোনও মেঘ নেই। দিব্যি রৌদ্র ঝকমলে দিন। ধরায় মানুষ খাচ্ছে, শুচ্ছে, নিত্যকার কাজকর্ম করছে। কৃষক মাঠে গরু নিয়ে চাষে যাচ্ছে। গোয়ালা গরুর দুধ দুইয়ে ঘরে ঘরে তা বিক্রি করে আসছে। পথযাত্রী নির্বিঘ্নে পথ ভাঙছে। দামোদরের ঘাটে ফেরি এসে ভিড়ছে। মানুষ ওঠা নামা করছে। ঘর পৌঁছচ্ছে। দোকানী দোকান করছে। খরিদ্দার মাল কিনছে। ছেলেমেয়েরা ইশকুল যাচ্ছে। বাড়ির গিন্নী তাদের ভাত খাইয়ে জামাকাপড় পরিয়ে ইশকুলে পাঠাচ্ছে।… সব নিয়ম মতো চলছে; কারণ আকাশে কোথাও মেঘ নেই। ঝড়ের কোনও পূর্বাভাষ নেই।

তবু ঝড় এল। আকাশের ঈশান কোণে মেঘ দেখা দিল। ধীরে ধীরে তা প্রলয়ের রূপ নিল। সুস্থ স্বচ্ছন্দের পৃথিবীকে ওলট পালট করতে ঝড় এসেছে । কোথা দিয়ে তার উদয়, হদিস জানে না কেউ। দুঃস্বপ্নের দোসর হয়ে তার আবির্ভাব।

বীরসিংহ গ্রামের ঠাকুরদাস পরিবারে আজ সেই রকমই এক দুঃস্বপ্নের আগমন ঘটল। বাড়ির কর্তাই ঘুমের মাঝে সেই দুঃস্বপ্ন দেখলেন ।

ঠাকুরদাস স্বপ্ন দেখলেন, তাঁর সুখশান্তির দিনগুলোর অবসান হয়েছে।   সংসারে কালের করাল মেঘ প্রবেশ করছে। ভোররাতে দেখা স্বপ্ন। যদিবা তা স্বপ্নই। তবু সে কথা তিনি কারোও কাছে ভাঙলেন না। আবার চুপ করেও থাকতে পারলেন না। স্বপ্নে তিনি দেখেছেন, বীরসিংহের বাড়ি শ্মশান হবে, বড়ছেলের সহোদরবিচ্ছেদ হবে, বন্ধুবিরোধ ঘটবে, আত্মীয়স্বজন বিরূপ হবে…। হায় হায় করে উঠলেন তিনি।

তিনি স্বপ্ন বিশ্বাস করছেন। শুধু কি বিশ্বাস? তা যাচাই করবার জন্যে পণ্ডিত গঙ্গানারায়ণ ভট্টাচার্যকে ডাকলেন। সকলের অগোচরে পণ্ডিতকে দিয়ে নিজের কোষ্ঠী গোণা করালেন। কী আশ্চর্য!  এ তো তাঁর কোষ্ঠীতেই লেখা রয়েছে-এই সময়ে তাঁর শনির দশা হবে। স্বপ্নে যা যা দেখেছেন, তার সবকটাই ফলবে।

পণ্ডিত আরও জানাল, এই স্থানে থেকে ঠাকুরদাস একদিনের জন্যেও সুখী হবে না। একস্থানে স্থায়ী হবে না। নতুন নতুন জায়গায় গিয়ে বসবাসের ইচ্ছে হবে।

মহা ভাবনায় পড়লেন তিনি। এ কোন অশনি সংকেত? শেষে কি জীবন সায়াহ্ণে এসে তাঁর গড়া সংসারে ভাঙাহাট দেখতে হবে? ভাবলেন, এর থেকে ভালো, বানপ্রস্থ নেওয়া। অন্যত্র কোথাও গিয়ে ঠাকুরের নামগান করে জীবনের বাকিদিনগুলো কাটিয়ে পরপারে যাওয়া।

অন্যত্র মানে তো, হিন্দুধর্মে বৃদ্ধ–বৃদ্ধাদের স্থান হয় কাশী, নচেৎ  মথুরা-বৃন্দাবন। বাবা বিশ্বনাথ নয় তো রাধাকৃষ্ণের  চরণে আশ্রয় নেওয়া। বেশিরভাগই চায় কাশীবাস। করতলধৌত পাপ নাশিনী গঙ্গার স্পর্শে থেকে জীবনের শেষদিন মণিকর্ণিকার ঘাটে দেহকে বিলীন করে  পরজন্মের জন্যে পুণ্যির সঞ্চয় করতে চায় । ঠাকুরদাসেরও মন চাইল, বানপ্রস্থে কাশীবাসী হবার। মনের কথা বললেন শম্ভুচন্দ্রকে। শুনে তো শম্ভুচন্দ্র অবাক! প্রশ্ন করল,  হঠাৎ! কেন তোমার হলটা কি?

-বয়স তো হল। আর কতদিন সংসারের হাল ধরে বসে থাকব? তাছাড়া তোমরা এখন সকলে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছ। আমাকে ছুটি দাও।  একথা তিনি বলছেন; কিন্তু সদ্য দেখা স্বপনের কথা মাথায় খেলছে। ভাঙছেন না মুখ ফুটে।

-বিষয়টা নিয়ে আমাকে বলছ বটে, তবে তুমি তো জানো, বড়দার সঙ্গে আলোচনা না করে আমি তোমাকে কোনও মত দিতে পারি কি?

-সে এখন কোথায়? কলিকাতায় আছে তো?

-মনে হয় না। খোঁজ নিতে হবে।

-নাও। শীঘ্র নিতে পারলেই ভালো হয়।

-মায়ের সঙ্গে আলোচনা করবে না?

