উপন্যাস। আবার এসো ফিরে। রামেশ্বর দত্ত
ঈশ্বরচন্দ্র হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। হ্যালিডের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। শেষে বললেন, আপনারা মজার লোক। প্রাণ নিয়ে পালালাম তাতে বললেন কাপুরুষ। আর ত্রিশ চল্লিশজন দস্যুর সামনে একা প্রাণ দিলে বলতেন, তাই তো, লোকটা বড় আহাম্মক, এত লোকের সামনে একা এগিয়ে মিথ্যে প্রাণটা দিল। আপনাদের মনের মতো কাজ করা কঠিন। এগুলেও দোষ, পিছুলেও দোষ।
মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে ঈশ্বরচন্দ্র হ্যালিডে সাহেবের ঘর ছাড়লেন। হ্যালিডে সাহেবের রসিকতা কিছুটা নিম্নবর্তী বলে মনে হয়েছে তাঁর।
রসিকতায় রসনা থাকে। সেখানে চারিত্রিক গুণাবলীর প্রশংসা থাকতে পারে; কিন্তু নিম্নবর্তী চরিত্রের পাঁক রসনাকে তিক্ত করে তোলে। এটাই স্বাভাবিক।
এরপর…
ঈশ্বরচন্দ্র কলেজ চালাচ্ছেন আর তার কানে আসছে নানান কথা। তার মধ্যে যা তাকে বিশেষ ভাবাচ্ছে, সেটা হল, হিন্দু কলেজের কিছু কিছু পড়ুয়া নিজের, বাপ ঠাকুরদার ধর্ম (হিন্দু) ছেড়ে খৃষ্টান হয়ে যাচ্ছে।
কয়েক বছর আগে এরকম ঘটনা ঘটিয়েছিল মধু। মানে মধুসূদন দত্ত। রাজনারায়ণ দত্তর ছেলে। ধর্ম পরিবর্তন করেছিল। ঈশ্বরচন্দ্র জানতেন। তখন মধুর বয়স ছিল সতেরো। ধর্ম নিয়ে বড্ড মাতামাতি শুরু করেছিল। বাবা হচ্ছেন কট্টর হিন্দু। ছেলে হল তাঁর বিপরীত। হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামি, নানান আদিদৈবিক, আদিভৌতিক আচার উপাচার তার পছন্দ নয়। সমাজের নিয়ম কানুনে ব্রাহ্মণদের অতিরিক্ত প্রাধান্য তার চক্ষুশূল ঠেকছিল। খৃষ্টান ধর্ম তার কাছে অনেক প্রগতিশীল, কুসংস্কারমুক্ত।
মধুর ছিল কবি ভাব। লর্ড বায়রণের কবিতায় মজা। তখন সে কলেজে। কলেজের পড়া ছেড়ে শুধু কবিতা লিখে চলেছে। ওর কলেজের এক ইংরেজ অধ্যাপক, নাম, ডেভিড লেস্টার রিচারডসন। তিনিও কবি। মধু অধ্যাপকের খুব কাছের হয়ে উঠল। অধ্যাপকের মত তার ওপরে বিস্তার হতে থাকল। সনেট জাতীয় কবিতা লিখতে শুরু করে দিল ওই বয়সেই। হিন্দু কলেজ ছেড়ে দিল। বিশপ কলেজে চলে গেল। সেখানে বেশি ইংরেজ ছাত্র। এসব সবই জানা রয়েছে ঈশ্বরচন্দ্রের।
তবে মধুর ব্যাপারটাকে ঈশ্বরচন্দ্র এতদিন একটা বিক্ষিপ্ত ঘটনা বলে মনে করতেন। তার মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষী গুণীর কাছে যা সম্ভব ছিল। কিন্তু এখন তো তিনি দেখছেন, রাম, শ্যাম যদু বা কলেজের ছেলেগুলোও অনেকেই ধর্ম পরিবর্তন করতে লেগেছে। চোখের ওপরে। ঘটনাগুলো শহরে ঘটছে। গ্রামে না হয় গরীবদের মধ্যে এর চল ভালো রকম রয়েছে, তা তিনি জানেন। খৃষ্টান হলে, দারিদ্র্য দূর হবে, ঘরের ছেলেরা বিনা বেতনে শিক্ষা পাবে, সেই আশায় সেখানে এর চল হয়েছে। তার জন্যে গ্রামে গ্রামে খৃষ্টধর্মের পাদ্রীরাও ঘুরছে । গির্জা তৈরী হচ্ছে। কিন্তু তাই বলে, শহরেও তা ঘটবে! এর একটা প্রতিকার হওয়া তো দরকার। তা না হলে, একদিন এমন হবে, হিন্দুদের আতস কাঁচের তলায় রেখে খুঁজে বার করতে হবে।
ঈশ্বরচন্দ্র এই নিয়ে লিখতে চান। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় তা প্রকাশও করবেন। তবে তার আগে বিষয়টা নিয়ে একবার আলোচনা করতে চান দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে। একদিন চললেন দেবেন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকো বাড়িতে। তিনি এলেন পাল্কী ভাড়া করে। শরীরটা দিনকতক ভালো যাচ্ছে না। হাঁটতে ইচ্ছে করছিল না।
পাল্কী এসে থামল ঠাকুরবাড়ির দোরগোড়ায়। তিনি নামলেন। ভাড়ার পয়সা মেটালেন। বড় গেট পেরিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকলেন। যথারীতি দ্বাররক্ষক তাঁকে দেখে সেলাম ঠুকে অতিথি ঘরে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে সে নিজে ছুটল বাবুকে খবর দেবার জন্যে।
ছুটির দিন। দেবেন্দ্রনাথ বাড়ির নিচের বৈঠকখানায় বসে। হাতে বই। পাতা খোলা। কিন্তু চোখ অক্ষরের ওপর নেই। উদাস মন নিয়ে বসে রয়েছেন। গভীর বেদনায় চোখ ছলছল করছে। কিছুদিন আগেই তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়েছে। দুর্ঘটনা ঘটেছে চোখের বাইরে। সুদূর ইংল্যান্ডে থাকার সময়ে দ্বারকানাথের মৃত্যু হয়েছে।
দ্বারকানাথ সেখানে হামেশাই যেতেন। একলা মানুষ। স্ত্রীকে হারিয়ে বিদেশে থেকে বেশি সময় কাটাতেন। আনন্দ স্ফূর্তির মধ্যে। তবে তিনি যে নিজের ছেলের প্রতি এতটাই অভিমানী হয়ে উঠেছিলেন, তা দেবেন্দ্র বুঝতে পারেননি।
ঘটনা হয়েছিল, বিদেশে বাবার জন্যে টাকা পাঠাতে দুমাস দেরী হয়েছিল। তাতেই অভিমান। এক আধটা টাকা নয়। মাসে লক্ষ টাকা। কলিকাতার সব ব্যবসা বাণিজ্য সামলে, ব্যাঙ্কের আমানতকে ঠিক রেখে, এতগুলো করে টাকা পাঠানো কিছু চাট্টিখানি কথা ছিল না। তাও কী, তিনি ওই টাকায় বিদেশে বসে এলাহি খরচ খরচা করে শেষ করছেন। কোথায় আজ ইংল্যান্ডের রাণীর সৌজন্যে পার্টি দিচ্ছেন, কোথায় ইংরেজ কর্তা অমাত্যদের নিয়ে স্ফূর্তি করছেন; আবার কখনো বা দু হাতে ইংরেজ মহিলাদের কাশ্মীরি শাল বিতরণ করছেন। সঙ্গে দু-চারজন দেশীয় যুবককে নিয়ে যেতেন, সেখানে তাদের থাকা খাওয়া, পড়ানো সব তিনিই করতেন। এ দেশে অর্জিত অর্থ ওইভাবেই তিনি শেষ করতে চেয়েছিলেন। তবে মনে হয়, সত্যিটা হচ্ছে, দেবেন্দ্রনাথ ছেলে হয়ে বাবার ওই উচ্চাভিলাষা মানতে না পারাটা বাবাকে সন্তানবিমুখ করে তুলেছিল। তিনি চেয়েছিলেন সন্তান তাঁরই মতো হোক। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ নিজের আধ্যাত্মিকতার পথ ধরে, সমাজ সংস্কারক হিসেবে কাজ করছিলেন, এটাও ছিল দ্বারকানাথের অভিমান। প্রিন্স উপাধি পাওয়া দ্বারকানাথের উপার্জিত বিশাল ঐশ্বর্যকে ছেলে নিজের করে ভাবতে পারল না, এটাতে তিনি ভেঙে পড়েছিলেন। ভাবলেন, তাহলে আর ওই ঐশ্বর্য বাঁচিয়ে রেখে লাভ কি? ধনসম্পত্তি শেষ করতে বসেছিলেন, শেষে ছেলেকেও ভুলে যেতে চেয়েছিলেন। তাই শেষটায় অদেখা দিয়ে চলে গেলেন।
-বাবু, ঈশ্বরচন্দ্র বাবু আয়া হ্যায়, আপসে মিলনে কা লিয়ে। ভেঁজু ক্যায়া?
