উপন্যাস।। আবার এসো ফিরে।। রামেশ্বর দত্ত

সেটা ছিল পৌষ মাস। আর এখন চৈত্রমাস। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে বাবা গুরুতর পীড়ায় পড়লেন সংবাদ পেয়ে  ভাইদেরকে সঙ্গে নিয়ে তড়িঘড়ি দ্বিতীয়বারের জন্যে কাশীতে আসলেন। মাত্র কটা দিন সেবা করলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। বাবা ইহজগৎ ছেড়ে চলে গেলশেষ ভরসার স্থল ফাঁকা হয়ে গেল 

  কাজ এখন বাবার নশ্বর দেহের সদ্গতি। শবযাত্রা শুরু হল। শেষ হল মণিকর্ণিকায় এসে।  পাঁচ বছর আগেই একবার যেখানে পা রেখেছিলন, মায়ের মরদেহ নিয়ে।

পর্ব- ৩১ 

  ঘাটে শবের লাইন। এধার ওধারে জ্বলন্ত চিতা। শব ছুঁয়ে বসেছেন ঈশ্বরচন্দ্র। চোখ চলে যাচ্ছে নিচে গঙ্গার দিকে। প্রবাহিত জলরাশি। আদি অন্তকাল ধরে বয়ে চলেছে। ঘাটের সিঁড়িতে মানুষ। কেউ বসে আছে উদাস দৃষ্টি নিয়ে। কোথাও বা মস্তক মুণ্ডনের কাজ চলছে।

কোণার দিকে এক চুল্লিতে মৃত দাহ করবার স্থান পাওয়া গেল। চিতা সাজানো হল। মৃতদেহে গব্য ঘৃত লাগিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র মন্ত্র পড়লেন। চিতায় ঠাকুরদাসের দেহ শায়িত হল।  হাতে অগ্নিযুক্ত পাটকাঠির আঁটি। দেহকে ঘিরে তিন পাক কাটলেন। ভাইরা সাহায্য করল। তিনি মুখাগ্নি সারলেন। হাতের জ্বলন্ত কাঠির গোছা নামিয়েই কান্নায় ভেঙে পড়লেন। হাউ হাউ শব্দে কাঁদছেন, আর প্রলাপ বকছেন, বাবার কাশীবাস-ই কাল হল…।

কিছু পরে বলছেন, বীরসিংহ গ্রাম তার সুসন্তানকে হারাল…। কপাল চাপড়াচ্ছেন, হায়, আমি পিতৃমাতৃ হীন হলাম। আমি  অনাথ…, কাকে আমার মনের কথা জানাব…

দীনবন্ধু, শম্ভুচন্দ্র এবং আরও অনেকে  চোখের জলে ভাসছে। দাদাকে  সামলাচ্ছে । তাঁরা  তো জানে, দাদাও কিছু সুস্থ নয়; অসুস্থ শরীর নিয়েই বাবার কাছে এসেছিলেন তিনি।

মানুষের মন আর শরীর  দুদিক ভাঙতে থাকলে কতদিন আর সে সুস্থ থাকতে পারে? তার ওপরে  মাথার ওপর যদি কন্যাদায় থাকে। ঈশ্বরচন্দ্রের তো এখন সেই অবস্থা।  ছোট মেয়ে, মানে শরৎকুমারীকে পাত্রস্থ করা বাকি রয়েছে। সঙ্গে নিজের শরীরের বেহাল অবস্থা। তিনি তাই চাইছেন  শরৎ এর  বিয়েটা দিয়ে নিজে পাকাপাকি ভাবে কর্মাটাঁড়বাসী হয়ে যাবেন; কিন্তু কালঅশৌচের কারণে তাতেও এক বছরের জন্যে বাধা এসে দাঁড়াল। অগত্যা তিনি আপাততঃ কলিকাতায় আরও কিছুকাল থাকবার মনস্থ করলেন; মেট্রোপলিটন কলেজের কাজকর্ম নিয়ে । এবার একটা নতুন বাড়ি করে কলেজ সেখানে স্থানান্তরের পরিকল্পনা নিতে হবে তাঁকে ।

                             (৩৫)

