উপন্যাস।। আবার এসো ফিরে।। রামেশ্বর দত্ত

ঠিক আছে, ঠিক আছে। এতে লজ্জার কিছু নেই রেআমি তো সব জায়গাতেই আগে দৌড়ে যাই। এখানেও তাই এলাম। ও এমনই বললাম তোকে। এই নেয়ে…, হাতে ধরা সেক্সপিয়ার রচনাবলী পুস্তকখানা কাদম্বিনীর হাতে তুলে দিলেন। হাত বাড়িয়ে তা নিয়ে আর এক প্রস্থ প্রণাম সারল কাদম্বিনী। তার দেখাদেখি অন্যান্য মেয়েরাও ঈশ্বরচন্দ্রকে প্রণাম করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তিনিও সকলের প্রণাম নিলেন এবং জনে জনে একান্ত শুভকামনা জানিয়ে আশীর্বাদ করলেন। মেয়েরা আপ্লুত।

এরপর…

পর্ব- ৩৪ 

 এরই মাঝে হয়েছে কী, হোস্টেল ওয়ার্ডেনের কাছে খবর গেছে, ঈশ্বরচন্দ্র স্বয়ং হোস্টেলে এসেছেন। কাদম্বিনীকে আশীর্বাদ জানাচ্ছেন। ওপর থেকে নেমে ছুটে ছুটে আসলেন। কমনরুমে হাজির  হলেন। বিশাল বপু। তিনতলা থেকে দৌড়ে নিচে আসতে তাঁর দম বেরিয়ে গেছে। হাঁ করা মুখে কালীঠাকুরের মতো জিহ্বা বার করে হাঁফাচ্ছেন।

-স্যার, আসবার আগে একটা খবর দিলেন না…

মহিলা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তবে তার আগেই ঈশ্বরচন্দ্র বলে উঠলেন, খবর দিয়ে আসলে তো আপনার হাঁফের মাত্রা আরোই বেড়ে যেত মহাশয়া।

-হে হে…কী যে বলেন স্যার? সত্যিই আমরা অপ্রস্তুতে পড়ে গেলাম। আপনাকে যে কী দিয়ে অভ্যর্থনা জানাবো…

-কেন, এই তো বেশ লাফিয়ে, ঝাঁপিয়ে, হাঁফিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন…

মেয়েরা একত্রে হেসে উঠল। এতদিন তাঁরা দূর থেকে অতি সম্ভ্রমের সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্রকে চাক্ষুষ করেছে। তাঁর এই রসিক রূপ এই প্রথম দেখছে তারা। কথাবার্তা, চালচলন, কিছুতেই কোনও জাঁকজমক নেই। সাধারণ থেকেও অতি সাধারণ মানুষ যেন তিনি।

মেয়েরাই ঈশ্বরচন্দ্রকে আপ্যায়ন করে ডাইনিং হলে নিয়ে গেল। বিভিন্ন ধরণের মিষ্টি দিয়ে প্লেট সাজিয়ে তাঁর সামনে রাখল। থালা ভর্তি সরস মিষ্টির বহর দেখে তিনি আবার রসিকতা করলেন, এত রস পান করলে আমি যে রসসিক্ত হয়ে পড়ব রে।

  পরে সত্যি কথাটাই পাড়লেন, বয়স হয়েছে। এখনও মধুমেহ রোগ থেকে দুরে রয়েছি বটে, তবে তোদের এই আপ্যায়নে আমি বোধ হয় এবার সেদিকে পা বাড়াব।…এই নেয়ে, বলে, থালা থেকে একটা মিষ্টি তুলে মুখে দিয়ে প্লেটটাকে সরিয়ে রেখে দিলেন। জল পান করলেন। এবার বেরবেন। আবার একদফা নমস্কারের লাইন পড়ল মেয়েদের। তার মধ্যে কাদম্বিনীও রয়েছে।

হোস্টেল ছেড়ে বেরবার মুখে ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, চন্দ্রমুখী মেয়েটা আজ উপস্থিত থাকলে ভালো লাগত।

-স্যার, ও তো পরীক্ষা দিয়েই দেরাদুনে বাড়িতে চলে গেছে।

কথাটা বললেন ওয়ার্ডেন। ঈশ্বরচন্দ্র উত্তর দিলেন, তা জানি। তাই তো পত্র মারফৎ তাকে আশীর্বাদ জানিয়ে এখানে আসছি।…আচ্ছা, সকলে ভালো থাকবি। আমি আবার আসব।

হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে ফিরে চললেন নিজের কলেজে।

                                                   (৩৮)

  ঈশ্বরচন্দ্রের মেট্রোপলিটন কলেজ দ্রুত উন্নতির শিখরে চড়ছে। কলেজে বি এ অনার্স ক্লাসের প্রবর্তন ঘটাবার পর সেই বছরেই কলেজে ছাত্র সংখ্যা এমন একটা জায়গায় গিয়ে পৌছল যে এবার কলেজের স্থানান্তকরণ না করলেই নয়। জায়গায় সঙ্কুলান হচ্ছে না। ফলে পড়াশোনায় মান বজায় রাখা কষ্টকর হয়ে উঠেছে। ঈশ্বরচন্দ্রের তা একেবারেই মনপুতঃ নয়। হয় কলেজের নতুন শাখা খুলতে হবে, নয়তো নতুন বাড়ি করে সেখানে কলেজকে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তাতে অবশ্য সময় লাগবে। তবে দুটো কাজই একসঙ্গে চালনা করেছেন।

প্রথম খুললেন শাখা প্রতিষ্ঠান। বউবাজার অঞ্চল তাঁর জানা জায়গা। প্রায় পুরো যৌবনকালটাই কেটেছে সেখানে।  অঞ্চলটা নিজের আঙুলের মতো চেনা। কলিকাতার মধ্যবর্তী অঞ্চল। সেখানে কলেজ খুললে, ছাত্রদের যেমন আসা যাওয়ার সুবিধে হবে; তেমনই অদূরে কলেজ পাড়ায় রয়েছে হিন্দুস্কুল-কলেজ, সংস্কৃত কলেজ, প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। এসব কারণে প্রথমাবস্থায় মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশনের শাখা সেখানেই খুললেন। দেখতে দেখতে প্রতিষ্ঠান ছাত্রে ভরে উঠল। শাখা প্রতিষ্ঠান খোলা তো নয়, ঈশ্বরচন্দ্রের কাজ দুগুণ বেড়ে গেল। এখান ওখান করে ছোটাছুটি করা।

এতদিন তিনি হয় পায় হেঁটে; আর না হলে কখনও সখনও পালকি নিয়ে চলাফেরা করতেন। তবে শহরে এখন ট্রাম গাড়ি আসায়, তাতে চড়ে যাতায়াত করছেন। ঘোড়ায় টানা ট্রাম। একটাই তার বগি। চলে রাস্তায়  পাতা লোহার পাতের বিশেষ ধরণের লাইনের ওপর দিয়ে । লাইন পাতা হয়েছে শিয়ালদহ থেকে আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত। গাড়ি যায় বৌবাজার, ডালহাউসি, স্ট্যান্ডরোড হয়ে।

ঈশ্বরচন্দ্র তাতে চড়ে এখন দ্রুত পৌঁছান। বউবাজারে শাখা প্রতিষ্ঠান খোলার কারণে তাঁর যাতায়াত অনেক বেড়ে গেছে। । নিত্য এতখানি হাঁটা শরীর আর নিতে পারছে না। গতির ট্রামে যাতায়াতে এক এক, দু পয়সা খরচ হয় বটে, তবে শরীরে অনেকটা সোয়াস্তি এসেছে। তাও বাড়ি থেকে ট্রাম রাস্তা পর্যন্ত আসেন পাল্কীতে চেপে। সবটাই শরীরকে বাঁচানোর জন্যে।

এরকম সময়ে একদিন পুরনো পাড়া শঙ্কর ঘোষ লেনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছেন। এখানেই ছিল আদি ক্যালকাটা ট্রেনিং ইশকুল। পরে বন্ধ হয়ে গেছে। তাঁর নজরে এল বিশাল  উন্মুক্ত একটা জায়গা । তিনি জানতেন,  অঞ্চলটার নাম প্রয়াত শঙ্কর ঘোষের নামে। ভদ্রলোক ছিলেন স্থানীয় ধনাঢ্য ব্যক্তি।  কাছেই এক কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । নাম দিয়েছিলেন ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি। সেটা ছিল ১৮০৩ সাল।

বিশাল খালি জায়গাটা দেখে ঈশ্বরচন্দ্র আকৃষ্ট হলেন।  মন ঘুরতে শুরু করল। মেট্রোপলিটন কলেজের জন্যে নতুন জায়গার কথা মনে এলো ।

পাল্কি থামালেন। নিচে নামলেন। স্থানীয় লোকজনের কাছে খোঁজ খবর নিয়ে জানলেন, জায়গাটা বহুদিন ধরেই খালি পড়ে রয়েছে।

-জায়গার মালিক কে?