-অবশ্যই করব। জানি, তোমার মাতৃদেবী কী বলবে। তবে, আমি তাকে মানিয়ে নিতে পারব। তুমি বরং ঈশ্বরের সঙ্গে কথাটা সেরে আমাকে জানাও।

-ঠিক আছে। দাদার খোঁজ নিচ্ছি।

ঈশ্বরচন্দ্র তখন কলিকাতায় নেই। অসুস্থ বন্ধুকে দেখতে গেছেন। বন্ধু,  রাজা প্রতাপচন্দ্র। তাঁর বাস মুর্শিদাবাদের কান্দিতে। সেখানে গেছেন। পরম বন্ধু ভীষণ অসুস্থ। নিজে হাতে তাঁর সেবার ভার তুলে নিয়েছেন।

এমন সময়ে হঠাৎ চিঠি গিয়ে পৌঁছল। খামের ওপরে লেখা শম্ভুচন্দ্রের নাম। আশ্চর্য হলেন, এই ঠিকানায় ভাইয়ের চিঠি!

খাম খুলে চিঠি পড়তে লাগলেন। পড়া যত এগোচ্ছে, ততই বিস্ময়ে আবিষ্ট হয়ে পড়ছেন। বাবার যে এমন মতি কেমন করে আসল, তা ভেবে পাচ্ছেন না। কী হল? সংসারে কোনও গোলযোগ? না, তাও তো হবার নয়। সুখের সংসার দেখে এসেছেন । এই ক’দিনে এমন কী ঘটল যে বাবা কাশী যাবার মনস্থ করে ফেলেছেন!…

কথাগুলো ভাবছেন। স্থির করলেন চিঠি দিয়ে বাবাকে আপাতত নিরস্ত করবেন। শম্ভুচন্দ্রের চিঠির উত্তর লিখতে বসলেন,-

পূজ্যপাদ শ্রীমৎ পিতৃদেব শ্রীচরণবিন্দেষু

প্রণতিপূরবকং নিবেদনম-

বর্তমানে আমি কান্দীতে আছি। সুহৃদের চিকিৎসায় ব্যপৃত। শম্ভুচন্দ্র পত্র দিয়েছে।  তাতেই জানলাম, আপনি কাশী যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। উত্তম কথা। শম্ভুচন্দ্র অবশ্য এও জানিয়েছে, আপনি সেখানে বাসা গাড়তে ইচ্ছুক। দেখুন, কাশী দর্শন করতে চান তো, এক কথা। তা সত্বর ব্যবস্থা করা যেতেই পারে। তবে, সেখানে স্থায়ী বাস গাড়তে হলে, আমার কিঞ্চিত আপত্তি রয়েছে। জানি না, হঠাৎ আপনার এ ইচ্ছে কেন হল। সংসারে আপনি এখনও মাথার ওপরে রয়েছেন, এটাই আমাদের কাছে অনেক ভরসা। আপনি যে আমাদের সকলের ভরসাস্থল, তা ভালো মতোই আপনি জানেন। তবুও কেন সেখানে গিয়ে থাকতে চান, তা আমার জানার প্রয়োজন রয়েছে।

এতদসত্বেও বলি, সেখানে যে একলা আপনার বয়সে বাস করা একেবারেই সমীচীন নয়, বা তা আমার মনোমতো কাজ হবে না, এটাও জানবেন। তবে আমি গ্রামে না ফেরা পর্যন্ত যেন এ বিষয়ে কোনও স্থির সিন্ধান্ত নেবেন না। এখানে আমার সুহৃদ খুবই অসুস্থ। ফেরায় দিন কতক সময় লাগবে।

প্রণতি পূর্বক

আপনার একান্ত অনুগত পুত্র,

ঈশ্বরচন্দ্র শরমণঃ

পত্র ডাকযোগে পাঠিয়ে দিলেন। নিজে ব্যস্ত রইলেন প্রতাপচন্দ্রের সেবা শুশ্রূষায়।

দিন পনের পরে প্রতাপচন্দ্র সামান্য সুস্থ হতে ঈশ্বরচন্দ্র কান্দী ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন। বীরসিংহে পৌঁছলেন দুদিনের মাথায়। এসেছেন, গোরুর গাড়ি আর পাল্কী চেপে। শেষের পথ পায়ে হেঁটে।

বাড়িতে এসে দেখেন, ঠাকুরদাস বেশ মন মরা হয়ে রয়েছেন।  দেখে কষ্ট পেলেন । ধীরেসুস্থে কথা পারলেন । জানতে চাইলেন, তিনি  যে কাশীবাসী হতে ইচ্ছা প্রকাশ করছেন, তার হেতু কী?

ঠাকুরদাস বললেন, কতকাল আর সংসার আগলে বসে থাকব, বাবা? এখন আমি এসব থেকে মুক্ত হতে চাই।  কাশীবিশ্বনাথের চরণে গিয়ে ঠাঁই নেব বলে মনস্থির করেছি। তোমার ফেরবার অপেক্ষাতেই ছিলাম।

ঈশ্বরচন্দ্র সন্তুষ্ট হল না। বললেন, বিশ্বনাথের দর্শন নিয়ে ফিরে আসুন। সে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

-তা হলে, সে কথাই বলতাম। কিন্তু মন চাইছে, সেখানে গিয়েই জীবনের বাকিকটা দিন কাটিয়ে পরপারে যেতে।

আসলে, শম্ভুচন্দ্রের মতোই বড় ছেলেকেও ঠাকুরদাস জানাতে পারছেন না স্বপ্ন দেখার কথা, বা কুষ্ঠি বিচারের ফল।  গঙ্গানারায়ণ পণ্ডিতের বারণ রয়েছে। বলে গেছে, সংসারের ভাঙনের কথা শুনলে, ঈশ্বরচন্দ্র তাকেই না জেরা করে বসে। ওসবে সে বিশ্বাসী নয়, তা পণ্ডিতের জানা।

বাবার কথার জবাবে ঈশ্বরচন্দ্র ফের প্রশ্ন তুললেন, সেখানে গিয়ে একলা থাকবেন কি করে?