  ঈশ্বরচন্দ্র বাদুরবাগানের বাড়িতে একলা বাস করছেন। সেজ মেয়ে, বিনোদিনী আর ওর বর সূর্যকুমার বাসা ভাড়া নিয়ে অন্যত্র চলে গেছে। মাঝেসাঝে আসে বাবাকে দেখতে। এছাড়াও জামাইয়ের সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্রের কলেজে দেখা হয়। তখন খোঁজখবর নিয়ে নেন বিনোদিনীর। সে সন্তান সম্ভবা। ঈশ্বরচন্দ্র সূর্যকুমারকে পরামর্শ দিয়েছেন, সামনের মাসেই বিনোদিনীকে বীরসিংহে ওর মায়ের কাছে রেখে আসতে, প্রথম সন্তান মায়ের ঘরে হোক। সূর্যকুমার এখন দিন গুনছে, কবে সে বাবা হবে।

এরকম সময়ে একদিন খবর এলো, ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবের ইচ্ছে ঈশ্বরচন্দ্রকে চাক্ষুষ করবার। মানুষটার জ্ঞান , পরোপকার, বাল্যবিবাহ বন্ধ, বহুবিবাহ রোধ, নানান বিষয়ে অবগত হয়ে ঠাকুর দেখা করবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন।  সন্ন্যাসী শিষ্যদেরকে বলেছেন। তাঁরাও ব্যবস্থায় রয়েছে। রামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর রয়েছেন। সেখান থেকে সোজা বাদুর বাগানে আসবেন।

খবরটা এলো রাজকৃষ্ণ বন্দোপাধ্যায়ের মাধ্যমে। তিনি প্রায়শই দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে যান। ঠাকুরের দর্শন নিতে। এবং তিনি যে ঈশ্বরচন্দ্রের অভিন্ন বন্ধু, সেটাও সন্ন্যাসীরা জেনেছেন। খবরটা তাই তাঁকেই দেওয়া হয়েছে।

  ইদানীং রাজকৃষ্ণবাবুই বাদুড়বাগানে আসেন; ঈশ্বরচন্দ্র আর সুকিয়া স্ট্রীটে রাজকৃষ্ণ বাবুর বড়ি যান না। ওই বাড়ির প্রতি তাঁর মন টানে না। সেখানে প্রভাবতীর অকাল মৃত্যুর পর তিনি বুঝছেন, একটা শিশু সম্পর্ককে কতখানি অটুট করে রেখেছিল। আজ সে নেই; তাই বন্ধু তথা বন্ধুর বাড়ির সব হিতৈষীর প্রতি মনের টান আলগা হয়ে গেছে।  তবু রাজকৃষ্ণবাবু মাঝে মাঝেই হুটহাট চলে আসেন। দুজনে বসে গড়গড়া টানেন। অনেক রাত পর্যন্ত গল্পগুজব চলতে থাকে। তারপর তিনি বাড়ি ফিরে যান।

সেদিন রাজকৃষ্ণবাবু যে এমন একটা সংবাদ দেবেন ঈশ্বরচন্দ্র ভাবতে পারেননি। শুনে বিস্মিত হলেন ঈশ্বরচন্দ্র! বন্ধুকে বললেন, কী কারণে ভাই তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চান?

-কারণ আর কী? তুমি বড় মানুষ।  বিদ্যার সাগর, দয়ার সাগর, বিধবা রমণীদের পরিত্রাতা, এসব ঠাকুরের কানে গেছে। তাই দেখা করতে আসছেন। …লোকে তাঁর দর্শন নিতে যায়। আর তিনি কিনা নিজে তোমার কাছে আসছেন।

ঈশ্বরচন্দ্র সামান্য হাসলেন। বললেন, ভালো কথা। তবে, উনি কি জানেন, আমি একজন নাস্তিক? ঠাকুর দেবতায় আমার বিশ্বাস নেই।

-আহা, অনেক নাস্তিককেই তো তিনি আস্তিক করেছেন। নরেন্দ্রনাথও তাঁকে ভন্ড সাধু ভেবে বসেছিল। মহেন্দ্র ডাক্তার এখনও তাঁকে সেই নজরেই দেখে অথচ প্রতি সন্ধেতে তাঁর কাছে না গেলে ডাক্তারের চলে না।  শোনোনি?