সঠিক ভাবে কেউই তা জানাতে সক্ষম হল না। কেউ নাম নিল শঙ্কর ঘোষ । কেউ বা তা নাকচ করে অন্য কারোও নাম নিল।

  কথা না বাড়িয়ে তিনি সেদিনের মতো ফিরে গেলেন নিজের কাজে। লোক লাগালেন। মালিকের খোঁজ হল। অল্পদিনে তাঁকে পাওয়াও গেল। দরদাম করে উপযুক্ত মূল্য দিয়ে জমিটা কিনে নিলেন ঈশ্বরচন্দ্র।

গাছ গাছালিতে ভরা জমি। তবে তা শহরের মধ্যেই। কাছেই ওই কালীমন্দির।

এমন এক জায়গায় নিজস্ব বাড়ি গড়ে কলেজ স্থানান্তরিত করলেও ছাত্রের অভাব হবে না। দেশে তো তাঁর কলেজই একমাত্র ব্যক্তিগত মালিকানায় গড়া কলেজ। বাকি যে কটা কলেজ রয়েছে, তা সরকারী পরিচালনায়। সরকারের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সেখানে ছাত্রদের অনেক বেশি মাইনে দিয়ে পড়তে হয়। আর তাঁর কলেজ স্বল্প বেতন নিয়ে ছেলেদের পড়বার সুযোগ করে দিয়েছে। তাইতেই কলেজ ফান্ডে বেশ কিছু অর্থ জমা হয়েছে।

বাড়ি তৈরী শুরু করলেন। টাকা খরচ হচ্ছে। বছর ঘুরে গেল। কাজ এগোতে এগোতে থমকে যাচ্ছে। টাকার অভাব। বাজার থেকে টাকা ধার করলেন। সময় লাগবে নতুন বাড়ি তৈরী হতে। লক্ষ্য রাখলেন, নতুন বছরে কলেজ নতুন বাড়িতে স্থানান্তরিত করে তবে তিনি কাজ থেকে ছুটি নেবেন।  সময়টা ঠিক রাখলেন ১ লা জানুয়ারি ১৮৮৭ ।

ইতিমধ্যে আবার পুস্তক বিক্রয়ের জন্যেও দোকান খুলেলেন। নাম দিলেন, দ্য ক্যালকাটা লাইব্রেরী। সুকিয়া স্ট্রীটে। তাঁর পুরনো বসত স্থান।  একদিন সেখানেই তিনি হারিয়েছেন তাঁর প্রভাবতীকে।

ক্যালকাটা লাইব্রেরিতে বসেই আবার তাঁর মনে পড়ে গেল প্রভাবতী সম্ভাষণের অসমাপ্ত লেখাটার কথা। একদিন খুঁজে খুঁজে তা বের করলেন নিজের বাড়ির লাইব্রেরী ঘর থেকে। সেদিন থেকেই আবার লেখা শুরু করলেন। প্রভাবতী, সেই তিন বছরের ছোট শিশুটি এখনও তাঁর মনে সেদিনের মতোই জাগরূক রয়েছে। এই বৃদ্ধ বয়সে শিশু যেন তাঁকে আবার নতুন করে ডাক দিল।

আগের লেখাটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন, -…… ‘প্রতিক্ষণেই আমার স্পষ্ট প্রতীতি হয়,… বৎসে! তোমার কিছুমাত্র দয়া ও মমতা নাই। যদি তুমি সত্বর পলাইবে বলিয়া স্থির করিয়াছিলে সংসারে না আসাই সর্বতোভাবে বিধেও ছিল।’

এইখানে এসে লেখা অর্ধসমাপ্ত করে রেখেছিলেন।   কর্মাটাঁড়ে রাতে বসে এতটা লেখার পর তাঁর লেখা থেমে গিয়েছিল। শেষ লাইনটা লিখে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। তারপর মন সুস্থ করবার জন্যে অভিরামকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন সাঁওতালি নাচ দেখার উদ্দেশ্যে।