বিহারি দ্বাররক্ষক দেবেন্দ্রনাথের সামনে এসে বলল। তাঁর চমক ভাঙল। বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ। জরুর ভেজিয়ে।
ঈশ্বরচন্দ্র সামনে এসে দাঁড়ালেন। পরনে হেটো ধুতি। গায়ে ফতুয়া। ওপর দিয়ে জড়ানো তাঁতের মোটা চাদর।
-আসুন, আসুন। দেবন্দ্রনাথ ঈশ্বরচন্দ্রকে অভ্যর্থনা জানালেন। সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে বসতে বললেন। প্রশ্ন করলেন, কেমন আছেন, বিদ্যাসাগর মশাই?
-আমি তো ভালই আছি। তবে আপনার পিতৃবিয়োগের সংবাদটা শুনেই এলাম। খুবই মর্মদায়ক।
দেবেন্দ্রনাথ চোখ বন্ধ করলেন। ঝপ করে জমা অশ্রুর দু ফোঁটা গাল বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়ল। জোর করে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলেন। মুখ তুলে একটা করুণ হাসি দিলেন। বললেন, আর কী বলব বলুন…
-সত্যি, এতদিনে আপনি বুঝি সাবালক হলেন, দেবেন্দ্র বাবু।
পরিবেশ সহজ করবার জন্যে ঈশ্বরচন্দ্র কথাটা বললেন, যাতে কষ্টের মাঝেও মানুষটাকে কিছুটা হাল্কা করা যায়। কথার অর্থ ধরতে পারলেন না দেবেন্দ্রনাথ। কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকালেন। ঈশ্বরচন্দ্র উচ্চারণ করলেন, জানেন, মাথার ওপর যতদিন ছাতা থাকে, তা সে পিতাই হন, আর মাতা, ততদিনই আমাদের শৈশবকাল। বাবা, বাছা, করে ডাকবার কেউ একজন থাকে। মনের দ্বিধা, সংশয়, ভালো মন্দ, কোনও কিছুর প্রয়োজনে মনে হয়, উনি তো আছেন, একবার আলোচনা করে নিলে হয় না? আর যেদিন দুজনেই ভগবানের প্রিয় হয়ে যান, সেদিন মনটাই হয়ে যায়, কাশী বিশ্বেশ্বরের মন্দির। মানে, কথা বলে যাও, পরামর্শ চেয়ে যাও, দুঃখ জানাও, উত্তর আর আসবে না। দেবতা যে পাথরের লিঙ্গ। শ্রদ্ধাভক্তি সবই দেখানো হবে, থাকবে না তাঁর প্রসারিত আশীর্বাদী হাত…
-আপনার মতো জ্ঞানী পণ্ডিতই এ কথা বলতে পারেন, বিদ্যাসাগর মশাই।
দেবেন্দ্রনাথের মনটা যেন একটু হালকা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে কথা বললেন।
-যা সত্যি, তাই বললাম, দেবেন্দ্রবাবু। আচ্ছা বলুন তো, আমরা হিন্দুরা, বিশেষ করে বাঙালীরা বাবা মাকে দেবতা বলে মানি কিনা? মানে জ্যান্ত দেবতা। যাঁর কাছে খিদে পেলে বলতে পারি, মা খিদে পেয়েছে, খেতে দাও। বাবাকে বলতে পারি, আজ আমার ইশকুলের মাইনে দিতে হবে। বাবা যেখান থেকে হোক, অর্থ জোগাড় করে এনে তা দেবেন। তাই বাবা মা-ই সন্তানদের কাছে ঈশ্বর, যাঁদের ছত্রছায়ায় থেকে সন্তান চিরকাল নিজেকে সুরক্ষিত ভাবে…
ঈশ্বরচন্দ্রের মুখের কথা শেষ হবার আগে দেবেন্দ্রনাথ বলে ওঠেন, না, না বিদ্যাসাগর মশাই, এ শুধু হিন্দু বা বাঙালীর কথায় সীমাবদ্ধ রাখছেন কেন? এ তো সব ধর্ম সব জাতের মধ্যে রয়েছে।
দেবেন্দ্রনাথ কথার মাঝে হালকা বোধ করতে থাকেন নিজেকে। মনের ভারটা অনেকটা কেটে গেছে।
-হ্যাঁ। সেজন্যেই তো, ইংরেজরা হিন্দু বাবা মায়ের অনুভূতি, তাঁদের সুখ দুঃখের কথা চিন্তা না করে, ছেলেদের ধরে ধরে খৃষ্টান বানাচ্ছে।
কথা শেষে তিনি মুখব্যদন করেন। পরে ফের কথা যোগ করলেন, এই জাতটা যেমন সভ্য, তেমন অসভ্য। খবর পাচ্ছেন না কিছু?
প্রসঙ্গটা দেবেন্দ্রনাথ ধরে ফেলেছেন। উত্তর করলেন, খবরও পাচ্ছি, বুঝতেও পারছি। কী বলবেন? আমার পরিচিত লোকের ঘরেই তো এ জিনিষ ঘটল। তাই নিয়ে কোর্ট আদালতও হল। জানেন না বুঝি?
বিস্ময় প্রকাশ করে ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, আপনার পরিচিত! কে?
-আর বলেন কেন। আমাদের সরকার মশাই। রাজেন্দ্রনাথ বাবু।
ঈশ্বরচন্দ্র উৎসাহী হয়ে উঠলেন ঘটনাটা জানাবার জন্যে। বললেন, যেমন?
-সে এক ল…ম্বা কাহিনি । দুই ভাইয়ের দুই বউ। একজন আমাদের সরকার মশায়ের। অন্যজন সরকার মশায়ের ভাই, উমাশঙ্করের। ভাইয়ের বউ আবার নাবালিকা। এগারো বছর বয়স। ভাইও চোদ্দো। দুই বউ পাল্কি চেপে যাচ্ছে। হঠাৎ সেখানে উমাশঙ্কর উদয় হয়ে পাল্কি থামিয়ে নিজের বউকে নিয়ে উল্টো পথে হাঁটা দিল। কী? না দুজনে নিজের ধর্ম ছেড়ে খৃষ্টধর্ম নেবে। ডফ নামের এক পাদ্রী তাদেরকে নতুন ধর্মে দীক্ষিত করবে বলে তাঁর নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিতে রাজী হয়েছে…
-এ তো ভারী অন্যায় কথা। দুজনেই তো নাবালক! নাবালকের আবার এ বিষয়ে স্বেচ্ছাধিকার রয়েছে নাকি!