-শুনেছি, আবার শুনি নি। কী বলি বলো তো? আসলে কি জানো রাজকৃষ্ণ, ওই দক্ষিণেশ্বরের ইতিহাসটাই আমার পুরোটা পড়া হল না। তা তার ধারক-বাহক-প্রচারক-সৃষ্টিকর্তা, থুড়ি সৃষ্টীকত্রী, সম্বন্ধে অজানাটা আমার কাছে কেমন খালি পেটে বদহজমের মতো হয়ে রয়েছে।

-এটা কিন্তু ঠিক হল না ভাই। খালি পেটে বদহজমের ঢেকুর তুলে ঠাকুরের সঙ্গে কী কথা বলবে?

-হ্যাঁ, এখন সেটাই আমার খামতি, আমি তা বুঝছি। তবে তুমি যদি এ বিষয়ে আমাকে একটু সাহায্য করো তো ভালো হয়। জানো কি ওই দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কিছু কথা?

  -কিছুটা জানি। তবে তোমায় একখানা পুস্তক এনে দেব। সেটা পড়লে সব জানতে পারবে।  রাজকৃষ্ণ গড়গড়ায় লম্বা সুখটান দিয়ে নাক মুখ থেকে অজস্র ধোঁয়া উদ্গীকরণ করে কথাটা বললেন।

-তাই দাও। হাতে কিন্তু সময় নেই। পারলে বইখানা কালকেই এনে দিও।

কথোপকথন শেষ হল সেদিনের মতো। রাজকৃষ্ণ বাড়ি ফিরলেন। পরের দিনই বইখানা নিয়ে গিয়ে ঈশ্বরচন্দ্রকে দিয়ে এলেন। বইটা তিনি উল্টেপাল্টে দেখলেন। মনে হল, বেশ তথ্য সমৃদ্ধ। ভাষাও প্রাঞ্জল। রচনাকার তাঁর চেনা কেউ নয়। এক অজানা লেখকের রচনা। ঈশ্বরচন্দ্র প্রথম থেকে পড়ছেন বইটা। তবে তাঁর প্রাসঙ্গিক স্থানে আসতে মনোযোগ বাড়ালেন। পড়ছেন,

… রানী রাসমনিদেবীর তখন যথেষ্ট বয়স হয়েছে। তবু স্বাস্থ্যে সেরকম আঁচ পড়েনি। মানসিক জোর ঠিক সেই আগের মতো। তিনি স্বয়ং জমিদারি পরিচালনা করেন, প্রজাদের দুঃখ দুর্দশার কথা নিজে শোনেন। সেসময় তাঁর জীবনের প্রধান ব্ৰত হয়ে দাঁড়াল দুটি। প্রজাদের প্রতি কোনও অবিচার হলে, সেখানে রুখে দাঁড়ানো, এবং সনাতন হিন্দু ধর্মের সংস্থাপন। ঈশাই ধর্মের রমরমা এবং ব্রাহ্ম ধর্মের বাড়বাড়ন্ত রুখে হিন্দু ধর্মের গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তিনি বদ্ধপরিকর। তিনি এই বৃহৎ কাজের দায়িত্ব নিজে তুলে নিয়েছেন। কিন্তু তখনও তিনি জানতেন না, এই  ব্যাপারেই প্রবল আঘাত ধেয়ে আসবে তাঁর নিজের দেশবাসীর কাছ থেকে। হিন্দু ধর্মের ধারক বাহক, ব্রাহ্মণদের দিক থেকে।

রানী বরাবরই বিচক্ষণ এবং স্বাবলম্বিনী। বিধবা হবার পর তিনি যেন আরও বেশি করে তা হয়ে উঠেছেন। এগারো বছর হল, তাঁর স্বামী জমিদার রাজকৃষ্ণ দাসের মৃত্যু হয়েছে। নিজের পুত্র সন্তান নেই। চার কন্যা সন্তান। একে একে সকলের বিবাহ দিয়ে তাদের সংসারমুখী করে এবার তিনি ইচ্ছে মতো নানান তীর্থ দর্শনে বেরিয়ে পড়েন। একমাস, কখনও বা তার বেশি সময় ধরে তীর্থস্থান ভ্রমণ করেন। সঙ্গে নেন বজরা, পাইক বরকন্দাজ এবং আত্মীয় পরিজনকে।