ঠাকুরদাস বললেন, কেন? সকলে যেভাবে থাকে, আমিও তাই থাকব।

-রান্নাবান্না করতে হবে, অসুখ-বিসুখ রয়েছে, সব কি একলা সামলাবার কাজ? তায় আপনার বয়স হয়েছে।

উত্তর এলো, এই বয়সে কাশীবাসই তো সর্বোৎকৃষ্ট, ঈশ্বর।

ঈশ্বরচন্দ্র ক্ষণেক চুপ করে থাকলেন। এ বিষয়ে মায়ের মত জানতে চাইলেন। ঠাকুরদাস বিস্তৃতে গেলেন না। শুধু বললেন, তোমার মা, তোমরা, না হয় মাঝে মাঝে সেখানে এসো। দেখা করে যাবে। তাতে তোমাদের চিন্তার অবসান হবে। আমারও ভালো লাগবে।

-চিন্তার অবসান এভাবে হয় না, বাবা । সব থেকে ভালো হয়, আপনার এই মত পরিবর্তন করলে।

-ঈশ্বর, আমাকে এ থেকে পিছিয়ে আসতে বোলো না। বরং দ্রুত আমার কাশী যাবার ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হয়।

অনুরোধ, উপরোধের বেড়া টপকে প্রস্তাবকে একেবারে সোজা সাপটা সামনে এনে হাজির করলেন ঠাকুরদাস। এরপর আর কী বা বলবার থাকতে পারে? নিজেই যেখানে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, সেখানে বেশি জোড় দিয়ে তা বন্ধ করে দেওয়ার অর্থ গুরুজনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাওয়া; তাঁর মনকষ্ট বাড়ানো, ঈশ্বরচন্দ্র ভাবলেন।

-আগে আমার সঙ্গে কলিকাতায় চলুন। সেখান থেকে আপনি কাশীযাত্রা করবেন। আমি নিজে গিয়ে আপনার থাকার সব বন্দোবস্ত করে দিয়ে আসব।

ঈশ্বরচন্দ্রের  প্রস্তাব ঠাকুরদাস মেনে নিলেন। সেইরকমই সব এগোচ্ছে। মাঝ থেকে আত্মীয়স্বজনের কাকুতিমিনতি আসছে। ঠাকুরদাস শুনছেন না। খবর গ্রামে ছড়িয়ে গেছে। কি? না, ঠাকুরদাস বন্দোপাধ্যায় ঘরবাড়ি, গ্রাম ছেড়ে কাশীধামে চলে যাচ্ছেন।

বন্ধু, শুভানুধ্যায়ী বয়স্ক পাড়াপ্রতিবেশি অনুরোধ জানাতে এল। বলল,  বাড়ুজ্জ্যেমশাই, এমন সুখের সংসার ছেড়ে কাশী চলে যাচ্ছেন কেন?

-যৌবনে গ্রাহস্থ্য, বার্ধক্যে বানারসী, এ তো বিজ্ঞজনদের কথা। তায়, আমি  কাশীবাসী হয়ে তাঁদের কথাকেই স্বীকৃতি দিচ্ছি। এতে আর নতুন কী?   ঠাকুরদাসের উত্তর।

-সে তো বটেই। তবে, আপনার সব সুযোগ্য সন্তানরা থাকতে আপনি গৃহ ছাড়া হয়ে থাকবেন? তাই কি হয়?

-সন্তান সুযোগ্য বলেই কি আর সংসার আঁকড়ে বসে থাকব? সারাজীবন এই করলে, ঠাকুরের নামগান করব কবে? কাশী গেলে বরং সকাল সন্ধ্যে গঙ্গা নেয়ে বাবা বিশ্বনাথের চরণে মাথা ঠুকে প্রনাম জানিয়ে পরলোকে যাবার পথটা সাফ করতে পারব।

-সবই তো বুঝলাম, কিন্তু আপনার বয়স হয়েছে, একলা থাকতে অসুবিধা বোধ করবেন।

-জলে পড়লে মানুষ সাঁতরাতে শেখে। আমাকেও না হয় তাই করতে হবে।

কান্নাকাটি করলেন জনা কয়েক বয়স্ক মানুষ। তবু কিছুতেই তাঁর মনের পরিবর্তন করা গেল না।

বাড়িতেও একই অবস্থা। সেখানের মানুষরাও বুঝিয়ে পেরে উঠছে না। শেষে নারায়ণচন্দ্রকে বলা হল, ঠাকুরদাকে মানানোর জন্যে। প্রিয় পৌত্রের কথায় যদি কাজ হয়। নারায়ণ যদিবা এখন আর সেই ছোটটি নেই; তবু তার ওপর ঠাকুরদাস এখনও দুর্বল। নাতির কথা ফেলতে পারেন না। সে গিয়ে ঠাকুরদাসের কাছে বায়না ধরল,  দাদু, তুমি যদি কাশী যাও, তাহলে আমিও তোমার সঙ্গে যাব।

-দূর বোকা। তোর কি এখন সেখেনে যেয়ে থাকবার বয়স হয়েছে? তুই লেখাপড়া করছিস। এরপর চাকরি করবি, বিয়ে হবে। সংসার পাতবি…

নাতিকে বোঝানো শুরু করলেন ঠাকুরদাস। নাতিও নাছোড়বান্দা, -না, ওসব বললে শুনব না। হয় তুমি আমাদের সকলকে সেখেনে নিয়ে চলো, না হলে, তুমিও যাবে না।