ঈশ্বরচন্দ্রকে উত্তেজিত হতে দেখা গেল। দেবেন্দ্রনাথ বলে চললেন, সে কারণেই তো রাজেন্দ্রবাবুর বাবা গিয়ে সেই ডফ সাহেবের কাছে মিনতি জানালেন, ওদেরকে ফিরিয়ে দিতে। পাদ্রী সেকথা শুনলই না। উপরন্তু নিজের অভীষ্ট পথে এগিয়ে যেতে থাকল। ছেলেও চাইছে না, বাবার কাছে ফেরত যেতে। নিরুপায় হয়ে রাজেন্দ্রবাবুর বাবা কোর্টে নালিশ ঠুকে দিলেন। আশ্চর্য, কোর্ট দ্রুত মামলা শুনে রায় দিল, ছেলে যখন নিজে থেকে বাবার কাছে ফেরত যেতে চায় না, সেখানে কোর্টের কিছু করণীয় নেই।…আচ্ছা বলুন তো, নাবালকদের জন্যে যে আইন রয়েছে, তার অমর্যাদা করা হল না?
দেবেন্দ্রনাথ থামলেন, ঈশ্বরচন্দ্র বলতে শুরু করলেন। তিনি তখন উত্তেজনার চরমে। হাত পা নেড়ে বললেন, না, না দেবেন্দ্রবাবু। এ জিনিষ চলতে পারে না। ওরা তাহলে এবার এই কেসের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে ছোট ছোট ছেলেদের মাথা খাবে। তাদেকে নিজের ধর্মে নিয়ে গিয়ে ফেলবে। সাধে কি আর বলছি, এর পরে হিন্দু খুঁজতে আতস কাচ লাগবে।…এ বন্ধ করতে কিছু একটা করতেই হয়…
-কী করবেন, বিদ্যাসাগর মশাই…, বলতে বলতে, দেবেন্দ্রনাথ হুঁকোর নলে টান দিলেন। বুড়বুড়ি কাটার শব্দ উঠল হুঁকোর জলে। ঈশ্বরচন্দ্র সেদিকে তাকিয়ে হুঁকোর বাহারখানা দেখলেন; একেবারে রূপোর পাতে বাঁধানো। হুঁকোর আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে। জ্বলন্ত টীকা বেশ সুগন্ধযুক্ত। তা নাকি অম্বরি তামাকু।
একটু পরে বাড়ির ভিতর থেকে দুজনের জলখাবার এলো। থালা ভর্তি লুচির পাহাড় । রূপোর থালা। প্রতি থালায় গোটা দশেক করে লুচি। গব্য ঘিয়ে ভাজা। ঘিয়ের সুগন্ধ এসে লাগছিল ঈশ্বরচন্দ্রের নাকে। সঙ্গে বড় এক বাটি ছোলার ডাল। ভিন্ন রেকাবিতে অনেক ধরণের মিষ্টি। রসের এবং শুকনো নোনতা জাতীয় । ভৃত্যরা সেসব এনে দুজনের সামনে রেখে গেল। জল ভর্তি গ্লাস দিল। গ্লাস রুপোর পাতের। কারুকাজ করা।
দেবেন্দ্রনাথ হুঁকোর নল মুখ থেকে নামিয়ে ঈশ্বরচন্দ্রকে আহারে আহ্বান জানালেন। বললেন, আসুন, সকালের জল খাবারটা খেয়ে নেওয়া যাক। পরে বাকি কথা হবে।
টোকিও ডায়েরি।। প্রবীর বিকাশ সরকার ।।
খাওয়ায় মন দিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। তিনি খাচ্ছেন, আর মনে মনে জরিপ করছেন, নিজের বাড়ির জলখাবারের মান। শুকনো বাসি রুটি আর খুব হল তো, কুমড়োর ছক্কা; না হলে দেশি গুড়। এই দিয়েই জলখাবার সেরে এসেছেন এত বছর। অবশ্য বীরসিংহে গেলে সকালের জল খাবারে কদিচ কখনও লুচি জোটে। ছুটিছাটার দিন।
খাওয়া শেষে দ্বিতীয় প্রস্থের আলোচনা শুরু হল। দেবেন্দ্রনাথ হুঁকোয় মুখ ঠেকালেন। ঈশ্বরচন্দ্রকে বললেন, আপনিও টানুন।
ঘরে এক ধারে রাখা অন্য হুঁকোর দিকে নজর দিয়ে ঈশ্বরচন্দ্রকে তা গ্রহণ করতে বললেন। তিনি বসলেন হুঁকো টানতে। ঈশ্বরচন্দ্র কথা শুরু করলেন, দেবেন্দ্রবাবু, আমি ঠিক করেছি, এই নিয়ে লেখালিখি করব। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় তা প্রকাশ করব। পরে এই নিয়ে একটা আন্দোলনও গড়ে তুলতে হবে আমাদের।
দেবেন্দ্রনাথ তাঁর কথা শুনলেন। একটু সময় চুপ করে থেকে নিজের মত দিলেন। বললেন, তাই করুন। আমিও এ বিষয়টা নিয়ে ওপর মহলে কথা চালাচালি করছি। এ অন্যায় কাজ চলতে পারে না।
পরে ইংরেজদের উদ্দেশ্যে সগোক্তি করলেন, তোমরা এসেছিলে বণিক সেজে। বণিকের দণ্ড হল রাজদণ্ড। আবার এখন দেশটাকেও তুলে নিয়ে যেতে চাইছ…
(১২)
কয়েক মাস কেটে গেল। শীত গ্রীষ্ম, বর্ষা পেরিয়ে শরত কাল এসেছে। ঘরে মা আনন্দময়ীর আসার সময় এগিয়ে আসছে। ঈশ্বরচন্দ্রের মন টানছে বাড়ির দিকে। দুর্গা পূজোয় তিনি প্রতি বছরই বীরসিংহে যান। সেখানে গিয়ে পূজোয় মেতে ওঠেন। পুজো গ্রামে হলেও, নিজের বাড়িতে প্রতিমা বসিয়ে পূজো করেন। জাঁক জমক করে পুজো হয়। সঙ্গে নানান অনুষ্ঠান। কলিকাতা থেকে দল আনান। এ বিষয়ে শম্ভুচন্দ্র উদ্যোগ নেন।
এক তো পূজোর উৎসব, আবার সামনে দীনময়ীর সন্তান প্রসবের দিন আগত। ঈশ্বরচন্দ্রের একটা করে দিন কাটছে, আর কলিকাতায় বসে দীনময়ীর শারীরিক অবস্থার কথা চিন্তা করে উদ্বিগ্ন হচ্ছেন। এতে যেমন উৎসাহ তেমনই মন খারাপও হচ্ছে। উৎসাহের কারণ, তিনি প্রথম সন্তানের পিতা হতে চলেছেন। আর মন খারাপ, কারণ এমন সময়ে প্রিয়জনের নিকট-অনুপস্থিতি মেয়েদের মনে যে কী নিদারুণ বেদনাদায়ক হয়, তা তিনি অনুভবে উপলব্ধি করতে পারছেন। তাতেই বিমর্ষ হচ্ছেন । ভাবনা, ভালোয় ভালোয় পুজোটা কাটবে তো?
