উপন্যাস।। আবার এসো ফিরে।। রামেশ্বর দত্ত

অভিরামের কথা শেষ হয় না। এমনিতেই সে একটু বেশি বকে। এব্যতীত কোনও কৃতিত্বের কাজ করল তো, হয়ে গেল। তার বড়াই করতে করতে কানে তালা লাগিয়ে দেবে। এখন ঈশ্বরচন্দ্রের মন লেখায় মত্তঅন্য কথায় মন সরছে না। অভিরামকে তাই কথার মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, আচ্ছা, আচ্ছা। এখন তুই ঘরে যা। আজ তো আর রাখালদের ইশকুল নেই; আমি বরং লেখাটা শেষ করি।

  কলম তুলে নিলেন। আবার লিখতে শুরু  করলেন।

পর্ব- ৩০ 

‘…কেবল তোমায় কোলে লইয়া তোমার লাবণ্যময় কোমল কলেবর পরিস্পর্শে, শরীর অমৃত রসে অভিষিক্ত করিতে পারিতেছি না। একদিন দিবাভাগে, নিদ্রাবেশে ঘটিয়াছিল, কেবল সেই দিন সেই সময়ে ক্ষণকালের নিমিত্ত, তোমায় পাইয়াছিলাম। দর্শনমাত্র আহ্লাদে অধৈর্য হইয়া, অভূতপূর্ব আগ্রহ সহকারে ক্রোড়ে লইয়া প্রগাঢ় স্নেহভরে বাহু দ্বারা পীড়নপূর্বক, সজল নয়নে তোমার মুখচুম্বনে প্রবৃত্ত হইতেছি, এমন সময়ে এক ব্যক্তি আহ্বান করিয়া আমার নিদ্রাভঙ্গ করিল। এই আকস্মিক নিদ্রাভঙ্গ দ্বারা , সে দিবস, যে বিষম ক্ষোভ ও মনস্তাপ পাইয়াছি, তাহা বলিয়া ব্যক্ত করিবার নহে।

‘বৎসে! তোমার কিছুমাত্র দয়া ও মমতা নাই। যদি তুমি সত্বর পলাইবে বলিয়া স্থির করিয়াছিলে সংসারে না আসাই সর্বতোভাবে বিধেও ছিল।’…

লাইনটা লিখে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। কলম নামিয়ে রাখলেন।

বাইরে  অন্ধকার নেমেছে।  আবছা অন্ধকার। দৃষ্টি অবরুদ্ধ । গ্রীষ্মদিনের দাবদাহ এখন শেষ। প্রকৃতি হাওয়ার ঝাঁপি উন্মুক্ত করে দিয়েছে।  ঠাণ্ডা হাওয়ার আনাগোনা শুরু হয়েছে।  শুনশান চতুর্দিক। সামনের পথে মানুষের চলাফেরায় যতি পড়েছে।  পথের ওপারে ধু ধু মাঠ। দূরে সার দিয়ে আম জাম, তেঁতুল, বট  অশ্বথ গাছের মেলা। আকাশে ক্ষীণ চাঁদের আলো। গাছ গাছালির দৃশ্য অস্পষ্ট। ধামসা মাদলের বোল কানে আসছে। চোখের জলে সিক্ত দৃষ্টি ঈশ্বরচন্দ্রের। আকাশের দিকে মুখ তুললেন। তারার দেখা মিলল। প্রভাবতীকে খুঁজছেন তারাদের দলে…

কতক্ষণ সেভাবে বসেছিলেন, তিনি নিজেও জানেন না। অভিরাম এসে পাশে দাঁড়িয়ে বাবুকে লক্ষ্য করল। তাঁর চোখে জল দেখে সে বলল, বাবু, তুই বুঝি তোর বাড়ির কথা মনে করে কাঁদছিস?

-হ্যাঁ রে, বাড়ির কথাই বটে।

মুখ নামিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র অভিরামের প্রশ্নের উত্তর দিলেন। তারপর কী মনে করে হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। অভিরামকে জিজ্ঞেস করলেন, তোর বুঝি কাজ শেষ হল?