সেবার তিনি যাচ্ছেন কাশীধামে। বিশ্বেশ্বর ও অন্নপূর্ণা দর্শন করে আসবেন মনস্থ করছেন। কাশী অনেক দূরের পথ, দস্যু-তস্করের উপদ্রবের ভয় আছে, কিন্তু একবার কোনো কথা মনে এলে রানী আর নিরস্ত হন না। তিনি এক সঙ্গে পঁচিশখানা বজরা সাজালেন, তাতে নিলেন ছ মাসের উপযোগী খাদ্যদ্রব্য আর প্রচুর লোকলস্কর ও অস্ত্ৰধারী প্রহরী। মধ্য রাত্রে জোয়ারের পর বজরার বহর ছাড়বে। আত্মীয় পরিজনদের নিয়ে রানী আগেই নিজস্ব বজরায় উঠে শুয়ে পড়েছেন। ঘুমের মধ্যে কখন বজরা ছেড়েছে, তিনি খেয়াল করেননি।

এমন সময় তিনি একটি স্বপ্ন দেখলেন। জগৎ জননী রূপী মা কালী তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন।  বলছেন, কাশী চললি? কাদের ছেড়ে তুই চললি, ভেবে দেখলি না? তোর সন্তানতুল্য প্রজারা না খেয়ে থাকছে, আর তুই  এদের সেবা না করে তীর্থে চললি! কিসের তীর্থ? ফিরে যা। এখানে এই গঙ্গাতীরেই মন্দির প্রতিষ্ঠা করে ওদের সেবার ব্যবস্থা কর, তাই হবে তোর তীর্থ দর্শন। ওদের মধ্যেই আমাকে পাবি। আমি তোর হাতের পূজো গ্রহণ করবো।

স্বপ্ন ভেঙে যেতেই রানী রাসমণি ধড়ফড় করে উঠে বসলেন। তাঁর সর্বাঙ্গ ঘামে সিক্ত। স্বপ্ন নয়, যেন একেবারে সত্য। মা তাঁকে আদেশ দিয়ে গেছেন। একটুক্ষণ আচ্ছন্ন ভাবে বসে রইলেন তিনি। তারপর বাইরে বেরিয়ে এসে চিৎকার করে বজরা থমাবার আদেশ দিলেন।

পরদিন প্ৰভাতে সবগুলি বজরার অন্ন বস্ত্ৰ স্থানীয় দরিদ্রদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে রানী ফিরে এলেন জানবাজারে, নিজ গৃহে। যাত্ৰা ভঙ্গের কারণ আর কারুর কাছে ব্যক্ত না করে তিনি ডেকে পাঠালেন মথুরকে। মথুরা বিশ্বাস রানির সেজ জামাই। সেজ কন্যা অকালে মারা যেতে চতুর্থ এবং সব ছোট কন্যাটির সঙ্গে মথুরের বিবাহ দিয়ে তাঁকে তিনি ঘরজামাই করে রেখেছিলেন। এই মথুর ছিলেন বেশ বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান, রানীর বিষয়কর্মের ডান হাত। মথুরকে ডেকে তিনি জানালেন, গঙ্গার কুলে জমি দেখতে। তিনি সেখানে মন্দির প্রতিষ্ঠা করবেন।

গঙ্গার পশ্চিম কূল, বারাণসী সমতুল, সুতরাং পশ্চিম পারে জমি পেলেই ভালো হয়। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সেদিকে পছন্দমতন এক লপ্তে অনেকখানি জমি পাওয়া গেল না, বরং পূর্বপারে দক্ষিণেশ্বর গ্রামে জমি ছিল। সে জমি বিক্রয়ও হবে।

জমিতে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাটর্নি হেস্টি সাহেবের কুঠি। তিনি সেটা বিক্রয় করবেন। ওই জমির লাগোয়া ছিল মুসলমানদের একটি পরিত্যক্ত কবরখানা ও এক গাজী সাহেবের পীরের আস্তানা। সর্বসাকুল্যে সাড়ে চুয়ান্ন বিঘা জমি। দুটি জমিই পাওয়া গেল। জমির মূল্য ৪২৫০০ ধার্য হল। রানীর নামে জমি ক্রয় করা হল। তারপরে শুরু হলো মন্দির নির্মাণের কাজ। গঙ্গার কুল বাঁধিয়ে দেওয়া হলো।  হলো বৃহৎ স্নান ঘাট। মন্দির চত্বরে তৈরী হল, দ্বাদশ শিব মন্দির, বিষ্ণু মন্দির, নবরত্ন চূড়াযুক্ত কালী মন্দির ও নাট মন্দির।