কাজ থেকে লম্বা ছুটি নিয়ে আশ্বিন মাসের মধ্যভাগে এক শুভদিনে ঈশ্বরচন্দ্র বীরসিংহ গ্রামের পথে রওয়ানা দিলেন। সঙ্গে তার পুষ্যির দল। ইতিমধ্যে মাস দুয়েক আগে সেজ ভাই শম্ভুচন্দ্রও কলিকাতায় এসে পড়েছিলেন। তিনিও রয়েছেন দাদার সঙ্গে। তাঁকে দিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র চিতপুরের শখের এক যাত্রাদলকে বায়না করিয়েছেন। পূজোয় গ্রামে গিয়ে যাত্রাপালা করবে। দুদিন যাত্রাপালা হবে। পালার নাম, অভিমন্যু বধ, আর কৃষ্ণ-অর্জুন-দ্রৌপদী উপাখ্যান।
চারদিনের পূজো। দুদিন মাত্র পালা হবে? এটা শম্ভুচন্দ্রের ঠিক মনঃপূত হচ্ছিল না। তাই তিনি দাদার অজ্ঞাতেই একদিনের পুতুলবাজির বায়না করে দিয়েছেন। নিজের গ্যাঁটের কড়ি দিয়ে। দাদার কাছ থেকে আর এর জন্যে টাকা চাওয়ার সাধ্য হয়নি। পাছে, দাদা ‘না’ করে দেন। তাহলেই পুতুলবাজির মতো কৌতুক ভরা নতুন জিনিষটা গ্রামের লোককে আর দেখাতে পারবেন না। নিজে একদিন কলিকাতার এক মেলায় তা দেখেছিলেন বটে। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গিয়েছিল। সেই থেকে মনে রেখেছিলেন, পূজোয় একে গ্রামে নিয়ে গিয়ে লোককে তাক খাইয়ে দেবেন। সর্বসাকুল্যে পঁচিশ টাকা লাগবে। তার পাঁচ টাকা বায়নামা দিতে হয়েছে। বাকি টাকা খেলা দেখাবার পর দিতে হবে। সবটাই শম্ভুচন্দ্র জোগাড় করে রেখেছেন। ছাত্র পড়াবার টাকা থেকে কিছু কিছু বাঁচিয়ে তা জমা করেছেন। দাদার অজান্তে কাজটা করেও কথাটা দাদার কাছে চেপে রাখতে পারলেন না । ভয়, দাদা পরে জানলে, পাছে রাগ করেন। পথেই তাই দাদার কাছে কথাটা উগরে দিলেন।
যাচ্ছিলেন গরুর গাড়িতে। দামোদর পেরিয়ে তিনটে গরুর গাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। ভাই দাদা আর দুজন একটায়। বাকি চারজন, আর একটায়। সব শেষের গাড়িতে ভৃত্য শ্রীরাম আর গোটা কয়েক কাপড়ের পুঁটুলি। তাতে রয়েছে নতুন কাপড়। বাড়ির সকলের জন্যে। তা বাদ দিয়েও গ্রামের পিসি খুড়ি, ঠাকুমা ছাড়াও গরীব দুঃখীদের জন্যে শাড়ি ধুতি। শ্রীরাম সেসব সামলে নিয়ে তৃতীয় গড়িতে বসে রয়েছে। সেও এই সময়ে বীরসিংহে আসে। সে আসলেও, সঙ্গে সঙ্গে নিজের গ্রামে চলে যায় না। পূজোর কটা দিন বাবুদের বাড়িতেই থাকে। বিজয়া কাটিয়ে তারপর নিজের গ্রামে যায়। আবার সকলের কলিকাতা রওয়ানা হবার আগে ফিরে আসে।
গাড়ি পাকা পথ ছেড়ে গ্রামের কাঁচা পথে নামল। সরু পথ। মাটির বড় বড় ঢেলার জন্যে পথ উঁচুনিচু। এ পথের তো আর দেখভাল সরকার থেকে করে না? যা হয়, তা গ্রামের লোকজন মিলে করে। সেখানে গাড়ির চাকা পড়ে এপাশ ওপাশ করে হেল দোল খেতেই থাকে।
পথের দুধারে সবুজ ধান ক্ষেত। মাঠে ধানগাছ লকলকিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। আগায় ফলন। ফলনে সোনা রঙ ধরেছে। আশ্বিনের মৃদু হাওয়ায় গাছ আনন্দে দোল খাচ্ছে। একবার মাথা হেঁট করছে আবার পরক্ষণে সোজা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কদিনের মধ্যেই ফলন কাটা পড়বে। নতুন ধানে ঘর ভরবে। বাড়ি বাড়ি নবান্নর উৎসব শুরু হবে। মেঠো রাস্তার ধারে ধারে কাশফুলের গুচ্ছ। তার মধ্যে দিয়ে তিনটে গোরুর গাড়ির মিছিল চলেছে। ঈশ্বরচন্দ্র একটায় বসে পথের শোভা দেখতে দেখতে চলেছেন। ঠিক সেই সময় শম্ভুচন্দ্র কথাটা বলে উঠলেন, দাদা, এবার কিন্তু পূজোয় একদিন পুতুলবাজিও হচ্ছে।
-সে আবার কে বায়না করল!
অবাক হয়ে ঈশ্বরচন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন। পরে বললেন, আমি তো জানি দুদিনের যাত্রাপালাই শুধু হবে।
-আমি করেছি, দাদা।
-তুই! কেন?
–দাদা, ভারি আমুদের জিনিষ। কলিকাতার এক মেলায় আমি দেখেছিলাম।
-টাকা?
–ও তুমি চিন্তা কোর না। আমি বায়নামার টাকা দিয়ে দিয়েছি। বাকি টাকাও সঙ্গে করে এনেছি। খেলার শেষে তা দিয়ে দোবো।
-তা বেশ করেছিস। কটা দিনই তো আমোদের…, কিছু লাগলে, আমাকে জানাস কিন্তু শম্ভু।
কথপোকথন শেষ হল। এতক্ষণে শম্ভুচন্দ্র নিশ্চিন্ত হলেন, যাক, দাদা, কিছু বলেনি।
নির্বিঘ্নে সকলে গ্রামে পৌঁছলেন। সঙ্গে সঙ্গে বাড়িময় হৈ হৈ, দাদা এসেছে…, মামা এসেছে…, চাকর দুজন ডাক পাড়ছে, বাবু এসেছে…। যে যেখানে ছিল, পুরুষ, রমণী, তাদের ছেলে,মেয়েরা, মায় চাকর, সবসুদ্ধ গোটা পরিবার এসে ভিড় করল বাড়ির চাতালে। মাথা হেঁট করে একে একে ঈশ্বরচন্দ্রের পায়ে ঢিপ ঢিপ প্রণাম করতে থাকল।
ওদিকে শ্রীরাম বাড়ির দুজন চাকদের ডেকে নিল, পুঁটলির বোঝা নামিয়ে গাড়ি খালি করতে। একটা দুটো করে মোট চারখানা। কোনওটায় রয়েছে, ছেলেদের ধুতি ফতুয়া, কোনটায় ছোট মেয়েদের ফ্রক জামা। আবার বাড়ির মহিলাদের জন্যে এক পুঁটুলিতে সাজগোজের কাপড়, সেমিজ, হাবিজাবি। এই রাজ্জির জিনিষ ঈশ্বরচন্দ্র বড়বাজারের সিংহ পরিবারের দোকান থেকে প্রতি বছর কিনে বাড়িতে নিয়ে আসনে। এটা তাঁর রীতি।
তাঁকে প্রণামের পালা শেষ হতে ঈশ্বরচন্দ্র এগিয়ে গিয়ে ঠাকুরদাসকে প্রণাম করলেন। ঠাকুরদাস, ভগবতীদেবী, দুজনাই বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। পূজোয় বাড়ির বড় ছেলের আগমন দুগগা পিতিমার আগমনের থেকে কিছু কম নয় তাঁদের কাছে। ভগবতীদেবীকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম সারলেন ঈশ্বরচন্দ্র।
