উপন্যাস।। কমরেড নয়ন।। সৌপ্তিক চক্রবর্তী
নয়ন আর কথা না বাড়িয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। ওদিকে পিলু ঘোষও তাদের বাড়িটা ক্রশ করে চলে গেল। পিলু ঘোষকে দেখলেই নয়নের সেই পিউয়ের আত্মহত্যার কথা মনে পড়ে। পাড়ার মোড়ে পিলু ঘোষের একটা লটারির দোকান আছে। টেনেটুনে সংসার চলে। পিউ ছিল পিলু ঘোষের মেয়ে। তখন তার বয়স হবে সাতাশ-আটাশ। সুশ্রী-লম্বা। একটা কল সেন্টারে কাজও করত শুনেছিল নয়ন। কেন যে সে এই রাস্তা বেছে নিয়েছিল তা আজও অজ্ঞাত। মানে পাড়ার লোকেদের কাছে। পিউই ছিল বড়। আর একটা ছেলে আছে। পিলু ঘোষের বাড়িটা নয়নদের দুটো বাড়ির পরেই।
ঘটনাটা আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগের। প্রতিদিনের মতোই পার্টি অফিসের সামনেটায় চেয়ার পেতে বসে নয়ন ও অন্যান্য কমরেডরা আড্ডা দিচ্ছিল। কাউন্সিলর রথীন মিত্রও ছিল। সেবার বোর্ড তৃণমূল গড়লেও বেশ কয়েকটা ওয়ার্ডের মতো এই ওয়ার্ডটাও তারা ধরে রাখতে পেরেছিল।
সন্ধে সাতটা হবে। হঠ্যৎ পাশের বাড়ির শুভ ছুটতে ছুটতে এসে হাঁফাতে হাঁফাতে বললঃ নয়নদা, সজলদা শিগগিরি চল। পিউদি ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে আর তারপরি চিৎকার করেছে। আর দরজা খুলছে না। কাকিমা, বিল্টু ডাকাডকি করছে কিন্তু তাও খুলছে না। শুনেই নয়ন ও অন্যান্যরা দৌড় লাগাল পিলু ঘোষের বাড়ি।
নয়নরা পৌঁছে দেখল পিউয়ের খুড়তুতো দাদা ভেলু ‘পিউ, এই পিউ’ বলে ডাকতে ডাকতে প্রবল ধাক্কাধাক্কি করছে দরজায়। সামান্য অপেক্ষা করেই নয়ন আর ভেলু মিলে ধাক্কা দিয়ে দরজার ছিটকানি ভেঙে ফেলল। দরজা থেকে ঘরের ভেতর তাকিয়েই নয়ন হতভম্ব দাঁড়িয়ে গেল। ওড়নার ফাঁস দিয়ে খাটের ঠিক ওপরে সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলছে পিউ। খাটের সামনে মেঝের ওপর একটা প্লাস্টিকের টুল উল্টে পড়ে আছে। ভেলুও হকচকিয়ে গিয়েছিল। তারপর দৌড়ে গিয়ে খাটে উঠে পড়ল। দেখাদেখি নয়নও।
‘ওরে তুই এ কী করলি রে?’ বলে দরজা ধরে আর্তচিৎকার করে উঠল পিউয়ের মা। ওদিকে নয়ন দুহাতে পিউয়ের কোমরটা জাপ্টে ধরে তুলে রেখেছে তার নিষ্প্রাণ শরীরটা আর ভেলু প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে ফাঁস খোলার। কিন্তু পারছে না। ‘শিগগির একটা ছুরি আন’ বলতেই বিল্টু ছুটে রান্নাঘরে চলে গেল ছুরি আনতে। ততক্ষণে পার্টি কমরেডরা, পাশের বাড়ির কেউ কেউ, পিউয়ের কাকিমা ইত্যাদি সবাই ঘরে ঢুকে পড়েছে। সুজয়ও এসে গেছে। খবর পেয়ে। ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স ডাকছে। অ্যাম্বুলেন্স ডাকাটা নেহাতই নিয়মরক্ষা আর এখনও হয়তো আশা আছে এমন ধরে নেওয়া। মিরাক্যল কি ঘটে না!
