ভালো থাকার চাবিকাঠি

বৈশাখী নার্গিস

এই একলা ঘর আমার দেশ/ আমার একলা থাকার অভ্যেস। হ্যাঁ ঠিক এটাই সম্ভবত আমার আপনার মতো মানুষদের মনের কথা হয়ে ওঠে মাঝে মাঝে। মন নিয়ে টানাটানি নাহয় বাদ দিলাম। কিন্তু রাত নামলেই ঘরের কোনে চুপটি করে বসে থাকি না কি। আর তখন ঘিরে ধরে যত রাজ্যের মন খারাপ। এত মেঘ জমে যায় মনের আকাশে যে, এই বুঝি ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে যাবে। কিন্তু তারপর, সেই তো কান্নাকাটি, চুপচাপ এক কোনে মুখ লুকিয়ে বসে থাকা ছাড়া কিছুই নেই। আসলে মন বেচারাই বা কি করবে, তারও তো একটা জগৎ দরকার।

মন এমন একটি জিনিষ যার উপর নির্ভর করে আমাদের সব কিছু। কেননা মন সায় না দিলে আমাদের কাজ করতে ইচ্ছে করে না। মনের বিরুদ্ধে কাজ করলে সেটা নিখুঁতও হয় না। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় যে কাজগুলো আমাদের জীবনের জন্য খুবই জরুরী, সেই কাজগুলো থেকে আমরা পালিয়ে বেড়াই। তার উপর আমাদের মানসিক চাপ, কাজের চাপ, সম্পর্কের চড়াই-উৎরাই ইত্যাদি আমাদের মনকে বিক্ষিপ্ত করে দেয়। এগুলোই হল মনকে বেঁকে দেওয়ার মূল কারন। কিন্তু জীবনে উন্নতি করতে গেলে ভালো থাকতে হবে। আর নিজেকে সফল করার জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণ সবচেয়ে বড়ো হাতিয়ার নিজেরই কাছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্রিগহ্যাম ইয়ং ইউনিভার্সিটির গবেষক জুলিয়ান হোল্ট তাঁর একটি রিপোর্টে জানিয়েছেন, একাকিত্ব, অবসাদ, নিজেকে একঘরে করে নেওয়ার প্রবণতা মানুষকে তাড়াতাড়ি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। এই গবেষণায় ৩ লক্ষ মানুষকে পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষা থেকে উঠে আসে, যাঁরা সামাজিক এবং পরষ্পরের সঙ্গে মেলামেশা করতে পছন্দ করেন, তাঁরা তুলনামূলক ভাবে অনেক সুস্থ। কিন্তু যাঁরা সমাজ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন তাদের কম বয়সেই মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

এই অল্পতেই মন খারাপ হওয়াটা কী নির্দেশ করে আসলে? যেসব মানুষের মন খারাপ হয়ে যায় সামান্য কারনে, তাদের সামাজিক দক্ষতা কম। তারা যদি নিজেদের আরও সামাজিক করে, অন্যান্য সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকে, তাহলে আর অল্পে মন খারাপ হবে না। আসুন জেনে নিই মন খারাপের কিছু দাওয়াই।

১। মেডিটেশন বা যোগাভ্যাস – আলসে ছেড়ে মন দিন যোগাভ্যাসে। মন নিয়ন্ত্রণ রাখতে মেডিটেশনের জুড়ি আর কিছু নেই। নিয়মিত মেডিটেশনের অভ্যাস মনকে শান্ত করে এবং দৃঢ় রাখতে সাহায্য করে। আর মন ঠিক থাকলে ফুরফুরে থাকে দিন। কাজও এগিয়ে যায় দ্রুত।

২। শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম আমাদের মধ্যে প্রায় খুব কম জনই জানি যে মন শিথিল রাখতে শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম ভীষণ প্রয়োজনীয়। নানা চাপের কারনে আমাদের মন প্রায়শই বিক্ষিপ্ত থাকে। এই চাপ হতে পারে সংসারের চাপ, পড়ার চাপ, কাজের চাপ ইত্যাদি। আর এই চাপের কারনে মাঝে মাঝে বেঁচে থাকার আনন্দটাই নষ্ট হয়ে যায়। বিষিয়ে ওঠে জীবন। আর চাপ নিয়ে কাজ করলে সেই কাজ কখনই ভালো হয় না, এ কথা আমাদের অজানা নয়। তাই মন ভীষণ বিক্ষিপ্ত এবং অস্থির থাকলে একে নিয়ন্ত্রণের জন্য শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করতে পারেন। এই ব্যায়াম করতে প্রথমে গভীরভাবে শ্বাস নিন। কিছুক্ষণ আটকে রাখুন। এরপর ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়ুন। এভাবে কয়েকবার ধরে করুন। এই ব্যায়াম আপনাকে শিথিল করতে সাহায্য করবে। নেতিবাচক চিন্তা ও আবেগগুলো থামাতে সাহায্য করবে। এবং যার ফলে আপনি আপনার কর্মক্ষেত্রে ভালো করতে পারবেন এবং জীবনটাকে সুন্দর মনে হবে।

৩। চিহ্নিত করুন চিন্তার কারণ- মনখারাপের কারনগুলোকে চিনতে পারলেই অর্ধেক মন খারাপ ভালো হতে বাধ্য। লিস্ট বানিয়ে নিই, ঠিক কোন কোন কারণে নেগেটিভ চিন্তা বাসা বাধতে শুরু করে নিমেষেই। বিচলিত হয়ে পরে মন, তার ফলে হারিয়ে যায় উৎসাহ আর বেলা শেষে সেই কাজ আমাদের দ্বারা হয়ে উঠে না। ফলাফলও জিরো। তাই প্রথমে চিন্তার উৎসটা খুঁজে বের করে থামিয়ে দিন অতিরিক্ত ভাবনা। পজিটিভ চিন্তা করা শুরু করুন। ভাবুন আপনার জীবনে কী কী ইতিবাচক দিক রয়েছে। এ ছাড়া ইতিবাচক বিষয়গুলোর একটি তালিকাও তৈরি করতে পারেন। নেগেটিভ চিন্তাগুলো যখন মাথায় আসবে, তখন ইতিবাচক চিন্তার সেই তালিকাটি দেখুন। আপনার মন শান্ত হবে।

৪। মনকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যান- আগেই বলেছি যে আমাদের মনকে বিক্ষিপ্ত করে তোলে আমাদের নেতিবাচক ভাবনাগুলো। তাই মন খারাপ হওয়ার পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসুন। কোনো কিছু খুব বেশি সমস্যার মনে হলে বা কষ্টদায়ক হলে, কিছু সময়ের জন্য বিষয়টিকে এড়িয়ে যান। অন্য কোনো কাজে মনোযোগ দিন। তাতে করে আপনার মনের উপর বিরূপ প্রভাব পরতে পারবে না। এবং আপনার মনকে প্রভাবিত করতে পারবে না। ফলে আপনার মন আপনার নিয়ন্ত্রনেই থাকবে।

৫। মিউজিক থেরাপি- আমাদের সবারই একটি ভালো লাগার জায়গা হল মিউজিক। মন ভালো রাখতে গান মারাত্মক মেডিসিন। তাই মন খারাপ থাকলে নিজের প্রিয় গান শুনতে পারেন। তবে মাথায় রাখতে হবে ‘স্যাড সং’ আপনার যতই প্রিয় হোক না কেন, মন খারাপ বা চাপে থাকলে এই ধরনের গান আপনাকে এড়িয়ে চলতে হবে। রোমান্টিক অথবা স্লো মিউজিক শোনার চেষ্টা করবেন এই সময়। ভালো গান শোনার ফলে শরীরে ডোপামিন নামক একটি হরমোন নিঃসৃত হয় যা মন ভালো করে তুলতে সাহায্য করে।