-এমন আবদার করিস না, বাপ। আমায় যেতে দেয়ে, তোরা বরং মাঝেসাঝে আসবি। দাদুর কাছে বেড়াতে আসবি…

নানান কথায় ঠাকুরদাস নাতিকেও মানিয়ে অবশেষে একদিন কলিকাতায় চললেন।  ছেলের সঙ্গে কথা হয়েছে, মাঝপথে সেখানে তাঁর আবাসে কয়েকদিন থাকবেন। তিনিই বাবাকে কাশীতে পৌঁছিয়ে থাকবার সুবন্দোবস্ত করে ফিরবেন। আসলে ঈশ্বরচন্দ্র তখনও ভাবছেন, এই করে যদি বাবাকে কাশীবাস থেকে বিরত করা যায়।

কোনও সন্তানের মন কি চায়, বৃদ্ধ পিতাকে একলা দূরে ফেলে রাখতে? তা তিনি যতই কিনা স্বেচ্ছায় তা করুন। অনুনয় বিনয় শুরু হল আবার, বাবা, আপনি বীরসিংহে ফেরত যান। তাতেই আমার শান্তি হবে। মন আমার কিছুতেই চাইছে না, আপনি অতদূরে গিয়ে একলা একলা পড়ে থাকবেন। আপনি গ্রামে ফিরে যান।

ঠাকুরদাস ভাবনায় পড়লেন। বললেন, আমায় সময় দাও। ভেবে দেখি।

পরিস্থিতি কিছুটা অনুকূলে ফিরছে। ঈশ্বরচন্দ্র দিনক্ষণের জন্যে টালবাহানা করছেন। হঠাৎ একদিন ঠাকুরদাসের মনে হল, ছোট ছেলেও তো কলিকাতাতেই  রয়েছে, এ বিষয়ে তার কী মত, সেটাই বা কেন জেনে নেন না?

ঈশানচন্দ্রকে ডাকলেন। বললেন, তুমি তো আমার কাশী যাবার কথা নিশ্চয়ই শুনেছ? কিন্তু তোমার বড়দাদা আমাকে গ্রামে ফিরে যাবার জন্যে পীড়াপীড়ি করছে, এতে তোমার কী মত?

-বাবা, আমার তো মনে হয়, দেশে ফিরে গিয়ে সংসারী ভাবে থাকা আর আপনার উচিত নয়, এই সময়ে আপনার কাশীধামে গিয়ে বাস করাই উচিত।

দুর্মুখ ঈশানচন্দ্র বড়দার মনের অবস্থাটা  বুঝল, কী বুঝল না, কঠিন কথাটা আলটপকা বলে দিল। তাতেই ঠাকুরদাসের মন বেঁকে বসল।

যেখানে একজনকে কাছে ধরে রাখবার জন্যে সংসার নামের নিক্তিটা নিরপেক্ষতা বজায় রেখে চলেছে ; সেখানে শুধু এক সন্তানের ইচ্ছে কিনা নিক্তির নিরপেক্ষতাটাকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিল?  আসলে তা নয়,- মানুষের ভালবাসার প্রতিরূপ প্রকাশ পায় তো তার কথায়-তাছাড়াও এটা তো মানতেই হয়, সুভাষী সন্তান পিতামাতাকে যেমন স্বর্গবাসের সুখ এনে দেয়, তেমনই দুর্মুখ সন্তান তাঁদের জন্যে নরকের দ্বার সুগম করে তোলে।

ছোটভাইয়ের কথাটা কানে যেতে ঈশ্বরচন্দ্র তাঁকে যতপরনাস্তি বকাঝকা করলেন। কিন্তু ফল ততক্ষণে যা হবার তা হয়ে গেছে। ঠাকুরদাস মন স্থির করে ফেলেছেন। গ্রামে আর ফিরবেন না। কাশীই যাবেন। সংসারে একজন হলেও তো, একজন অন্ততঃ তাঁর গৃহবাস থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। আর ঈশান কিছু বাচ্ছা ছেলে নয়? ঘর গেরস্থি করা বিবাহিত সন্তান।

ঈশ্বরচন্দ্র তখনও তাঁর আশায় কুঠারাঘাত হানলেন না।  বাবার কাশী যাওয়া দিন পনেরো পিছিয়ে দিলেন। বললেন, বাবা, আপনি চলে যাচ্ছেন। সেকারণে আমাদের চিত্ত বিনোদনের জন্যে তো কেউ থাকবে না। তাই আপনার একখানা ছবি আঁকিয়ে নিতে চাই। তাতে পনের দিন সময় লাগবে।

ঈশ্বরচন্দ্রের মনে তখনও আশা, মাঝের পনেরো দিনে বাবা যদি মত পরিবর্তন করে?

একশত টাকা খরচ করে ইংরেজ হাডসন সাহেবকে ভাড়া করলেন। হাডসন ভালো চিত্র আকে। তাঁর আঁকা ছবির মানুষকে জান্ত মনে হয়। আগেও ঈশ্বরচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর মোলাকাত হয়েছে। ঈশ্বরচন্দ্রের ছবি এঁকে দিয়েছিলেন। পাইকপাড়ার রাজবাটীতে বসিয়ে। টাকা দিতে চেয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। টাকা নেয়নি। ছবি উপহার দিয়েছিল। ঈশ্বরচন্দ্রের গুণগ্রাহী ব্যক্তি।  সেই হাডসনকে দিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বাবার ছবি আঁকালেন। তাতে দশ দিন সময় কাটল। ঠাকুরদাস রোজই যান। আঁকা একটু একটু করে এগোয়। ঠাকুরদাস কোনও কথা তোলেন না। প্রসঙ্গ ওঠালেন, আঁকা শেষ হতে। বললেন, বাবা ঈশ্বর, অনেকদিন তো গেল।।  এবার কাশী যাবার ব্যবস্থা করো।

-তাহলে মানলে না বাবা আমার কথা?