মনোমোহিনী, দিগম্বরী, মন্দাকিনী, ঈশ্বরচন্দ্রের তিন বোন তাদের ছেলেপুলে এবং বরদের নিয়ে কদিন আগে থাকতেই মায়ের বাড়িতে এসে ঠাঁই গেড়েছে। বরাবর তাই করে ওরা। পূজোয় সকলে এককাট্টা হয়। কটা দিন হৈ হুল্লোড় করে কাটিয়ে যায়। ভগবতীদেবীর মেয়েরা যেমন এতে আনন্দ পায়, তাদের বরেরাও প্রাণ খুলে আড্ডা মজলিশ খাওয়া দাওয়া করে কটা দিন কাটায়। ছেলেপুলেদের কথা না বলাই ভাল। মামা, মাসী, দাদু দিদিমার সঙ্গে পূজোর চারদিনে তাদের অনেক আদর আবদার হুল্লোড় হয়। বয়স্করা তা হাসি মুখে সামলায়।
একে একে সকলে ঘরে ঢুকে গেল। বাইরে দাঁড়িয়েই ঈশ্বরচন্দ্র ওপরের দালানে দৃষ্টি রেখে দেখে নিয়েছিলেন দীনময়ীকে। ঘোমটার আড়াল থেকে মুখ বের করে তিনি নিচের কাণ্ড কারখানা দেখছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্রের সঙ্গে চোখাচোখি হতে এক মুখ হাসি ছড়িয়ে নিজের মানুষটির মনে আনন্দের ঢেউ তুলে দালান থেকে সরে ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলেন উপরে তাঁর আগমনের জন্যে। দীনময়ীর এখন আটমাস চলছে। পূজোর দশমীর পরেই তার সাধ ভক্ষণ অনুষ্ঠান হবে। ভরা পেটে তাই তিনি আর নিচে নামেননি। দালান থেকেই সব দেখছিলেন।
বাইরে কাজের জন্যে রয়ে গেলেন শুধু শম্ভুচন্দ্র। সঙ্গে ভৃত্য শ্রীরাম। নির্দিষ্ট পুঁটুলি খুলে কাজের লোকেদের জামা কাপড় বিতরণ সেরে ফেললেন শম্ভুচন্দ্র। বাকি বোঝাগুলো লোক দিয়ে তুলিয়ে নিয়ে নিজে ভিতরে ঢুকলেন।
গ্রামের পূজো যা হচ্ছে, তা হচ্ছে। সেখানে ঈশ্বরচন্দ্রের মন যতখানি না পড়ে থাকে, তার থেকে ঢ়ের বেশি থাকে বাড়ির পূজোয়। যেটা কি না স্বাভাবিক। তবে, গ্রামের লোক তাঁকে ছাড়লে তো? বাড়ুজ্যে পরিবারের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে সে এক এলাহি কাণ্ড করে পুজো হচ্ছে সেখানে। বারোয়ারী পূজোর চল শুরু না হলে কি হবে, ঠাকুরদাস পরিবারের কাছে এটাই গ্রামের লোকের আবদার। ঈশ্বরচন্দ্রেরও তায় সায় রয়েছে। টাকা তিনি বাবার হাত দিয়ে দেওয়ান। ঠাকুরদাসও তাতে অল্প কিছু টাকা যোগ করেন। জমানো টাকা থেকে তা দেন।
বাড়ির ঠাকুর হয়েছে চালচিত্তির দেওয়া। ছোট্ট ঠাকুর। লোকে বলে পুতুলঠাকুর। গ্রামের ঠাকুর তার থেকে একটু বড়। দুটোই চালচিত্তিরের ঠাকুর। কুমোর পাড়ায় তৈরি হয়েছে । মণ্ডপে আসছে পঞ্চমীর দিন।
মণ্ডপ হচ্ছে কাঁচা বাঁশের চালা; ওপরে মোটা চট সেলাই করে ছাউনি দেওয়া। তিনপাশ ঘেরা। রঙিন চাদরে। লাল নীল, বাঘ ছাপ, ফুল ছাপের গৃহস্থ বাড়ির চাদরে মণ্ডপ শোভা পাচ্ছে। তার নিচে উঁচু মাটিতে কাদা লেপে প্রতিমা বসবার আসন তৈরী হয়েছে। সবটাই আগে থাকতে সেরে রাখা ছিল। করেছে বাড়ির ছেলে মেয়ে বড় ছোটজন মিলে। বারোয়ারী পূজোতেও সেই একই চল। সেখানে করেছে গ্রামের ছেলে যুবকরা মিলে।
ডুলি চাপিয়ে প্রতিমাকে মণ্ডপে আনা হচ্ছে। সঙ্গে চার ঢাকির দলের বাজনা, কাঁইনানা, কাঁইনানা, গিজদা, গিজোর, গিজোড় গিজোড়, বোল তুলে বেজে চলেছে। আগুপিছু ছেলের দলের নাচ চলছে। মেজদা দীনবন্ধুর নির্দেশ এবং তাঁর আর্থিক সহায়তায় ছোট দুই ভাই, ঈশান আর শিব আগে থাকতে ঢাকি বায়না করার কাজটা করে রেখেছিল। ঢাকিরা দুর গ্রামের । সেখানে গিয়েই তাদের বায়নামা করে আসা হয়েছে। ওই দলের সঙ্গে ছোট দুটো ছেলে। তাদের হাতে কাঁসর। কাই নানা, কাঁই নানা আওয়াজ তুলছে। সঙ্গে পোঁ ধরা বাঁশির সুর।
প্রতিমা এলো। বেদীতে বসানো হল। একটু পরেই পুরোহিতও এসে হাজির। পণ্ডিত বিষ্ণুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। সহযোগী দুজন। একজন চণ্ডীপাঠের; অন্যজন কাজের জোগাড় দেবার। এ’কদিন তাঁরা ঠাকুরদাসের বাড়ির অতিথি সদস্য হয়ে থাকবে। যতক্ষণ না বিসর্জনের ঘট নাড়া হচ্ছে।
ঢাকির দল থাকবে পাঁচদিন। তাদের থাকবার আলাদা ছাউনি পড়েছে। মূল মণ্ডপ থেকে একটু দূরে। বাহ্যি পেচ্ছাবের ব্যবস্থা খোলা মাঠে। স্নান গ্রামের ছোট পুকুরে। তাদের কাজ হচ্ছে, সকাল দুপুর সন্ধ্যে যখন পূজো হবে, বাদ্য বাজাবে। এছাড়াও বাড়ির বড়কর্তা, মেজকর্তা চাইলে, তারা বিশ্রাম থেকে উঠেও বাদ্যিতে বোল তুলবে। নানান ধরণের বোল, দাদাগো দিদিগো গাবলাতে গরু দেখসে; গরু গরু গরু তার দেখব কি আর…। সেসব বোল কানে গেলে এক তো ছেলে বুড়ো করে সকলের পশ্চাতদেশ দুলবে, সঙ্গে হাসির ফোয়ারা ছুটবে। তায় সকালের বোল, দুপুরে বাজবে না। তার আবার অন্য বোল। সন্ধের ধুনুচি নাচের বোল সেও আরও আলাদা, ঝিকুর ঝিকুর, ঝিক ঝিক ঝিক, নাচতে না জানলে উঠোন ব্যাঁকা। পোঁ বাঁশিতে গানের সুর, ঢোলকে নাচের তাল। তা শুনে শুনে পাড়ার কচি ছেলে, যুবকরা দু পাছা চাপড়িয়ে নাচ করবে।
পঞ্চমীর পূজো গেল নমো নমো করে। সেদিন বিশেষ কোনও অনুষ্ঠান নেই। ষষ্ঠী থেকে শুরু হল আসল পূজো। বাড়ির মেয়ে বউরা সকলে সেদিন বাইরে বেরিয়ে পূজো মণ্ডপে এসে ভিড় করল। সকাল সন্ধে পূজো। দীপ ধূপ ধুনো পড়ল ঠাকুরের সামনে। পুরোহিত মন্ত্র উচ্চারণ সহ দুবেলার পূজো সারল। ষষ্ঠীতে ঠাকুরের কৃপা পাবার জন্যে ছেলে মেয়ের মায়েরা গলায় কাপড় দিয়ে পুষ্পাঞ্জলি দিল। দিনের বেলা। দিনে ফলাহার , রাতে লুচি তরকারী খেল।
উপন্যাস ।। আবার এসো ফিরে।। রামেশ্বর দত্ত