-হাঁ বাবু। রাতে টাটকা মাছের ঝোল আর ভাত খাবি। আমি তৈরী করে নিয়েছি।

-আজ আর লেখবার মন করছে না রে। চল বাইরে ঘুরে আসি, বলে, ঘাড় কাত করে খাড়া কানে মাদলের শব্দের দিকে ইঙ্গিত করে অভিরামকে বললেন, চল, আজ সাঁওতালদের নাচ দেখে আসি। মনটা আজ একদম ভালো নেই রে…

-চল বাবু, ভালই হবে। আকাশে আজ চাঁদও অনেক বড় উঠেছে। ওদের লাচের দিন। একটু একটু বাজনার আওয়াজ আসছে, শুনতে পাচ্ছিস?

-শুনছি বলেই না, বলছি…

-তুই ওদের সঙ্গে লাচবি?

-দূর, আমি কিনাচতে পারি নাকি?

-কিচ্ছু শক্ত লয়, বাবু। চল, আজ তোকে উদের লাচ লাচাইন আনব। শরীর মন ঝরঝরে হয়ে যাবে, দেখবি।

অভিরাম ছুটে ঘরে ঢুকে বাবুর গায়ের চাদরটা নিয়ে এলো। বলল, বাইরে ঠাণ্ডা আছে। চাদর গায়ে চড়িয়ে নে।

একটু অপেক্ষা কর, বলে ঈশ্বরচন্দ্র পা চালিয়ে কলঘরের দিকে গেলেন। কর্ম সেরে বেরিয়ে এসে দুজনে পথে নামলেন। পিছনে ঘরবাড়ি খোলাই পড়ে রইল।

এখানে চুরি চামারির কোনও ভয় নেই। আর এ বাড়িতে চুরি করতে আসবেটাই বা কে? যেখানে মনিব নিজে থেকে অন্যের হাতে সিন্দুকের চাবি তুলে দেয় অপরিচিতকে, সেখানে কে আসবে তাঁর বাড়ির বস্তু চুরি করতে? তা ছাড়াও, হেথা  সাঁওতালদের বাস। দরকারে তারা পছন্দের জিনিষ চেয়ে নেবে, তবু চুরি করায় তাদের প্রবৃত্তি আসবে না। অভিরাম তো জানে সব। তাই আর ঘরে তালাচাবি লাগাবার কথা চিন্তাই করল না সে। না, তা করলেন ঈশ্বরচন্দ্র।

পথে হাঁটছেন। গ্রামের পথ। কাঁচা । মাটির ঢেলায় রাস্তা মাঝে মধ্যে উঁচু-নিচু হয়ে রয়েছে। অভিরাম তরতরিয়ে হাঁটলেও ঈশ্বরচন্দ্র পা ফেলছেন সাবধানে।  চাঁদের আলোয় অবশ্য পথের চড়াই উতরাই নজরে আসছে।  দুধারে শাল গাছের সারি। তার মধ্যে দিয়ে সরু পথ এগিয়ে গেছে। বেশ অনেকটা রাস্তা আসবার পরে কাঁচা সড়ক ছেড়ে মাঠে নামতে হল। অভিরাম পথ চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মাঠে ঘাসের আধিক্য। পায়ে পায়ে তা মাড়িয়ে মাঠ পেরিয়ে গ্রামের উঠোনে এসে ঢুকল দুজনে।  জায়গাটাকে ওরা গ্রামের উঠোন বলে।

উঠোনই বটে। মাঝখানে এক বিশাল চত্বরকে ফাঁকা রেখে চারধার দিয়ে মানুষের বাস । দূরে দূরে বাসাগুলোর অবস্থান। মাটির ঘর; মাথা ঝাউগাছের শুকনো পাতা দিয়ে ঢাকা। টিম টিম করে লম্ফ বাতি জ্বলছে ভেতরে। অন্ধকারে তাতেই ঘরগুলোর অস্তিত্ব নজরে আসছে।

