শতবর্ষে সত্যজিৎ ।। শৈবাল চৌধুরী
তৃতীয়পক্ষ পেজ থ্রি- ২ মে ২০২১ সত্যজিৎ রায়ের শততম জন্মদিন। বিশ্বজুড়ে এখনাে যে ক’জন মানুষের পরিচয়ে বাঙালির বিশ্বজোড়া পরিচিতি তাঁদের একজন সত্যজিৎ রায়। সারা পৃথিবীর কাছে সত্যজিতের পরিচিতি একজন সেরা চলচ্চিত্রকার রূপে। আমাদের এই উপমহাদেশের নানান জাতির কাছেও তাই। কিন্তু বাঙালির কাছে তাঁর পরিচয় কেবল একজন চলচ্চিত্রকার হিসেবে কখনাে নয়। তিনি শুধু চলচ্চিত্রশিল্পের মাধ্যমেই নয়, নানাভাবে বাংলা সংস্কৃতিকে ক্রমশ সম্পদশালী করে গেছেন। তাই বাঙালির কাছে সত্যজিৎ তার সংস্কৃতির এক অভিভাবক। মননে, রুচিতে, বােধে এবং শিল্পের অনুধাবনে যিনি তাঁদের আধুনিকতার ঠিকানা এনে দিয়েছিলেন, এনে দিয়েছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রে প্রকৃত রেনেসাঁর সন্ধান। বাংলা চলচ্চিত্রকে অধিষ্ঠিত করেছিলেন বিশ্ব চলচ্চিত্রের অঙ্গনে।
যে পরিবারে সত্যজিতের জন্ম ১৯২১ সালে, সে পরিবারের কয়েক প্রজন্মের অনেক সদস্য বাংলা সংস্কৃতিকে নানাভাবে পরিপুষ্ট করেছেন। পারিবারিক পারিপার্শ্বিকতার গুণে সত্যজিৎও সেই ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রেখেছেন বটে, তবে তা সম্পূর্ণ মৌলিক ও অভিনব ভাবে। আর সেই মৌলিকত্ব ও অভিনবতা তাঁকে অর্জন করতে হয়েছে নিরলস পরিশ্রম ও অবিরাম চর্চার মধ্য দিয়ে।
শৈশবে পিতৃহারা হয়ে রীতিমত জীবনযুদ্ধে যুঝতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু আকৈশােরের সংস্কৃতিচর্চা তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে অভীষ্ট লক্ষ্যে। এই জীবনবীক্ষণের চিত্র আমরা দেখি তাঁর। দ্বিতীয় শেষ ছবি ‘শাখা প্রশাখায়। সেখানে মূল চরিত্রের মুখে আমরা শুনি; পরিশ্রম ও সততাই হলাে জীবনের উত্তরণের প্রধান দুটি সােপান।
একজন শিল্পীর জীবনের শেষ কাজকে বলা হয়, ‘সােয়ান সঙ’। মহৎ শিল্পীদের সােয়ান সঙে তাঁদের জীবনের শিল্পকৃতির নির্যাসের প্রতিফলন ঘটে। সত্যজিৎ রায়ের সােয়ান সঙ ছিল আগন্তুক। সত্যজিৎ নিজেও বলেছেন এই ছবির বিষয়বস্তু তাঁর সারা জীবনের দর্শন। ছবির মূল চরিত্র মনমােহন মিত্র সত্যজিতের প্রতিভূ। এই চরিত্রের মুখে সত্যজিৎ বলে গেছেন তাঁর সারা জীবনের অনেক অভিজ্ঞতার কথা। সত্যজিৎ রায়ের অন্যতম সেরা এই সৃষ্টি তাঁর জীবনদর্শনের চলচ্চৈত্রিক দলিল হয়ে আছে, যার প্রতিটি দৃশ্যের মাধ্যমে আমরা বুঝে নিতে পারি অনেকটা এই চলচ্চিত্র স্রষ্টাকে ।