সপ্তমীর ভোরে বাজনদারের বাজনায় পাড়া পড়শির ঘুম ভাঙিয়ে শুরু হল নবপত্রিকার বরণ। প্রথমে স্নান। ঘাড়ে করে নবপত্রিকা নিয়ে চললেন শম্ভুচন্দ্র। গ্রামের বড় পুকুরে। আধ ক্রোশ দূরে। পিছনে ছেলের দল । তা ফিরে আসতে গণেশের পাশে নবপত্রিকার স্থাপনা হল। বাড়ির মেয়ে বউরা ততক্ষণে ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে নতুন কাপড় গায়ে চড়িয়ে মণ্ডপে হাজির। পরণে নীল রং মাখানো নতুন কোরা তাঁতের কাপড়। ঈশ্বরচন্দ্রের আনা। সপ্তমীর সারাদিনে আর কোনও পূজোর বালাই নেই।
পরের দিন সকালেই শুরু হল অষ্টমীপূজো। বাড়ির মেয়ে বউরা সাতসকালে স্নান সেরে ভিজে চুলে নতুন শাড়ি পড়ে পূজো আঙ্গিনায় এসে ভিড় করেছে। বাদ শুধু দীনময়ী। ঘটা করে পূজো হচ্ছে। পণ্ডিত মশাই মন্ত্র উচ্চারণ করছেন। জোর গলায়। বউরা গালায় কাপড় দিয়ে ঠাকুরের সামনে হাত জোড় করে বসে। মেয়েরা অতটা না করলেও তারা ভক্তির মাঝে হাসি ঠাট্টায় রত। ছোটরা হুটোপাটি করছে।
পুষ্পাঞ্জলির ডাক পড়তে যে যেখানে ছিল চলে এলো। সার দিয়ে দাঁড়াল। কয়েক সারিতে। সামনে ঠাকুরদাস, ভগবতী দেবী সহ ঈশ্বরচন্দ্র। পরের সারিতে দীনবন্ধু, শ্মম্ভুচন্দ্র, ঈশান। পাশ দিয়ে বাড়ি এবং প্রতিবেশী বউরা। অনেক বাইরের পুরুষরাও এসেছে। তারাও এখানে পুষ্পাঞ্জলি দেবে। সকলের সামনে বাড়ির ছোটরা। হাঁটু গেড়ে বসে। কেউবা ঘাসের মাটিতে থেবড়ে বসেছে। পণ্ডিত বিষ্ণুচন্দ্র মন্ত্র বলছেন,-
নমঃ মহিষগ্নি মহাময়ে চামুন্ডে মুণ্ডমালিনী। আয়ুরারোগ্য বিজয়ং দেহি দেবী নমোহস্তুতে…
বাজখাঁয়ি গলার শব্দ সকলের কানের মধ্যে দিয়ে একেবারে মনের গভীরে পৌঁছিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সমস্বরে চিৎকার করে মন্ত্র পড়া চলছে ভক্তদের।
একবার মন্ত্র শেষে হাতের ফুল বেলপাতা ঠাকুরের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেওয়া হল। দ্বিতীয়বার অন্য মন্ত্র। নমঃ সৃষ্টিস্থিতিবিনাশনাং শক্তিভূতে সনাতনি , গুণাশ্রয়ে গুণময়ে নারায়ণি নমোস্তু তে।
পরে, নমঃ শরণাগত পরিত্রানায় সরবস্যতিহরে দেবী নারায়ণি নমোস্তু তে। এষ সচন্দন-পুষ্পবিল্লপত্রাঞ্জলিঃ নমঃ দক্ষযঞ্জ বিনাশিন্যে মহাঘোরায়ৈ যোগিনী কোটিপরিবৃত্তায়ৈ ভদ্রকাল্যৈ ভগবত্যৈ দুর্গায়ৈ নমঃ।
প্রতিবারেই নতুন ফুল, বেলপাতা।
পুষ্পাঞ্জলি শেষ। এবার প্রণাম মন্ত্র। পণ্ডিত হাঁক পাড়লেন, সকলে চোখ বুজুন। হাত জোড় করে প্রণাম করুণ আর বলুন, জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী। দুর্গা শিবা ক্ষমা ধাত্রী স্বাহা স্বধা নমস্তু তে।
পুষ্পাঞ্জলি শেষে ভক্তিভরে মা দুর্গাকে প্রণাম জানিয়ে শান্তির জল নিয়ে যে যার মতো চলে গেল। বসে রইলেন ঠাকুরদাস আর ভগবতীদেবী। ঈশ্বরচন্দ্র ভাইদের নিয়ে চললেন, সন্ধি পূজোর সরঞ্জাম দেখতে ।
বিকেল তিনটেতে বসল সন্ধিপূজোর আসর। ঠাকুরের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হবে এখন। একশ আট প্রদীপ জ্বলে উঠল। একশ আট পদ্ম সাজান হল রেকাবিতে। তাতে সারা বাড়ির মহিলারা হাত লাগালো। দীনময়ীই শুধু বাদ তা থেকে। ঘোমটার আড়ালে মুখ ঢেকে তিনি বসে রয়েছেন মণ্ডপের এক কোণায়। তাঁকে ঘিরে রয়েছে, মন্দাকিনী আর দিগম্বরীর মেয়েরা। তারা পূজো দেখছে আর মাঝে মাঝে তাদের বড় মামীর সঙ্গে গল্প করছে। ভরন্ত পেটে দীনময়ীর এই চেহারা তাদের চোখে নতুন। মামীর কাছ ছাড়া হচ্ছে না।
ওদিকে পট্টবস্ত্র পরিধান করে ঈশ্বরচন্দ্র, ভগবতীদেবী আর ঠকুরদাস বসে সন্ধি পূজো দেখছেন। বাড়ির অন্যান্য মহিলারা গলায় কাপড় দিয়ে হাত জোড় করে বসে আছে। বাইরের থেকে গ্রামের অনেক মহিলারাও এসে ভিড় করেছে। সার দিয়ে বসা। তাদের বেশিরভাগই অনাহূত। কিন্তু তবু তারা আসে। পুজো দেখে। খাওয়া দাওয়া সারে। অষ্টমীর খাওয়া। সেও এক মহা আনন্দের । ঈশ্বরচন্দ্রই এ প্রথা চালু করেছেন। এই বাড়ির পূজোর প্রতি গ্রামের মানুষের আলাদাই একটা টান রয়েছে। বাড়ির কর্তার অনুরোধে পূজো শেষে পাত পেরে বসে খেয়েও যাবে।
সন্ধি পূজো শেষ হল। খাওয়া-দাওয়ার পালা শুরু। ভাত পাঁচ তরকারী, পায়েস দিয়ে খাওয়া। ব্রাহ্মণের বাড়ি। অষ্টমীতেও ভাতের চল। কায়স্থ হলে লুচি হত। বামুন চাকর রেখে রান্না করানো। সারাদিনে পাত পড়ল কিছু না হলেও দুশো মানুষের। পেট ভরে খেয়েদেয়ে ঢেঁকুর তুলতে তুলতে লোক ফিরে গেল।
সন্ধে হতে গ্রামের মানুষের ঢল নামল। অন্ধকার পথ। তাতে কী? সবপথ তখন মিলে গেছে মন্ডপতলার পূজো প্রাঙ্গণে এসে। ছেলে, বুড়ো, বাচ্ছা, মেয়ে বউরা দল বেঁধে চলেছে। অমন যে গ্রামের রাস্তা অন্য সময় ফাঁকা পড়ে থাকে, সেখানে লোক পায়ে পায়ে চলেছে। শুধু তো বীরসিংহ গ্রাম নয়। আশপাশের পাঁচ সাতটা গ্রাম থেকেও মানুষ আসছে। এমন পুজো অন্য গ্রামে হয় কোথায়? সেখানে তো সব নমো নমো করে পূজো। মানুষগুলোর গায়ে নতুন জামা কাপড়ের মেলা। যে যেমন পেরেছে, নতুন সুতো গায়ে তুলেছে।
সকলে গিয়ে জমল মন্ডপতলার মাঠে। সেখানে কিছু অস্থায়ী দোকানীর ভিড়। বেলুন, চরকি, নিয়ে বিক্রেতা দাঁড়িয়ে। তাকে ঘিরে কচি কাঁচার দল। কড়ি, আধলা ছোট বড় দিয়ে বেলুন কিনছে। বিলিতি বেলুন।
কেউ বা অদূরের বসা ঘুগনিওয়ালাকে ঘিরে রয়েছে। গরম ঘুগনি কিনে খাচ্ছে। মিঠাইয়ের দোকান বসেছে। তেলের কুপি জ্বালিয়ে। চলছে জিলিপি ভাজা। এক পয়সায় দশখানা। আজ সকলের হাতেই কিছু না কিছু পয়সার সমাগম হয়েছে। বিশেষ করে ছোটদের। বাবা মা দাদা দিদির কাছ থেকে দান পেয়েছে। তাই দিয়ে আনন্দ করছে।