ঈশ্বরচন্দ্রের মন ভারি হয়ে গেল। চোখে জল। স্থির হয়ে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। ঠাকুরদাস জায়গা ছেড়ে উঠে গেলেন। দুজনের কথা হচ্ছিল বাড়ির সামনের ঘরে বসে।

ঘরে দুটো জানলা। দুটোই খোলা। বাঁ দিকের দেওয়ালের জানলাটা দিয়ে শহরের অনেকটা দেখা যায়। আকাশ নজরে আসে। ঈশ্বরচন্দ্রের চোখ চলে গেল খোলা আকাশের দিকে। ধু ধু আকাশে দুপুরের রোদ গায়ে মেখে একলা একটা চিল উড়ে বেড়াচ্ছে। স্থির হয়ে সেদিকেই তাকিয়ে রইলেন। ফোঁটা ফোঁটা জল পড়তে থাকল দুগাল বেয়ে।

দুদিন পরে বাবাকে নিয়ে চললেন কাশীতে।

জল পথে যাচ্ছেন। সেই মতো চারদিনের রসদ সঙ্গে রাখলেন। ঠাকুরদাসের ব্যাক্স পেঁটরা নিজে হাতে কিছুটা গোছগাছ করলেন। কাশীবাসে একমাসের মতো রসদও নিলেন বাবার জন্যে।

নির্দিষ্ট দিনে নৌকো ছাড়ল আউট্ট্রাম ঘাট থেকে। দিনে নৌকো চলছে। রাতে কোনও ঘাটে ভিড়িয়ে বিশ্রাম নেওয়া হচ্ছে। এক এক করে চারদিন কাটল। পাঁচ দিনের মাথায় নৌকো এসে বেনারসের গঙ্গায় পড়ল। সকালেই তা ঘাটে ভিড়ল।

দশাশ্বমেধ ঘাট । ঘাটে স্নানার্থীর ভিড়। পুরুষ-মহিলা করে বহু মানুষের ভিড়। তাদের মধ্যে অনেকে জলে নেমে স্নান করছে। কেউ বা সাঁতার কাটছে গঙ্গার বুকে। ফুল মালা, ধূপ হাতে কেউ পুরোহিতের পড়া মন্ত্র আউড়িয়ে গঙ্গাদেবীর পূজো করছে। সেসব দেখতে দেখতে ঈশ্বরচন্দ্র নৌকো ছেড়ে ঘাটে নামলেন। বাবাকে নামালেন। সঙ্গের জিনিষপত্র মাথায় কাঁধে নিয়ে ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলেন। কিছুটা সময় বসে বিশ্রাম নিলেন দুজনে।

এবার আস্তানা খোঁজার কাজ। মাসিক ভাড়ায় তা নিতে হবে। একজনের থাকবার মতো আস্তানা। মালপত্র সহ ঠাকুরদাসকে ঘাটে বসিয়ে  ঈশ্বরচন্দ্র বেরলেন ঘরের খোঁজে।

ঠাকুরদাসের ইচ্ছে, গঙ্গার কাছাকাছি বাসা নেওয়ার। প্রত্যহ কাশী বিশ্বনাথের দর্শন সম্ভব হবে। এ কথা তিনি নৌকোয় বসে ছেলের কাছে ব্যক্ত করেছেন। ঈশ্বরচন্দ্র সেই মতো ঘরের খোঁজ করছেন।

দশাশ্বমেধ ঘাটের সরু গলি ধরে তিনি এগোচ্ছেন। লক্ষ রাখছেন, কোথাও কোনও কাগজে লেখা বিজ্ঞপ্তি চোখে পরে কিনা। ভাড়ার ঘরের বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার চল রয়েছে কাশীতে-এ কথা ঈশ্বরচন্দ্র জানতেন। কিন্তু সেরকম কোনও বিজ্ঞপ্তি লটকানো নেই কোনও বাড়ির গায়ে।

চলতে চলতে নজরে এলো একটা খাবারের দোকান। দোকানের সামনে উঁচু পাতা উনুন। গনগন করে কাঠের আগুন জ্বলছে। তাতে বড় কড়াই বসানো। গরম গরম পুরী ভাজা চলছে। কয়েকজন ক্রেতা দোকানের ভিতর বসে পুরী-তরকারী খাচ্ছে।

তিনিও এক পয়সার পুরী-তরকারী কিনলেন। ফিরে গিয়ে বাপ বেটাতে খাবেন। খাবার শুদ্ধু শালপাতার ঠোঙাটা হাতে নিয়ে দোকানীর কাছে জানতে চাইলেন, কোনও এক কামরার ঘর ভাড়ায় পাওয়া যাবে, ভাই? হিন্দিতে প্রশ্ন করেছেন।

দোকানী সামান্য সময় চুপ থেকে কী যেন ভাবল। তারপর বলল, বাবু, ইঁহা সে ছে নম্বর গলিমে চলে যাইয়ে। ফির ডাহিনা মুরিয়ে। তিন মাকান ছোড় কর চৌথা মাকানমে এক দুকান মিলেগা। কাপড়াকা দুকান। উঁহা খোঁজিয়ে। সয়দ ঘর মিল জায়গা। মালুম হ্যাঁয় কী ঘর খালি হ্যায়। ঘর লেকিন মাকানকা পিছে তরফ হ্যায়। এক তল্লামে । মকানসে আলগই।

-হ্যাঁ, হ্যাঁ। সেটাই ভালো হবে। বয়স্ক মানুষ। একলা থাকবেন তো। ওপর নীচও করতে পারবেন না। আচ্ছা, ওই বাড়িওয়ালার নামটা কি  বলতে পারবে?