মন্দির গঠনের কাজে যাতে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে সেইজন্য রানী কঠোর কৃচ্ছতা অবলম্বন করলেন। ত্রি-সন্ধ্যা স্নান, হবিষ্যান্ন গ্রহণ, ভূমিতে শয়ন এবং নিশিদিন ইষ্টদেবতার কাছে প্রার্থনা। সাত বছর ধরে চললো মন্দির নির্মাণের কাজ। এসময়ে প্রতিদিন তিনি জামাইকে জিজ্ঞেস করে কাজের অগ্রগতির খোঁজ নেন।  মাঝে মাঝে নিজে দক্ষিণেশ্বর গ্রামে গিয়ে কাজের অগ্রগতি দেখে আসেন।

মন্দির গড়া শেষ হল। কিছুদিনের মধ্যেই মূর্তি প্রতিষ্ঠা হবে। রানী এর মধ্যেই দিনক্ষণ দেখতে শুরু করেছেন। আর তখনই বাধার পাহাড় এগিয়ে এলো। এলো অন্য দিক থেকে। মথুর বিষণ্ণ মুখে দুঃসংবাদ আনল,  ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিতেরা ফতোয় দিয়েছেন, জানবাজারের জমিদার-পত্নী রাসমণি দাসী দক্ষিণেশ্বর গ্রামে মন্দির প্রতিষ্ঠা করলে, সে কাজ হবে অশাস্ত্রীয়।

রানী আকাশ থেকে পড়লেন। অশাস্ত্রীয়! তিনি শুদ্ধচিত্তে, ফলের প্রত্যাশী না হয়ে, তাঁর সমস্ত সম্পদ উজাড় করে মন্দির স্থাপন করতে চান, সে কাজ অশাস্ত্রীয় কেন হবে?

মথুর জানালেন যে, ব্ৰাহ্মণরা বলেছেন, শূদ্রের কোনো অধিকার নেই দেবদেউল প্রতিষ্ঠার। শূদ্রের হাতের পূজো কোনো দেব-দেবী নেন না। এই বলে পণ্ডিতরা ঘোঁট পাকাচ্ছে।

রানী  দৃঢ়তার সঙ্গে জানালেন, মা যে স্বয়ং তাঁকে দেখা দিয়ে বলেছেন,  তিনি তাঁর হাতের পূজো নেবেন!

ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিতেরা সে স্বপ্নের কথা বিশ্বাস করলেন না। জানালেন, স্বপ্নের কথা বলে শাস্ত্ৰ পাল্টানো যায় না।

রানী রাসমণি স্থির হয়ে গেলেন। তিনি বিচক্ষণতার প্রতিমূর্তি। তাঁর শ্রদ্ধাভক্তি, ধর্ম সংস্থাপনের জন্য তাঁর ব্যাকুলতা, এ সবই তুচ্ছ হতে পারে না। তিনি শূদ্র বংশীয়া বটে, তবে মাহিষ্য। মাহিষ্যরা মোটেই শূদ্ৰ নয়।  জমিদারির কাগজপত্রে তাঁর নামের শিলমোহরে লেখা থাকে, কালীপদ অভিলাষী শ্ৰীমতী রাসমণি দাসী। এর পরেও পণ্ডিতেরা মায়ের পূজো করতে দেবে না!  দক্ষিণেশ্বরের মন্দির বিগ্রহহীন শূন্য পড়ে থাকবে না, কখনই। এ বিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহ।