সবুজ ঘাস ভরা উঠোনে আগুনের কুণ্ডলী জ্বলছে। আগুন ঘিরে দাঁড়ানো মেয়েরদল। গাছ কোমর করে শাড়ি পরা। হাঁটু খোলা। মাথায় কবরী। কবরীতে পলাশ ফুল। কোমর থেকে কোমরে হাতের বন্ধন। সাঁওতালি রমণীর শৃখলাবদ্ধ দল। অপেক্ষা, মাদলে বোল  ওঠার । তাদের মাঝে দাঁড়ানো দুই পুরুষ। একজনের হাতে মাদল। অন্যজন ধামসা হাতে। বাকি পুরুষরা বৃত্তের বাইরে দাঁড়িয়ে। ওরা প্রস্তুত। বাকি শুধু ইশারার।

অভিরাম ঈশ্বরচন্দ্রকে সেখানে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করালো। পরে বসেও পড়ল মাঠের একধারে। ওরা দেখল ঈশ্বরচন্দ্রকে। অনেকেই চেনে তাঁকে। কেউ কিছু উপকারও পেয়েছে। না হলেও তাঁর কাছ থেকে ওষুধের পুড়িয়া নিয়ে যায়নি, এমন জন সেখানে কমই ছিল।

বাবুর কাছে ছুটে এলো জনা দুই লোক আর এক রমণী। উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে উঠল, কী ভাগ্য আমাদের, বাবু এয়েছে, আমাদের লাচ দেখবে আজ।…বাবু, আজ তুকেও আমাদের সঙ্গে লাচাব।

ঈশ্বরচন্দ্র বসে রয়েছেন। বলে উঠলেন, দূর, আমি কী নাচতে পারি? তুরা লাচ, আমি দেখি।

-হেই, বাবু লাচতে বলেইয়েছে…,

দৌড়ে ফিরে গেল তারা। ধম, ধম ধামসা বেজে উঠল। মাদলে বোল উঠল। নাচ  শুরু হয়ে গেল। রমণীদের পা পড়ছে ধামসার তালে তালে, হাত দুলছে, কোমর নড়ছে। মুখে প্রাণ ভোলানো হাসির ঢেউ।…একবার কোমর ভাঙছে, নিচু হচ্ছে। পরক্ষণেই সোজা হয়ে আকাশের দিকে বুক চিতিয়ে দিচ্ছে। পুরুষ মেয়ের দল নেচে চলেছে। ঈশ্বরচন্দ্র দূরে বসে তা উপভোগ করছেন। মন হাল্কা হয়ে গেছে।

অনেকটা সময় নাচ চলবার পর, রমনীদের মধ্যে থেকে দুজনে ছিটকে বেরিয়ে এল। কোনও পুরুষের ইশারা হয়েছে। তারা দুজন সটান ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে চলে এলো। হাত ধরে তাঁকে টেনে ওঠাল।

-আরে, আরে কী করছিস, কী করছিস? করে, ঈশ্বরচন্দ্র বাধা দিতে গেলেন।

-তুকে লাচাব বাবু। চল আমাদের সঙ্গে।

ঈশ্বরচন্দ্রকে টানতে টানতে নিয়ে ফিরল দলের মাঝে। ওপাশ থেকে কয়েকজন পুরুষ, রমণীদের দলে  এসে ভিড়ল। এ দল থেকেও সমসংখ্যক রমণী, পুরুষ দলে গিয়ে যোগ দিল। ওরা অভিরামকেও টেনে নিল।

আবার মাদল বেজে উঠল। ঈশ্বরচন্দ্রকে নিয়ে নাচ শুরু হল।  জীবনে প্রথম এমন নাচ। অপক্ক তিনি। পা ফেলছেন। ছন্দ মিলছে না। না হচ্ছে রমণীদের পায়ের সঙ্গে পা মেলানো; না, মাদলের তালে তা মিলছে। শুধু কোমর দুলিয়ে যাচ্ছেন। দেখে ওদিকের দলে অভিরামের কী হাসি! ঈশ্বরচন্দ্রের নিজেরও হাসি পাচ্ছে। তিনি বলছেন, ওরে আমাকে ছাড়…