সত্যি বলতে কি নয়নের যে ঠিক কেমন অনুভুতি হচ্ছিল তা সে কোনোদিনই প্রকাশ করতে পারেনি। হয়তো পারবেও না। পরিণত বয়সে সেই প্রথম সে কোনো যুবতী শরীর এভাবে জড়িয়ে ধরেছিল অথচ সে শরীর মৃত!
ছুরি দিয়ে ফাঁস কেটে পিউয়ের শরীরটা ভেলু আর নয়ন মিলে যখন বিছানায় শুইয়ে দিচ্ছে তখনই নয়ন বুঝল পিউ আর নেই। মানে থাকতে পারে না। তার হাতে ধরা পিউয়ের ঘাড়। স্পাইনাল কর্ড ভেঙে গিয়ে লটপট করছে আর হিসুও বেরিয়ে গেছে পিউয়ের। পেটের নিচে ম্যাক্সির খানিকটা ভিজে গেছে। শেষ প্রেশারটা আর কি।
পিউয়ের মা বিলাপ করে যাচ্ছিল একটানা। নয়নকে সামনে পেয়ে তার পাঞ্জাবিটা দুহাতে শক্ত করে ধরে ‘ওরে নয়ন এ আমার কি হল রে!’ বলে ডুকরে উঠতেই নয়ন মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে বললঃ কিচ্ছু হয়নি বৌদি, আমরা তো ঠিক সময় এসে পড়েছি, অ্যম্বুলেন্সও এসে গেছে, শান্ত হও একটু।
ততক্ষণে ধীরে-সুস্থে রথীন মিত্র ঘরে এসে ঢুকল। পরপরই তৃণমুলের পরাজিত প্রার্থী মলয় লাহিড়ি। অ্যম্বুলেন্স এসে গেছে। বিশ্বাস না করলেও এটা সত্যি যে পিউয়ের প্রায় ঠান্ডা হয়ে আসা শরীরটা যে চারজন ধরাধরি করে অ্যম্বুলেন্সে তুলল তারা হল রথীন মিত্র, মলয় লাহিড়ি, নয়ন আর সুজয়। যতটুকু নয়নের মনে পড়ে সেই প্রথম ও শেষবারের মতো তারা চারজন মিলে একইসাথে কোনো কাজ করেছিল।
অ্যম্বুলেন্স স্টার্ট দিতে না দিতেই পিলু ঘোষ এসে পৌঁছল। তাকে দেখে পিউয়ের মা আবার ডুকরে উঠে বললঃ ওগো, আমাদের পিউ গলায় দড়ি দিয়েছে গো! বলেই আবার কান্নায় ভেঙে পড়ল।
নয়ন একটা কথা শুনেছিলঃ অল্প শোকে কাতর আর বেশি শোকে পাথর। সেইবার দেখল। পিলু ঘোষ একটাও কথা বলল না। বৌদি ছুটে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে তাকে খামছে ধরে বুকে মাথা রেখে বিলাপ করে যাচ্ছিল। আর সত্যি সত্যিই ঠিক পাথরের মতোই স্তির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল পিলু। চোখে জল নেই কোনো। একবারের জন্য যে হাত তুলে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরবে তারও শক্তি ছিল না।
অ্যম্বুলেন্সে করে পিউকে নিয়ে চলে যেতেই নয়ন আবার ওই ঘরে এসে ঢুকেছিল। তার নজরে পড়েছিল নিচু দেরাজের ওপর পেন চাপা দেওয়া একটা রুলটানা কাগজ। সে ওটা নিয়ে পিউয়ের কাকিমার হাতে দিল। যদি পুলিশ কেস হয় তখন লাগবে সেটা। ওটা আর কিছুই নয় পিউয়ের সুইসাইড নোট। ইংলিশে লেখা। নয়ন পুরোটা পড়েনি। চোখ বোলাতেই ‘আই কুইট’ লেখাটা দেখে নিয়েছিল। তবে যেটা নয়নের নজরে পড়েছিল তা হল পিউয়ের হাতের লেখা ঝকঝকে মুক্তোর মতো। শেষলেখাতেও দ্যুতি হারায়নি।