-মগন শেঠ।  ছ’ নং গলি, ২১ নম্বর মাকান। কৌন রহেগা বাবুজি?

-আমার বাবা। বয়স্ক মানুষ।

-উঁহা সভি বুজরুক আদমি রহতে হ্যায়।  উনলোগ সবেরে গঙ্গা নাহাকে মেরে হি দুকানমে আতে। সবজী-পুরী খা কর যাতে হ্যায়। আপকা পিতাজীকো ভী দুকান দিখা দেনা। ইঁহা আনে পর বহুত জনসে মুলাকাত হোগা। আচ্ছা লাগেগা।

-বাঃ। এ তো খুব ভালো হল। আচ্ছা, আগে দেখি গিয়ে। ঘরটা ব্যবস্থা হয়ে গেলে ভালোই হয়। এসে জানিয়ে যাব তোমায়।

দোকানীকে ধন্যবাদ জানিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র পৌঁছলেন মগন শেঠের গদিতে। দেখা হয়ে গেল শেঠের সঙ্গে। ঘরও খালি রয়েছে। মাসের ভাড়া দশ টাকা। ঘর দেখলেন। নির্দিষ্ট ঘরখানা মূল বাড়ির পিছন দিকের অংশে। খোলা জায়গার ওপরে। ঘরের দেওয়াল সরু সরু ইঁট,চুন-সুড়কি দিয়ে গাঁথা। ওপরে খড়ের ছাউনি।  ঠাকুরদাসের ঘরের আশপাশ করে আরও গোটা দশেক একই ধরণের ঘর। জানলেন, সেগুলো সব ভর্তি।

তিন মাসের অগ্রিম ভাড়া দিতে হবে। তাই দিলেন। ভাড়ায় নিয়ে নিলেন। পরে বাবাকে এনে তুললেন সেখানে।

বাবা স্বহস্তে পাক করবেন। তার সব ব্যবস্থা পাকা করলেন। অন্যান্য কিছু দরকারি সামগ্রী কিনেকাটে ঘর গুছিয়ে দিলেন।  তিনটে দিন বাবার সঙ্গে থেকে কাটালেন । সব শেষ মন খারাপ নিয়ে কলিকাতা ফিরে এলেন ঈশ্বরচন্দ্র।

এরপরের সময়টা চৈত্র মাস। আর ক’টা দিন পরেই বৈশাখ জ্যৈষ্ঠের খর মাসের আগমন ঘটতে চলেছে। ঈশ্বরচন্দ্র বাবাকে কাশীতে রেখে গ্রামে ফিরলেন না। সোজা কলিকাতায় চলে এলেন। এক তো রয়েছে নিজের ভাঙা মন। ওপর থেকে বাড়ির মানুষদের মনকষ্ট তিনি দেখতে চান না। জলজ্যান্ত একজন মানুষ জীবিত অবস্থায় সংসার থেকে বিদায় নিলে কারই বা মন ভালো থাকে? ভগবতীদেবীর মন কাচের শার্সির মতো ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। বাড়ির বউদেরও মন কিছু ভালো নেই।

এমনই দিনে ঠাকুরদাসের দেখা স্বপ্ন যেন দৈববাণী হয়ে ফিরে এল। আঘাত হানল বীরসিংহের বসত বাড়িতে।

রাতের অন্ধকারে বাড়ি জ্বলে উঠল। দাউ দাউ করে। কোথা থেকে আগুন এলো, কেউ বুঝবার আগেই মানুষজনে ভর্তি বাড়ি  আগুনের কবলে! চীৎকার উঠল, আগুন আগুন। মানুষগুলোর ঘুম ভাঙল ।  যে যার মতো দুড়দাড় করে বাইরে বেরিয়ে পড়ল। সকলে যখন বাইরে, দেখা গেল সেখানে ভগবতীদেবী আর দীনবন্ধু অনুপস্থিত। কী হলে রে,  মা, দাদার কী হল! জানা গেল, দুজনে ভিতরে রয়ে গেছে।

কলিকাতা থেকে গ্রামে এসেছিলেন দীনবন্ধু। মা বেটাতে এক ঘরে শুয়ে রাত পর্যন্ত গল্পগুজব চলেছে। হামেশাই তা করেন। পরে নিজের ঘরে শুতে গেলে পাছে স্ত্রী-ছেলেমেয়ের ঘুম ভেঙে যায়, সেকারণে মায়ের ঘরে শুয়েই রাত কাটিয়ে দেন। সেদিনও তাই করেছেন।

গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু হল, মা…, দাদা…  শিগগীর বেরিয়ে এসো। বাড়িতে আগুন লেগেছে…।

যে যার মতো করে চেঁচিয়ে দুজনের ঘুম ভাঙাতে চাইছিল। ঘুমন্ত মানুষ দুজনের কানে অবশেষে সেই ডাক পৌছাতে তাঁরাও আঁচ পেলেন, কিছু একটা ঘটেছে। তখনও কি তাঁরা জানেন, বিপদ তাদেরকে ঘিরে ফেলছে? টের পেলেন বাইরের উত্তাপে। আগুন তখনও বসত বাড়ির অন্য দিকে থাবা বসিয়েছে। এ দিকটায় পৌঁছায়নি। দুজনে তাই কোনও রকমে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারলেন। প্রাণে বেঁচে গেলেন।

বাইরে এসে আগুনের লেলিহান শিখা দেখে ভগবতীদেবীর সম্বিত ফিরল। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার জুড়লেন, ও মাগো…। একি সর্বনাশ করলে গো ঠাকুর…। এ আমাদের কোথায় রেখে গেলে তুমি…

কান্না । চোখের সামনে আবাস বাড়ির আগুন। মনে দুঃসহ কষ্টের ঢেউ। তিনি  ভাবলেন, এ কি স্বামীর  গৃহত্যাগে অভিশাপের ফল? পরক্ষণে মনে হল, তা কী করে হয়? তিনি তো  মুখে হাসি নিয়ে স্বেচ্ছায় গৃহত্যাগ করেছেন…