কিন্তু কে তখন তাঁর কথায় কান দেয়। শেষ পর্যন্ত  নৃত্য পটীয়সী রমণীর দল তাঁকে জোর করে নাচ শিখিয়েই ছাড়ল। শেষ যখন ওরা হাঁড়িয়ার কলসি থেকে নেশার বস্তু ঢালছে , ঈশ্বরচন্দ্র সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লেন। বাড়ির পথ ধরলেন। রাত তখন অনেকটাই গড়িয়ে গেছে। অন্ধকার পথ ধরে  ফিরছেন।  অভিরামকে সাবাসী জানালেন ঈশ্বরচন্দ্র। আজ ভারী মজা হয়েছে তাঁর।

দিনকয়েক আর ‘প্রভাবতী সম্ভাষণ’ লেখায় মন লাগাতে পারলেন না।   অথচ ‘প্রভাবতী সম্ভাষণ’ উপাখ্যানটা তাঁর নিজের জীবনের প্রত্যক্ষ করা ঘটনা হলেও, কেন যেন বাকি লেখাটুকুতে কলম সরছে না। পরে লিখবেন, পরে লিখবেন, করে, রোজ তা রেখে দিচ্ছেন। প্রভাবতী সম্বন্ধে মন চাইছে একটিবার সে তাঁর স্বপ্নে আসুক।

এমন চিন্তার মাঝে প্রভাবতী সত্যিই একদিন তাঁর স্বপ্নে এলো। তিনি দেখছেন, ছোট্ট মেয়েটা যেন তাঁকে বলছে, নীনা, তুই আমাকে এত মনে করিস, আমি খুব কষ্ট পাই। তুই বরং আমাকে ভুলে যা। ঠাকুরকে ডাক, ঠাকুরকে…

স্বপ্ন ভেঙে গেল। উঠে বসলেন। ভাবলেন, ওই এক রত্তি শিশুও জেনে গেল আমার বিশ্বাস- অবিশ্বাসের কথা? উপবীতধারী ব্রাহ্মণ হয়েও যে আমি কোনও ঠাকুরের ঘটে পটে ফুল মালা চড়াই না, তা কি আমার ঠাকুর দেবতার প্রতি অবিশ্বাস?

মনে মনে প্রভাবতীকেই স্মরণ করে বললেন, নীনা, আমি ঠাকুরে অবিশ্বাসী হলেও, ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখি; ঈশ্বর যে কোনও এক অনাদি অনন্ত পুরুষ স্রষ্টারূপে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্র পরিব্যাপ্ত ও প্রকাশিত রয়েছে, তারই মঙ্গল-নিয়মে বিশ্বচরাচর নিয়মিত চলছে; জগতের জীবকুল তার থেকে উৎপন্ন হয়ে তাতেই অবস্থান করছে, আবার নিজ কর্ম শেষে তাতেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে, এ তত্ত্বে আমার অবিশ্বাস  নেই; মানুষের মাঝে আমি তোমার ঠাকুরকে দেখি, নীনা; যেমন তোমাকেও মনে করেছিলাম আমি।

সৌভাগ্যক্রমে সেদিনই ঘটনাটা ঘটল। রাতে শুয়ে ঘুমচ্ছেন। মাঝ রাতে হঠাৎ বাড়ির বাইরে থেকে বিদ্যেসাগর…বিদ্যেসাগর করে হাঁকডাক। তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। ভেবেছিলেন, এমন শব্দে অভিরামও উঠে পড়বে। তবে সে ঘুমলে যে মরা হয়ে যায়, তা তাঁর জানা ছিল। দরজা খুলে তিনি একলাই বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলেন। দেখেন, গেটের বাইরে দুজন দাঁড়িয়ে। রাতের নিকষ কালো অন্ধকারে লোকদুটোকে ভূতের মতো দেখাচ্ছে। দূরে দাঁড়িয়েই প্রশ্ন করলেন, এত রাতে হাঁকডাক পারছিস কেন রে?