নয়ন বাড়ি ঢুকেই সোজা বাথরুমে চলে গেল। ঠান্ডা জলে অনেক্ষণ ধরে স্নান করল। মাথাটা ব্যাথা না করলেও বমি বমি ভাবে আর চোখের সমস্যায় কাবু ছিল সে। এখুনি হয়তো আবার মাথা যন্ত্রণাও শুরু হবে! ঘরে গিয়ে বিছানায় বসল। নুপুরবৌদি এসে একটু দইয়ের ঘোল দিয়ে গেল। সেটা খেয়ে নিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল।
এগারো
আজ তিন-চারদিন হল নয়ন বিছানায় পড়ে আছে। তিন-চারদিনই হবে হয়তো। নয়ন পুরোপুরি ঠাওর করতে পারে না। যন্ত্রণায় মাথাটা তার ছিঁড়ে যাচ্ছে। এমআরআই করে ফেরার পর থেকে আর বাড়ি থেকে বেরোয়নি। মাঝে মাঝে জ্ঞান ফিরছে। একটুক্ষণ থেকেই আবার চলে যাচ্ছে। একটা ঘোর তন্দ্রার মধ্যে বেঁচে আছে যেন। প্রথম দু-তিনদিন কোনোমতে উঠে বাথরুম যেতে পারছিল। গতকাল থেকে তাও পারছে না। টিংকু ধরে নিয়ে গিয়ে কাল আর আজ পটি করিয়ে দিয়েছে। হিসুটা বিছানাতেই। প্রথমদিন দুপুরে ডিম-ভাত খেয়েছিল। বমি হয়ে গেল। তারপর ফ্যানাভাত তাও বমি হল। গত দু-তিনদিন দুধ-খই। আজ শুধু দুধ খেয়েছে একবার। নিজে খেতে পারছে না। মাথাই তুলতে পারছে না। নুপুরবৌদি খাইয়ে দিচ্ছে। কি যে হল!
মিহির আর টিংকু ওদিকে এমআরআই রিপোর্ট নিয়ে গিয়েছিল গগনডাক্তারের কাছে। ভাল করে দেখে জবাব দিয়ে দিয়েছে। ব্রেণ টিউমার। ফাইনাল স্টেজ। সে নাকি সেটাই সন্দেহ করেছিল। ‘দেখ, আমায় যদি জিজ্ঞেস কর তবে বলব, আর কিচ্ছু করার নেই। একেবারে একজ্যাক্ট তো বলা সম্ভব নয় তবে একমাসও থাকতে পারে, দুমাসও থাকতে পারে কি কিছু বেশিও হতে পারে। তবে ট্রিটমেন্টে আর কাজ হবে না। তাও, তোমরা একটা সেকেন্ড ওপিনিয়ন নিয়ে নাও।’ বলে গগনডাক্তার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল।
ইশ! সামনেই বাই-ইলেকশন। আর তাকে ঠিক এখনই বিছানায় পড়তে হল! একবার দুবার বুঝেছিল যে কেউ কেউ তাকে দেখতে আসছে। রিংকু আর তার বর রবি এল। মিহিরদাতো এলই। রথীন মিত্রও যেন এল মনে হল। আর হ্যাঁ, সুপ্রিয়রা এল। ইশ! যদি মেঘনা থাকত এই সময়। কি সুন্দর করে ও মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল! সেই যেমন মা দিত। আর ওই যে শরীরিসুখ! ঘোরের মধ্যে পড়ে থাকতে থাকতে নয়নের এমনই সব মনে হত লাগল।
পার্টি অফিসের কথা, হারুদা-মিহিরদার সাথে প্রথম ভোটের কাজ করার দিনগুলোর কথা, এক্স এমএলএ কাঞ্চন সান্যালের সাথে আলাপ হওয়ার দিনটা, পুরনো পার্টি অফিসটার কথা, রেড ভলেন্টিয়ার হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে করোনার দিনগুলোর লড়াইয়ের কথা এইসব আরও অনেককিছু ছেঁড়া ছেঁড়া ভাবে মনে পড়তে থাকল তার।