এরপরের লেখা শুরু করলেন।–

‘…তুমি অল্প দিনের জন্যে আসিয়া সকলকে কেবল মর্মান্তিক বেদনা দিয়া গেলে। আমি যে তোমার অদর্শনে কি বিষম যাতনা ভোগ করিতেছি, তাহা তুমি একবার ভাবিতেছ না। আমার আহার বিহার, শয়ন, উপবেশন কোনও বিষয়ে অণুমাত্র সুখ নাই। আহারের সময় অধিক দিন, শোক সংবরণে অসমর্থ হইয়া, নয়ন জলে অন্ন ব্যঞ্জন দূষিত করি; একাকী উপবিষ্ট হইলে, তোমার চিন্তায় একান্ত মগ্ন হইয়া অবিশ্রান্ত অশ্রুবর্ষণ করি; কখন কখন, ভাবনাভরে, যেন যথার্থই তোমার কথা শুনিতে পাইলাম, এই মনে করিয়া চকিত হইয়া উঠি। ফলতঃ তুমি যে আমার কিরূপ যাতনায় নিক্ষিপ্ত করিয়া গিয়াছ, তাহার কিঞ্চিতমাত্র অনুভব করিতে পারিতেছ না।

বৎসে ! …

পরপর আরও ছটা অধ্যয় লিখে  গেলেন। শেষে এসে লিখলেন, –

‘বৎসে ! তোমায় আর অধিক বিরক্ত করিব না; একমাত্র বাসনা ব্যক্ত করিয়া বিরত হই-যদি তুমি পুনরায় নরলোকে জন্মপরিগ্রহ করিয়া থাক, যেন অবিচ্ছিন্ন সুখ সম্ভোগে কালহরণ কর; আর যাঁহারা তোমার স্নেহপাশে বদ্ধ হইবেন, যেন তাহাদিগকে আমাদের মতো যন্ত্রণাভোগ করিতে না হয়।

সারারাত জেগে ঈশ্বরচন্দ্র লেখা শেষ করে খাতা কলম বন্ধ করলেন। আবেগ মণ্ডিত হয়ে পড়েছিলেন। অশ্রুসিক্ত নয়ন তাঁর। ঝাপসা দৃষ্টি। খোলা জানালা দিয়ে দৃষ্টি বাইরের জগতে গিয়ে পড়ল।

ভোরের আলো ফুটছে । পূবে ক্ষীণ আলোকরেখা। পশ্চিমে মলিন চাঁদ। আকাশভরা স্বচ্ছ মেঘের বলিরেখা। পাখিদের কূজন সময়ের অপেক্ষায় থমকে রয়েছে।

চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন  । কলঘরে গিয়ে প্রাতঃকৃত্য সারলেন। তারপর সোজা ছাদে উঠে গেলেন।

কলিকাতার বাদুরবাগানের বাড়ির আকাশে নতুনের আবেশ; বাতাসে নবীন সুঘ্রাণ। বাংলার বুকে সেদিন  নববর্ষের সূচনা হচ্ছে। আর একটু পরেই কলিকাতা শহর জেগে উঠবে। দেখবে নতুন বছরকে। ঘরে ঘরে শঙ্খধ্বনিতে তার আহ্বান ঘটবে। বাঙালি নতুন সাজে সুসজ্জিত হবে। নতুন খাতা- পূজোয় ব্যবসায়ীর দল গিয়ে ভিড় জমাবে কালীমন্দিরে। দিনভর চলবে সে অনুষ্ঠান। দোকানে, ব্যবসা স্থলে গণেশের মূর্তি বসিয়ে ধূপ ধুনো ফল প্রসাদ সাজিয়ে ব্রাহ্মণ পুরোহিত দিয়ে পূজো সারা হবে।