সত্যজিতের সময়ে বাংলা মূলধারার চলচ্চিত্রশিল্পও যথেষ্ট পরিণত ও মানসম্পন্ন হয়ে উঠেছিল। একে তাে তিনি সকলের মাথার উপর অভিভাবকের ছায়া দিয়ে গেছেন, তার ওপর তাঁর নির্মাণদলের বিভিন্ন অভিনয়শিল্পী, কলাকুশলীরা মূলধারার ছবিতেও কাজ করতেন। এছাড়া অনেকে সরাসরি তাঁর কাছে বুদ্ধি পরামর্শ চাইলে নির্দ্বিধায় তিনি সহযােগিতা করে যেতেন। বিভিন্ন নির্মাতা ও কলাকুশলীদের লেখা থেকে এসব কথা জানা যায়। মূলধারার এসব ছবি আজ যখন দেখি, রীতিমত শিল্পসমৃদ্ধ চলচ্চিত্র বলে মনে হয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই সত্যজিৎ রায়ের বিস্তৃত প্রভাব ছিল বাংলা এবং উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে। যেন বিশাল বিটপীর ছায়াতলে বিস্তৃত শ্যামল সবুজ তরুরাজি। তেমনি সত্যজিৎ রায়ও যথেষ্ট ওয়াকিবহাল থাকতেন মূলধারার চলচ্চিত্র সম্পর্কে। এখান থেকে সব সময়ই তিনি অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলীদের নিয়েছেন। প্রথম থেকে শেষ ছবিটি পর্যন্ত রয়েছে এর শত উদাহরণ।
এসব ছবি দেখার পাশাপাশি সিনে পত্রপত্রিকার সঙ্গেও তাঁর নিয়মিত সংযােগ ছিল। নানান সাক্ষাৎকারে মূলধারার ছবি সম্পর্কে তাঁর অনেক ভাবনা চিন্তার কথা আমরা জানতে পাই। এমনকি হিন্দি সিনেমার গান সম্পর্কে তাঁর স্বপক্ষীয় মতামত আজও আমাদের ভাবায়। আজকের মতাে উন্নাসিকতা কিংবা খারিজি মানসিকতার এতটুকু পরিচয় সে সময় পাওয়া যেত না। এই মানসিকতা কেবল নিজেকেই অক্ষভুক্ত করে না, মন্দজনক পরিণতিও ডেকে আনে।
সােনার চামচ মুখে নিয়ে না জন্মালেও সত্যজিৎ জন্মেছিলেন সােনার কাঠি হাতে নিয়ে। যার পরশে বাংলা তথা উপমহাদেশীয় চলচ্চিত্র সাবালকত্ব পেয়েছে। চলচ্চিত্রঅভিনয়, চলচ্চিত্রসংগীত এবং চলচ্চিত্রসাহিত্যে তিনি যেমন দিয়েছেন আধুনিকতার দিশা, তেমনি নিজের মৌলিক চিন্তার সঙ্গে চলচ্চিত্রের প্রকৃত প্রকরণের মিশেলে চলচ্চিত্রের বিভিন্ন কারিগরি শাখাতে সমৃদ্ধি এনে দিয়েছেন।
বাংলা সংস্কৃতির প্রধান পুরােহিত রবীন্দ্রনাথকে সার্থকভাবে অনুধাবনে এবং ধারণে সক্ষম। হয়েছিলেন সত্যজিৎ । রবীন্দ্রনাথের আধুনিক ও বিশ্বজনীন মননশীলতার যথার্থ প্রতিফলন আমরা দেখি সত্যজিতে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যথাযথ প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি (একমাত্র বললেও ভুল কিছু বলা হয় না) সত্যজিতের তৈরি। রবীন্দ্রনাথের কাহিনিতে সত্যজিৎ নির্মাণ করেছেন পাঁচটি চলচ্চিত্র তিনকন্যার, পােস্টমাস্টার, মনিহারা ও সমাপ্তি, চারুলতা এবং ঘরে বাইরে। পরিমিত এবং পরিশীলিত প্রয়ােগের গুণে আমরা যেমনভাবে পাই পাঁচটি সেরা চলচ্চিত্র, তেমনভাবে পাই চলচ্চিত্রে প্রকৃত রবীন্দ্রনাথকে । রবীন্দ্রনাথের সংগীতের বুদ্ধিদীপ্ত প্রয়ােগও আমরা সত্যজিতের কয়েকটি চলচ্চিত্রে পাই।