সেকেন্ড ওপিনিয়নও নেওয়া হল। টিংকুর এক কলিগের সুবাদে কলকাতার এক বড় ডাক্তারের থেকে। তবে বিশেষ কোনো হেরফের হল না। গগনডাক্তার ভুল বলেনি কিছু। একবার জ্ঞান ফিরে নয়ন যখন জিজ্ঞেস করেছিল রিপোর্টের কথা টিংকু তাকে মিথ্যা বলেছিলঃ ও তেমন কিছু নয়, ওষুধে আস্তে আস্তে সেরে যাবে। তুই ওসব নিয়ে ভাবিস না। চুপ করে ঘুমো এখন।
মায়ের গলাটা পেল যেন, ওই তো মেঘনা এল মনে হয়, গেটে যেন শব্দ হল, মিহিরদা ডাকছে, না? ‘এই বিশু এটা কিভাবে লিখছিস? দে, তুলিটা আমায় দে, তুই ধর এগুলো’ সজল বিরক্ত হয়ে বলে উঠল যেন। নয়ন চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে। নির্ঘুম এক ঘোর খালি। একটা ঘুটঘুটে অন্ধকার যেন তার পাশে বসে অপেক্ষা করছে আর প্রস্তুতি নিচ্ছে ঝাঁপিয়ে পড়ার। আর কতক্ষণ!
মেঘনার সাথে সঙ্গমের তৃপ্তি, যার গাঢ়তার রেশ তখনও মেলায়নি আর আসন্ন বাই-ইলেকশনে কোনো কন্ট্রিবিউশন না রাখতে পারার চূড়ান্ত আক্ষেপ নিয়ে নয়ন জ্ঞান-অজ্ঞানের মাঝে পড়ে থাকল।
বারো
নয়ন মারা গেল। একদিন ভোরবেলা। শেষ এগারোটা দিন আর জ্ঞান ফেরেনি।
প্রতিদিনের মতো ঘুম থেকে উঠে নয়নকে দেখতে এসে তার গায়ে হাত দিয়েই নুপুরের মনে হয়েছিল যে নয়ন বোধহয় আর নেই। টিংকু-তুলিকে ঘুম থেকে তুলে সে তা জানায়। তারপর গগনডাক্তার এসে পরীক্ষা করে ডেথ-সার্টিফিকেট দিয়ে গেল।
শেষশয্যায় পরিচ্ছন্ন নয়ন বেশ নোংরা হয়ে গিয়েছিল। হিসু-পটি সে সবই বিছানায় করছিল। জ্যাঠার আয়াকে কিছু এক্সট্রা টাকা দিয়ে সারাদিনে একবারই পরিষ্কার করাতে পারছিল তার দাদা-বৌদি। আর গাটাই যা মুছিয়ে সে দিত একবার। মাঝে মধ্যে শেভিং। পায়জামাটা খুলে নেওয়া হয়েছিল প্রথমেই। দিন পাঁচেক পর গন্ধ বেরলে খুলে নেওয়া হয় পাঞ্জাবিটাও। যে নয়ন রোজ সাবান দিয়ে স্নান করত এই এতদিন স্নান না করে পড়েছিল। গায়ে চাপা দেওয়া চাদরটাই যা বদলে দেওয়া হত।
খবর পেয়েই মিহির, বিশু আর সজলকে নিয়ে, ছুটে এল। একটু পরেই এল সুপ্রিয় আর অর্পিতা। রথীন মিত্র আর হারু এসে শেষদেখা দেখে গেল। ততক্ষণে রিংকু আর রবিও এসে পড়েছে। মেঘনা সুপ্রিয়কে বলেই রেখেছিল ‘নয়নদা কেমন থাকে আমায় জানাস’। সব শেষে এল মেঘনা। উদভ্রান্তের মতো ছুটে এসে নয়নের ঘরে ঢুকে সবাইকে চমকে দিয়ে সে নয়নের মাথায়-বুকে-গালে হাত বোলাতে বোলাতে ডুকরে কেঁদে উঠল। তারপর কারও দিকে না তাকিয়ে প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। এই ঘরে সে আর থাকতে পারছিল না। তুলসীমঞ্চের সামনেটায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে সে উবের বুক করতে থাকল। সুপ্রিয় আর অর্পিতা তাকে দুপাশ থেকে স্বান্তনা দিচ্ছিল।