আজ একটু পরেই তাঁকে একবার শঙ্কর ঘোষ লেনে নতুন বাড়ি তৈরীর কাজ দেখতে যেতে হবে।

কলেজের নতুন ভবন তৈরীর কাজকে অগ্রাধিকার দিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র যত বেশি কাজে মত্ত হয়ে উঠছেন, ততই তাঁর শরীরের প্রতি অবহেলার ভাগ বেড়ে চলেছে। শেষে একদিন বেশ ভালোরকম অসুস্থ হয়ে পড়লেন। উদরের রোগের কারণে খাওয়া দাওয়াতে অত্যন্ত বেশী রকমের সাবধানী হওয়ায়, রোজকার খাদ্যও নিয়মিত এবং সময়ে হয়ে উঠছিল না। ফলে বায়ু ও অম্ল পীড়ায় তাঁকে বেশি রকম কাবু করে ফেলল। এবার তো বাড়িতে আর একলা থাকা চলে না। ইচ্ছে করলেন, কর্মাটাঁড়ে চলে যাবার; কিন্তু শরীরের অবস্থা এমন নয় যে ট্রেন যোগে অতটা দূরত্ব যাওয়া সম্ভব হবে তাঁর পক্ষে।

দাদার অসুখের সংবাদ পেয়ে দীনবন্ধু এলেন তাঁকে দেখতে। দীনবন্ধুর অবস্থান তখন কলিকাতাতেই। তিনি ঈশ্বরচন্দ্রকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখবার প্রস্তাব দিলেন। রাজি হলেন না ঈশ্বরচন্দ্র। ভাইকে প্রস্তাব দিলেন তাঁর বউদি অর্থাৎ দীনময়ীকে গ্রাম থেকে নিয়ে আসবার। স্ত্রী আগমনে তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন, এমনটাই জানালেন।

দাদার ইচ্ছে পূরণ করতে দীনবন্ধু বীরসিংহে গেলেন। স্বামীর অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে দীনময়ী উতলা হলেন বটে, তবে তখন তাঁরও সামনে উভয় সঙ্কট। ছোটমেয়ে, শরৎকুমারী তাঁর কাছে এসে রয়েছে। মেয়ে সন্তানসম্ভবা। প্রথম বাচ্ছা। মায়ের কাছে হবে, তাই সে শ্বশুরবাড়ি থেকে এসে মায়ের কাছে রয়েছে। সামনের মাসেই তাঁর প্রসবের দিন।

বাবার অসুস্থার সংবাদ নারায়ণচন্দ্রের কাছেও পৌঁছাল। সে কলিকাতা গিয়ে বাবার কাছে থাকতে চায়। সঙ্গে ভবসুন্দরীকেও নিয়ে যাবে।

প্রস্তাবটা অতি উত্তম। কিন্তু তাতে বাধ সাধছে, বাবা যদি ত্যাজ্যপুত্রের হাতের অন্ন-জল গ্রহণ না করে? মনে তাঁর এমনটাই সংশয়। বিষয়টা নিয়ে আলোচনাও চলল নারায়নচন্দ্র,  দীনময়ীদেবী এবং দীনবন্ধুর মাঝে। অনেক আলোচনার পরেও পথ বেরল না। শেষ  শম্ভুচন্দ্র সেখানে উপস্থিত হয়ে প্রস্তাব রাখলেন, দাদা তো তাঁর পুত্রকে ত্যাজ্যপুত্র করেছেন; কিন্তু পুত্রবধূর ওপরে তো তিনি সদয় আছেন; তবে কেন না, বউমাই সেখানে গিয়ে দিন কতক থেকে শ্বশুরমশাইকে যত্ন আত্তি করে সুস্থ করে তোলে? শম্ভুচন্দ্র নিজেও কলিকাতায় দাদার কাছে এসে থাকার জন্যে প্রস্তুত।

এমন এক প্রস্তাবে সকলেই এ সমস্যার সমাধানের পথ দেখলেন। নিরুপায় হয়ে দীনময়ীও রাজী; তবে মনটা খারাপ হয়ে গেল তাঁর। এমনিতেই স্বামীর কাছে এখন তিনি দূরের মানুষ হয়ে গেছেন; তায়, নিজে থেকে তাঁকে ডেকে পাঠালেও যেতে পারছেন না, এতে না তিনি অভিমান করে বসেন। বয়সটা যে বড় বালাই?