কিন্তু ব্রাহ্মণরা তাঁর মন্দির গড়াকে অশাস্ত্রীয় বলে ঘোষণা করলে পাপের ভয়ে কেউ তো সে মন্দিরে যাবে না? রানীর চোখে জল। তবু এ নিয়ে তিনি বসে থাকবেন না। একটু পরে চোখের জল মুছে জামাইকে জানালেন,  হেরে যেতে তিনি শেখেননি । কলিকাতার পণ্ডিতরা বলেছে বলে সেটাই তো শেষ কথা নয়। লোক পাঠাতে বললেন, কাশীতে, মারহাট্টাদের দেশে, দক্ষিণ ভারতে। সেখানের বড় বড় পণ্ডিতদের আহ্বান জানাতে বললেন।

কিন্তু দূর দূর দেশ থেকেও নৈরাশ্যজনক সংবাদ আসতে লাগলো। শূদ্রের মন্দির প্রতিষ্ঠার অধিকার ভারতের ব্ৰাহ্মণ সমাজ মেনে নেবে না কিছুতেই। কলিকাতার পণ্ডিতরা প্রকাশ্যে আন্দোলন শুরু করলো। তাঁরা প্রচার করলো, রাসমণি দাসীর এই স্পর্ধা কিছুতেই সহ্য করা হবে না। এই ঘোর অনাচার মেনে নিলে হিন্দু সমাজে প্রবল বিকার দেখা দেবে। টাকা দিয়ে আর সব কেনা যায়, ধর্ম কেনা যায় না। রাসমণি দাসী আবার সেখানে অন্নভোগ দিতে চায়! শূদ্রের অন্ন দেওয়া হবে দেবতাকে! এর মধ্যেই কি কলির পাঁচ পা বেরুলো! ব্রাহ্মণদের উক্তি।

ধর্মপ্ৰাণা রানী রাসমণি ইংরেজের বিরুদ্ধে কূট কৌশলে লড়েছেন, কিন্তু ব্ৰাহ্মণ তাঁর চোখে দেবতুল্য, সেই ব্ৰাহ্মণের বিরুদ্ধে তিনি লড়বেন কী ভাবে? ভাঙা মনকে শক্ত করলেন।

রানীর মুশকিল হল, তিনি ব্ৰাহ্মণদেরও দুহাতে দান ধ্যান করেন। তাঁদেরকে শত্ৰু বলে মনে করতে পারছেন না। তবে পণ্ডিতসমাজ পুরো ব্যাপারটিকেই অশাস্ত্রীয় বলে ঘোষণা করে বসলে জনসাধারণ তাঁর দিকে আসবে না। তাঁর চাই শাস্ত্রের সমর্থন। ব্ৰাহ্মণ ছাড়া পূজা হয় না। দেবেন্দ্র ঠাকুরের দল পূজা আচ্চা তুলে দিয়ে বেদ পাঠ করাচ্ছে। সে সবের বিরুদ্ধেই তো রানী রাসমণি পূজার মহিমা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চান। অথচ ব্ৰাহ্মণরাই তাঁকে প্রতিহত করছেন!

মথুর মাঝে মাঝে সান্ত্বনা দিতে আসেন, কিন্তু রানী কিছুতেই প্ৰবোধ মানেন না। তিনি কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। মা কালী নিজে এসে তাঁকে অন্নভোগ দিতে বলেছিলেন, আদেশ দিয়েছিলেন মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দরিদ্রনারায়ণের সেবা করতে, তা আর ইহজীবনে সম্পন্ন হবে না!

একদিন মথুর হন্তদন্ত হয়ে এসে রাণীমাকে জানালেন, একটি সুসংবাদ আছে! উপায় হয়েছে।

কী উপায়, জানতে চাইলেন রানীমা।

মথুরের উত্তর, এক চতুষ্পাঠীর পণ্ডিত জানিয়েছেন,  রাণীমা মন্দিরের যাবতীয় সম্পত্তি কোনো ব্ৰাহ্মণকে আগে দান করুন। পরে সেই ব্ৰাহ্মণ যদি মন্দিরে বিগ্ৰহ প্ৰতিষ্ঠা করে অন্নভোগের ব্যবস্থা করেন, তা হলে আর শাস্ত্রের কোনো বাধা থাকে না।

রানী জানতে চাইলেন, ওই পণ্ডিতের বিধান সবাই মানবে কিনা। উনি কে এবং কোথায় থাকেন।

মথুরবাবু জানালেন, উনিও যে-সে পণ্ডিত নন। শাস্ত্রের বচন উদ্ধার করে ব্যাখ্যা করেছেন বিষয়টা।