কিছুক্ষণ থেকে সুপ্রিয় আর অর্পিতাও চলে গেল। মিহির-সজল-বিশু মিলে নয়নের গাটা ভিজে গামছা দিয়ে ভাল করে মুছিয়ে তারই কাচা-ধোয়া পাঞ্জাবি-পায়জামায় সাজিয়ে দিল তাকে। খাট সাজাল ফুলে। ধরাধরি করে নয়নের জানহীন শরীরটা যখন খাটে শোয়ানো হল তুলসিপাতা, চন্দন ইত্যাদি দিয়ে তখন যন্ত্রণায় সেটা দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। হু-হু করে ওজন পড়ে গিয়ে অস্থিচর্মসার কুঁকড়ে আছে। তার ওপরেই পরম যত্নে তিন কমরেড মিলে বিছিয়ে দিল লাল রঙের একটা বড় কাপড়। তার মাঝখানে সাদা রঙে আঁকা কাস্তে-হাতুরি।
বেলা বাড়তে না বাড়তেই তার আশি বছরের পুরনো একতলার ঘর ছেড়ে শেষযত্রায় চলল নয়ন। নুপুর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ মুছতে মুছতে, ফোঁপাতে ফোঁপাতে তাকে শেষবিদায় দিল। তুলি আর রিংকুও জলভরা চোখে সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। শুধু তার বিরাশি বছরের শয্যশায়ী জ্যাঠা জানতে পারল না যে তার আদরের নয়ন চলে গেল।
টিংকুর মনে হতে থাকল সত্যিই! সারাজীবন তার এই ভাইটা নিজের জন্য কিচ্ছু চাইল না! শুধু প্রাণ ঢেলে পার্টি করে গেল! তার বাবা ডেকে চাকরি দিলেও সে ফিরিয়ে দিয়েছিল! দুবেলা দুমুঠো যে খেত তার জন্যও মাসখরচ দিত! একটা ঘরও নিজে থেকে ছেড়ে দিয়েছিল পরিবারের আয়ের কথা ভেবে! আর কি করবে! পায়জামা-পাঞ্জাবি-হাওয়াই পরেই কাটিয়ে দিল গোটা জীবন। ছিল বলতে খালি সস্তার হাতঘড়ি, বলপেন, খাতা-বই, ফুট থেকে কেনা চিরুনি আর অতি সাধারণ একটা সেলফোন। ওয়ালেটের বিলাসিতাও করেনি কখনও। জীবনটা ভোগ করে নয়, শুধুমাত্র কাটিয়ে চলে গেল ভাইটা তার।
কোনোদিন পার্টিক্লাশ না করা, সেভাবে মার্ক্স-লেনিন না-পড়া (বাংলা অনুবাদে সামান্য ছাড়া) কিন্তু বহু যুদ্ধের ঘাম-রক্তঝরা সৈনিক, পার্টির চিরঅনুগত ও একনিষ্ঠ হোল-টাইমার নয়ন তার শেষযত্রায় মাত্র তিনজন কমরেডকে পেল। সাথে চলল রবি আর টিংকু। ঘাটকাজ তো টিংকুই করবে।
টেম্পোটা স্টার্ট দিতেই মিহির চোখ মুছে শুন্যে হাত ছুঁড়ে চিৎকার করে উঠলঃ কমরেড নয়ন রায় অমর রহে।
বিশু-সজলের সাথে আজ, কেন জানে না, কোরাসে রবি-টিংকুও বলে উঠলঃ অমর রহে, অমর রহে।
বিছানায় পড়ার আগে পর্যন্ত তার ছিপছিপে-লম্বা শরীরটা টানটান রেখে মাথা উঁচু করে বেঁচে গেল কমরেড নয়ন। আজীবন দৃপ্ত ও লড়াকু নয়ন। যাকে লোভ কিংবা ভোগ কোনোটাই কোনোদিন স্পর্শ করার হিম্মত করেনি!
টেম্পো চলতে থাকল…
মিহির-সজল-বিশু গণসংগীত গাইতে শুরু করল…
***সমাপ্ত***