লোক দুজন গেট খুলে ভিতরে ঢুকল। সামনে এসে দাঁড়াল। তাদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠল, বিদ্যেসাগর, তুই শীগগির চল, না’হলে আমার ছেলেটা আর বাঁচবে না…

-কী হয়েছে তোর ছেলের?   ঈশ্বরচন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন।

-ছেলে সারা শরীর খিঁচচ্ছে। ওকে বুঝি ভুতে ধরেছে। মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বের করছে।

রোগীর এমন করুণ অবস্থার কথা শুনে ঈশ্বরচন্দ্র আতান্তরে পড়লেন। ভাবলেন, এদের কথা তো? না বোঝে রোগ অসুখের ব্যাপারস্যাপার, না, ওষুধ পত্রের ব্যবহার। কিছু না বুঝলেই উল্টোসিধে করে বুঝে, সবটাকে ভুতের নামে চালান করে দেওয়ার চল রয়েছে এদের মধ্যে। তিনি ফের প্রশ্ন করলেন, ছেলের বমি হচ্ছে? পায়খানা হয়েছে?

-হ্যাঁ। সন্ধ্যে থেকে অনেকবার হয়েছে।

-কী, বমি ? না, পায়খানা?

-দুটোই হচ্ছে গো বাবু।

অন্য লোকটা এবার কথা বলল। ঈশ্বরচন্দ্র বুঝে গেলেন, অসুখটা কী। ওলাওঠা হয়েছে। বারবার দাস্ত আর বমির কারণে শরীরে জলের পরিমাণ কমে গিয়ে শিরায় টান পড়ছে। কথা না বাড়িয়ে তিনি তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে গেলেন।  একগ্লাস জলে নুন চিনি মিশিয়ে নেড়ে সেটা লোকটার হাতে দিয়ে বললেন, এক্ষুণি নিয়ে গিয়ে এইটো তোর ছেলেকে খাওয়াতে থাক। একজন যাবি। একজন থাকবি। আমি আসছি একটু পরেই, বলে তিনি বাথরুমের দিকে ফিরলেন।

বাথরুম সেরে বেরিয়ে অভিরামকে ডেকে তুললেন। মাঝ রাতে এভাবে ঘুম ভাঙিয়ে তাকে ডেকে তোলায়, সে উঠল বটে তবে বাইরে বেরিয়ে লোকটাকে দেখে খেঁচিয়ে বলল, বাবুকে ডাকবার আর সময় পেলি নে হতচ্ছাড়া? রাত কটা বাজে বলতো?

লোকটা চুপ করে ছিল। অভিরামকে সে ভাবল, বাবুর গণ্যমান্য কেউ হবে বটে। হাতজোড় করে বলল, আমরা গরীব। পয়সা নেই ডগটর দেখাবার। বাবু শুনেছি গরীবের ভগবান। মরা মানুষকে জ্যান্ত করে দেয়। তাই এয়েছি গো বাবু তার কাছে। বাবু না গেলে ছেলেটা মরে যাবে…

লোকটার একটানা কথার মাঝে অভিরাম যা বোঝার বুঝে ফেলল। সেও ভিতরে ঢুকে গেল। বাথরুম সেরে বেরিয়ে ওষুধের বাক্সটা হাতে তুলে নিল। বাবুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। লোকটা আগে আগে। ঈশ্বরচন্দ্র আর অভিরাম তার পিছনে চলেছে। একসময় গ্রাম শেষ হয়ে এল। অভিরাম বলল, বাবু, আমরা মেথর পাড়ায় যাচ্ছি। সেটা গ্রামের একধারে। অনেকটা পথ।

অভিরাম ভেবেছিল, মেথর নাম শুনে তার বাবু কিছু বলবে। হয়ত বা ফিরেও যেতে পারে। কিন্তু সেসব কিছুই হল না। উল্টে ঈশ্বরচন্দ্র অভিরামকে জিজ্ঞেস করে বসলেন, তুই কি সেখানে যাবি না?