স্বামী-স্ত্রীর মাঝে যতই কিনা বনিবনা না থাকুক, তবু কাছে থাকার একটা অন্য ফল থাকেই; তা সে যতই পাশে আছি বলা যাক; বয়সকালে কাছ আর পাশ, দুটো শব্দের মধ্যে অন্তরটা অনেক বেশি হয়ে প্রতিভাত হয়।

নারায়নচন্দ্র ভবসুন্দরীকে কথাটা জানালেন। ভবসুন্দরী তাতে না, বা হ্যাঁ, কিছু না জানিয়ে, স্বামীকে শুধু বলল, তোমার যা ইচ্ছে।

-কেন, বাবার কাছে গিয়ে থাকতে কি তোমার কোনও অসুবিধা আছে?

নারায়ণচন্দ্র প্রশ্ন করল স্ত্রীকে। ভবসুন্দরী উত্তর দিল, অসুবিধা আর কী। তোমার বিষয়গুলো এখন আমাকে একলা শুনতে হবে, এই যা।

তাঁর গলার স্বরে কিঞ্চিত ক্ষোভের প্রকাশ ঘটল। সে বুঝতে পারছে,  এই সুযোগ শ্বশুররমশাই হয়তো ব্যবহার করবেন।

পুত্রের প্রতি পিতার দুর্ব্যবহারের কারণ তার জানা। মানুষটি নিজ পুত্রবধূর প্রতি সদয় হয়েও সন্তানকে ত্যাজ্যপুত্র করেছেন শুধু মাত্র পুত্রের উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনের জন্যে! এই নিয়ে অবশ্য শ্বশুরমশাই এবং স্বামী, দুজনের সঙ্গেই বিশেষ অলোচনার সুযোগ তাঁর নেই। আড়েঠাড়ে স্বামীকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করলেও খোলামেলা কোনও উত্তর পায়নি । সেই থেকে জিজ্ঞেস করা বন্ধই করে দিয়েছে। তারপরেও এতগুলো বছর কেটে গেছে। সন্তানের মা হয়েছে। তাঁর সন্তানদেরও ঠাকুরদা হিসেবে শ্বশুরমশাই যা যা করণীয়, তা করেছেন। পৌত্র-পৌত্রীদের ভালোবাসেন। সময়ে সময়ে তাদের জন্যে নানান উপহার পাঠিয়ে দেন কলিকাতা থেকে। কিন্তু তবু নিজের সন্তানকে ক্ষমা দেখাবার নাম করেন না।

ভবসুন্দরী ভাবল, এইবার না হয় স্বামীকে রাজি করিয়ে শ্বশুর মশাইয়ের জন্যে একখানা পত্র লিখিয়ে নিয়ে যাবে। দেখবে, তা পেলে শ্বশুর মশাইয়ের মন পরিবর্তন হয় কিনা। সেইমত বলেকয়ে পত্রও লেখাল স্বামীকে দিয়ে। সেটা সঙ্গে করে একদিন কলিকাতায় শ্বশুরের কাছে এসে উঠল। সেজ শ্বশুরের সঙ্গে কলিকাতায় এসেছে।  সাথে করে ছোট ছেলেকেও এনেছে। নাতি, প্যারীকে দেখে যদি দাদুর মনের পরিবর্তন হয়।

শম্ভুচন্দ্র দিন কয়েক দাদার কাছে থেকে তাঁকে কিছুটা সুস্থ হবার পথে এগিয়ে দিয়ে গ্রামে ফিরে গেছেন। এখন পুত্রবধূর সেবায় দিন কাটছে ঈশ্বরচন্দ্রের। প্যারীর সঙ্গেও গল্পগুজব, লুডোখেলা, তামাশা করা, বই পড়ে শোনানো, ইত্যাদিতে ব্যস্ত থাকছেন দিনের অনেকটা সময়। ঠিক এই সময়ে ভবসুন্দরী একদিন কথায় কথায় নারায়ণচন্দ্রের বিষয়টা ওঠাল। স্বামীকে উদ্দিষ্ট করে বলল, আপানকে সেবা করবার জন্যে ওনার খুব আসবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু..

