সিজোফ্রেনিয়া কি? এর লক্ষণ কি ভাবে কেউ বুঝবেন? উপশম কি সম্ভব?

আমাদের দেশ চন্দ্রযানে সওয়ার হয়ে সুদূর চাঁদে পাড়ি দিলেও এখনো পর্যন্ত আমাদের দেশে অনেকাংশেই রয়েছে প্রদীপের নীচে অন্ধকার। মানসিক রোগের ভুলপথে চিকিৎসার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় বিভিন্ন জায়গায়। এর মূল কারণ অবশ্যই সচেতনতার অভাব ও কিছু ক্ষেত্রে কুসংস্কার। সবচেয়ে বেশি ভুল চিকিৎসার সন্মুখীন হয় সিজোফ্রেনিয়ার রোগীরা।

সিজোফ্রেনিয়া কি?

সিজোফ্রেনিয়া হলো একটি অত্যন্ত জটিল মনোরোগ। সিজোফ্রেনিয়া শব্দের উৎস Skhizein বা আলাদা করা এবং Phren বা মন এই দুটি নিয়ে গঠিত। দ্বিখণ্ডিত সত্ত্বা বা দুটি মিশ্র ব্যক্তিত্বের মানুষের যুগপৎ প্রতিক্রিয়াই এই রোগ সৃষ্টি করে।

সেখানে একের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারে আরো একটি মানুষ। ১৬-৩০ বছর বয়সের মধ্যেই এই রোগটি সবচেয়ে বেশি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় বিকৃতি এত ধীর গতিতে এগোয় যে রোগী বুঝেই উঠতে পারেনা যে সে এই রোগে আক্রান্ত। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে আত্মহনন এর ঘটনাও ঘটে।

পৃথিবীর মাত্র ১% লোকই এই রোগে আক্রান্ত হয়। জিন, বংশগত, পরিবেশগত, মস্তিষ্কের রসায়ন গত উপাদান ইত্যাদির কারণে এই রোগ আপনার হতে পারে। মস্তিষ্কে হঠাৎ আঘাত বা অনেকদিনের মানসিক অস্থিরতা ও চাপ জন্ম দিতে পারে এই রোগের। প্রধানত, নিজের চারপাশের জগৎকে অপ্রকৃতস্থ ভাবে ব্যাখ্যা করাই হলো সিজোফ্রেনিয়া।

এই রোগের লক্ষণ:

দৈনন্দিন জীবনে স্বাভাবিক কাজকর্মে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এর অভাব, অকারণ সন্দেহপ্রবনতা, অলীক কল্পনায় মশগুল হয়ে থাকা সিজোফ্রেনিয়াকে চিহ্নিত করে। চিন্তাভাবনার বিশৃঙ্খলার জন্য রোগী নিজের কাছের লোকজনদের ও ভুল বোঝে। সবসময় মৃত্যুভয় তাদের তাড়া করে।

দীর্ঘমেয়াদি বা ক্রনিক সিজোফ্রেনিয়ার বৈশিষ্ট্য

আচরণগত: এদের আচরণ হয় অদ্ভুত। এরা মনে করে সবাই এদের বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত। তাই অনেকসময় এদের রাগ বা ভয় হয়ে ওঠে মাত্রাছাড়া। সমাজের কারোর সাথে যোগাযোগ রাখা এরা নিরাপদ বলে মনে করে না।

চিন্তাগত: চিন্তাগত বিকৃতি একটি সাধারণ বিষয় সিজোফ্রেনিয়ার ক্ষেত্রে। অসংঘটিত চিন্তাভাবনা, কাজকর্মে গতিহ্রাস, অবিশ্বাস, ধারণা বিভ্রান্তি এদের গ্রাস করে।

মুড: মেজাজগত দিক থেকেও এরা থাকে উত্তেজিত, বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব এদের কোনকাজেই শান্তি পেতে দেয় না। ফলে মানসিক উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা বা অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয়ে উঠতে দেখা যায় এদের।

মনোবৈজ্ঞানিক দিক: অলীক, অবাস্তব দৃষ্টি বিভ্রম এদের সহজেই অবিশ্বাস এর দিকে ঠেলে দেয়। এটাকে মনোবিজ্ঞান এর ভাষায় প্যারানোয়া বলা হয়। এছাড়া ডিপ্রেশন, নিজে নিজে কারোর কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়া বা বিড়বিড় করে কথা বলার মতো উপসর্গ দেখা যায়।

চিকিৎসা:

যদিও সিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রাথমিক উপায় সাকায়াট্রিস্ট বা হাসপাতালে যাওয়া। কারণ তাঁরা এই ব্যাপারে অভিজ্ঞ এবং সঠিক চিকিৎসা করতে সক্ষম। তবে শুধু ওষুধ নয় যথাযথ কাউন্সেলিং ও প্রয়োজন।

  1. টিপিক্যাল এনটি সাইকোটিক একটি ওষুধ যা ডোপামিন নামক মস্তিষ্কের রসায়নকে কমিয়ে উপশম দেয়। এছাড়া, ক্লোরপ্রমাজিন লার্গাক্ট্রিল, হ্যালোপেরিডল, পিমোসাইড ওরাপ ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়।
  2. এটিপিকাল এন্টি সাইকোটিক ঔষধ মস্তিষ্কের সেরোটোনিন এর উপর কাজ করে রোগীর বদ্ধমূল ধারণা বা তার চিন্তাভাবনার অসঙ্গতি নিয়ন্ত্রণ করে। সাইকোলজিক্যাল থেরাপির মাধ্যমে রোগীর চিন্তন প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করে তার আচারব্যবহার এ সন্তোষজনক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হয়। এর ফলে তার আত্মবিশ্বাস ও কর্মপ্রেরণা ফিরে আসে।
  3. কমিউনিটি হেলথ টিমের সদস্যরা সিজোফ্রেনিয়ার দৈনন্দিন সমস্যার মোকাবিলার পথ বাতলে দেন। ব্যক্তি বিশেষে আলাদা ভাবে নজর রাখা সম্ভব হয় এক্ষেত্রে। কেয়ার কো অর্ডিনেটর লক্ষ রাখেন আপনি ঠিকমতো পরিষেবা পাচ্ছেনা কিনা।
  4. ফ্যামিলি ওয়ার্ক আরেকটি উপায় যেটি রোগীর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ, তার ক্রম উন্নতি ইত্যাদি ব্যাপারে খেয়াল করতে সাহায্য করে।
  5. সর্বোপরি, স্বনির্ভরতা, নিজের যত্ন নেয়া, মানসিক প্রশিক্ষণ ও অনুশাসন, রিলাক্সিং এর পদ্ধতি রোগীকে ফিরিয়ে আনতে পারে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে।
শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page