১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল সত্যজিৎ প্রয়াত হয়েছেন। দীর্ঘ ২৯ বছরেও তাঁর স্মৃতি এতটুকু ম্লান হয়নি। প্রাসঙ্গিকতা বরং ক্রমবৃদ্ধিমান। তাঁর ছবিকে অবলম্বন করে ছবি নির্মাণ করছেন অনুজ প্রজন্মের নির্মাতারা। গৌতম ঘােষ নির্মাণ করেছেন অরণ্যের দিনরাত্রির সিরিয়াল আবার অরণ্যে এবং অতি সম্প্রতি সৃজিৎ মুখােপাধ্যায় তাঁর প্রথম ছবি অটোগ্রাফ নির্মাণ করেছেন নায়ক এর প্রসঙ্গানুক্রমে। অটোগ্রাফ ফিল্ম উইদিন ফিল্ম আঙ্গিকের একটি ছবি, যেখানে দেখা যায় একজন তরুণ পরিচালক সত্যজিতের নায়ক ছবিটি পুননির্মাণে আগ্রহী। এই গল্প নিয়ে ছবিটি। অর্থাৎ, ছবির উপরিকাঠামাে ও অন্তকাঠামাে দুটো জুড়েই সত্যজিৎ। ছবিটির বিষয়বস্তুর চমৎকারিত্বের মতােই সত্যজিৎ বঙ্গ চলচ্চিত্র সংস্কৃতির উপরি ও অন্তনিহিত কাঠামােজুড়ে বিরাজমান।
চলচ্চিত্রের বাইরে বাংলা প্রকাশনা শিল্পে এবং অংকন শিল্পেও তিনি তাঁর পূর্ববর্তী দুই পুরুষের উত্তরাধিকারকে আরাে সমৃদ্ধ করে গেছেন। বাংলা সাহিত্যেও রেখে গেছেন মৌলিক অবদান।
বাংলা চলচ্চিত্র (বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের) আবারাে ভালাে জায়গায় ফিরে চলেছে। তরুণ প্রজন্মের নির্মাতারা মানসম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন। এক্ষেত্রেও সত্যজিতের প্রচ্ছন্ন প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। যে ভাষার চলচ্চিত্রে এত বড় মনীষীর অবস্থান, তাঁর কাজের প্রতি একটা অবচেতন লক্ষ থাকে সকলের, বিশেষ করে নবীনদের। তাঁর মানের প্রতি এবং সম্মানের প্রতি দৃষ্টি থাকে আন্তরিক চলচ্চিত্রকর্মী মাত্রের। এ প্রসঙ্গে চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ গাসতঁ রােবের্জের একটি কথার উল্লেখ করা যায়, ‘সত্যজিৎকে নবীন চলচ্চিত্রকারেরা বর্তমানে বা ভবিষ্যতে নেতা হিসেবেই ভাববেন। সবাই হয়তাে তাঁর পদ্ধতিকে অনুসরণ করতে চান। কিন্তু তাঁকে শ্রদ্ধা করেন।’
আমার বিশ্বাস এই নবীন চলচ্চিত্রকারদের শ্রদ্ধায় মিশে আছে কিছুটা ভক্তিযুক্ত ভয় এবং অনেকটাই ভক্তিজনিত বিস্ময় ও ভালােবাসা। শততম জন্মবার্ষিকীতে এই নেতার প্রতি প্রেমভরা শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাই রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী ধার করে, ‘সীমার মাঝে অসীম, তুমি বাজাও আপন সুর—আমার মধ্যে তােমার প্রকাশ তাই এত মধুর।
লেখক : চলচ্চিত্র নির্মাতা, সভাপতি, চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্র ও খণ্ডকালীন শিক্ষক, নাট্যকলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।