-না বাবু, তুই গেলে তো আমাকেও যেতে হয়।

-তোর মন না চাইলে, তুই ফিরে যা। আমি একলাই যাচ্ছি।

-তা কী হয়। তবে বাড়ি ফিরে নেয়ে নেবখন। তুকেও নাইতে হবে।

ঈশ্বরচন্দ্র মনে মনে হাসলেন। মুখে বললেন, সে পরের কথা পরে হবে। এখন গিয়ে ছেলেটাকে আগে বাঁচাই তো? দ্যাখ বুঝি এতক্ষণে তার হাত পা বেঁকে প্রাণটাই না বেরিয়ে গিয়ে থাকে।

শেষে সগোক্তি করতে করতে চললেন, দেশে সরকার আছে, না হাতি আছে। এদের জন্যে কেউ নেই। এরা এভাবেই পড়ে পড়ে মার খাবে চিরটাকাল। এদের দুর্দশা দেখলে কান্না পায়…

মেথর পাড়ার যে বাড়িতে গিয়ে উঠলেন, সেখানে না আছে বসবাসের পরিবেশ; না তা মনুষ্যবাসের উপযুক্ত স্থান। চারিদিক পূতিগন্ধময়। দলে দলে শূকর ঘুরছে গণ্ডা গণ্ডা ছানাপোনাদের নিয়ে।

ঘরের ভিতরে ঢুকে কুপির আলোয় রোগীকে দেখলেন। অতি শীর্ণকায় এক বছর সাতের ছেলে। মাটিতে মাদুর পেতে শোয়ানো। দু চোখ বন্ধ করে মরার মতো শুয়ে রয়েছে। দেহে প্রাণ আছে কিনা এমনিতে বোঝবার উপায় নেই। তার শয্যার আশাপাশ দিয়ে জলের ধারায় দাস্ত বয়ে চলেছে।

রোগীর নাড়ি দেখলেন । প্রাণটা ধুকপুক করে চলছে তখনও। তাড়াতাড়ি ওষুধের বাক্স খুললেন।  ঘরের স্বল্প আলোয় খুঁজে খুঁজে দুটো ওষুধের শিশি বের করলেন। একটা থেকে কয়েক ফোঁটা ওষুধ রোগীর মুখে ঢেলে দিলেন। পরে অন্যটা থেকে। সঙ্গে নুন চিনির জল। ঠায় রোগীর পাশে বসে এভাবেই একঘণ্টা অন্তর অন্তর ওষুধ খাইয়ে  চললেন।

ভোরের আলো ফুটছে, রোগী চোখ খুলল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন ঈশ্বরচন্দ্র। পরে আরও ওষুধ ওদের হাতে দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, কখন কীভাবে তা খাওয়াতে হবে। তারপর বেরিয়ে পড়লেন সেখান থেকে। বাড়ি ফিরে অভিরামের পাল্লায় পড়ে জামাকাপড় পরিবর্তন করে  শুতে গেলেন।  তাঁর কানে তখন একটা কথা বারবার বেজে চলেছে, তুই ভগবান, তুই না আসলে, আমার ছেলে মরে যেত,- লোকটা, লোকটার বউ আর মেথর পাড়ার লোকগুলো এই বলে তাঁকে প্রণাম জানিয়ে বিদায় দিয়েছিল।

ঈশ্বরচন্দ্র শুলেন। কিন্তু ঘুম আসল না? পুরনো দিনের কথা মনে আসছে। তিনি কিনা ভগবান! এ কথা মানেন না। ভগবানের সাথে ধর্মের যোগ, তা তিনি জানেন। আবার ধর্মে ব্যবসায়ীদের কারসাজি।

আজকের ব্যাপারে ভৃত্য অভিরামের ওপরেও তিনি কিছুটা বিরক্ত হয়েছেন; অভিরামের ওই মেথর, মেথর,  শব্দটার উচ্চারণে। ভাবতে থাকলেন, কৈ তাঁর মনে তো এসব কিছু আসে না। ঈশ্বরে বিশ্বাসী না হলেও তিনি মানুষের কাজ ব্রহ্মজ্ঞানে করেন। এই কর্ম করতেই তাঁর ইহ জগতে আসা।