আজকের আসরে পুতুলবাজি । গ্রামে ঢেরা পিটিয়ে তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পুতুল খেলানোর দল সকালেই গ্রামে এসে গেছে। মন্ডপতলায় একটা ঘরে ঠাঁই নিয়েছে তারা।
দুপুরের মধ্যে মণ্ডপতলার ভোল পাল্টে গিয়েছিল। একদিকে একটা ছোট স্টেজ । ভূঁয়ের থেকে সামান্য উঁচুতে। কাঠের পাটা লাগানো স্টেজ। তিনদিক ঘেরা। মাথা নেড়া। সামনে দড়ি। তাতে চাদর ঝোলানো। রঙিন চাদর। কারোও বাড়ি থেকে ধার করে আনা । পরদার কাজ করবে।
স্টেজের সামনে দর্শক বসার স্থান। শতরঞ্জি পাতা। বাড়ুজ্জ্যে বাড়ির লোকজন এসে গেছে । ঈশ্বরচন্দ্র তাদের নিয়ে সামনে বসেছেন। সেখানে দীনময়ী অনুপস্থিত। শম্ভুচন্দ্র হর্তাকর্তা হয়ে সব দিক সামলাচ্ছেন।
মণ্ডপের চারধারে লন্ঠন বাতি ঝোলানো। রেড়ির তেলের বাতি জ্বলছে। পলতে ওস্কানো রয়েছে। তাই আলোর জোর। আলোয় লোকজনের মুখ চিনতে অসুবিধা হচ্ছে না। বয়স্ক পুরুষ, মহিলারা সামনের সারিতে। তাদের আগে অবশ্য রয়েছে কচি কাঁচার দল। হৈ হট্টগোল চালিয়েই যাচ্ছে। ছেলে, যুবকরা পিছনের সারিতে একদিকে। অন্যদিকে মহিলাদের দল।
হঠাৎ ভ্যাঁ পোঁ, ভ্যাঁ পোঁ আওয়াজ। সঙ্গে ডুগডুগির শব্দ। কচিকাঁচার দল চুপ মেরে গেল। সকলের দৃষ্টি তখন সামনের স্টেজের দিকে। চাদরের পর্দা সরে গেল। পিছনে জ্বলে উঠল একটা লন্ঠনবাতি। তার আলোয় নজরে এল, নকল এক বাদশা। রংচং করা কাঠের পুতুল। জমকালো তার পোশাক। গলায় মস্ত ঝোলা চেনের মালা। চকচক করছে। বাদশা একটা উঁচু চেয়ারে উপবিষ্ট। বাজনা বেজে চলল। একে একে স্টেজের দুদিক থেকে সার দিয়ে দুটো দুটো, চারটে মেয়ে পুতুল বাদশার সামনে এসে দাঁড়াল। তাদের সাজপোশাকও বেশ চকচকে। মুখের রঙ লাল। মাথায় টায়রা পরানো। তারা নাচ শুরু করল। হাত পা নেড়ে, এক একবার স্টেজের ওপর লাফ দিয়ে , বাদশাকে ঘিরে ঘিরে। বাজনা যত দ্রুত হচ্ছে, নর্তকীদের নাচ অঙ্গভঙ্গি তত বাড়ছে।…নাচ শেষ করে নর্তকীরা বিদায় নিতে ঢুকল কোতোয়াল। সে ধরে এনেছে দুজনকে। তারা নাকি রাজ্যে রাজ্যে চুরি করে বেরায়। বাদশার কাছে কোতোয়াল নালিশ জানাচ্ছে। সে নালিশ মুখের আওয়াজে। পিঁ পিঁ শব্দ করে। কোথা থেকে যে সেই শব্দ আসছে, অনেকেই তা ধরতে পারছে না। আসলে, পুতুল নাচের কারিগরকে তো কেউ দেখতে পাচ্ছে না। সে দাঁড়িয়ে আছে সুতোর গোছা ধরে আর একপ্রস্থ পর্দার আড়ালে। স্টেজের ঘোর অন্ধকারের মধ্যে। তার হাতের সুতোর টানে, আর মুখে তালপাতার বাঁশি থেকে আওয়াজ বেরিয়ে দারুণ এক নাটকের সৃষ্টি করছে পুতুলের দল। ছোটরা ভারি আমোদ করছে সেই শব্দ শুনে।
বিচার পর্ব চলল অনেকক্ষণ। মাঝে হাসির খোরাক আনল, ক্যাংলা নামের এক জোকার। সে অবশ্য জ্যান্ত মানুষ। নিচের দর্শকদের সামনে ঘুরে ঘরে পয়সা তুলছে। কী? না চোররা বাদশাকে নজরানা দিলে, তারা মুক্তি পেয়ে যাবে। যে যা পারছে, আধ পয়সা, এক পয়সা, কড়ি, তাই নিজেদের পকেট থেকে তুলে এনে ক্যাংলার হাতে দিয়ে তাকে বিদেয় করছে। ক্যাংলার কাঙালির বেশভূষা দেখে হাসির লহর উঠছিল দর্শকদের মধ্যে। এদিক সেদিক থেকে বাচ্ছারা হাত বাড়িয়ে ক্যাংলার হাত ছুঁয়ে মজাও করছিল।
মজাটা জমে উঠল পরের খেলায়। ভয়ের খেলা। চাঁচাড়ি দিয়ে একটা ঘেরা কুয়ো বানানো হয়েছে। সেই কুয়ো থেকে উঠে এল কুঁয়োভূত। সে পুতুলের যেমন বড় নধর, তেমনি তার বীভৎস রূপ। মাথায় খাড়া খাড়া চুল। চোখ তার ঠেলে বেরিয়ে আসছে। পরণে কালো পোশাক, মুখ অসম্ভব রকমের বিকৃত করা। ছোটারা তো তাকে দেখেই দু চার হাত পিছিয়ে এসেছে। যাদের মা, কাকী, মাসীরা এসেছিল, সেই সব বাচ্ছারা মা কাকীদের কোলে চলে গেছে। ভূতটা অনবরত মুখ হাঁ করছে, আর সেখান দিয়ে আগুনের ফুল্কি বেরিয়ে আসছে।
এ খেলার উদ্দেশ্য বাচ্ছারা যাতে পাতকুঁয়োর সামনে না যায়। সেখানে ওই পাতকুঁয়োভুতের বাস। গ্রামেগঞ্জে জলের একমাত্র উৎস পাতকুঁয়ো। মাটির প্রায় সমতলে কুঁয়োর পাড়। সেখানে ছোটরা গিয়ে অনেক সময় বিপদ ঘটায়। পড়েও যায় কুঁয়োর মধ্যে। তাই তাদের জন্যে এই খেলা। সেখানে যাতে না যায় আর।…
খেলা শেষ। পুতুল বাজিগর এবার সবার সামনে এসে দেখা দিল। দেখা গেল, কুড়ি বাইশ বছরের একজন যুবক এতক্ষণ এসব কান্ড করে গেছে। তার সঙ্গে আরও দুজন লোক তার কাজে সাহায্য করবার জন্যে এসেছে। দুজনের একজন আবার সেই ক্যাংলা। ক্যাংলার আসল রূপ দেখে ছোটরা তার পিছনে পড়ে গেল। সেও খানিক তাদের নিয়ে মজা মস্করা করল। সেদিনের মতো অনুষ্ঠান শেষ হল। ফিরে চলল যে যার বাড়ির দিকে। ঈশ্বরচন্দ্রও হাসতে হাসতে তাঁর দলবলকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন।
সে রাতে দীনময়ীর পাশে শুয়ে শুয়ে তাকে পুতুলবাজির পুরো গল্পটা শোনালেন ঈশ্বরচন্দ্র। স্ত্রীর স্ফীত উদরে হাত বোলাতে বোলাতে আফসোস করতে থাকলেন, এমন একটা নতুন জিনিষ তার দেখা হল না। সোৎসাহে দীনময়ী বললেন, আপনি দেখেছেন তো? তাহলেই আমার দেখা হল।
শম্ভুচন্দ্রের নাম নিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, নাহ, বুদ্ধি করে ও এ কাজটা করে ভালই করেছে। গ্রামে তো এ জিনিষ দেখা যেত না। তবু ওর জন্যে তা সম্ভব হল।
-আপনি এখন ক’দিন থাকবেন?