মোমের আলো দিকে তাকিয়ে থাকুন– মাঝে মাঝে খুব অস্থির লাগে। কোথাও ভালো লাগছে না, কিছু ভালো লাগছে না। এই হয়ে ওঠে আমাদের মনের স্ট্যাটাস। এর থেকে বেরোনোর আরও একটি উপায় হল অন্ধকার ঘরে মোমের আলোর দিকে তাকিয়ে থাকা। হ্যাঁ, এই সামান্য কাজটিও আপনার মন ভালো করে দিতে পারে কয়েক মুহুর্তেই। মোমবাতি জ্বালিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকুন। যতক্ষণ পর্যন্ত আলোকে স্থির মনে হবে না, ততক্ষণ তাকিয়ে থাকুন। এটি করলে আপনার মন শান্ত হবেই হবে। নিয়মিত এই থেরাপি মেন্টাল স্ট্রেন্থ বাড়াতে সাহায্য করে।

৭। পজিটিভ হয়ে উঠুন- পজিটিভ এনার্জি আমাদের সবসময় ঝলমলে করে রাখে। যার ফলে কাজ বলুন আর স্বাভাবিক জীবনযাপন। দুটোই হ্যাম্পার হতে থাকে। মন খারাপ যদি একটানা বহু দিন চলতে থাকে, সঙ্গে কাজের ইচ্ছে, ঘুম বা খিদের ইচ্ছে চলে যায় বা কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না, তবে সেটা ডিপ্রেশন। এভাবেই নিজেকে গুটিয়ে নেন অনেকে। কারও কারও মাথা-গা-হাত-পা ব্যথা হতে পারে। সব সময় নিজেকে ছোট করে দেখা বা আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা দিতে পারে। নেগেটিভ চিন্তা গ্রাস করতে করতে অনেকের মৃত্যু চিন্তাও আসে। তাই পজেটিভ চিন্তা ভাবনা করুন। ঝলমলে রোদ্দুর ফুটে উঠবেই রাত পেরোলে।

এবার টুকরো কিছু টিপস। যা কাজে দেবে সবার। আর মন খারাপ কমে যাবে আপনাআপনিই। অনেকেই বলেন, মন খারাপের নাকি কোনো কারণ থাকে না। তবে এর ওষুধ আপনার, আমার হাতেই আছে। যে কারণেই মন খারাপ হোক না কেন, প্রশ্রয় দেবেন না। বরং কাজের মধ্যে ডুবে থাকবেন। দেখবেন মন খারাপ হচ্ছে না। তখন যেটা ভাল লাগে, সেটা করুন। বই পড়ুন। বাগানে সময় কাটান। কাউকে ফোন করুন, চ্যাট করুন। অন্য কিছুতে মনকে ব্যস্ত করে ফেলতে হবে।

মাঝে মাঝে আকাশ মেঘলা থাকলেও মন খারাপ হয়ে যায়। আসলে সূর্যালোকের অতিবেগুনি রশ্মি ব্রেনের ফিল গুড কেমিক্যালগুলোকে উজ্জীবিত করে। তাই রোদ না উঠলে মন খারাপ হয়। সে ক্ষেত্রেও একই টোটকা। মনকে ব্যস্ত রাখুন। ভোরবেলা উঠুন। সকালের নরম রোদ মন ভালো রাখতে সাহায্য করে। কোনো কাজে এক বার সাফল্য না পেলে যে বার বার তেমনটাই হতে থাকবে তা নয়। আজ হয়নি কাল হবে। যেটুকু পাচ্ছি, সেটাতেই বরং পুরোপুরি মন দিই। এভাবেই নিজেকে মোটিভেট করতে হবে। তাছাড়াও স্ট্রেস নেওয়ার ক্ষমতা অল্প অল্প করে বাড়াতে হবে। দরকার মতো ‘না’ বলতে শিখতে হবে। নিয়মিত প্রাণায়াম করলেও স্ট্রেস নেওয়ার ক্ষমতা বাড়বে। ডায়েরি লিখুন নিয়মিত। মনের গ্লানিগুলো পাতায় লিখে ফেললে স্ট্রেস কমে। প্যান্ডোরা বক্স থেকে বের করে নিন ছোট ছোট খুশীগুলোকে। রূপকথার জগত আমাদের সবার মধ্যেই আছে। ভালো থাকার চাবিকাঠি লুকোনো আছে আমাদের সবার মধ্যে।

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page