(৩৪)

 

কর্মাটাঁড়ে স্থিতি বাড়ছে ঈশ্বরচন্দ্রের। আর ঠিক তখনই কাশী থেকে বাবার লেখা চিঠি হাতে এলো,

…আমার ৮৩ বৎসর বয়স হল, বিশেষতঃ এই অবসন্ন সময়ে আমার ভ্রান্তি হয়ে থাকে, তুমি আমার বংশের জ্যেষ্ঠ, এতাবৎকাল তুমি আমার ভরণ পোষণ প্রভৃতি করেছ, এখন আমার ইচ্ছে তোমার মুখ দর্শন করি। অতএব লিখি, যদি তুমি শরীরগতিক স্বচ্ছন্দরূপ সুস্থ থাকো, তা হলে ইতিমধ্যে এখানে একদিনের জন্যে এসে আমার মানসপূর্ণ করবে।

পত্র পাওয়া ইস্তক ঈশ্বরচন্দ্র কাশী রওয়ানা দিলেন। বাবার ইচ্ছে। এবার আর জল পথে না গিয়ে ট্রেনে গেলেন। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের রেল ব্যবস্থা বিস্তার করেছে। গাড়ি এলাহাবাদ পর্যন্ত যাচ্ছে। বাষ্প ইঞ্জিনে গাড়ি টানছে। বেনারস পৌছতে সময় নিল দেড় দিন। দ্বিতীয় দিনে পৌঁছলেন।

দীর্ঘপ্রস্থে ছোট হলেও বেনারস খুবই ব্যস্ত স্টেশন। বহু যাত্রী ট্রেন থেকে নামল। স্টেশনে দুটি মাত্র লাইন। একটা দিয়ে গাড়ি যায়, একটায় আসে।

প্ল্যাটফরম ছেড়ে বেরিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র একটা টাঙা ভাড়া করলেন। আট আনা ভাড়া। সোজা গিয়ে পৌঁছলেন বিশ্বনাথ গলির মুখে। গাড়ি ছেড়ে গলিতে ঢুকলেন। পায়ে হেটে ছ’ নম্বর গলিতে উঠে মগন শেঠের ডেরায় পৌঁছলেন। ঠাকুরদাস ছেলের আগমনের অপেক্ষাতেই ছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্রকে দেখে তিনি অত্যন্ত খুশি হলেন। বাবাকে প্রণাম সারলেন ঈশ্বরচন্দ্র । ঘরে ঢুকলেন দুজনে।

দেড় দিনের ট্রেন যাত্রায় মুখ চোখ বসে গিয়েছিল ঈশ্বরচন্দ্রের। তাড়াতাড়ি করে ছেলেকে স্নান–খাওয়া করিয়ে নিলেন ঠাকুরদাস। তারপর কিছুটা সময় বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যের মুখে দুজনে বসলেন  কথপোকথনে। সাংসারিক নানান কথাবার্তার মাঝে কর্মাটাড়ের কথাও উঠল। ঈশ্বরচন্দ্র সবিস্তারে সেখানের জীবনযাত্রার কথা বাবাকে জানালেন। এমনকি এও বললেন, সেখানে গিয়ে থাকলেই তাঁর মন-শরীর ভালো থাকে। সাঁওতালদের জন্য নানান কাজ করে চলেছেন।

-তাহলে কি এখন সেখানেই থিতু হবে? ঠাকুরদাস জানতে চাইলেন।

-সেরকমই মনস্থ করেছি বাবা। কলিকাতায়ও তো কলেজের কাজ কর্ম থাকে। তাই যাওয়া আসার মধ্যে থাকব, এমনটা চিন্তা করে রেখেছি। অত্যন্ত যতদিন না, আমার কলেজেকে নতুন বাড়িতে স্থানান্তরিত করতে পারি। আপনি তো জানেন, কলেজই আমার ধ্যানজ্ঞান। আর তাইতেই আনন্দ পাই। সংসারের কথা আর বেশি কী বলি? সেসব তো আপনাকে লিখে জানিয়েছিও। নতুন করে কিছু আর বলবার নেই।…

ঈশ্বরচন্দ্র স্থির করে এসেছিলেন এক-দুদিনই বাবাকে সঙ্গ দিয়ে ফিরে আসবেন। সেখানে দিন কতক থাকলেন। বাবার সব রকমের সুখ, সুবিধার উপযুক্ত সাধন করলেন।  পরে বাবার কাছে জানতে চাইলেন, তিনি কি এখনও সেখানেই থাকতে চান?