  কথা মাঝ পথে থামিয়ে রেখে ইচ্ছাকৃত সেখান থেকে উঠে গিয়ে শ্বশুরের জন্যে ফলের রস করে আনতে গেল। বুঝতে চাইল, শ্বশুরমাশাই  নিজে থেকে এই নিয়ে কিছু বলেন কিনা।

গেলাসে লেবুর রস ভরে নিয়ে এল। শ্বশুরের হাতে গ্লাস তুলে দিল। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র তখনও কিছুই বললেন না। প্রশ্নও তুললেন না। রস পান করে নিশ্চুপে রইলেন। ভবসুন্দরীর অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল পুনরায় একই প্রসঙ্গ তুলতে। তবে এবার  খালি গ্লাসখানা রাখতে গিয়ে হাতে করে নারায়ণচন্দ্রের লেখা চিঠিখান নিয়ে এল। তাড়াতাড়ি সেটা শ্বশুরের হাতে তুলে দিল। ভাব দেখাল,  যেন এ ক’দিন এখানে আসা ইস্তক চিঠির কথা তাঁর মনেই ছিল না। মুখেও সেরকমই কথাটা বলল, উনি এই পত্রখানা লিখে আমার হাতে দিয়েছিলেন। আপনাকে দিতে দেরী হয়ে গেল।

-পত্র কে দিয়েছে?  ঈশ্বরচন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন।

-আপনার ছেলে দিয়েছে। কাজে কাজে একেবারে ভুল হয়ে গেছে।

বাহানার উত্তর দিল। ঈশ্বরচন্দ্র হাত বাড়িয়ে পত্রখানা নিলেন। তবে তখন তখনই আগ্রহ  দেখিয়ে তা পড়লেন না। অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন।

রাতের সময়। ঘরে আর কেউ নেই। ঈশ্বরচন্দ্র একলাই রয়েছেন। খাটে আধা শোয়া অবস্থায়। চিঠিটা বার করলেন। দীর্ঘ তিন পাতার চিঠি। তিনি পড়তে শুরু করলেন-

শ্রীচরণারবিন্দেষু-প্রণতি পূর্বকং নিবেদনম

আপনার চরণ-কৃপায় আমার সকলই হয়েছে। যেমন হউক দশ টাকা উপার্জন করছি। বাইরে দেখতে আমি পরম সুখে আছি। কিন্তু আমার অন্তরে অহরহ বিষম কীট দংশন করছে। বেশভূষা পরিত্যাগ করেছি, অপর কোনও কামনাই মনোমধ্যে উদয় হয় না, কেবল মাত্র আপনার চরণ সেবাই এ দাসের মন অধিকার করে রয়েছে। পূর্বকৃত পাপগুলি স্মরণ হচ্ছে ও মন অনুতাপে বিকৃত হচ্ছে, কেবল মনে হচ্ছে, হায়! যদি সেসকল পাপ কাজ দ্বারা পিতৃচরণে অপরাধী না হতাম। যেমন পাপ করেছিলাম তেমন প্রতিফলও প্রাপ্ত হচ্ছি  আজ আপনার চরণতলে থাকলে কি বলে গণ্য হতাম, আর এখনই বা কি হয়ে আছি। জনসমাজে হেয় হয়ে আছি। এ সকলও সহ্য করতে পারছি, কিন্তু আপনার এ বয়সে পীড়ার সময়ে আমি আপনার চরণ সেবা করতে পারলাম না, এ অপেক্ষা আমার আর কি দুর্ভাগ্যের বিষয় হতে পারে?

পড়া থামিয়ে দিলেন। চোখের কোল মুছলেন ঈশ্বরচন্দ্র। ক্ষণিকের জন্যে দুচোখ মুদলেন। কিছু ভাবনা মনে আসছিল। তবে সেসব সরিয়ে রেখে আবার চিঠি পড়তে শুরু করলেন,

আমার জীবনের প্রধানতম কর্তব্য প্রতিপালন করতে পারলাম না। আপনি একবার স্বর্গীয় পিতামহের চরণ সেবার জন্যে কাশীধামে গমন করবার উদ্যোগ করছেন, এমন সময় আপনার এক আত্মীয় বললেন, ‘বিদ্যাসাগর, এমন গরমের দিনে কাশী যাবে বড় ভয়ের কথা।’ আপনি অম্লান বদনে উত্তর দিলেন, ‘কর্তব্য করতে যাব, তাতে প্রাণের ভয় করলে চলবে কেন?’  সেই থেকে মহাপুরুষ উচ্চারিত বেদবাক্যগুলি এ অধমের অন্তরে খোদিত হয়ে আছে। আজ আমি নিজ কর্মদোষে সেই কর্তব্য কর্ম থেকে বঞ্চিত হয়ে রয়েছি।

চলবে… 

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page