চৈত্রের খরায় দেখতে দেখতে  বসতবাড়িখানা ছাই হয়ে গেল। গর্বের বাড়ি ধুলোয় মিশিয়ে গেল। ঠাকুরদাস ব্যাড়ুজ্জ্যের বসত বাড়ি আর নেই।

 

কলিকাতায় বসে ঈশ্বরচন্দ্র গৃহদাহের দুঃসংবাদ পেলেন । সঙ্গে সঙ্গে তিনি কিছুক্ষণের জন্যে কেমন বোবা হয়ে গেলেন। হাঁকপাঁক করে উঠল সারা শরীর। মনের মধ্যে একটা কষ্ট।

ঘরে একলাই ছিলেন। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন দেওয়ালের দিকে। দৃষ্টি ধীরে ধীরে আবছা হয়ে আসছে। বুঝতে পারছেন, এবার বুঝি তাঁর জীবনে দুর্দিনের কালো ছায়া পড়তে শুরু করল। তা নাহলে, একদিকে যেমন নিজের শরীরের ভাঙন; অপরদিকে আত্মীয় পরিজন থেকেও কি কম কষ্ট পাচ্ছেন তিনি? এক তো বাবার গৃহত্যাগ, মায়ের একলা হয়ে যাওয়া, নারায়ণ, ঈশানের অসদাচরণ, অমন সুখের আলয়ের ভস্ম হয়ে যাওয়া।… না জানি, আরও কী কী দুঃখের বোঝা তাঁর জন্যে অপেক্ষা করে রয়েছে?

ছুটে গেলেন গ্রামে।  কান্নায় ভেঙে পড়লেন মায়ের কাছে। ভগবতীদেবী ছেলের মনকষ্ট বুঝতে পারছেন। তিনি নিজেও তো বিদ্ধৃত । মন ভেঙে গেছে। তবু ছেলেকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে উচ্চারণ করলেন, বাবা, সবই পরমেশ্বরের ইচ্ছে। এ সংসারে মারবেন তিনি; রাখবেনও তিনি।

-দুঃখ হয় মা। কত কষ্টে এই সাধের আলয় গড়ে তোলা হয়েছিল। তোদের আশীর্বাদের ফল। আর আজ কিনা সকলে গৃহহারা হয়ে গেলি…

-কী আর করা যাবে। এখন নতুন করে ভাবতে হবে । যা হোক করে মাথা গোঁজার ঠাঁই গড়ে নিতে হবে। আমার আশীর্বাদ রইল। তুমি আবার তা গড়ে দিতে পারবে, ঈশ্বর।

ঈশ্বরচন্দ্র চোখের জল মুঝলেন। নিজেকে শক্ত করলেন। বললেন, তোর আশীর্বাদ রয়েছে। আমিও রয়েছি। ঠিক আছে। নতুন আবাস গড়ে দোবো। তবে তুই আর দীনু যে বেঁচে গেছিস, এর জন্যে তোর পরমেশ্বরকে ধন্যবাদ জানা।

 

এমন হঠাৎ আসা বিপদের জন্যে অনেকেই অনেক কথা বলা শুরু করল। গ্রামবাসীদের মাঝে এমন কথাও উঠল, দেখো গিয়ে এ কাজ ওঁদের কোনও আত্মীয় করেছে কিনা?…মানুষ তো মানুষের ভালো দেখতে পারে না?

ঈশ্বরচন্দ্র কানেও সেসব কথা এলো। তিনি কানে নিলেন না। দয়াময়ী মা যখন বলেছে, এ কাজ পরমেশ্বরের ইচ্ছানুসারে হয়েছে, এরপর আর কোনও কথা হয় না। চুপ করে রইলেন। তখন তখন নিজে আর বাড়ি গড়লেন না। কিছুদিনের মধ্যেই ভাইদের এবং নিজের পরিবারের থাকবার মতো কুঠি গড়ে দিলেন। তারপরে ভগবতীদেবীকে অনুরোধ করলেন, তুই মা আমার সঙ্গে কলিকাতায় চল।

অমলিন হাসিতে মুখ উজ্জ্বল করে ভগবতীদেবী বললেন, সে কি কথা বাবা? এখানে সবাই পড়ে থাকবে আর আমি একলা পা উঠিয়ে কলিকাতা চলে যাব? তাই কি হয়?

-কেন হয় না, মা? এখন তো তোর মানুষটাও কাছে নেই, তাহলে যাবি না কেন?

ঈশ্বরচন্দ্রের একান্ত ইচ্ছে, মাকে সঙ্গে করে কলিকাতায় নিয়ে যান। কিন্তু তিনি যে আবার অন্য ধাতুতে গড়া মহিলা! ভগবতীদেবী বললেন, ওরে, এখানে যে নিরাশ্রয় এতগুলো গরীব ছেলেকে পুষ্যি রেখে পড়াশোনা করাচ্ছিস, তাদের দেখবে কে? ওরাও তো আমার সন্তান।

-মা, ওদের ভার তুই দীনময়ীর ওপর দিয়ে আমার সঙ্গ নেয়ে…

-ভালো কথাই বললি। সে বেচারি পুরো সংসার সামলাবে, না এতগুলো পড়ুয়ার খাওয়া থাকা দেখবে?…তাছাড়াও, পাড়াপ্রতিবেশীই বা কী বলবে? বাড়িতে নিত্য অতিথির আনাগোনা রয়েছে। তারা ভাববে, নাঙল হল পর, বুড়ি ছাড়ল ঘর।

মুখে হাসি। তবে সে হাসি করুণ। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বললেন,  তোর মনে খুব কষ্ট, নারে?