-ভালই তো আছি।  ঠাকুরদাস উত্তর করলেন।

-না, এই যে মাঝে মাঝে উতলা হয়ে পড়ছেন। তার থেকে কলিকাতায় আমার কাছে গিয়ে থাকলেই কি ভালো হবে না?

-তুমিই বা কয়দিন সেখানে থাকছ? গৃহ ছাড়া হয়ে, স্বজনের থেকে দূরে সরে গিয়ে তুমিই কি খুব সুখে আছো?

-না বাবা, আমি সুখে আছি। ভাববেন না, আমি স্বজনদের মন থেকে দূর করে দিয়েছে। তারা সবসময়ই আমার মনের ভিতরে আছে। তাদের জন্য আমি প্রয়োজন মতো অর্থের জোগানো দিয়ে যাচ্ছি। তবে কী, সংসারের ভিতরে আবদ্ধ থাকতে ইচ্ছে করছে না। অনেক তো করলাম…বলে, ঈশ্বরচন্দ্র মাঝ পথে চুপ করে গেলেন। অধোবদনে বসে রইলেন কিছুটা সময়। তারপর আবার কথা শুরু করলেন, আপনি যেমন সংসার থেকে দূরে এসে কাশীবাসি হয়ে জীবনের অর্থ খুঁজছেন, আমিও তেমনই ওই সাঁওতালদের মধ্যে থেকে জীবনের শেষ কাজ করছি। আর তো সংসারের প্রতি আমার কোনও দায় নেই। এখন ওদেরকেই স্বজন ভেবে নিয়ে বাঁচতে চাইছি, জীবনের শেষ কটা বছর। মানুষগুলো সত্যিই খুবই সরল, সাদাসিধে, বাবা। না মিশলে বোঝা যায় না…

-তোমায় তাহলে ডেকে পাঠিয়ে অসুবিধার সৃষ্টি করলাম ঈশ্বর?

-না, না। তা কেন হবে? আমাদের মনও তো আপনার জন্যে উতলা হয়।

ঠাকুরদাস ঈষৎ হাসলেন। মলিন হাসি। পরে উত্তর করলেন, সেও তো এখান থেকেই পরলোকে পাড়ি জমিয়েছে। আমিও তাকে অনুসরণ করি?

ঈশ্বরচন্দ্র বুঝলেন, বাবার মন কাশী ছেড়ে যাবার নয়। কাশীতে মায়ের স্মৃতি নিয়ে পড়ে থাকতে চান তিনি । তাই আর জোরাজুরি না করে বাবাকে সুস্থ দেখে  কলিকাতায় ফিরে এলেন।

সেটা ছিল পৌষ মাস। আর এখন চৈত্রমাস। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে বাবা গুরুতর পীড়ায় পড়লেন।  সংবাদ পেয়ে  ভাইদেরকে সঙ্গে নিয়ে তড়িঘড়ি দ্বিতীয়বারের জন্যে কাশীতে আসলেন। মাত্র কটা দিন সেবা করলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। বাবা ইহজগৎ ছেড়ে চলে গেল। শেষ ভরসার স্থল ফাঁকা হয়ে গেল।

কাজ এখন বাবার নশ্বর দেহের সদ্গতি। শবযাত্রা শুরু হল। শেষ হল মণিকর্ণিকায় এসে।  পাঁচ বছর আগেই একবার যেখানে পা রেখেছিলন, মায়ের মরদেহ নিয়ে।

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page