পণ্ডিতের নাম রামকুমার ভট্টাচার্য। হুগলীর কামারপুকুরে বাড়ি। কলকাতায় এসে ঝামাপুকুরে টোল খুলেছেন। তাঁর সঙ্গে থাকে তাঁর সতেরো বছর বয়সী এক ভাই, তার নাম গদাধর। ছেলেটি বেশ ভালো গান গায়।

১৮৫৫ সালের ৩১ শে মে জ্যৈষ্ঠ পৌর্ণমাসী তিথিযোগে জগন্নাথের স্নানযাত্রার দিনটি শুভযোগ, সেইদিন হলো প্রতিষ্ঠা-উৎসব। নিজের গুরুর নামে মন্দির উৎসর্গ করে বিগ্রহ স্থাপনা করলেন। পূজারি পুরোহিত হিসেবে বহাল করলেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায় মশায়কে। তিনি নিয়ে এলেন নিজের ছোট ভাই, রামকৃষ্ণ, আর ভাগ্নে, হৃদয়কে তাঁর কাজে সাহায্য করবার জন্যে। মাত্র একবছরের মাথায় রামকুমারের মৃত্যু হল। পূজারী হলেন রামকৃষ্ণ। এরপর রানীও পরলোক গমন করলেন ১৮৬১ সালে।…

বইটি পড়ে ঈশ্বরচন্দ্র বেশ তুষ্ট হলেন। মনে মনে ভাবলেন, এবার অন্তত দক্ষিণেশ্বর মন্দির নিয়ে কিছু কথা বলা যাবে।

এরপর এলো সেই নির্দিষ্ট দিন। মাহেন্দ্রক্ষণ। ঠাকুর রামকৃষ্ণ হাসতে হাসতে গাড়িতে উঠছেন আর সঙ্গী মহেন্দ্র মাষ্টারকে বলছেন, চলো যাই, আজ সাগর দেখে আসি।

মহেন্দ্র মাষ্টার কথাটা তৎক্ষণাৎ বুঝলেন না, তবু বললেন, বোধ করি, সাগর দেখার খুব ইচ্ছে আপনার?

-সেখানেই তো যাচ্ছি। উনি তো সাগরই। শুধু এক সাগর নয়; দুই দুই সাগর। চলোখন। তুমি তো ওঁকে দেখেছ, আমিই বরং প্রথম দেখব। খুব মজা হচ্ছে।

ফিটন গাড়ি ছাড়ল। জোড়া ঘোড়ায় গাড়ি টানছে। ভিতরে ঠাকুর বসে রয়েছেন। সঙ্গে মাস্টার ও আরও দুজন;- ভবনাথ আর হাজরা। দুজনেই রামকৃষ্ণের পরম ভক্ত। রোজদিনই কলিকাতা থেকে সাড়ে আট মাইল হেঁটে দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের কাছে যায়। সারা বিকেল সন্ধে অন্য আগত ভক্তদের সঙ্গে তাঁর সামনে বসে থাকে। ভক্তি কথা শোনে ঠাকুরের মুখে। নামগান করে। তারপর একসময় উঠে পড়ে। বাড়ি ফেরে। সেই আট মাইল পথ পায়ে হেঁটে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। আবার পরেরদিন একই রুটিন। এক একদিন ঠাকুরের আদেশে রাতের ভোগারতির প্রসাদ খেয়েও ফেরে। আবার কোনোদিন বা ঠাকুর, সারদামাকে বলে লুচি হালুয়া করিয়ে  খাইয়ে ফেরত পাঠান ভবনাথ আর হাজরাকে। দুজন ছাড়াও  তো সঙ্গে রয়েছে মহেন্দ্র মাষ্টার;-ঠাকুরের ছায়া সঙ্গী। নিজের ইশকুল মাস্টারির  চাকরি ছেড়ে দক্ষিণেশ্বরেরই সারাদিন পড়ে আছে  । শুধু তাঁর নজর,  কখন ঠাকুরের মুখ নিঃসৃত হয়ে অমৃতবাণী বর্ষণ হবে আর তা লিপিবদ্ধ করে নেবে বগলদাবা করা খাতাটায়।

চলবে… 

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page