প্রসঙ্গ পাল্টে দীনময়ী প্রশ্ন করলেন।
-কেন বলো তো? প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন। সেটা অবশ্য ঠিক দেখায় না জেনে ঈশ্বরচন্দ্র নিজেই জবাব দিলেন, আছি, দীনময়ী। তোমার বোধ হয় ভয় হচ্ছে?
-হবে না? আপনি কি মনে করেন আমি খুব সাহসী? না বাবা, আমার খুব ভয় লাগছে।
দীনময়ী হাত বাড়িয়ে স্বামীকে আঁকড়ে ধরলেন। বললেন, এসময়ে শুনেছি মেয়েরা মায়ের কাছে গিয়ে থাকে। তা আপনার মা তো আমাকে কাছ ছাড়াই করলেন না।
-মায়ের ইচ্ছে, প্রথম সন্তান তাঁর চোখের সামনে হোক। তাছাড়াও মা তো এতগুলো সন্তানের জন্ম দিয়েছে। মায়ের অভিজ্ঞতাও এখানে কাজ করবে। পেটোয়া দাইমা রয়েছে আমাদের । তাকে দিয়েই মা তোমার প্রসব করাবে, ভয় কোর না দীনময়ী। তাছাড়াও আমি তো পাশে রইলাম…
স্বামীর শেষ কথায় দিনময়ী খুশি হলেন। নিজের শরীরের কথা ভুলে একেবারে স্বামীর বুকের ওপর উঠে এলেন। বললেন, খোকার ডাক শুনবেন?
সরে গিয়ে চিত হয়ে শুলেন। ঈশ্বরচন্দ্রের মাথা নিজের স্ফীত পেটের ওপর ধরলেন। উত্তরপুরুষের ক্ষীণ নড়াচড়া অনুভব করলেন ঈশ্বরচন্দ্র। তারপর দুজনে একসময় ঘুমিয়ে পড়লেন।
নবমীর সকাল এলো। সূর্য উঠল। দিনের আলো চোখে ফিকে লাগছে। মনে বিষাদের সুর। পুরোহিত মন্ত্র পড়ছেন। উপস্থিত কারোও মন নেই সেদিকে। নিশি পোহালেই তো পূজো শেষ। তবু আজকের জন্যে বাকি রয়েছে সন্ধের যাত্রা পালা। তাতেই যা কিছু আনন্দ। আজকের পালা অভিমন্যু বধ। পূজোর বেলা যেমন তেমন কাটিয়ে সন্ধে নামতেই মানুষ চলল যাত্রাপালার আসরে।
যাত্রা শুরু হল। আসর জমজমাট। এক ঘণ্টা কেটে গেছে। দর্শক উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে, কখন অভিমন্যুর প্রবেশ ঘটবে। যাত্রার বাজনদারেরা বাজনা বাজিয়েই চলেছে। আওয়াজ চড়ছে উঁচু থেকে উঁচুতে। বাঁশির সুর সপ্তমে। হঠাৎ প্রবেশ ঘটল অভিমুন্যর। অর্জুন-পুত্র অভিমন্যু। দেহে যোদ্ধার সাজ। হাতে খোলা তরবারি। দর্শক উল্লাসে ফেটে পড়ল।
অভিমন্যু পরাক্রম দেখাতে শুরু করল। মহাভারত যুদ্ধের ১৩ তম দিন। অর্জুন, সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ। কৌরবদের দ্বিতীয় অংশের সঙ্গে যুদ্ধ করছে তারা। ইতিমধ্যে দ্রোণাচার্য চক্রব্যূহ রচনা করে ফেলেছে। ব্যূহ ভাঙার দায়িত্ব পড়ল অভিমন্যুর ওপর। দায়িত্ব পূর্ণ করার উদ্দেশ্যে সে কৌরবদের তিন অক্ষহিনী সেনাকে মেরে ফেলল। শ্রীকৃষ্ণ, বলরাম এবং কৃষ্ণ পুত্র প্রদুন্মর দেওয়া যুদ্ধের সমস্ত কৌশল ব্যবহার করে অজেয় রয়ে গেল অভিমন্যু। এইবার সে চক্রবূহ্য ভেদ করবে। কিন্তু… বূহ্য ভেদ করা হল না। কৌরব পক্ষের যোদ্ধারা একসঙ্গে হাত মেলাল। ছল করে অভিমন্যুকে তারা সরিয়ে নিয়ে গেল দূরে। নির্মম হাতে হত্যা করল বীরকে।
নিদারুণ শোকের দৃশ্য। হায় হায় রব উঠল দর্শকদের মধ্যে থেকে। বয়স্কা মহিলাদের কেউ চোখের জল ফেলল। পুরুষরা চোখের কোল মুছল । নবমীর নিশি গড়িয়ে এলো।
এল দশমীর সকাল। সকালে দধিকর্মা সেরে পুরোহিত তার দলকে নিয়ে নিজ গ্রামে ফিরে গেছেন । হাত ভরা দক্ষিণা আর গরুর গাড়িতে চাপিয়ে চারদিনের পূজোয় দেওয়া দান সামগ্রীর ঢারি নিয়ে। সেও এক দেখবার মতো জিনিষ। দূরে আড়ালে দাঁড়িয়ে যুবকের দল টিপ্পনী কেটেছে, দেখ দেখ, দাদু সারা বছরের কামাই করে নিয়ে যাচ্ছে। বয়োজ্যষ্ঠদের কানে গেছে কথাটা। তারা হাসি গিলে প্রচ্ছন্ন রাগ দেখিয়ে বলেছে, এই চুপ, চুপ। পণ্ডিত মশাই যাতে না শোনে। তা বিষ্ণুচন্দ্র তো বয়সের ভারে এক কান না, দু কানেই কম শোনে, তা কে জানে? কাজ থেকে তার মন একটুও সরায়নি।
সেদিনের যাত্রাপালা বসল দুপুরে । কৃষ্ণ-অর্জুন-দ্রৌপদি উপাখ্যান। দিনের আলো থাকতে থাকতে তা শেষ হয়ে গেল। এরপর শুরু হল দেবীবরণ। সঙ্গে মহিলাদের সিঁদুরখেলা। মাথা মুখে সিঁদুর মেখে এক একজন মহিলা হয়ে উঠলেন মা চণ্ডী। শেষে ঠাকুর ভাসানের পালা। বাড়ির ঠাকুর আর গ্রামের ঠাকুর দুই পাশাপাশি চলল। মা দুর্গা তার ছেলেমেয়েকে নিয়ে কাঁধে চড়ে এসেছিলেন আবার কাঁধে চেপেই চললেন। এসেছিলেন নিরাভরণে। গেলেন, ফুল মালা, ধুপ ধুনো, আতসবাজির ঝলক দেখতে দেখতে। সঙ্গে বাজনদারদের তাল, ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন, ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ…। সঙ্গে উদোম নাচ । ছেলে বুড়ো নির্বিশেষে। সব শেষে ফিরে এসে মিষ্টিমুখ।
চলবে…