ছেলের কথার ধারপাশ দিয়ে না গিয়ে ভগবতীদেবী বলে উঠলেন, হ্যাঁরে, তোর বাবা সেখেনে কেমন আছে?

ঈশ্বরচন্দ্র বুঝলেন, মা কথা ঘুরিয়ে অন্য প্রসঙ্গে যেতে চাইছে । তিনি উত্তর করলেন, গতমাসেই হেমলতা আর গোপালচন্দ্রকে সেখানে পাঠিয়েছিলাম। দিনকতক মেয়ে জামাইয়ের সেবা শুশ্রূষা পেয়ে ভালই লেগেছে বাবার।

-সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেলে, আমাকেও বরং একবার সেখেনে রেখে আসিস। সেবা তো তিনি আবার নেবেন না…,  কপট অভিমান দেখালেন।

কথা শেষ করে ভগবতীদেবী উঠে পড়লেন। বাড়ির চাতালে গড়ে ওঠা অস্থায়ী আস্তানায় গিয়ে ঢুকলেন । ঈশ্বরচন্দ্র মাকে অনুসরণ করলেন।

দিন কয়েক পরে তিনি একলাই কলিকাতায় ফিরে গেলেন।

(২৬)

 

কলিকাতায় ফিরেও ঈশ্বরচন্দ্রের মনে শান্তি নেই। এক তো ওভাবে বসত বাড়ির বিনাশ, যা মন থেকে মেনে নেওয়া যাচ্ছিল না। উপরন্তু যে ভাইদের নিয়ে তাঁর এত বছরের গর্ব ছিল, সেখানে সম্পর্কের ফাটল লক্ষ্য করেছেন। এর আঁচ বীরসিংহে গিয়ে আগেই পেয়েছিলেন। যৌথ সংসারে এ বিচ্যুতি তাঁর আর একদফা মনোকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তবু মনে করেছেন, এতদিনে প্রত্যেক ভাইয়েরই সংসার হয়েছে। দিনে দিনে তাদের ছেলে মেয়েদের জন্ম হয়েছে। গোটা সংসারটা একটা জাহাজের মতো বেড়ে উঠেছে। অথচ জাহাজের মাথায় মাস্তুল নেই। বাবার সংসার ত্যাগের পর তা নিশানা হারিয়েছে। সামান্য ঝড়েই টালমাটাল হচ্ছে। তিনি নিজেও সামনে থাকেন না। ভাইয়দের একলা ক্ষমতায় তা সামাল দিয়ে ওঠে সম্ভব হচ্ছে না। বউ বউয়ে সদ্ভাব থাকছে না। যার আঁচ এসে পড়ছে তাদের স্বামীদের মধ্যে। ওপর থেকে দুর্মুখ ঈশান সকলের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে উঠেছে। নেই তার রোজগার পাতি; অথচ সংসারে কতৃত্ব করতে চায় ষোল আনা। সকলে তা মানবে কেন? এই নিয়ে নানান অশান্তি লেগেই আছে সংসারে।

এই অবস্থায় মায়ের তাঁর সঙ্গে থাকাটা অত্যন্ত জরুরী মনে হয়েছিল। তৃতীয় চক্ষু দিয়ে তিনি দেখতে পাচ্ছেন, অদূর ভবিষ্যতে মায়ের একা থাকা বেশ কষ্টের হবে। হতে পারে, তা আর্থিক দিক থেকে নয়, তবে মানসিক দিক দিয়ে মা একাকী হয়ে যাবে। সংসারে আর সেই আগের দিনের মতো বাঁধন নেই। বউ, বউরা যে যার নিজের নিজের নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তাদের সংসারও ডালপালা মেলেছে, স্বাভাবিক তারা আর মাকে সময় দেবে কেমন করে? মা থাকে পাড়াপ্রতিবেশি, আর ইশকুলের নিরাশ্রয় ছাত্রদের নিয়ে। নিজের লোকের সান্নিধ্য মা হারিয়ে ফেলেছে।

সান্নিধ্যের ভাবনা আসাতে ঈশ্বরচন্দ্রের ভাবনা সুদূর প্রসারিত হয়। তিনি মনে করেন, এই যে তিনি নিজেই বা এখন কটাদিন দীনময়ীকে সঙ্গ দিতে পারছেন? কিন্তু দীনময়ী জানে,  স্বামী একবার গ্রামে আসলে, তাঁকে কাছে পাবেই। এই বয়সে শরীরের টান তো আর থাকে না; যা থাকে তা হচ্ছে দুজনের অন্তরের টান। স্বামী এসে সন্তানদের কাছে টেনে নিচ্ছে, তাদের অভাব অভিযোগ, আহ্লাদ স্বামী মেটাচ্ছে, তাতেই পত্নীমন বর্ষার জলে টইটুম্বুর পুকুরের মতো হয়ে যায়। এছাড়াও রয়েছে, দুজনের একটু কথা, অসময়ের একটু চোখাচোখি, নিভৃতে গা ছোঁয়াছুঁয়ি, রাতটুকু পাশাপাশি থাকা, সামান্য খিটিমিটি, কখনও মতান্তর, তা থেকে মনান্তর, তারপর এক রঙিন রাতে  রাগ অভিমান ভেঙে পরস্পর পরস্পরকে বুঝে নেওয়া, কে দোষী, কে নির্দোষ, তার ফয়সালা ঘটিয়ে স্বামী–স্ত্রীর মাঝে আজীবন ঘটে চলা সোহাগ আদর, এর মূল্যই বা কম কি? এতেই তো দুজনের অন্তর বাঁধা পড়ে থাকে আমৃত্যু। অথচ, মায়ের ক্ষেত্রে, তাঁর কাকে পাবার আছে? নেই নেই, কেউ নেই…

চলবে… 

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page